পাতি চখাচখি | Common Shelduck | Tadorna tadorna
পাতি চখাচখি | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, চীন, তিব্বত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান ও ইরাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও সুলভ দর্শন। দর্শনীয় চেহারাও বটে। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশের প্রায় বিভাগেরই নদ-নদীতে কম-বেশি বিচরণ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে কিংবা মোহনাতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যের সন্ধানে বড় বড় দলে বিচরণ করে অগভীর জলাশয়ে। শিকার কৌশল দেশীয় গোত্রের পাতি হাঁসের মতো। সাধারণত এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের কলহ-বিবাদ ঘটায় না। বলা যায় সারাদিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। পুরুষ পাখি পারতপক্ষে তেমন ডাকাডাকিও করে না। স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নিচু গলায় শিস কাটে। সঙ্গী জবাব দেয় তখন ‘গ্যাগ-গ্যা-গ্যা’ সুরে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতিটি দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা আরেকটু সদয় হলে বোধ করি এদের আগমন আরো বেশি বেশি ঘটবে দেশে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি চখাচখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন শেল ডাক’ (Common Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না টাডোর্না’, (Tadorna tadorna) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। অনেকে ‘শাহ চখা বা সাচ্কা’ নামেও ডাকে। দেশে দুই প্রজাতির চখাচখি নজরে পড়ে। যথা: খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। এরা লম্বায় ৫৮-৬৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১ কেজি। কপাল, মাথা ও গলা ধাতব সবুজ। ঠোঁট রক্ত লাল, গোড়া স্ফীত লাল পুঁটলি। বুক ও ঘাড়ে সাদার ওপর পাটকিলে চওড়া বন্ধনী। পিঠ ধবধবে সাদা। ডানা কুচকুচে কালো। লেজ ও কোমর সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা মেটে-লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী পাখি খানিকটা ছোট। এ ছাড়াও স্ত্রী পাখির বুকে পাটকিলে বর্ণের প্রান্তটা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার তালু, গলার পেছন ও পিট কালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: জলজ কীট, ছোট শামুক, চিংড়ি, ধান, শৈবাল, কেঁচো, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। মধ্য এশিয়ার পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে প্রাকৃতিক ফাটলে কিংবা মাটির প্রাকৃতিক গর্তে পালক দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/04/2014
পাহাড়ি নিমপ্যাঁচা | Mountain Scops Owl | Otus spilocephalus
পাহাড়ি নিমপ্যাঁচা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির পাখি। ভয়ঙ্কর দর্শন। গোলাকার চোখ। গোলাকার শারীরিক গঠনও। মাথার দু’পাশে ছোট্ট খাড়া ঝুঁটি। এক কথায় প্রজাতি দর্শনে বা শারীরিক গঠনে যে কেউ ভয় পেতে পারেন। ভয় পেতে পারেন ওদের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনেও। আসলে এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। অন্যসব শিকারি পাখিদের মতো অত হিংস নয় ‘পাহাড়ি নিমপ্যাঁচা’। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। চোখজোড়া প্রসারিত করে তাকিয়ে থাকে। ভয় পাওয়ার অবশ্য এটিও একটি কারণ হতে পারে। আদতে এরা ভীতু প্রকৃতির। পাহাড়ি এলাকায় বাস। লোকালয়ে খুব একটা দেখা যায় না। লোকালয়ে এলেও সেটি হতে হবে অবশ্যই পাহাড়ঘেরা অরণ্য। মিশ্র চিরহরিৎ বনে দেখা যায়। এ ছাড়াও পাহাড়ি পাইন বনে কিংবা নাতিশীতোষ্ণ পাহাড়ি এলাকায় দেখা মেলে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, পূর্ব-ভারত (সিকিম), নেপাল (হিমালয়ের উত্তর অংশ), মিয়ানমার, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, সুমাত্রা ও মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন এদেরকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে বিরল দর্শন। কালেভদ্রে দেখো মেলে। নিশাচর পাখি। মূলত রাতের আঁধার ঘনিয়ে এলে ওরা শিকারে বের হয়। পাহাড়ের বনজ এলাকায় খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। একাকি কিংবা জোড়ায় জোড়ায় গাছের ডালে বসে থাকে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে উড়ন্ত পোকামাকড়ের খোঁজ খবর নেয়। খোঁজ খবর নেয় ইঁদুর বা সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীরও। নাগালের ভেতর এলে কেবল ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি নিমপ্যাঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘মাউন্টেইন স্কোপ আউল’ (Mountain Scops Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Otus spilocephalus | এরা ‘লালচে নিমপোখ’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২০ সেন্টিমিটার। মাথার দু’পাশে কান আকৃতির ছোট ঝুঁটি। কপালে সাদা ছোপযুক্ত, কিছু কিছু স্থানে সাদা ফোঁটা। দেহের উপরাংশ শেয়াল-বাদামি রঙের চিত্রবিচিত্রিত। দেহের নিচের দিকে শেয়াল রঙের চিতির ওপর বাদামি রেখাযুক্ত। চোখের তারা উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট খাটো, বাদামি রঙের। পায়ের আঙুল ফ্যাকাসে সাদাটে। পা পালকে আবৃত থাকে। প্রধান খাবার: পাহাড়ি কীটপতঙ্গ, গোবরে পোকা, ইঁদুর, টিকটিকিসহ অন্যান্য সরীসৃপ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। মরা গাছের প্রাকৃতিক কোটরে ৩-৫টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে মাসখানেক লেগে যায়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/08/2015
লক্ষ্মীপেঁচা | Barn Owl | Tyto alba
লক্ষ্মীপেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিদের মুখাবয়ব অনেকটাই মানবশিশুর মতো। গোলাকৃতির মুখ, বড় বড় চোখ এবং চেপ্টা ঠোঁটটি মানুষের নাকের আদলে হওয়ায় এমনটি মনে হয়। একটা সময় এ পাখি আমাদের দেশে সুলভ দর্শন ছিল। বর্তমানে এদের বাসস্থান সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এরা কালেভদ্রে নজরে পড়লেও উৎসুক মানুষের কাছে নাজেহাল হয় খানিকটা। অবশ্য যারা এদের চেনেন, তারা মোটামুটি পাখিটাকে নিরাপদে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরাও মানুষকে কিছুটা নিরাপদ মনে করে। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এ পাখি। গভীর জঙ্গল এদের অপছন্দ। পুরনো দোর-দালান কিংবা গাছের কোটরে এদের বাসস্থান। নিরাপদ মনে হলে একই বাসায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। এরা নিশাচর হলেও খুব ভোরে এবং গোধূলি লগ্নে শিকারে বের হয়। কখনো মানুষের কোনো ধরনের অনিষ্ট করে না এরা; বরং কিছুটা উপকারেই আসে। ইঁদুর খেয়ে মানুষের ফসল রক্ষা করে। প্রতিদানে মানুষও এদের আগলে রাখার চেষ্টা করে। এদের মাংস ভক্ষণে অরুচি থাকায় শিকারিরাও এ পাখি শিকার করে না খুব একটা। এত কিছুর পরও ওরা আজ অস্তিত্ব সংকটে। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। খাদ্য সংকটও আরেকটি কারণ। তার ওপর রয়েছে গাছের প্রাকৃতিক কোটর স্বল্পতা এবং পুরনো দর-দালান হ্রাস পাওয়াতে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে চিরচেনা এসব পাখি সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল অচেনা হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ জেলায় অমনটি ঘটেছে। এ প্রজাতির একটি পাখি ছয়তলা ভবনে ঢুকে পড়লে ওটাকে অক্ষত অবস্থায় ধরে চিড়িয়াখানায় পাঠানোর উদ্যাগ নেয়া হয়। এ ধরনের প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায় আমাদের দেশে। এতে ওই পাখিটা নিরাপদ হতে পারলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায় ওদের পরিবারের। প্রথমত ওর জুড়ি পাখিটার আহাজারি, অবশেষে এলাকা পরিত্যাগ। দ্বিতীয়ত যদি ওই পাখির ডিম অথবা শাবক থেকে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমেয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বিরল