মরুর ফিদ্দা | Desert wheatear | Oenanthe deserti
মরুর ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট শরৎকালে পরিযায়ী হয়ে আসে মরু কিংবা রুক্ষ অঞ্চল থেকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি পশ্চিম সাহারা, মিসরের পশ্চিম অংশ, চীন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান, দক্ষিণ ককেশাস, উত্তর মঙ্গোলীয়া, মরক্কো, ইরাক, ইরান, উত্তর আরব উপদ্বীপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা। ইউরোপের কিছু কিছু অঞ্চলেও দেখা যায়। প্রজাতিটি তেমন বাহারি রঙের না হলেও দেখতে মন্দ নয়। গায়ের রং বালির মতো। বালির ওপর বিচরণকালীন দূর থেকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচরণ করে একাকী। জোড়ায়ও খুব বেশি দেখা যায়। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। মরুময় কিংবা পাথুরে এলাকায় ঘুরেফিরে পোকামাকড় শিকার করে। তবে এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা যে কোনো রুক্ষ পরিবেশে অনায়াসে টিকে থাকতে পারে। তথাপিও বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে ইতিমধ্যে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরুর ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: ডেজার্ট হুইটইয়ার (Desert wheatear), বৈজ্ঞানিক নাম: Oenanthe deserti | এরা ‘ঊষর কানকালি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৪ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। গ্রীষ্মে পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় ফ্যাকাসে। চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশ কুচকুচে কালো, যা ঘাড়ের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ ফ্যাকাসে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকে কালো-সাদার মিশ্রণ। লেজের গোড়ার দিক ফ্যাকাসে বাদামি। লেজের পালক কালো। বুকের ওপর বাদামি-সাদা, দেহতল ফ্যাকাসে বাদামি। শীতে রং উজ্জ্বল হয়। স্ত্রী পাখির চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশের কালো অংশের পরিবর্তে বালি বাদামি। পিঠ বালি বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ধূসর কালো। উভয়ের চোখ গাঢ় বাদামি। ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গুবরেপোকা, মাছি, পিঁপড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড়। এছাড়া শস্যবীজের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে পাথুরে পাহাড়ের ওপর। এ ছাড়াও চিরহরিৎ কাঁটাঝোঁপের ভেতরও সংসার পাতে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৪ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/10/2015
কালিম পাখি | Purple Swamphen | Porphyrio porphyrio
কালিম পাখি | ছবি: ইন্টারনেট অনেকের ধারণা এরা অতিথি পাখি। ধারণাটি রটিয়ে দেয়ার জনক পাখি শিকারিরাই। কারণ অতিথি পাখির নাম শুনলে ভোজন রসিকদের জিভে জল আসে। তখন বিক্রি করতে সুবিধা হয়। দাম-টামও বেশি পাওয়া যায়। প্রকৃত তথ্যটি হচ্ছে, এরা আমাদের দেশীয় জলচর পাখি। স্বভাবে বুনো হলেও মোটামুটি পোষ মানে। মুক্ত অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। আবার একাকী বা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করে। ওদের বিচরণের ক্ষেত্র জলাশয়ের জলদামের ওপর। আবার জলেও সাঁতার কাটে, তবে তুলনামূলকভাবে কম। জলকেলি ওদের ভীষণ পছন্দ। জলের ছোঁয়ায় রূপের ঝলক আরো বেড়ে যায়। এ সুন্দর প্রজাতির পাখিদের বছর ত্রিশেক আগেও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাশয়ে কিংবা হাওর অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত। বর্তমানে