বাদামি ঈগল | Steppe Eagle | Aquila nipalensis
বাদামি ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট শিকারি পাখি। শীতে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া পূর্ব ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, রাশিয়া, রুমানিয়া, মঙ্গোলিয়া, উত্তর-পূর্ব চীন, দক্ষিণ তিব্বত, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকা (শীতকাল) পর্যন্ত। স্বভাবে হিংস্র। অন্যসব ঈগলদের মতোই শিকার খোঁজে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএ প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামি ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘স্টেপ ঈগল’ (Steppe Eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: Aquila nipalensis | কোনো কোনো পাখি বিশারদের কাছে এরা ‘নেপালি ঈগল’ নামে পরিচিত। তবে কেন এ নামকরণ তা বিস্তারিত জানা যায়নি। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৬২-৮১ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ১৬০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ২-৩.৫ কেজি। স্ত্রী পাখি ২.৩-৪.৯ কেজি। মাথা ও গলা কপি বাদামি। পিঠ পাঁশুটে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ক্রিম সাদা। ওড়ার পালক কালচে। কোমরের পালক ক্রিম সাদা। লেজ কালচে বাদামি। বুক ও পেট পাঁশুটে বাদামি। ঠোঁট শিং কালো শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া এবং মুখের কিনার হলুদ। পা বাদামি পালকে আবৃত। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, ইঁদুর, সরীসৃপ ও ছোট পাখি। এ ছাড়াও সব ধরনের টাটকা এবং গলিত মাংস খায়। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুলাই। তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। ডালপালা দিয়ে বড়সড়ো অগোছালো বাসা বানায়। এক বাসায় বহু বছর ধরে ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৪০-৪৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৫৫-৬৫ দিন। প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৪-৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/10/2016
খাটো আঙ্গুল সাপঈগল | Short toed Snake Eagle | Circaetus gallicus
খাটো আঙ্গুল সাপঈগল | ছবি: ইন্টারনেট উপমহাদেশী অঞ্চলে শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি রাশিয়া, পূর্ব ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ, ইরান, মঙ্গোলিয়া, চীন, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল। মরু কিংবা পার্বত্য এলাকায় বিচরণ আধিক্য। খোলা মাঠপ্রান্তর, জলাভূমির আশপাশেও দেখা মেলে। সাপ ও সরীসৃপ আছে এমন এলাকায় বেশি পরিলক্ষিত হয়। হিংস প্রজাতির পাখি। দৃষ্টিশক্তি প্রখর। প্রায় ৫০০ মিটার উঁচু থেকেও শিকার নজরে পড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। পাখির বাংলা নাম: ‘খাটো আঙ্গুল সাপঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘শর্ট-টোড সেক ঈগল’ (Short-toed Snake Eagle) বৈজ্ঞানিক নাম: Circaetus gallicus | এরা ‘মাথাভারি ঈগল’ নামে পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৬২-৭০ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ১৬৬-১৮৮ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ১.২-২ কেজি। স্ত্রী পাখি ১.৩-২.৩ কেজি। মাথা, ঘাড় ও গলা সাদার ওপর বাদামি দাগ। পিঠ বাদামি, মাঝে মধ্যে সাদা টান। ডানার প্রান্ত পালক গাঢ় বাদামি। লেজ কালচে বাদামি। বুক ও পেট সাদা। চোখ কমলা-হলুদ। ঠোঁট শিং কালো শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। পা ফ্যাকাসে হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। যুবাদের রঙ ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট-বড় সাপ ও সরীসৃপ। এ ছাড়াও ব্যাঙ, ছোট পাখি, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদিও শিকার করে। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর। স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। ডালপালা দিয়ে বড়সড়ো অগোছালো বাসা বানায়। এক বসায় বহু বছর যাবৎ ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ১টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৪৫-৪৭ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৭০-৮০ দিন। প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৩-৪ বছর। গড় আয়ু ১৭ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/06/2017
সাদাগলা লেজনাচানি | White throated Fantail | Rhipidura albicollis
সাদাগলা লেজনাচানি | ছবি: ইন্টারনেট আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী পাখি এরা। মানুষকে ভয় পেলেও একেবারেই ঘরের লাগোয়া গাছ-গাছালিতে এরা বিচরণ করে। গ্রাম-গঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ঝোপ-জঙ্গলে এদের কম-বেশি দেখা যায়। ছোট গাছের ডালে কিংবা মাটিতে নেচে বেড়ায় সুযোগ পেলেই। বিশেষ করে স্যাঁতস্যাঁতে ছায়াময় স্থানে এদের বেশি দেখা যায়। তার কারণও আছে অবশ্য। কারণটি হচ্ছে ওদের পছন্দের শিকার মশা-মাছি বা ছোট পতঙ্গ এতদাঞ্চলে বেশি মেলে। এ ছাড়া স্ত্রী-পুরুষ পাখিদের মধ্যে প্রেম নিবেদনের মোক্ষম স্থানও বটে। তবে যেখানেই বিচরণ করুক না কেন চুপচাপ বসে থাকার মতো পাখি নয় এরা। বরং উল্টো ওদের চরিত্র। সাংঘাতিক চঞ্চল প্রকৃতির পাখি ওরা। চোখের নিমেষেই ফুরুৎ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ করেই চোখের সামনে এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ নেচে-গেয়ে আবার ফুরুৎ। এ হচ্ছে ওদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ পাখিরা কালো ধাচের হলেও দেখতে ভারী চমৎকার। বিশেষ করে ওদের লেজটা বেশ আকর্ষণীয়। নেচে বেড়ানোর সময় লেজটাকে ছাতার মতো মেলে ধরে। ঠিক সে সময় পেখমমেলা ময়ূরের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে আসে ময়ূর দেখিয়েদের মনে। একটা সময় এ পাখিদের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা ছিল। ওদের দেখলেই কেন জানি ছুঁয়ে আদর করতে ইচ্ছে করত। অনেকবার চেষ্টাও করেছি ধরতে। ওদের বাসার ওপর সুতার ফাঁদ পেতে ধরার অহেতুক প্রচেষ্টা কম করিনি। এমনকি রাতেও অপারেশন চালিয়েছি। কামিয়াবি হতে পারিনি। খুব চতুর প্রকৃতির হওয়াতে এরা ধরাছোঁয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে বারবারই। আর হ্যাঁ, পাখি পর্যবেক্ষক হওয়ার আগ মুহূর্তেও একটি ভুল ধারণা ছিল এ পাখির প্রজতির প্রতি। তখন আমার ধারণা ছিল এরা ‘শ্যামা’ গোত্রের পাখি। পরে শ্যামা পাখির দর্শন পেয়ে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তৎসঙ্গে এ প্রজাতির পাখির সঠিক পরিচয় জানতে পেরে আমি বেশ আনন্দিতও হয়েছি। আশা করি প্রিয় পাঠকরাও সে আনন্দের ভাগিদার হবেন। প্রতিবেশী পাখির সঠিক পরিচয়টা জানতে পারবেন। এ পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাগলা লেজনাচানি’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট থ্রোটেড ফ্যানটেইল’ (White-throated Fantail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘রাইপিডুরা আলবিকল্লিস’ (Rhipidura albicollis), গোত্রের নাম: ‘রাইপডুরিনি’| এরা লম্বায় ১৬-১৮ সেন্টিমিটার। মাথাটা কালো। গলার দুই পাশে সাদা। চোখের ওপর রয়েছে সাদা টান। এ ছাড়া এদের বাদবাকি পালক ধূসর-পাটকিলে। লেজের অগ্রভাগ সাদা। ঠোঁট, পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। এরা পতঙ্গভুক পাখি। মশা, মাছি, বোলতা জাতীয় পতঙ্গের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন সময় ফেব্র“য়ারি থেকে মে। ভূমি থেকে সামান্য উঁচু গাছের দুই ডালে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে নরম চিকন ঘাস-লতা, গাছের সরু শিকড়। স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। শাবক বাসা ত্যাগ করে ১৫ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/01/2013