বন্যপ্রাণী অথবা যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে ওকে চিড়িয়াখানায় না পাঠিয়ে বরং চিকিৎসা দিয়ে ওর পরিবেশেই ওকে উন্মুক্ত করে দেয়া। এ পাখির বাংলা নাম: লক্ষ্মীপেঁচা, ইংরেজি নাম: বার্ন আউল (Barn Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: টাইটো আলবা (Tyto alba), গোত্রের নাম: টাইটোনিদি। এরা লম্বায় ৩৪-৩৫ সেন্টিমিটার। এদের গোলাকৃতি মুখটি ধবধবে সাদা। ঘাড় ও ডানা হলদে-বাদামি। দেহের উপরের দিকটা সোনালি-বাদামি। গলা, পেট, বুক থেকে নিচের দিকে সামান্য চিতি। লম্বা ঠোঁটটি মাংসল সাদা। ঠোঁটের গোড়ার দিকে চেপ্টা মোমের মতো উন্মুক্ত ঝিল্লি মাংসল। চোখ গোলাকৃতির। লেজ খাটো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। লক্ষ্মীপেঁচার প্রধান খাবার ছোট সরীসৃপ, ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ইত্যাদি। জানা যায়, খাদ্য ও বাসস্থান ঠিকঠাক থাকলে বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করতে সক্ষম লক্ষ্মীপেঁচা দম্পতি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 11/01/2013
উদয়ি ধলা চোখ | Oriental White Eye | Zosterops palpebrosus
উদয়ি ধলা চোখ | ছবি: ইন্টারনেট বছর দুয়েক আগে কুমিল্লার ‘বার্ডস’-এ গিয়েছি। নানা জাতের দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির সমাহার ওখানে। পরিকল্পিত উদ্যান। বলা যায় দেখার মতো। সহকর্মীরা উদ্যানের ভেতর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছেন। আমি খুব বেশি ভেতরে প্রবেশ করিনি। উদ্যানের ভেতরের পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে মৃদু পায়চারি করছি। মাঝেমধ্যে দুর্লভ গাছগুলোর শাখা প্রশাখায় নজর বুলিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছি। কাজ তো শুধু দু’টিই। বন আর বন্যপ্রাণী সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া। বার্ডসে ঢুকে বেশ কিছু পরিচিত পাখি নজরে পড়েছে। যাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়তই সাক্ষাৎ হয় এমন ধরনের পাখিই বেশি ওখানে। শুধু সোনালু গাছে বসা একটি পাখিই দেখেছি, যাকে আর কখনো কোথাও দেখিছি বলে মনে হয়নি। সোনালু ফুলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে পাখিটি। ফলে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে। পাখিটি দেখতে ভারি চমৎকার। ওর উড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রয়েছি। অপরূপ রূপের অধিকারী পাখিটি উড়ে গেলেও স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে ওর দুটি চোখ। মনে হয়েছ সাদা চশমা পরেছে পাখিটা। চশমার ফ্রেমের ভেতর কুতকুতে দুটি চোখ প্রসারিত করে রেখেছে। পাখিটির ইংরেজি নাম: ‘ওরিয়েন্টাল হোয়াইট আই’, (Oriental White Eye) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘জসটেরোপস্ পালপেব্রোসাস’, (Zosterops palpebrosus) গোত্র: ‘জোসটেরোপিদি’| বাংলা নাম: অনেক। বাবুনাই, চশমা পাখি, সিত নয়ন, শ্বেতার্ফী, সাদা চোখ ইত্যাদি। আমাদের দেশের পাখি বিশারদরা নাম রেখেছেন ‘উদয়ি ধলা চোখ’। বাবুনাই এ দেশের ক্ষুদ্রতম পাখি ফুলঝুরির চেয়ে আড়াই সেন্টিমিটার বড়। এটি লম্বায় ১০ সেন্টিমিটার। গায়ের বর্ণ সবুজাভ সোনালি হলুদ। অনেক সময় উজ্জ্বল হলুদও দেখায়। চোখের চারপাশে গোলাকার সাদা বলয়। সরু কালো ঠোঁট নিচ দিকে সামান্য বাঁকানো। চিবুক ও গলা উজ্জ্বল হলুদ। পেটের দিকের পালক সাদাটে ধূসর। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। খাবার হিসাবে এদের প্রিয় পোকমাকড়, ফুলের মধু, ছোট বুনোফল। এ পাখি আমৃত্যু গাছের শাখায় বিচরণ করে। জীবদ্দশায় মাটিতে নামে না। মধুপান করে পানির পিপাসা মেটায়। অথবা বৃষ্টির পানি গাছের গায়ে লেগে থাকলে তা খেয়ে নেয়। এরা নির্জনতাপ্রিয়। একাকি চলাফেরা করে। প্রজনন সময় হলে জোড়া বাঁধে। এ সময় বেশ মিষ্টি সুরে গান গায় পুরুষ পাখিটি। গান গাওয়ার ঢং বেশ চমকপ্রদ। প্রথমে নিচুস্বরে গায়। পর্যায়ক্রমে স্বর বাড়িয়ে পুনরায় নিুস্বরে নিয়ে আসে। দীর্ঘসুরে গান গাইতে পারে না। দম ছোট এবং কণ্ঠস্বর চাপা। বড়জোর ৮-১০ সেকেন্ড দম আটকে রাখতে পরে। ‘সিসি.. টিসির..’ শব্দে ডাকাডাকি করে। বাংলাদেশের সর্বত্রই কমবেশি নজরে পড়ে। এপ্রিল থেকে জুন এদের প্রজনন সময়। বাসা বাঁধতে সময় নেয় ৩-৪ দিন। ঘন পাতার আড়ালে বাসা বাঁধে। বাসাটা ঝুলন্ত। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে মাত্র ১০-১২ দিন। বাংলাদেশের আর কোনো পাখির ডিম এত অল্প সময়ে ফুটতে দেখা যায় না। বাবুনাইদের বাচ্চা স্বাবলম্বী হতে সময় নেয় ৩০-৩৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/09/2012
দেশি মেটেধনেশ | Indian Grey Hornbill | Ocyceros birostris
দেশি মেটেধনেশ | ছবি: ইন্টারনেট দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি অদ্ভুত গড়নের ‘দেশি মেটেধনেশ’। এক সময় রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ বনাঞ্চলে দেখা যেত। শুষ্ক বনভূমির উঁচু গাছ-গাছালিতে বিচরণ করত। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে। বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও দেশি মেটেধনেশ বাংলাদেশে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তথাপিও প্রজাতিটিকে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। আমাদের দেশে মোট চার প্রজাতির ধনেশের সাক্ষাৎ মেলে। এদের প্রতিটি প্রজাতিরই স্বভাব কিংবা খাবার একই ধরনের। ধনেশ প্রজাতির সবাই প্রজনন সময়ে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। যেমন স্ত্রী পাখি স্বেচ্ছায় গাছের কোটরে ঢুকলে পুরুষ পাখি ওকে বন্দি করে রাখে। কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয় কাদামাটি দিয়ে। পুরুষ পাখি নিজেই কাদামাটি বহন করে এনে ঠোঁট দিয়ে লেপে দেয়। শুধু ছোট্ট একটি ছিদ্র রাখে বায়ু চলাচল এবং খাবারের জোগান দিতে। পুরুষ পাখিকেই খাবারের জোগান দিতে হয় তখন। ডিম-বাচ্চা ফুটলেও খাদ্যের চাহিদা মেটায় পুরুষ পাখিই। শাবক স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষ পাখিকেই খাবার জোগানে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চারা ফুরফুরে হলে ভেতর থেকে মা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে মাটির আস্তর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি মেটেধনেশ’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল’ (Indian Grey Hornbill), বৈজ্ঞানিক নাম: Ocyceros birostris | এরা ‘পুটিয়াল ধনেশ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৬১ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই। যেটুকু তফাত নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে, স্ত্রী পাখির ঠোঁটের ওপরের বর্ম ছোট ও ঠোঁটের ডগা অস্পষ্ট। বাদ বাকি পুরুষ পাখির মতোই। প্রজাতির পিঠ বাদামি-ধূসর। শরীরের পালকগুলো দেখতে অনেকটাই বালুকাময় মনে হয়। দেহের নিম্নাংশ কালচে ধূসর। ধূসর লম্বা লেজের মধ্য পালকের প্রান্ত সাদা। চোখের ওপরের ভ্রু প্রশস্ত সাদা। কান ঢাকনি কালচে ধূসর। ঠোঁট বাঁকানো, সূচালো। ঠোঁটের ওপর শক্তপোক্ত সেøট-কালো রঙের শিরন্ত্রাণ। পা ও পায়ের পাতা সেøট-কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঠোঁট হলুদ, শিরন্ত্রাণ নেই। প্রধান খাবার: গিরগিটি, টিকটিকি, ইঁদুর, গুবরে পোকা, ফল ও ফুলের পাপড়ি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। গাছের প্রকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৩৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/09/2014
ছোট ফুলঝুরি | Pale-billed Flowerpecker | Dicaeum erythrorynchos