এদের সাক্ষাৎ ওভাবে মেলে না। গত বর্ষায় আমি দেখেছি বিক্রমপুরের রামপালে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাখি দেখতে বেরিয়েছি এক বিকেলে। হাঁটতে হাঁটতে রাজা বল্লাল সেনের দিঘির পাড়ে হাজির হলাম। দেখতে পেলাম দিঘিটার আকার আকৃতি আগের মতো নেই। জলজ উদ্ভিদ বা জলদামের কারণে এটি এখন বিলে পরিণত হয়েছে। তার পরও এখানে কিছু জলচর পাখির দেখা মেলে। পাখি বিশেষজ্ঞরাও মাঝে মধ্যে এখানে পাখি পর্যবেক্ষণে আসেন। মাঝে মধ্যে আমিও যাই। সেদিনও গিয়েছি। কয়েক প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেলেও এ পাখির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে বেশি। দূর থেকে দেখতে পেয়েছি দুটি জলচর পাখি জলদামের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর পর বিরতি নিয়ে ওড়াউড়ি করছে। দৃশ্যটি বেশ লেগেছে আমার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়ে ওদের প্রজাতি শনাক্ত করে নিয়েছি। পাখিগুলো পূর্ব পরিচিত বিধায় ওদের পেছন আর অযথা সময় নষ্ট করিনি। বলতে দ্বিধা নেই, এ পাখি আমি নিজেও ক’দিন পুষেছি। আবার খাঁচার দরজা উন্মুক্ত করে ওদের প্রকৃতির কোলে ফিরিয়েও দিয়েছি। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালিম,’ ইংরেজি নাম: ‘পার্পল সোয়াম্পহেন’(Purple Swamphen) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পরফাইরিও পরফাইরিও’ (Porphyrio porphyrio), গোত্রের নাম: ‘রাললিদি’। এরা লম্বায় ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার। ঠোট, কপাল পালকহীন উজ্জ্বল লাল। মাথা থেকে গলা হালকা নীলাভ বর্ণ। এ ছাড়া সমস্ত শরীরের পালক বেগুনি-নীলের মিশেল। লেজের তলা সাদা। পা ময়লা লাল। পায়ের আঙ্গুল তুলনামূলকভাবে বড়। দেখতে নোংরা মনে হয়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এরা ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। ডিমে তা দেয়ার দায়িত্ব স্ত্রী পাখির ওপরে বর্তালেও ওই সময়ে পুরুষ পাখিটি বাসার কাছাকাছি থেকে স্ত্রী পাখিকে সঙ্গ দেয়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/11/2012
কালোমাথা টিয়া | Grey headed parakeet | Psittacula finschii
কালোমাথা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) উপজেলার শায়েস্তানগর গ্রামে। প্রয়াত স্কুল মাস্টার বড় মামার তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া করতাম। মামাতো ভাই নূরুল আলম লিটন আর আমি ছিলাম অনেকটাই মানিকজোড়ের মতো। স্কুল থেকে ফিরে দুজন টই-টই করে ঘুরে বেড়াতাম গ্রামের আনাছে-কানাছে। ঘুড়ি-নাটাই, পাখির বাসা এসব করে করে দিন কাটিয়ে দিতাম। একদিন পাখির বাসা খুঁজতে গিয়ে গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকালে গাছের কোটরে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর চেঁচিয়ে উঠলাম ডান হাতের তর্জনীর মাথা হারিয়ে। সেই স্মৃতি আজও বহন করছি আমি। পাখিটি ছিল টিয়া প্রজাতির। এরা সহজেই সরু তার কেটে ফেলতে পারে ওদের ধারালো ও শক্ত ঠোঁটের কামড়ে। তখন প্রজাতির নাম জানা ছিল না। ‘টিয়া’ নামেই চিনতাম। ওরা এখন অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে। অথচ ওরা দেশের আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। নজরকাড়া রূপ। শাল এবং মিশ্র-চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এক সময় লোকালয়ে কম-বেশি দেখা যেত, হালে তেমন একটা দেখা যায় না। এরা একাকী কিংবা ছোট-বড় দলে বিচরণ করে। বিশ্বে প্রায় ১৬ লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এদের আবাস হলেও বাংলাদেশে অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও লাওস পর্যন্ত। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালোমাথা টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-হেডেড প্যারাকিট’, (Grey-headed parakeet), বৈজ্ঞানিক নাম: Psittacula finschii | এরা ‘মেটেমাথা টিয়া’ নামেও পরিচিত। পুরুষ পাখি লম্বায় ৩৬ সেন্টিমিটার, লেজ ২৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী পাখি লম্বায় লেজসহ ২২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। তবে উভয় পাখির মাথা কালচে বা স্নেট কালো। মাথায় গাঢ় ধূসর অংশকে ঘিরে কালো দাগ। মাথার পেছনটায় নীলচে-সবুজ। পিঠ গাঢ় সবুজ। লেজ সবুজাভ হলুদ। মোটা লেজের পালক অর্ধেকটাই হলদেটে। দেহতল হালকা সবুজ। ঠোঁটের উপরের অংশ লাল, ডগা হলদেটে। নিচের অংশ হলদেটে। চোখের তারা হলুদ। পা কালচে। পুরুষ পাখির ডানার উপর খয়েরি-লাল বর্ণের পট্টি রয়েছে, যা স্ত্রী পাখির নেই। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির লেজ স্ত্রী পাখির তুলনায় লম্বা। প্রধান খাবার: ছোট ফল, শস্যবীজ, ফুলের মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ-এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২২ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৪০-৪৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/10/2018
লম্বাঠোঁটি দামা | Long billed Thrus | Zoothera monticola
লম্বাঠোঁটি দামা | ছবি: ইন্টারনেট ভূচর পাখি। স্বভাবে পরিযায়ী। দেশে শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। প্রজাতির অন্যদের মতো চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। বিচরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। হিমালয়ের ২২০০-৩৮০০ মিটারেও উঁচুতে দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। গানের গলা ভালো। মিষ্টি সুরে গান গায়। গাছের উঁচু ডালে বসে খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে গান গায়। স্বভাবে লাজুক। বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। চিরহরিৎ ছায়াময় স্থানে বিচরণ। পাইন বন অথবা সুঁচালো চিরহরিৎ বনে বেশি দেখা যায়। দেখা যায় লতাগুল্মের নিচেও। আবার পাথুরে এলাকায়ও বিচরণ রয়েছে। এতদঞ্চলের পরিত্যক্ত বা স্যাঁতসেঁতে এলাকার লতাপাতা উল্টিয়ে এবং ঘন ঘন ঠোঁট চালিয়ে খাবার খোঁজে। গাছের উঁচুতে এরা বিচরণ করে না। দেশের সর্বত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। প্রজাতিটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হলেও বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। প্রজাতিটির বাংলা নাম: ‘লম্বাঠোঁটি দামা’, ইংরেজি নাম: ‘লং-বিলেড থ্রাস’(Long-billed Thrush), বৈজ্ঞানিক নাম: Zoothera monticola | এরা ‘লম্বাঠোঁট দামা’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির দামা নজরে পড়ে। ত্মধ্যে ‘কমলা দামা’ ব্যতীত অন্যরা পরিযায়ী প্রজাতির পাখি। এরা দৈর্ঘ্যে ২৬-২৮ সেন্টিমিটার লম্বা। ওজন ১১৫-১৩০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। রঙে সামান্য পার্থক্য আছে। পুরুষ পাখির মাথা ফ্যাকাসে বাদামি। ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত অন্ধকার জলপাই-বাদামি রঙের। সাদাটে গলায় বাদামি বুটিক। দেহতল ক্রিম সাদার ওপর বাদামি বুটিক। ঠোঁট ও পা শিংকালো। তুলনামূলক ঠোঁট খানিকটা লম্বা। অপরদিকে স্ত্রী পাখি লালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: কেঁচো, পোকামাকড়, লার্ভা, ছোট শামুক ইত্যাদি। মাঝে মধ্যে ছোট ফলফলাদি খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ২-৭ মিটার উঁচুতে। গভীর কাপ আকৃতির বাসা। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, শুকনো ঘাস ও লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/05/2016
