তিলা মুনিয়া | Spotted munia | Lonchura punctulata
তিলা মুনিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অতিপরিচিত পাখি এরা। দেখতেও বেশ সুন্দর। প্রকৃতিতে বিচরণের চেয়ে আজকাল ওদের বেশি দেখা যায় খাঁচায় বন্দি অবস্থায়। যে কোনো পাখির দোকানে গেলেই ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘কিরিটি চিরিটি চিট্টি-কিট্টি-কিটরি… কিচ কিচ’ সুরে ডাকাডাকি করে আকুতি জানায় মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে। কিন্তু দোকানির মন গলে না তাতে। সে বড়োজোর হাত বদল করতে রাজি, খাঁচার দরজা খুলে চিরতরে মুক্ত করে দিতে নারাজ। কারণ দোকানি এর পেছনে লগ্নি করেছে। পাখিশিকারিদের দাদন দিয়েছে; বিনিময়ে শিকারিরা দেশের গ্রামাঞ্চল, জলা-জঙ্গল কিংবা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে দোকানির কাছে সরবরাহ করে। সব ধরনের পাখিই তারা শিকার করে। এর মধ্যে এ পাখিই বেশি ওদের ফাঁদে পড়ে। এর অন্যতম কারণ এরা বাস করে দলবদ্ধভাবে। জালের ফাঁদ পাতলে প্রায় পুরো ঝাঁকই ধরা পড়ে যায়। খুব সহজেই ধরা পড়ে বিধায় এ পাখি মোটামুটি দামেও সস্তা। তাই ওদের প্রতি দোকানি এবং ক্রেতার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি থাকে। উপরে উল্লিখিত পাখির বাংলা নাম: ‘তিলা মুনিয়া’। ইংরেজি নাম: “স্পটেড মুনিয়া” (Spotted munia), বৈজ্ঞানিক নাম: লনচুরা পাংকটুল্যাটা (Lonchura punctulata)। গোত্রের নাম পাসেরিদি। আমাদের দেশে যে ক’প্রজাতির মুনিয়া বেশি দেখা যায়, ওরা হচ্ছে কালোমাথা মুনিয়া, সাদাগলা মুনিয়া, সাদাপিঠ মুনিয়া, তিলা মুনিয়া ও লাল মুনিয়া। মুনিয়া প্রজাতির মধ্যে লাল মুনিয়াই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তিলা মুনিয়া লম্বায় ১১-১২ সেন্টিমিটার। মাথা, চিবুক, গলা, ঘাড় কালচে বাদামি। পিঠ চকোলেট-পাটকিলে। বুক-পেট হালকা হলুদাভের ওপর কালো বৃত্তের ভেতর সাদা ছিট ছিট দাগ। তলপেটের দিকে ছিট বা কোনো ধরনের দাগ নেই। লেজের উপরের গোড়ার দিক হলুদাভ। তলার দিকটা সাদাটে। ত্রিকোণাকৃতির ঠোঁটটি নীলচে কালো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। পাখিবিশারদ ছাড়া সর্বসাধারণের পক্ষে স্ত্রী-পুরুষ নির্ণয় করা কঠিন। মুনিয়ারা মাটিতে নেমে হাঁটতে পারে না। চড়–ই পখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। বাস করে দলবদ্ধভাবে গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায়, গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে। দৃশ্যটি দেখার মতো বটে। সব ধরনের মুনিয়ার খাবার ধান, কাউন ও শস্যবীজ। এরা খোসা ছিলে শস্যদানা খায়। প্রজনন সময় জুলাই থেকে অক্টোবর। কাঁটাঝোপ, কাশবন অথবা নল-খাগড়ার বনে এরা বাসা বাঁধতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুকনো খড়, লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ৪-৬টি। তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ মিলে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ১৪-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/10/2012
ঝুঁটিওয়ালা ঠোঁটকালো গাংচিল | Sandwich Tern | Sterna sandvicensis
ঝুঁটিওয়ালা ঠোঁটকালো গাংচিল | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। স্যান্ডউইচ আকৃতির গড়ন। দেখতে অনেকটাই ‘বড়ঠোঁটি গাংচিল’দের মতো। চাল-চলনও ওদের মতোই। প্রজাতির দেখা মেলে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে। বালুবেলাতেও বিচরণ করতে দেখা যায়। এছাড়া কৃষি জমিতে বিচরণ রয়েছে। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। কলোনি টাইপ বাসা বাঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। তবে নিজেদের মধ্যে কমবেশি ঝগড়া বাঁধে। এ সময় বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’ সুরে। প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক নয়। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদেরকে পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি দক্ষিণ-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্র, পূর্ব-দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা, উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিম আফ্রিকা, গ্রেট ব্রিটেন এবং ভূমধ্য অঞ্চল পর্যন্ত। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ঝুঁটিওয়ালা ঠোঁটকালো গাংচিল’, ইংরেজি নাম: ‘স্যান্ডউইচ টার্ন’, (Sandwich Tern), বৈজ্ঞানিক নাম: Sterna sandvicensis | এরা ‘স্যান্ডউইচ পানচিল’ নামে পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৩৭-৪৩ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৮৫-৯৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রজনন পালক ভিন্ন। মাথায় টুপি আকৃতির ঘন কালো পালক, যা ঘাড় অবধি নেমে খাড়া হয়ে থাকে। পিঠ ও ডানা ধূসর সাদা। লেজ সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। ওড়ার পালক সাদা। চোখের বলয় কালো। ঠোঁট কালো, সুঁচালো, অগ্রভাগ হলদেটে। পা ও আঙ্গুল কালো। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, সামুদ্রিক কৃমি। এ ছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড়, সরীসৃপ, শুককীট খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। উপকূলীয় এলাকার জলাশয়ের কাছাকাছি বেলাভূমি এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৩ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ২৮-৩৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/04/2016
কালোমাথা টিয়া | Grey headed parakeet | Psittacula finschii
কালোমাথা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) উপজেলার শায়েস্তানগর গ্রামে। প্রয়াত স্কুল মাস্টার বড় মামার তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া করতাম। মামাতো ভাই নূরুল আলম লিটন আর আমি ছিলাম অনেকটাই মানিকজোড়ের মতো। স্কুল থেকে ফিরে দুজন টই-টই করে ঘুরে বেড়াতাম গ্রামের আনাছে-কানাছে। ঘুড়ি-নাটাই, পাখির বাসা এসব করে করে দিন কাটিয়ে দিতাম। একদিন পাখির বাসা খুঁজতে গিয়ে গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকালে গাছের কোটরে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর চেঁচিয়ে উঠলাম ডান হাতের তর্জনীর মাথা হারিয়ে। সেই স্মৃতি আজও বহন করছি আমি। পাখিটি ছিল টিয়া প্রজাতির। এরা সহজেই সরু তার কেটে ফেলতে পারে ওদের ধারালো ও শক্ত ঠোঁটের কামড়ে। তখন প্রজাতির নাম জানা ছিল না। ‘টিয়া’ নামেই চিনতাম। ওরা এখন অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে। অথচ ওরা দেশের আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। নজরকাড়া রূপ। শাল এবং মিশ্র-চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এক সময় লোকালয়ে কম-বেশি দেখা যেত, হালে তেমন একটা দেখা যায় না। এরা একাকী কিংবা ছোট-বড় দলে বিচরণ করে। বিশ্বে প্রায় ১৬ লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এদের আবাস হলেও বাংলাদেশে অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও লাওস পর্যন্ত। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালোমাথা টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-হেডেড প্যারাকিট’, (Grey-headed parakeet), বৈজ্ঞানিক নাম: Psittacula finschii | এরা ‘মেটেমাথা টিয়া’ নামেও পরিচিত। পুরুষ পাখি লম্বায় ৩৬ সেন্টিমিটার, লেজ ২৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী পাখি লম্বায় লেজসহ ২২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। তবে উভয় পাখির মাথা কালচে বা স্নেট কালো। মাথায় গাঢ় ধূসর অংশকে ঘিরে কালো দাগ। মাথার পেছনটায় নীলচে-সবুজ। পিঠ গাঢ় সবুজ। লেজ সবুজাভ হলুদ। মোটা লেজের পালক অর্ধেকটাই হলদেটে। দেহতল হালকা সবুজ। ঠোঁটের উপরের অংশ লাল, ডগা হলদেটে। নিচের অংশ হলদেটে। চোখের তারা হলুদ। পা কালচে। পুরুষ পাখির ডানার উপর খয়েরি-লাল বর্ণের পট্টি রয়েছে, যা স্ত্রী পাখির নেই। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির লেজ স্ত্রী পাখির তুলনায় লম্বা। প্রধান খাবার: ছোট ফল, শস্যবীজ, ফুলের মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ-এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২২ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৪০-৪৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/10/2018