ছোট ফুলঝুরি | ছবি: ইন্টারনেট এরা অতি সুলভ দর্শন স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পশ্চিম মিয়ানমার পর্যন্ত। বিচরণ করে পর্ণমোচী অরণ্য, ফুল এবং ফল বাগানে। অস্থিরমতি পাখি। সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটায় গাছের চিকন ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর ‘চিক্..চিক্..চিক্..’ সুরে গান গাইতে থাকে। পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট ফুলঝুরি’, ইংরেজি নাম: ‘প্লেইন-বেলিড্ ফ্লাওয়ার পেকার’ (Pale-billed Flowerpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Dicaeum erythrorynchos। এরা ‘মেটেঠোঁট ফুলঝুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৮ সেন্টিমিটার। মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ধূসরাভ-জলপাই। দেহতল ধূসরাভ। ঠোঁট ত্বক রঙের। ঠোঁটের গোড়া প্রশস্ত, ডগা সরু। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কালো। প্রধান খাবার: ফুলের মধু, মাকড়সা, ছোট পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ৩-৭ মিটার উঁচুতে গাছের চিকন ডালে। বাসা নাশপতি আকৃতির। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের সরু তন্তু, শ্যাওলা, তুলা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, ১৯/০৬/২০১৫
তিলা মুনিয়া | Spotted munia | Lonchura punctulata
তিলা মুনিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অতিপরিচিত পাখি এরা। দেখতেও বেশ সুন্দর। প্রকৃতিতে বিচরণের চেয়ে আজকাল ওদের বেশি দেখা যায় খাঁচায় বন্দি অবস্থায়। যে কোনো পাখির দোকানে গেলেই ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘কিরিটি চিরিটি চিট্টি-কিট্টি-কিটরি… কিচ কিচ’ সুরে ডাকাডাকি করে আকুতি জানায় মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে। কিন্তু দোকানির মন গলে না তাতে। সে বড়োজোর হাত বদল করতে রাজি, খাঁচার দরজা খুলে চিরতরে মুক্ত করে দিতে নারাজ। কারণ দোকানি এর পেছনে লগ্নি করেছে। পাখিশিকারিদের দাদন দিয়েছে; বিনিময়ে শিকারিরা দেশের গ্রামাঞ্চল, জলা-জঙ্গল কিংবা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে দোকানির কাছে সরবরাহ করে। সব ধরনের পাখিই তারা শিকার করে। এর মধ্যে এ পাখিই বেশি ওদের ফাঁদে পড়ে। এর অন্যতম কারণ এরা বাস করে দলবদ্ধভাবে। জালের ফাঁদ পাতলে প্রায় পুরো ঝাঁকই ধরা পড়ে যায়। খুব সহজেই ধরা পড়ে বিধায় এ পাখি মোটামুটি দামেও সস্তা। তাই ওদের প্রতি দোকানি এবং ক্রেতার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি থাকে। উপরে উল্লিখিত পাখির বাংলা নাম: ‘তিলা মুনিয়া’। ইংরেজি নাম: “স্পটেড মুনিয়া” (Spotted munia), বৈজ্ঞানিক নাম: লনচুরা পাংকটুল্যাটা (Lonchura punctulata)। গোত্রের নাম পাসেরিদি। আমাদের দেশে যে ক’প্রজাতির মুনিয়া বেশি দেখা যায়, ওরা হচ্ছে কালোমাথা মুনিয়া, সাদাগলা মুনিয়া, সাদাপিঠ মুনিয়া, তিলা মুনিয়া ও লাল মুনিয়া। মুনিয়া প্রজাতির মধ্যে লাল মুনিয়াই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তিলা মুনিয়া লম্বায় ১১-১২ সেন্টিমিটার। মাথা, চিবুক, গলা, ঘাড় কালচে বাদামি। পিঠ চকোলেট-পাটকিলে। বুক-পেট হালকা হলুদাভের ওপর কালো বৃত্তের ভেতর সাদা ছিট ছিট দাগ। তলপেটের দিকে ছিট বা কোনো ধরনের দাগ নেই। লেজের উপরের গোড়ার দিক হলুদাভ। তলার দিকটা সাদাটে। ত্রিকোণাকৃতির ঠোঁটটি নীলচে কালো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। পাখিবিশারদ ছাড়া সর্বসাধারণের পক্ষে স্ত্রী-পুরুষ নির্ণয় করা কঠিন। মুনিয়ারা মাটিতে নেমে হাঁটতে পারে না। চড়–ই পখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। বাস করে দলবদ্ধভাবে গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায়, গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে। দৃশ্যটি দেখার মতো বটে। সব ধরনের মুনিয়ার খাবার ধান, কাউন ও শস্যবীজ। এরা খোসা ছিলে শস্যদানা খায়। প্রজনন সময় জুলাই থেকে অক্টোবর। কাঁটাঝোপ, কাশবন অথবা নল-খাগড়ার বনে এরা বাসা বাঁধতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুকনো খড়, লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ৪-৬টি। তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ মিলে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ১৪-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/10/2012