সুন্দরী প্রিনা | Graceful Prinia | Prinia gracilis
সুন্দরী প্রিনা | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। ভোলাভালা চেহারা। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। সাংঘাতিক চঞ্চল হলেও উড়তে খুব পারদর্শী নয়। দ্রুত উড়তে গেলে মনে হয় নিচে ঝুলে পড়বে। কিন্তু ভাবেসাবে দেখায় খুব উড়তে পারে। তবে এরা খুব আমুদে পাখি। সারাদিনই নেচেগেয়ে কাটাতে পছন্দ করে। খাদ্যের সন্ধানে গাছগাছালিতে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায়। ছোট ছোট পোকামাকড় সংগ্রহ করে খায়। বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে। মূলত এরা ঘাসবনের পাখি। এ ছাড়াও শুষ্ক অঞ্চল, বিশেষ করে সারিবদ্ধ গাছপালা কিংবা কাঁটা গাছে বিচরণ রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। কণ্ঠস্বর সুমধুর। ‘টিস..টিস..’ কণ্ঠে ডাকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এ ছাড়াও মিসর, ইরাক, ইসরাইল, সোমালিয়া ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃতি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী এরা হুমকি নয়, অবস্থান মোটামুটি সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘সুন্দরী প্রিনা’| ইংরেজি নাম: ‘গ্রেসফুল প্রিনিয়া’, (Graceful Prinia) | বৈজ্ঞানিক নাম: Prinia gracilis| এরা ‘চটপটে বুনো টুনি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১০-১৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৮ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন হলেও পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখি বাদামি রঙের। মাথা, ডানা ও লেজে গাঢ় বাদামি টান। গলা বাদামি সাদা। স্ত্রী পাখি হালকা বাদামি। উভয়ের লেজ লম্বা, কালচে বাদামি। দেহতল বাদামি-সাদা। ঠোঁট খাটো, গোলাপি কালচে। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা হলুদাভ ত্বক বর্ণের। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: গোবরে পোকা, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ভূমি থেকে দুই-তিন মিটার উঁচুতে লতাপাতা পেঁচিয়ে থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১০-১১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/03/2018
মরিচা কপাল ডোরাডানা | Rusty fronted Barwing | Actinodura egertoni
মরিচা কপাল ডোরাডানা | ছবি: ইন্টারনেট মাথায় চমৎকার ঝুঁটি। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। দেখতে বুলবুলি পাখির মতো মনে হতে পারে। আসলে এরা বুলবুলি প্রজাতির কেউ নয়। প্রজাতিটি দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র দেখা যায় না। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নাতিশীতোষ্ণ এলাকার ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্য। এ ছাড়া লতাগুল্মের ঝোপ কিংবা সুঁচালো চিরহরিৎ বনে বিচরণ রয়েছে। এরা একাকি বিচরণ করে না বললেই চলে। ছোট দলে বিচরণ করে। দলে কমপক্ষে ৬ থেকে ১২টি পাখি দেখা যায়। শুধু প্রজনন মৌসুমে দলত্যাগ করে জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। এদের চেহারা রাগীরাগী হলেও স্বভাবে হিংস নয়। দলের সবাই একত্রে বা মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল (হিমালয়ের পাদদেশ), ভুটান, পশ্চিম মিয়ানমার, চীন (ইউনান) পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান খুব বেশি সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরিচা কপাল ডোরাডানা’, ইংরেজি নাম: ‘রাস্টি