হলদে পা গাঙচিল | Yellow legged Gull | Larus cachinnans
হলদে পা গাঙচিল | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবলমাত্র শীতে প্রজাতির আগমন ঘটে। দেশে দেখা মেলে সুন্দরবন এলাকায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নিঝুমদ্বীপ ও মনপুরাতে। এছাড়াও খাবারের সন্ধানে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে বিচরণ করতে দেখা যায় এ সময়। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। এরা বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও বালুতটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদের। মরা মাছ খাওয়ার লোভে দ্বীপাঞ্চলের জেলে পল্লীতে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। নিজেদের মধ্যে খুঁনসুটি বেঁধে গেলে বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’। প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, ইসরাইল, সিরিয়া, তুরস্ক, সাইপ্রাস, সেনেগাল, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও ইংল্যান্ড পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে পা গাঙচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়লো-লেগড গাল’ (Yellow-legged Gull), বৈজ্ঞানিক নাম: Larus cachinnans| এরা ‘জল কবুতর’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫২-৬৮ সেন্টিমিটার। ডানা প্রসারিত অবস্থায় ১২০-১৫৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। মাথা, ঘাড় ও গলা ধবধবে সাদা। পিঠ ও ডানা ধূসর। তবে ডানায় সামান্য ফুটকি নজরে পড়ে। লেজে কালোর ওপর দু-একটি সাদা ফুটকি। দেহতল ধবধবে সাদা। ওড়ার পালক সাদা। চোখের বলয় লাল, তারা হলদেটে। ঠোঁট মোটা হলুদ। নিচের ঠোঁটের ডগা উজ্জ্বল লাল। পা ও আঙ্গুল হলুদ। প্রধান খাবার: মাছ। এছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড় খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মে পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে নিজ বাসভূমিতে। জলাশয়ের কাছাকাছি ভূমি অথবা পাথুরে এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৩১ দিন। শাবক শাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/11/2015
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
ভূমা পেঁচা | Dusky eagle owl | Bubo coromandus
ভূমা পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির পাখি। ভয়ঙ্কর দর্শন। হলুদ রঙের গোলাকার চোখ। গোলাকার শারীরিক গঠনও। দিনে গাছের বড় পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। কিছুটা লাজুক স্বভাবের বলা যায়। জনবসতি আছে এমন সব আমবাগানে অথবা তেঁতুল গাছে বিচরণ করে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। একজোড়া অনেক বছর যাবৎ একই গাছে বাসা বাঁধে। গাছের ডালে চোখ প্রসারিত করে চুপচাপ বসে থাকে। ওই অবস্থায় যে কেউ দেখলে ভয় পেতে পারেন। তার ওপর গুরুগম্ভীর সুরে ডেকে ওঠে, ‘দুঃখ দুঃখ দুঃখ’। যার ফলে পিলে চমকে ওঠে অনেকেরই। আসলে ওরা একেবারেই নিরীহ প্রাণী। অন্যসব পেঁচাদের মতো এরাও মাথা ঘুরিয়ে ঘাড়ের ওপর নিয়ে ঠেকাতে পারে। শিকার সন্ধানে পদ্ধতিটি দারুণ কাজে দেয়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। বিশ্বে প্রজাতিটির অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন এদেরকে উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ভূমা পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘ডাস্কি ঈগল আউল’ (Dusky eagle-owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Bubo coromandus | এরা ‘মেটে হুতোম পেঁচা’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ৪৮-৫৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার দু’পাশে কান পশম