দেশি গাঙচষা | Indian Skimmer | Rynchops albicollis
দেশি গাঙচষা | ছবি: ইন্টারনেট এরা বিপন্ন প্রজাতির পাখি। আইইউসিএন এ প্রজাতির পাখিকে সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে’ এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত। এক সময়ে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসে এদের দেখা যেত। সম্প্রতি এতদাঞ্চলে গাঙচষা নজরেই পড়ে না। জানা যায়, সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। ‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’ উল্লেখ করেছে বিশ্বে গাঙচষা পাখির আনুমানিক সংখ্যা ৪০০০ থেকে ৬৭০০টি। তবে বাংলাদেশে এ পাখির বিচরণ রয়েছে। শীতে পদ্মা, মেঘনার চরাঞ্চলে এবং হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেল ও দমারচরে এদের দেখা মেলে। এটি নিঃসন্দেহে পাখিপ্রেমীদের জন্য একটি সুখবর। এরা ঝাঁক বেঁধে বড় নদীর মোহনার ওপর উড়ে উড়ে শিকার খোঁজে। এ পাখির বড় গুণ হচ্ছে দেহটাকে না ভিজিয়েই শিকার ধরতে পারে। পরিশ্রান্ত হলে বালুচরে বিশ্রাম নেয় এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ওভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ভোর ও গোধূলিলগ্নে শিকার ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন ওরা উড়তে উড়তে ‘ক্যাপ-ক্যাপ-ক্যাপ..’ সুরে ডাকে। এই পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি গাঙচষা’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান স্কিমার’ (Indian Skimmer), বৈজ্ঞানিক নাম: Rynchops albicollis | লম্বায় ৪০ সেন্টিমিটার (ডানা ৩৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৭.৭ সেন্টিমিটার)। ঠোঁটের আকৃতি ছুরির মতো লম্বাটে। নিচের ঠোঁটের তুলনায় ওপরের ঠোঁট সামান্য খাটো। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল। ডগা কমলা। মাথা ও ঘাড় কালো। কপাল ও গলা সাদা। কাঁধ, ডানা, লেজের উপরিভাগ কালো। প্রজনন মৌসুমে পিঠ কালচে বাদামি দেখায়। ডানার প্রান্ত সাদা। গলার নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দেশি গাঙচষা পাখি মৎস্যভুক। মাঝেমধ্যে জলজ পোকামাকড়ও শিকার করে। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত। বাসা বাঁধে নদীর আশপাশে। সাধারণত বালি খুঁড়ে এরা বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/09/2013
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস | Northern Pintail | Anas acuta
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। সুলভ দর্শন। শীতে দেশের উপকূলীয় এলাকার নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিল-ঝিলে ছোট-বড় ঝাঁকে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারত পর্যন্ত এর বিচরণ ক্ষেত্র। বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। এরা ভোরে ও গোধূলিলগ্নে শিকারে ব্যস্ত থাকে। শিকার খোঁজে মাথা ডুবিয়ে, লম্বা লেজটা উঁচানো থাকে তখন। পুরুষ পাখি ডাকে, প্রিউ…প্রিউ সুরে। স্ত্রী পাখির সুর ভিন্ন। ডাকে, কিউয়্যাহ…কিউয়্যাহ সুরে। স্বভাবে শান্ত। প্রজনন মৌসুমে নিজ বাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। পাখির বাংলা নাম: ‘উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘নর্দার্ন পিনটেইল’(Northern Pintail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস আক্যুটা’(Anas acuta), গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। পিনাকৃতির লেজের কারণে এদেরকে অনেকে ‘পিনপুচ্ছ’ নামেও ডাকে। লম্বায় পুরুষ পাখি ৫৯ থেকে ৭৬ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫১ থেকে ৬৪ সেন্টিমিটার। গলা সরু। পুরুষ পাখির লেজ লম্বা ও চোখা। প্রজনন মৌসুমে রঙ বদলায় পুরুষ পাখির। তখন মাথা, মুখ ও ঘাড় চকোলেট-বাদামি রঙ ধারণ করে। ঘাড়ের দু’পাশ দিয়ে সাদা পট্টি সরু থেকে চওড়া হয়ে বুক পেট অবধি নেমেছে। পিঠ তামাটে।ডানার কিনারের পালক তামাটে-সবুজ মিশ্রণ। ডানার ঢাকনি কালো। দেহের পাশ থেকে দেখা যায় মিহি ধূসরাভ রেখাবৃত। বস্তিপ্রদেশ কালো। স্ত্রী পাখির রঙ ও আকার ভিন্ন। মাথা ও ঘাড় বাদামি। শরীর সামান্য পীতাভ রঙের ওপর চিত্রবিচিত্র আঁকা। আকারে ছোট। উভয়ের ঠোঁট সিসে-ধূসর। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদ। ছোট পোকামাকড়েও অরুচি নেই। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। সাইবেরিয়া-মঙ্গোলিয়ার উত্তরাঞ্চলের আর্দ্রভূমিতে ঘাস-লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৭-৯টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/11/2013