সবুজ ডোরা কাঠঠোকরা | Streak breasted Woodpecker | Picus viridanus
সবুজ ডোরা কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল আবাসিক পাখি। দেখা মেলে প্যারাবনে, চিরসবুজ বন, এবং উপকূলীয় এলাকার ঝোপ-জঙ্গলে। দেশে দেখা মেলে সুন্দরবনাঞ্চলে। বিচরণ করে একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। খাদ্যের সন্ধানে পতিত কাঠের গুঁড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে পোকামাকড় খোঁজে। হাঁটেও লাফিয়ে লাফিয়ে। গাছের খাঁড়া কাণ্ডের বাকল জড়িয়ে ধরে তরতরিয়ে ওপরে উঠতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময় গাছে গাছেই কাটিয়ে দেয়। ভয় পেলে গাছের কাণ্ড জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে থাকে। স্বভাবে শান্ত। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া মিয়ানমার থেকে মালয় পেনিনসুলায় পর্যন্ত। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত নয়। বিচরণকালীন সময় জোড়ের পাখির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ‘কিউপ..কিউপ..’ সুরে ডেকে। প্রজননকালীন সময় হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষ পাখি গাছের ফাঁপা ডালে ঠোঁট দিয়ে আঘাত করে স্ত্রী পাখিকে সুর বাজিয়ে শোনায়। পাখির বাংলা নাম: ‘সবুজ ডোরা কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘স্ট্রিক-ব্রেস্টেড উডপেকার’ (Streak-breasted Woodpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘Picus viridanus’। এরা ‘দাগিবুক কাঠকুড়ালি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির কপাল ও চাঁদি উজ্জ্বল লাল। স্ত্রী পাখির কপাল ও চাঁদি কালো। এছাড়া উভয়ের পিঠ ব্রঞ্জ-সবুজাভ, ডানার প্রান্ত পালক কালো-সাদায় ঢেউ খেলানো। লেজের ওপরের দিক হালকা বাদামি ডোরাসহ কালচে। লেজতল সাদাটে এবং কালচে জলপাই রঙের ছিটদাগ। ভ্রু-রেখা সাদা। কান-ঢাকনি মলিন সাদা। দাগহীন গাল ধূসর রঙের। গলা ফিকে জলপাই-বাদামির ওপর সাদা ছিট দাগ। থুঁতনি সাদা। দেহের নিম্নাংশ হলদে-সবুজের সঙ্গে হালকা হলুদ বর্ণের মিশ্রণ এবং পেটে জলপাই রঙের আঁশটে দাগ। কোমর অনুজ্জ্বল হলুদ-সবুজ। ঠোঁটের কোনায় কালো দাগ। ওপরের অংশ ধোঁয়াটে কালো নিচের অংশ হলুদ, অগ্রভাগ কালচে। চোখ কালচে-লাল। পা ও পায়ের পাতা ধূসর-সবুজ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পালক অনুজ্জ্বল। প্রধান খাবার: পিঁপড়া, উইপোকা, লার্ভা। এ ছাড়াও ফুলের রসের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। গাছের ঊর্ধ্বমুখী ডালে নিজেরা গর্ত খুঁড়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/01/2016
দেশি গাঙচষা | Indian Skimmer | Rynchops albicollis
দেশি গাঙচষা | ছবি: ইন্টারনেট এরা বিপন্ন প্রজাতির পাখি। আইইউসিএন এ প্রজাতির পাখিকে সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে’ এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত। এক সময়ে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসে এদের দেখা যেত। সম্প্রতি এতদাঞ্চলে গাঙচষা নজরেই পড়ে না। জানা যায়, সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। ‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’ উল্লেখ করেছে বিশ্বে গাঙচষা পাখির আনুমানিক সংখ্যা ৪০০০ থেকে ৬৭০০টি। তবে বাংলাদেশে এ পাখির বিচরণ রয়েছে। শীতে পদ্মা, মেঘনার চরাঞ্চলে এবং হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেল ও দমারচরে এদের দেখা মেলে। এটি নিঃসন্দেহে পাখিপ্রেমীদের জন্য একটি সুখবর। এরা ঝাঁক বেঁধে বড় নদীর মোহনার ওপর উড়ে উড়ে শিকার খোঁজে। এ পাখির বড় গুণ হচ্ছে দেহটাকে না ভিজিয়েই শিকার ধরতে পারে। পরিশ্রান্ত হলে বালুচরে বিশ্রাম নেয় এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ওভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ভোর ও গোধূলিলগ্নে শিকার ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন ওরা উড়তে উড়তে ‘ক্যাপ-ক্যাপ-ক্যাপ..’ সুরে ডাকে। এই পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি গাঙচষা’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান স্কিমার’ (Indian Skimmer), বৈজ্ঞানিক নাম: Rynchops albicollis | লম্বায় ৪০ সেন্টিমিটার (ডানা ৩৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৭.৭ সেন্টিমিটার)। ঠোঁটের আকৃতি ছুরির মতো লম্বাটে। নিচের ঠোঁটের তুলনায় ওপরের ঠোঁট সামান্য খাটো। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল। ডগা কমলা। মাথা ও ঘাড় কালো। কপাল ও গলা সাদা। কাঁধ, ডানা, লেজের উপরিভাগ কালো। প্রজনন মৌসুমে পিঠ কালচে বাদামি দেখায়। ডানার প্রান্ত সাদা। গলার নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দেশি গাঙচষা পাখি মৎস্যভুক। মাঝেমধ্যে জলজ পোকামাকড়ও শিকার করে। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত। বাসা বাঁধে নদীর আশপাশে। সাধারণত বালি খুঁড়ে এরা বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/09/2013
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
মেটে কাঠ ময়ূর | Grey Peacock Pheasant | Polyplectron bicalcaratum
মেটে কাঠ ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। চেহারা অন্যসব ময়ূরের মতো তত আকর্ষণীয় নয়। কালেভদ্রে দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ অরণ্যে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে ১৯৭৮ সালেও দেখা গেছে। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতির বিস্তৃতি ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও চীন পর্যন্ত। এতদাঞ্চলের আর্দ্র ঘন চিরসবুজ অরণ্য এদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। বনতলের ঝোপজঙ্গলে কিংবা বনপ্রান্তে এমনকি খোলা মাঠেও এরা বিচরণ করে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় সাধারণত জোড়ায় জোড়ায়। একাকী খুব কমই দেখা যায়। গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতো মাটিতে আঁচড় কেটে কীটপতঙ্গ বের করে খায়। খাদ্যের সন্ধান পেলে পুরুষ পাখি ‘অক-কক-কক-কক-’ সুরে আওয়াজ করে স্ত্রী পাখিকে কাছে ডেকে নিয়ে আসে। প্রজাতির সংখ্যা বিশ্বে সন্তোষজনক নয়। তবে গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা হ্রাস পেলেও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। এরা বাংলাদেশে মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মেটে কাঠ ময়ূর’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে পিকক-ফেজেন্ট (Grey Peacock-Pheasant), বৈজ্ঞানিক নাম: Polyplectron bicalcaratum| এরা ‘মেটে কাঠমৌর’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫৬ সেন্টিমিটার (লেজ ৩১ সেন্টিমিটার)। দেহের তুলনায় লেজ অনেক বড়। ওজন ৭৩০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথায় পীতাভ খাড়া পালক। ঘাড় বাদামি-পীতাভ। পিঠ ধূসর-বাদামি, তার ওপর বেগুনি-সবুজ চক্র যা লেজেও রয়েছে। থুতনি-গলা সাদাটে। দেহের নিন্মাংশে সাদা ডোরা। স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য খাটো। এদের মাথার চুড়াও খাটো। ডানায় এবং লেজে অস্পষ্ট চক্র। উভয়ের চোখের চারপাশ হলুদাভ চামড়ায় আবৃত। ঠোঁট পীতাভ বর্ণের। ঠোঁটের অগ্রভাগ ও মধ্যভাগ কালো। পা ও পায়ের পাতা কালচে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে স্ত্রী পাখিদের মতো। প্রধান খাবার: শস্যদানা, ফল, পোকামাকড় ও ছোট শামুক। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। ঝোপের ভেতর মাটির প্রকৃতিক গর্তে নরম খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১ দিন। ডিম ফুটে ছানা বের হয়েই মায়ের সঙ্গে খাবারের সন্ধানে ছুটে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/10/2014