রয়েছে, যা ঝুঁটি আকৃতির দেখায়। চোখের দু’পাশে কপালের ওপর সাদা-বাদামি টান। মুখমণ্ডল হলদে-বাদামি। দেহের উপরাংশ ফ্যাকাসে-ধূসর রঙের ছিট ছিট। দেহের নিচের দিকে হলদে-বাদামির ওপর টানা বাদামি-কালো রেখা। চোখের তারা হলুদ, মনি বাদামি। আসমানী ফ্যাকাসে ঠোঁট আকারে খাটো, নিচের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। পায়ের আঙুল ধূসর। প্রধান খাবার: ছোট পাখি, ইঁদুর, টিকটিকি ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে নভেম্বর। আবার অঞ্চলভেদে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে প্রজনন ঘটে। এরা অন্যান্য পেঁচাদের মতো গাছের কোটরে অথবা দর-দালানের ফাঁকে বাসা বাঁধে না। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি বড় গাছের কাণ্ডে সরু ডালপালা দিয়ে। বাসা অগোছালো, শ্রীছাদ নেই। অনেকটা ঈগল বা চিলের বাসার মতো। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক শাবলম্বী হতে মাসখানেক লেগে যায়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/04/2016
লটকন টিয়া | Vernal hanging parrot | Loriculus vernalis
লটকন টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট মাধবকুণ্ড পৌঁছাতে তখনো প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার পথ বাকি। ঠিক এ মুহূর্তেই গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে তাই জলপ্রপাতের উদ্দেশে হাঁটতে লাগলাম। কিছু দূর যেতেই এক সঙ্গী হাতের তর্জনী উঁচিয়ে রাস্তার পাশের জঙ্গলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলাম দুটি বুনো খরগোশ খাবার খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম ছবি তুলতে আর তখনই ওরা লাফিয়ে জঙ্গলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওদের পিছু নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম, ‘চি-ট-ট, চি-ট-ট’ সুর কানে যেতেই। সুরটা গাছের উপরের মগডাল থেকে আসছে। পরিচিত সুর। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে বাইনোকুলার বের করে আইপিচে চোখ রাখলাম। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম ৭-৮টি পাখি বুনো ফল ঠোকরে খাচ্ছে আর মৃদু স্বরে আওয়াজ করছে। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্থানীয় প্রজাতির পাখি হলেও এরা এখন সুলভ থেকে অসুলভ হয়ে পড়েছে। দেশে খুব একটা নজরে পড়ে না আজকাল। শিকারিদের খপ্পরে পড়ে বন্দীদশায় কাটাতে হচ্ছে এদের। মিশ্র চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা এরা। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার ও সিলেটের সমতল এবং পাহাড়ের পাদদেশের গাছগাছালিতে দেখা যায়। দেখা যায় চা-বাগানাঞ্চলেও। রাতে গাছের মগডালে বাদুরের মতো ঝুলে ঘুমায়। ওদের নামকরণের পেছনে স্বভাবটি যোগ হয়েছে তাই। পাখির বাংলা নাম: ‘লটকন টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘ভারনাল হ্যাংগিং প্যারেট’,(Vernal hanging parrot), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লরিক্যুলাস ভারনালিস’,(Loriculus vernalis)। গোত্রের নাম: ‘সিট্টিসিদি'(Psittaculidae) | এরা ঝুলন টিয়া নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় সাত প্রজাতির টিয়া দেখা যায়। লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার (লেজ ৪ সেন্টিমিটার)। ঠোঁট টকটকে লাল। গলায় ফিরোজা রঙের ছোপ। দেহের উপরাংশ ঘাস-সবুজ। পিঠের শেষাংশ থেকে লেজের ওপর পর্যন্ত উজ্জ্বল লাল। দেহের নিচের পালক হলদেটে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। স্ত্রী পাখির গলায় ফিরোজা রঙের উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: ছোট নরম ফল, ফুলের মধু। এ ছাড়াও তালের রসের প্রতি আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। প্রচুর তালের রস পান করে অনেক সময় নেশাগ্রস্ত হয়ে চুপসে থাকে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে নরম লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/06/2018