তামাপিঠ লাটোরা | IdeanBay backed shrike | Lanius vittatus
তামাপিঠ লাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও তুরস্ক পর্যন্ত। বিচরণ করে আবাদি জমি, বনপ্রান্তরের খোলা মাঠে এবং ঝোপ-জঙ্গলের কাছাকাছি এলাকায়। পতঙ্গ শিকারের উদ্দেশ্যে এতদস্থানে ওড়াউড়ি করে। এ ছাড়াও বাঁশের খুঁটি কিংবা গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষায় সময় কাটায়। স্বভাবে হিংসুটে। স্বজাতির কেউ নিজ সীমানার কাছাকাছি এলে সহ্য করতে পারে না, চেঁচিয়ে বিদায় করে। পাখিটির বাংলা নাম: ‘তামাপিঠ লাটোরা’, ইংরেজি নাম: ইন্ডিয়ান বে-ব্যাকড শ্রাইক (IdeanBay-backed shrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Lanius vittatus | এরা ‘লালচে-পিঠ কসাই’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ১৭-১৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২০-২৮ গ্রাম। কপাল কালো। মাথা ফিকে ধূসর, ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠের মধ্যখানটা তামাটে বাদামি। পাশের দিকে কালোর ওপর সাদা ছোপ। লেজ কালো। গলা সাদাটে। দেহতল বাদামি সাদা। স্ত্রী পাখির কপালের কালো অংশটুকু সরু। উভয়ের চোখ বাদামি। কালচে বাদামি। পা ময়লা কালচে। প্রধান খাবার: ফড়িং, পঙ্গপাল, ঝিঁঝিঁ পোকা, টিকটিকি ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ৪ মিটার উচ্চতায় গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, পশম, মাকড়সার জাল ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/02/2016
জল মুরগি | Common moorhen | Gallinula chloropus
জল মুরগি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির জলচর পাখি এরা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে বাস করে। শীত মৌসুমে আবার পরিযায়ী হয়েও অনেকে চলে আসে আমাদের দেশে। স্থানীয় প্রজাতির সাক্ষাৎ মেলে শীতেই বেশি। মৌসুমের অন্য সময়েও দেখা মেলে তবে তুলনায় একেবারেই নগণ্য। যত্রতত্র দেখা যাওয়ার নজির খুব বেশি নেই। সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হাওরাঞ্চলে। দেখতে অনেকটাই ডাহুকের মতো। ঠোঁটের গোড়ার লাল বর্ণটা বাদ দিলে ডাহুক মনে হবে যে কারো কাছেই। সম্প্রতি দেখেছি পাখিটাকে বিক্রমপুরে অবস্থিত রাজা বল্লাল সেনের দীঘির পাশের বিলটাতে। এক বন্ধু জানিয়েছেন, ওখানে নাকি একজোড়া পাখি দেখেছেন তিনি। সংবাদটা শুনে লোভ সামলাতে পারিনি, ছুটে গিয়েছি সেখানে। বিল পাড়ে গিয়েছি বিকেলের কিছু আগে। ভাগ্যটা ভালো ছিল আমাদের, খুব বেশি সময় লাগেনি ওদের সাক্ষাৎ পেতে। প্রথমে একটি পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি, জলদামের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে সে। আমার সঙ্গী ওদিকে ফিরে ক্যামেরা তাক করার আগেই জোড়ের অন্য পাখিটি ধইঞ্চা ক্ষেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে যুগলবন্দি হতে সহায়তা করেছে। এদের বাংলা নাম : ‘জল মুরগি’, ইংরেজি নাম : ‘কমন মুরহেন’ (Common moorhen), বৈজ্ঞানিক নাম : ‘গ্যাললিন্যুলা ক্লোরোপাস’ (Gallinula chloropus), গোত্রের নাম : ‘রাললিদি’। এ পাখি পান পায়রা বা ডাকাব পায়রা নামেও পরিচিত। এ পাখি লম্বায় ৩০-৩৮ সেন্টিমিটার। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল, অগ্রভাগ হলদেটে। মাথা, গলা কালো। পিঠ, ডানা পিঙ্গল। ডানা বুজানো অবস্থায় সাদা ডোরা দেখা যায়। লেজের ওপর কালচে, নিচের দিক সাদার ওপর কালো ছোপ। চোখের তারা লালচে। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ-হলুদ, হাঁটুর ওপর লালবলয়। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: ব্যাঙাচি, ছোট মাছ, ঘাস বীজ, কীট পতঙ্গ ইত্যাদি। আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবার এদের পছন্দ। বলা যায় সর্বভূক পাখি এরা। প্রজনন সময় মে থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে ঘাস বনের ভেতর অথবা জলের ওপর নুয়েপড়া গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো চিকন ডালপালা ও শুকনো ঘাস লতা। ডিম পাড়ে ৪-৭টি। ডিম ফুটে ১৮-২২ দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/06/2013
গাঙশালিক | Bank myna | Acridotheres ginginianus