পাতি চখাচখি | Common Shelduck | Tadorna tadorna
পাতি চখাচখি | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, চীন, তিব্বত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান ও ইরাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও সুলভ দর্শন। দর্শনীয় চেহারাও বটে। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশের প্রায় বিভাগেরই নদ-নদীতে কম-বেশি বিচরণ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে কিংবা মোহনাতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যের সন্ধানে বড় বড় দলে বিচরণ করে অগভীর জলাশয়ে। শিকার কৌশল দেশীয় গোত্রের পাতি হাঁসের মতো। সাধারণত এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের কলহ-বিবাদ ঘটায় না। বলা যায় সারাদিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। পুরুষ পাখি পারতপক্ষে তেমন ডাকাডাকিও করে না। স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নিচু গলায় শিস কাটে। সঙ্গী জবাব দেয় তখন ‘গ্যাগ-গ্যা-গ্যা’ সুরে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতিটি দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা আরেকটু সদয় হলে বোধ করি এদের আগমন আরো বেশি বেশি ঘটবে দেশে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি চখাচখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন শেল ডাক’ (Common Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না টাডোর্না’, (Tadorna tadorna) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। অনেকে ‘শাহ চখা বা সাচ্কা’ নামেও ডাকে। দেশে দুই প্রজাতির চখাচখি নজরে পড়ে। যথা: খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। এরা লম্বায় ৫৮-৬৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১ কেজি। কপাল, মাথা ও গলা ধাতব সবুজ। ঠোঁট রক্ত লাল, গোড়া স্ফীত লাল পুঁটলি। বুক ও ঘাড়ে সাদার ওপর পাটকিলে চওড়া বন্ধনী। পিঠ ধবধবে সাদা। ডানা কুচকুচে কালো। লেজ ও কোমর সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা মেটে-লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী পাখি খানিকটা ছোট। এ ছাড়াও স্ত্রী পাখির বুকে পাটকিলে বর্ণের প্রান্তটা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার তালু, গলার পেছন ও পিট কালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: জলজ কীট, ছোট শামুক, চিংড়ি, ধান, শৈবাল, কেঁচো, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। মধ্য এশিয়ার পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে প্রাকৃতিক ফাটলে কিংবা মাটির প্রাকৃতিক গর্তে পালক দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/04/2014
মেঠো কাঠঠোকরা | Eurasian Wryneck | Jynx torquilla
মেঠো কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিরা মাটিতে দাঁড়ালে অনেকটাই গুইসাপের শাবকের মতো মনে হয়। গলার নিচটায়ও রয়েছে সে ধরনের আঁকিবুঁকি চিহ্ন। আর ওদের পিঠের দিকে তাকালে অজগর সাপের চিত্রটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এমনই অদ্ভুত গড়নের পাখি এরা। খুব চতুরও এ পাখি। মাটিতে বিচরণ করেও বন্যপ্রাণীর শিকারে পরিণত হয় না খুব একটা। বরং বিপদে পড়লে অভিনয় করে পার পেয়ে যায়। হঠাৎ করে এরা যদি কোনো মানুষের নজরে পড়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়টাকে ১৮০ ডিগ্রি কোনে ঘোরাতে থাকে আর চোখ উল্টিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে মাটিতে শুয়ে পড়ে। ভাবটা এমন দেখায় মনে হচ্ছে বুঝি ওর ঘাড়টা মচকে গেছে এখন প্রচণ্ড ব্যথায় কোকাচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষ ওদের বেগতিক ভাবসাব দেখে থমকে যায় বা ধরতে ইতস্ততবোধ করে। ঠিক তখনই ডানায় বাতাস লাগিয়ে ফুরুৎ। এরা পরিযায়ী পাখি। শীতকালে চীন, সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছায়। থাকে বসন্তকাল অবধি। তবে এদের মূল বাসভূমি ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। ডাকে নাকি সুরে ‘খেক্-খেক্-খেক্’ শব্দে। এ ধরনের পাখি বহু বছর আগে দেখেছি মিরপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে। দেখেছি মাটির ওপর বিচরণ করতে। নির্জনে খুঁটেখুঁটে পোকামাকড় খাচ্ছে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘মেঠো কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান রাইনেক’ (Eurasian Wryneck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘জাইংকস টরকিল্লা’, (Jynx torquilla) গোত্রের নাম : ‘পাইকিদি’। উল্লেখ্য, অন্যসব কাঠঠোকরা প্রজাতির পাখিদের সঙ্গে এদের চেহারার মিল না থাকাতে অনেকে এদের ‘ঘাড়ব্যথা’ পাখি নামে ডাকে। লম্বায় এরা ১৬-১৯ সেন্টিমিটার। তুলনামূলক লেজ খানিকটা লম্বা। গায়ের বর্ণ ধূসর-মেটের সঙ্গে সাদার মিশ্রণে রয়েছে ছোপ, ডোরা খাড়া দাগ। পিঠের ওপর মোটা দাগ। মাথা, গলার নিচে আড়াআড়ি কালো ডোরা দাগ, পেটের দিকটায় সাদার উপরে এলোমেলো দাগ। লেজ বলয়যুক্ত। চোখের পাশের রেখা ঘাড়ের মাঝ বরাবর চলে গেছে। ঠোঁট, পা বাদমি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও আসলে পুরুষ পাখির গায়ের বর্ণ কিছুটা উজ্জ্বল। এদের প্রধান খাবার পোকামাকড়। তবে পিঁপড়া, পিঁপড়ার ডিম এদের প্রিয়। খেঁজুরের রস খেতেও দেখা যায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে গাছের খোড়লে। অনেক সময় অন্য প্রজাতির কাঠ ঠোকরাদের পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৭-১০টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/01/2013
ভাদি হাঁস | White winged Duck | Asarcornis scutulata
ভাদি হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। কয়েক দশক আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ বনের জলাশয়ে দেখা যেত। সম্প্রতি এ প্রজাতির পাখি কারো নজরেই পড়ে না। মূলত এরা ধীরগতির সে ললগ্নে জলাশয়ের ওপর নেমে আসে এবং সারারাত ধরে শিকারের লিপ্ত থাকে। ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হলে পুনরায় গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে পুরুষ পাখি ‘ক্রংক-ক্রংক’ স্বরে আওয়াজ করে। এ প্রজাতির সঙ্গে গৃহপালিত চীনা হাঁসের আকার-আকৃতি কিংবা বর্ণের মিল ব্যাপক। পাখিবিশারদ ব্যতিরেকে অন্য কারো পক্ষে প্রজাতি শনাক্তকরণ কঠিন বৈকি। বর্তমানে এদের বিস্তৃতি বিশ্বে সন্তোষজনক নয়, শুধু এশিয়ার কিছু অঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। যতদূর জানা যায়, উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বভাগ পর্যন্ত বিস্তৃতি। বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত এ প্রজাতির পাখি। প্রধান কারণ অবাধে বৃক্ষ নিধন। বিশেষ করে উঁচু গাছগাছালি বিলীন হওয়াতে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। বিঘ্ন ঘটছে বিচরণেও। ফলে এরা আর এ দেশমুখী হচ্ছে না। বিশ্বে বিপন্ন ও বাংলাদেশে অতিবিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তাই। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত রয়েছে। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘ভাদি হাঁস’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট-উয়িংড ডাক’ (White-winged Duck), বৈজ্ঞানিক নাম: Asarcornis scutulata | এরা লম্বায় ৮০-৮২ সেন্টিমিটার (ঠোঁট ৬ সে.