ফ্রন্টেড বারউইং’ (Rusty-fronted Barwing), বৈজ্ঞানিক নাম: Actinodura egertoni | এরা ‘লালমুখ দাগিডানা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ২২-২৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৩-৩৮ গ্রাম। কপাল মরিচা লাল। মাথা ও ঝুঁটি ডার্ক-বাদামি। পিঠ পাটকিলে। ডানা পাটকিলের সঙ্গে সাদা-কালো মিশ্র ডোরাদাগ। লেজ পাটকিলে হলেও অগ্রভাগ কালচে, নিচের পালকের অগ্রভাগ সাদা। থুতনি মরিচা-লাল। দেহতল বাদামি-ধূসর। ঠোঁট খাটো হলদেটে ত্বক বর্ণ। পা ত্বক বর্ণের। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ফড়িং, বীজ, কচিপাতা। ছোট ফলের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। ভূমি থেকে ৬ মিটার উচ্চতার মধ্যে কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস-লতা, শৈবাল, ফার্ন, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদওপরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/12/2016
পাহাড়ি কানকুয়া | Lesser Coucal | Centropus bengalensis
পাহাড়ি কানকুয়া | ছবি: ইন্টারনেট কোকিল পরিবারের সদস্য হলেও নিজেরা বাসা বানাতে সক্ষম। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃতি রয়েছে। দেশের সর্বত্রই কমবেশি দেখা যায়। স্বভাবে হিংস্র। গাছ-গাছালির চেয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বেশি দেখা যায়। ওড়াউড়ি তেমন পছন্দের নয়। অবশ্য খুব ভালো উড়তেও জানে না। ঝোপ-জঙ্গলের ভেতরে হেঁটে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করে। ক্ষণে ক্ষণে ‘বুট-বুট-বুট’ সুরে উচ্চকণ্ঠে ডেকে ওঠে। নির্জন দুপুরে কিংবা গভীর রাতে আচমকা ডেকে ওঠে মানুষের পিলে চমকে দেয়। পাখিদের কাছে এরা ডাকাত পাখি নামে পরিচিত। বিশেষ করে ছোট পাখিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। ছোট পাখিদের বাসার সন্ধান পেলে তছনছ করে দেয়। পায়ের শক্ত নখ এবং তীক্ষ ঠোঁট দিয়ে বাসা ফালা ফালা করে ডিম-বাচ্চা খায়। যেসব পাখি গাছের কোটরে ডিম পাড়ে ওদের ডিম-বাচ্চাও রেহাই পায় না। গাছের কোটরে লম্বা পা ঢুকিয়ে ডিম-বাচ্চা বের করে আনে। হিংস্রতায় অদ্বিতীয় হলেও এরা নিজেদের সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখে। নিয়ম করে প্রত্যহ গোসলাদি সেরে নেয়। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি কানকুয়া’, ইংরেজি নাম: ‘লেসার কুকাল’ (Lesser Coucal), বৈজ্ঞানিক নাম: Centropus bengalensis | অঞ্চলভেদে ‘কানাকোকা, হাঁড়িকুড়ি, কুক্কাল, বাংলা কুবো’ নামে পরিচিত। সাধারণত দুই প্রজাতির কানকুয়া দেখা যায়। বড় কানকুয়া ও পাহাড়ি কানকুয়া। দৈর্ঘ্য ৩১-৩৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৮৮ গ্রাম। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় কিছুটা বড়। চেহারায় পার্থক্য নেই। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। মাথা, ঘাড়, বুক, পেট নীলাভ কালো। পিঠ উজ্জ্বল বাদামি। লেজ ধাতব কালো। চোখ টকটকে লাল। তবে মনিটা কালো। নীলচে কালো ঠোঁটের অগ্রভাগটা বাঁকানো। পা ধাতব কালো। যুবাদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: পাখির ডিম-বাচ্চা, ছোট সাপ, গিরগিটি, ইঁদুর, কেঁচো, পঙ্গপাল, ফড়িং, লোমশ শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। বাসা বানায় বাঁশঝাড় অথবা ঘন পাতার গাছে। এছাড়াও অন্যান্য ঝোপ জঙ্গলের ভেতরেও বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে ব্যবহার করে কাঠি, বাঁশপাতাসহ নানা ধরনের লতাপাতা। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। শাবক উড়তে শেখে ৪০ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/09/2015