তামাপিঠ লাটোরা | IdeanBay backed shrike | Lanius vittatus
তামাপিঠ লাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও তুরস্ক পর্যন্ত। বিচরণ করে আবাদি জমি, বনপ্রান্তরের খোলা মাঠে এবং ঝোপ-জঙ্গলের কাছাকাছি এলাকায়। পতঙ্গ শিকারের উদ্দেশ্যে এতদস্থানে ওড়াউড়ি করে। এ ছাড়াও বাঁশের খুঁটি কিংবা গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষায় সময় কাটায়। স্বভাবে হিংসুটে। স্বজাতির কেউ নিজ সীমানার কাছাকাছি এলে সহ্য করতে পারে না, চেঁচিয়ে বিদায় করে। পাখিটির বাংলা নাম: ‘তামাপিঠ লাটোরা’, ইংরেজি নাম: ইন্ডিয়ান বে-ব্যাকড শ্রাইক (IdeanBay-backed shrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Lanius vittatus | এরা ‘লালচে-পিঠ কসাই’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ১৭-১৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২০-২৮ গ্রাম। কপাল কালো। মাথা ফিকে ধূসর, ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠের মধ্যখানটা তামাটে বাদামি। পাশের দিকে কালোর ওপর সাদা ছোপ। লেজ কালো। গলা সাদাটে। দেহতল বাদামি সাদা। স্ত্রী পাখির কপালের কালো অংশটুকু সরু। উভয়ের চোখ বাদামি। কালচে বাদামি। পা ময়লা কালচে। প্রধান খাবার: ফড়িং, পঙ্গপাল, ঝিঁঝিঁ পোকা, টিকটিকি ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ৪ মিটার উচ্চতায় গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, পশম, মাকড়সার জাল ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/02/2016
জিরিয়া | Kentish plover | Charadrius alexandrinus
জিরিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অতি সুলভ দর্শন, পান্থ পরিযায়ী পাখি (চলার পথের প্রজাতি)। শীত আগমনের পূর্বেই পরিযায়ী হয়ে আসে উত্তর ও মধ্য এশিয়া থেকে। মূলত এরা সৈকতচারী পাখি। ঠিক অক্টোবরের দিকে আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নেয় উপকূলীয় এলাকার বনাঞ্চলের জলাশয়ের কাছাকাছি কিংবা মোহনা ও দ্বীপাঞ্চলের বালুকারাশিতে। বিচরণ করে পাহাড়ি এলাকার ঝর্ণার ধারেও। অনেক সময় উপকূলীয় এলাকার লোকালয়ের হালচাষ করা জমিতেও বিচরণ করতে দেখা যায়। এরা ছোট-বড় কিংবা মিশ্র দলে শিকারে বের হয়। দলে অনেক সময় হাজারখানেক পাখিও দেখা যায়। সারাদিন বালুকারাশি বা বালুকাদাময় এলাকায় পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। খাদ্যের সন্ধানে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করতে দেখা যায়। চলার পথে মাঝে মাঝে ‘টুউ-ইট টুউ-ইট ইট্টাপ ইট্টাপ’ সুরে ডাকে। সুর তেমন শ্রুতিমধুর নয়। ডানা লম্বা এবং ছুঁচাল বিধায় উড়তে পারে বেশ দ্রুত। দৌড়াতেও পারে দ্রুতগতিতে। বেশ মিশুক পাখি। সৈকতচারী অন্য সব প্রজাতি পাখির সঙ্গে মিলেমিশে কাটিয়ে দেয়। বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশেও ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘জিরিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘কেন্টিশ প্লোভার’, (Kentish plover), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘চারাড্রিয়াস আলেকজান্ড্রিনাস’ (Charadrius alexandrinus)। এরা ‘ভাঙ্গা অঙ্গুরী বাটান’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। শীতে রং বদলায়। মাথা লালচে বাদামি। ভ্রু সাদা। ঘাড়ে সাদা বন্ধনী। বন্ধনীটা অনেক সময় অপূর্ণ দেখায়। পিঠ ও ডানা ধূসরাভ-বাদামি। ওড়ার পালক ধোঁয়াটে। বুকের পাশ কেটে বাদামি ছোপ ডানার সঙ্গে মিশেছে। যা প্রজনন মৌসুমে কালো দেখায়। বুক থেকে লেজের তলদেশ পর্যন্ত সাদা। ঠোঁট শক্তপোক্ত কালো। ডাগর ডাগর চোখ কালো রঙের। লম্বা, কালচে পা জলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে উপযোগী। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: শুককীট, ছোট কাঁকড়া ও অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। উত্তর ও মধ্য-এশিয়ার নিজস্ব বাসভূমিতে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটিতে সামান্য খোদল করে অথবা সমতল ভূমিতে বাসা বাঁধে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সরাসরি মাটিতে ডিম পাড়তে। উল্লেখ্য, পাখি পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন তারা নাকি উপমহাদেশের সিন্ধু, বেলুচিস্তান, শ্রীলঙ্কা, গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে এদের বাসা বাঁধতে দেখেছেন। এরা ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটাতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/04/2014
কুড়া ঈগল | Pallas’s fish eagle | Haliaeetus leucoryphus
কুড়া ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট মূলত উপমহাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। কাশ্মীর থেকে হিমাচল, পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের হিমালয়ের ১৮০০ ফুট উচ্চতায় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ পর্যন্ত বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়াও দক্ষিণ রাশিয়া, মধ্য এশিয়া হয়ে ট্রান্স বৈকালিয়া, দক্ষিণ পারস্য উপসাগর ও উত্তর বার্মায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আমাদের দেশের বড় নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় কিংবা দিঘি-নালার আশপাশে এক সময় বেশ দেখা যেত। গত কয়েক দশক ধরে এদের উপস্থিতি অপ্রতুল্য। যতদূর জানা যায়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও এদের অবস্থা সংকটাপন্ন। সে তুলনায় বাংলাদেশে উপস্থিতি সামান্য ভালো। এদের খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও বড় বড় বৃক্ষনিধনের ফলে প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। এ পাখি উঁচু গাছের মগডালে বাসা বাঁধে। নিরাপদ মনে হলে দীর্ঘদিন একই স্থানে ডিম পাড়ে। পরবর্তী বছরগুলোতে শুধু বাসাটাকে মেরামত করে নেয়। বেশির ভাগ জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। এরা রাত-বিরাতে ডেকে ডেকে প্রহর ঘোষণা করে। ডাকে ‘অহক্ষয়-অহক্ষয়’ সুরে। আই.ইউ.সি.এন এ প্রজাতির পাখিকে বিপন্নের তালিকায় স্থান দিয়েছে। এতে করে পরিষ্কার হয়ে গেছে এদের ভূত-ভবিষ্যত আমাদের কাছে। আমি নিজ গ্রামে ছোটবেলায় এদেরকে বহুবার দেখেছি। এখনো মাঝেমধ্যে নজরে পড়ে, তবে তা কালেভদ্রে। পাখির বাংলা নাম: ‘কুড়া ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালাসেস ফিশি ঈগল’ (Pallas’s fish eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘হালিয়াইটাস লিউকরাইফাস’ (Haliaeetus leucoryphus), গোত্রের নাম: ‘এ্যাকসিপিট্রিদি’। লম্বায় ৭৬-৮৪ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ও গলা ফিকে সোনালি- পাটকিলে। পিঠ গাঢ় বাদামি। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ কালো, মাঝখানটায় সাদা বলয়। বুক থেকে নিচের দিকে ক্রমান্বয়ে ফিকে থেকে গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করেছে। ঠোঁট গাঢ় সেøট-কালো। পা হলদেটে সাদা। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, ব্যাঙ। প্রজনন সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ। বাসা বাঁধে উঁচু গাছের শিখরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ঘাস, লতাপাতা ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫-২৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/11/2013