মি লেজ ১৫ সে.মি)। ওজন প্রায় ৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির আকারে ও বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় সাদার ওপর ছোট ছোট কালো দাগ। কাঁধে সাদা পট্টি। পিঠ কালচের সঙ্গে তামাটের মিশ্রণ। ডানায় নীলাভ কালো বন্ধনী। ডানার কনুইয়ের প্রান্তে খাড়া নখর বিদ্যমান। স্ত্রী পাখি আকারে খানিকটা ছোট। দেহের পালক অনুজ্জ্বল। মাথায় ঘন কালো দাগ। ঠোঁট কমলা। পুরুষ পাখির ঠোঁটের গোড়ায় মাংসপিণ্ড স্ফীত রয়েছে। এটি প্রজনন মৌসুমে আরো স্ফীত হয়। পা ও পায়ের পাতা কমলা হলুদের মিশ্রণ। পায়ের পেছনের আঙুল সামান্য ছড়ানো। প্রধান খাবার: শামুক, ছোট মাছ, পোকামাকড় ও জলজ উদ্ভিদের কচিপাতা। প্রজনন সময় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। আম, উরি, সিভিট, ছুন্ডুল ইত্যাদি গাছের ৩০ মিটার উঁচুতে প্রাকৃতিক কোটরে ঘাস বা লতাপাতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৭-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/12/2013
পাহাড়ি কানকুয়া | Lesser Coucal | Centropus bengalensis
পাহাড়ি কানকুয়া | ছবি: ইন্টারনেট কোকিল পরিবারের সদস্য হলেও নিজেরা বাসা বানাতে সক্ষম। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃতি রয়েছে। দেশের সর্বত্রই কমবেশি দেখা যায়। স্বভাবে হিংস্র। গাছ-গাছালির চেয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বেশি দেখা যায়। ওড়াউড়ি তেমন পছন্দের নয়। অবশ্য খুব ভালো উড়তেও জানে না। ঝোপ-জঙ্গলের ভেতরে হেঁটে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করে। ক্ষণে ক্ষণে ‘বুট-বুট-বুট’ সুরে উচ্চকণ্ঠে ডেকে ওঠে। নির্জন দুপুরে কিংবা গভীর রাতে আচমকা ডেকে ওঠে মানুষের পিলে চমকে দেয়। পাখিদের কাছে এরা ডাকাত পাখি নামে পরিচিত। বিশেষ করে ছোট পাখিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। ছোট পাখিদের বাসার সন্ধান পেলে তছনছ করে দেয়। পায়ের শক্ত নখ এবং তীক্ষ ঠোঁট দিয়ে বাসা ফালা ফালা করে ডিম-বাচ্চা খায়। যেসব পাখি গাছের কোটরে ডিম পাড়ে ওদের ডিম-বাচ্চাও রেহাই পায় না। গাছের কোটরে লম্বা পা ঢুকিয়ে ডিম-বাচ্চা বের করে আনে। হিংস্রতায় অদ্বিতীয় হলেও এরা নিজেদের সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখে। নিয়ম করে প্রত্যহ গোসলাদি সেরে নেয়। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি কানকুয়া’, ইংরেজি নাম: ‘লেসার কুকাল’ (Lesser Coucal), বৈজ্ঞানিক নাম: Centropus bengalensis | অঞ্চলভেদে ‘কানাকোকা, হাঁড়িকুড়ি, কুক্কাল, বাংলা কুবো’ নামে পরিচিত। সাধারণত দুই প্রজাতির কানকুয়া দেখা যায়। বড় কানকুয়া ও পাহাড়ি কানকুয়া। দৈর্ঘ্য ৩১-৩৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৮৮ গ্রাম। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় কিছুটা বড়। চেহারায় পার্থক্য নেই। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। মাথা, ঘাড়, বুক, পেট নীলাভ কালো। পিঠ উজ্জ্বল বাদামি। লেজ ধাতব কালো। চোখ টকটকে লাল। তবে মনিটা কালো। নীলচে কালো ঠোঁটের অগ্রভাগটা বাঁকানো। পা ধাতব কালো। যুবাদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: পাখির ডিম-বাচ্চা, ছোট সাপ, গিরগিটি, ইঁদুর, কেঁচো, পঙ্গপাল, ফড়িং, লোমশ শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। বাসা বানায় বাঁশঝাড় অথবা ঘন পাতার গাছে। এছাড়াও অন্যান্য ঝোপ জঙ্গলের ভেতরেও বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে ব্যবহার করে কাঠি, বাঁশপাতাসহ নানা ধরনের লতাপাতা। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। শাবক উড়তে শেখে ৪০ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/09/2015