গাঙশালিক | ছবি: ইন্টারনেট যত্রতত্র বিচরণ না করলেও দেশে কম-বেশি দেখা যায় এ পাখি। তবে বেশি দেখা যায় নদ-নদীর অববাহিকায়। দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। নামে বহুল পরিচিত হলেও অনেকেই দেখেনি এখনো এদের। এ পাখি দেশে তত সুলভও নয় আজকাল। খানিকটা অসুলভ হয়ে পড়েছে বলা যায়। এর জন্য অধিকাংশ দায়ী পাখি শিকারিরা। শিকারিরা অতি সহজে এদের জীবন্ত শিকার করতে পারে। আর এ কাজটি করে তারা ওদের প্রজনন মৌসুমে। এ সময়ে ওরা নদ-নদীর বা খালপাড়ের খাড়া কিনারে গর্ত করে বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধে কলোনি আকারে। পাশাপাশি অনেক পাখি গর্ত করে ডিম পাড়ে। আবার এও দেখা যায়, একই বাসায় একাধিক দম্পতি ঘর বাঁধে। সামাজিকতার বন্ধন এদের মাঝে ব্যাপক। আর সে সুযোগটিই নেন শিকারিরা। তারা প্রজনন মৌসুমে রাতের আঁধারে গর্তে হাত ঢুকিয়ে এদের জীবন্ত ধরে রাজধানীর বিভিন্ন পাখির দোকানে সরবরাহ করে। এদের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। দোকানিরা এদের বুনো ময়না বলে চালিয়ে দেন। চেহারাটাও সে ধাঁচের। অনেকটাই ময়না পাখির মতোই। পাখি সম্পর্কে যাদের ধারণা কম তারাই এদের ক্রেতা। এ পাখির বাংলা নাম: ‘গাঙশালিক’, ইংরেজি নাম: ‘ব্যাংক ময়না’ (Bank myna), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘অ্যাকরিডোথেরেস জিনজিনিয়ানাস’ (Acridotheres ginginianus), গোত্রের নাম:‘স্টুরনিদি’। গাঙশালিক লম্বায় ২৩ সেন্টিমিটার। মাথা মসৃণ কালো। থুঁতনি গলা পর্যন্তও তদ্রপ। কপালে ছোট কারো ঝুঁটি। দেহের অধিকাংশ পালক নীলচে ধূসর। ডানার পালক কালো। ওড়ার পালক সাদাটে ছোপ। পেটের নিচের দিকে বাদামি-কমলা। লেজ কালো। কনীনিকা গাঢ় লাল। ঠোঁট লালচে হলুদ। চোখের দু’পাশ পালকহীন পাটকিলে হলদে-লাল। পা কমলা-লাল। গাঙশালিকের প্রধান খাবার পোকা-মাকড়। এছাড়া শস্যদানাও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। নদী বা খালের খাড়া পাড়ে গর্ত করে বাসা বাঁধে। এছাড়াও দালান-কোঠা, পুরনো পুলের ফোঁকরে বাসা বাঁধে। মাটিতে বাসা বাঁধলে সে ক্ষেত্রে গর্তটা লম্বা করে বেশ। অনেক শাখা-প্রশাখা থাকে। এর মধ্যে শুকনো ঘাস লতাপাতা ঢুকিয়ে ডিম পাড়ার উপযোগী করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/05/2014
লালগলা ডুবুরি | Red necked Grebe | Podiceps grisegena
লালগলা ডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। শীতে দেখা মেলে। বিচরণ করে স্বাদুজলে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট দলেও নজরে পড়ে। হ্রদ কিংবা বড় জলাশয়ে দেখা মেলে। সাঁতারে খুব পটু। পানকৌড়িদের মতো ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডুব সাঁতার দিয়ে বাসায় পৌঁছে। এদের লেজ নেই। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুঁচালো। নিজ বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে পিঠে চড়িয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, উত্তর-পশ্চিম ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, জাপান, পূর্ব চীন সাগর, মঙ্গোলিয়া, পশ্চিম সাইবেরিয়া, পশ্চিম কানাডা, উত্তর-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘লালগলা ডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘রেড-নেকেড গ্রিব’ (Red-necked Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps grisegena | এরা ‘লালঘাড় ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৪৩-৫৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬১-৮৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৬৯২-৯২৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অভিন্ন। কপাল ও মাথার তালু কুচকুচে কালো। মাথার পেছনের পালক সামান্য লম্বা। ঘাড় ও গলা মরিচা লাল। ঘাড়ের মাঝ বরাবর কালো চওড়া টান দেখা যায়। চোখের নিচ থেকে অর্থাৎ থুঁতনি ও গাল ময়লা সাদা রঙের। পিঠ কালচে বাদামি। বুক লালচে বাদামি। পেট ধূসর সাদা। লেজ খাটো, নেই বললেই চলে। সুঁচালো ঠোঁটের উপরের অংশ কালচে। নিচের অংশ হলুদ রঙের। চোখের বলয় কালো। চোখের তারা গাঢ় বাদমি। পা সবজেটে। পায়ের পাতা চওড়া এবং চেপ্টা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এ ছাড়াও ছোট চিড়িং, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ২-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/02/2016
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013