পাহাড়ি নীলকণ্ঠ | Dollarbird | Eurystomus orientalis
পাহাড়ি নীলকণ্ঠ | ছবি: ইন্টারনেট দুর্লভ দর্শন। পরিযায়ী পাখি। আমাদের দেশে প্রজনন সময়ে (গ্রীষ্মকালে) দেখা মেলে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেটের চিরসবুজ অরণ্যে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনিতে পরিযায়ী পাখির বিস্তৃতি রয়েছে। এরা আমাদের দেশে মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত হয়েছে। তবে বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত রয়েছে। এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। ডাকে ‘ক্যাক.. ক্যাক’ সুরে। ওড়ার সময় ডাকে ‘ক-চক-চক-চক’ সুরে। পাখিটাকে প্রথম দেখি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। চা বাগানের ভেতরে উঁচু একটা গাছের মগডালে বসে রয়েছে। দেখতে খানিকটা সমস্যা বোধ করেছি। বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়েও প্রজাতি শনাক্ত করতে কষ্ট হয়েছে। পরক্ষণে চিনতে পেরে বেশ উত্তেজিত বোধ করেছি সেদিন। অধিক উত্তেজনা নিয়েই দ্রুত টুকিটাকি লিখে নিয়েছি। নোট নেয়া শেষ হতেই অসুস্থ শরীরে সুস্থতার ইঙ্গিত পেয়ে গেছি মহূর্তেই। পাখির বাংলা নামঃ পাহাড়ি নীলকণ্ঠ, ইংরেজি নামঃ ডলারবার্ড (Dollarbird), বৈজ্ঞানিক নামঃ Eurystomus orientalis, পরিযায়ী। আমাদের দেশে নীলকণ্ঠ এবং পাহাড়ি নীলকণ্ঠ নামক দুই প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। লম্বায় ৩০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০ গ্রাম। ঠোঁট কমলা লাল। মাথা কালচে-বাদামি। গলা থেকে নীলাভ আভা ঠিকরে বের হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের পালক কালচে নীল। ওড়ার পালক কালচে-বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকের গোড়া রূপালী-সাদা। চোখের বলয় হলদে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা লাল। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। এদের ঠোঁট অনুজ্জ্বল। প্রধান খাবারঃ উড়ন্ত পোকামাকড়। এরা উড়ে উড়েই শিকার ধরে। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে কিংবা পাহাড়ের প্রাকৃতিক গর্তে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-২০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩০-৩৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 09/04/2022
বড় খোঁপাডুবুরি | Great Crested Grebe | Podiceps cristatus
বড় খোঁপাডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী প্রজাতির জলচর পাখি। স্বাদুজলে বিচরণ করে। বিরল দর্শন। এক সময় দেশের বড় জলাশয়, নদ-নদী এবং মোহনা অঞ্চলে দেখা যেত। হালে সে রকমটি নজরে পড়ে না। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। ছোট অথবা মাঝারি দলেও নজরে পড়ে। সাঁতারে খুব পটু। ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি, ভীতুও সাংঘাতিক। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। যেখানে বাসা বাঁধে সেখানে ডুবসাঁতার দিয়ে পৌঁছে। এদের গড়নও আজব। লম্বা গলা, মাথার ওপর খোঁপাবিশিষ্ট ঝুঁটি। লেজহীন। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুচালো। ঠোঁট মাঝে মাঝে পিঠের পালকের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে জলে ভেসে বেড়ায়, তখন দূর থেকে মনে হয় বুঝি কোনো ফুলের গুচ্ছ জলে ভাসছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপ, দক্ষিণ-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, উত্তর টেরিটরি, কুইন্সল্যান্ড, ক্রান্তিয় আফ্রিকা ও এশিয়া পর্যন্ত। বাংলা নাম: ‘বড় খোঁপাডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেট ক্রেস্টেড গ্রিব’, (Great Crested Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps cristatus | এরা ‘খোঁপাযুক্ত ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৩৬-৬১ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৫৯-৭৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০০-১৫০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে অভিন্ন। কপাল বাদামি-কালো। মাথার তালুতে খোঁপাকৃতির বাদামি-কালো ঝুঁটি। মাথার পেছন থেকে গলার উপরিভাগ মদ-বাদামি। লম্বা গলা ও ঘাড়ের দু’পাশ বাদামি-সাদা। দেহের উপরের দিকটা কালচে-বাদামি। পিঠের দু’পাশ লালচে-বাদামি। লেজ একেবারেই খাটো, নেই বললেই চলে। লেজের দেহতল বাদামি-সাদা। দেহের পালক রেশমী এবং নরম। ঠোঁট ছোট সুচালো, কালচে-বাদামি। চোখ লালচে-বাদামি। চোখের পাশটা সাদা। পা কালচে। নখ চওড়া এবং চেপ্টা। শীতে রং বদলায়। যুবাদের রং ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ। এছাড়াও ছোট ব্যাঙ জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৪-২৬ দিন। শরীরে পালক গজাতে সময় লাগে ১০-১১ সপ্তাহ। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/11/2015
চিতিপাক গোশালিক | Spot winged Starling | Saroglossa spiloptera
চিতিপাক গোশালিক | ছবি: ইন্টারনেট বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাস্থল পরিষ্কার বনপ্রান্ত, খোলা বন, কৃষিজমি। এ ছাড়াও পর্বতের ৭০০-১০০০ মিটার উঁচুতে দেখা যায়। দেশে যত্রতত্র দেখা যায় না। বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। বিচরণ করে ছোট দলেও। স্বভাবে অন্যসব শালিকের মতোই ঝগড়াটে। সারাদিন খুনসুটি করে কাটায়। তবে ওদের ঝগড়া খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় না, কিচির-মিচির পর্যন্তই ঝগড়া। পরক্ষণে আবার মিলেও যায়। আবার শুরু। এভাবেই দিন কাটে। পারতপক্ষে কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি। বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘চিতিপাক গোশালিক’, ইংরেজি নাম: ‘স্পট-উইংড স্টার্লিং’ (Spot-winged Starling), বৈজ্ঞানিক নাম: Saroglossa spiloptera। এরা ‘লালচেগলা শালিক’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১০ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে: গো-শালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, পাতি কাঠশালিক, গোলাপি কাঠশালিক, চিতিপাখ গোশালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, বামুন কাঠশালিক ও ধলাতলা শালিক। এরা লম্বায় ১৯-২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা বাদামি। ঘাড় ও পিঠ ধূসর এবং কালো-বাদামি। ডানার প্রান্ত নীলাভ কালো। লেজ লালচে বাদামি। গলা লালচে। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদাটে। বুকের দু’পাশ শেয়ালে লাল। ঠোঁট নীলাভ কালো। চোখের বলয় সাদা। পা বেগুনি কালো। দেখতে একই রকম মনে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ। আকারেও সামান্য ছোট। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, পিঁপড়া, ছোট ফল, ফুলের মধু। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। বাসা বাঁধে ৬-১০ মিটার উচ্চতার গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, লতাপাতা, দড়ি, কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/08/2017
ধলামাথা কাঠকুড়ালি | Pale-headed Woodpecker | Gecinulus grantia
ধলামাথা কাঠকুড়ালি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন ‘ধলামাথা কাঠকুড়ালি’। কালেভদ্রে দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ অরণ্যে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল ও চীনের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত। মূলত এরা বাঁশবন কিংবা আর্দ্র পাতাঝরা বনের বাসিন্দা। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা একাকী। মরা গাছের কাণ্ড ঠুকরিয়ে খাবার খোঁজে। এক গাছ থেকে অন্য গাছে যায় তরঙ্গাকারে ওপর-নিচ হয়ে ওড়ে। মজাদার সেই দৃশ্য উপভোগ করার মতো। কণ্ঠস্বর কর্কশ। ডাকে ‘চেইক-চেইক-চেইক..’ সুরে। বিরক্ত হলে সুর পাল্টে ফেলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে মরা গাছের কাণ্ডে ঠোঁট দিয়ে জোরে জোরে ড্রাম বাজানোর মতো শব্দ করে। এ ছাড়াও ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে ভন ভন আওয়াজ করে স্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্যশ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। শত্রুমুক্ত প্রজাতি। শিকারি (মানুষ) দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার মতো ঘটনা শোনা যায়নি। শোনা যায়নি শিকারি পাখি দ্বারা নির্যাতিত হতেও। তথাপিও প্রজাতি দেশে বিপদমুক্ত নয়। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে অবাধে বৃক্ষ নিধন। যার ফলে আজ প্রজাতিটি বিরল দর্শন হয়ে পড়েছে। অথচ এরা স্থানীয় প্রজাতিরই পাখি। পাখির বাংলা নাম: ‘ধলামাথা কাঠকুড়ালি’, ইংরেজি নাম: ‘পেল-হেডেড উডপেকার’ (Pale-headed Woodpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Gecinulus grantia | এরা ‘হালকা রঙের কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৫ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ১৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথার তালু গাঢ় পাটকিলে, স্ত্রী পাখির সোনালি জলপাই-হলুদ। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্কদের উভয়ের ঘাড় ও ঘাড়ের পাশ সোনালি জলপাই-হলুদ। পিঠ খয়েরি-লাল। ডানার প্রান্ত পীতাভ-পাটকিলে। লেজ বাদামি। দেহতল খয়েরি-বাদামি। ঠোঁটের অগ্রভাগ পাণ্ডু বর্ণের, গোড়ার দিক ফ্যাকাসে। চোখ লালচে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা জলপাই রঙের। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, পোকামাকড় ও গোবরে পোকা। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। গাছের কাণ্ডে নিজেরা গর্ত খুঁড়ে বাসা বাঁধে। একই বাসা কয়েক বছর ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/08/2015
বড় বনলাটোরা | Large Woodshrike | Tephrodornis gularis
বড় বনলাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট মিশ্র পর্ণমোচী বন, বন প্রান্তর এবং চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা। স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বড় বনলাটোরার বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। দূরদর্শনে ‘পাতি বনলাটোরা’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। চেহারায়ও খুব একটা ভিন্নতা নেই। শুধু আকারে একটু বড় এরা। প্রজাতির কারোই আহামরি রূপ নেই। তবে চেহারাটা মায়াবি ধাঁচের। বিশেষ করে ওদের কাজল কালো চোখ পাখি প্রেমীদের মায়া জাগিয়ে তোলে। প্রজাতির দেখা মেলে শুষ্ক বন-বনানী কিংবা ঘন পাতার গাছগাছালির ডালে। ভাওয়াল শালবনে বেশি দেখা মেলে। স্বভাবে শান্ত। কিছুটা লাজুকও। উঁচু গাছের ঘন পাতার আড়ালে বিচরণ করে। শিকারে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। পতঙ্গভুক অন্যান্য পাখির সঙ্গেও শিকারে বের হয়। মাটিতে নেমেও শিকার খোঁজে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি সুর করে গান গায়। সুর শুনতে মন্দ নয়। উভয় প্রজাতিই কিছুটা বোকা কিছিমের। স্ত্রী পাখি যখন ডিমে তা দেয় ঠিক তখনই পুরুষ পাখি মনের আনন্দে সামান্য দূরের গাছের ডালে বসে গান গাইতে থাকে। ফলে চতুর শিকারি পাখিরা বুঝে যায় ওদের বাসার অবস্থান। এবার অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। একটি ভালো খবর দিতে চাই আপনাদের। পত্রিকায় প্রকাশিত পাখি নিয়ে আমার লেখাগুলো যারা এক সঙ্গে পেতে চান তারা https://pakhi.tottho.com ঠিকানায় ক্লিক করতে পারেন। এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন বগুড়া জেলার একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হাবিবুর রহমান। ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাকে, পাখি সংক্রান্ত সব ক’টি লেখা একত্রিত করার জন্য। এ পাখির বাংলা নাম: ‘বড় বনলাটোরা’, ইংরেজি নাম: ‘লার্জ উডশ্রাইক’ (Large Woodshrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Tephrodornis gularis| এরা ‘বড় সুধুকা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১৮-২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮-৪৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। উভয়েরই কাজল কালো চোখ। চোখের দু’প্রান্তে চওয়া কালো টান। মাথা নীল কালো। ঘাড় ও পিঠ কালচে-ছাই রঙের। ডানার প্রান্ত কালচে-বাদামি। লেজ গাঢ় খয়েরি। লেজের মধ্যখানের পালক দুটোতে ছাই রঙের ছোপ, বাইরের পালক ময়লা সাদা। গলার নিচে থেকে বুক পর্যন্ত ছাই রঙ। বুকের নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত সাদাটে। ঠোঁট সে্লট কালো। পা সিসে-কালো। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে পঙ্গপাল, ফড়িং ও ঝিঁঝিঁ পোকার প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময়ের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। বাসা বাঁধে গাছের উঁচুতে তে-ডালের ফাঁকে। ঘাস, লতাপাতা, শিকড় ও মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/11/2015
মেঠো রাতচরা | Savanna Nightjar | Caprimulgus affinis
মেঠো রাতচরা | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যততত্র দেখা যায় না। তুলনামূলক পাথুরে এবং মজা এলাকায় বেশি নজরে পড়ে। এ ছাড়াও তৃণময় সমভূমি এলাকায় দেখা মেলে। প্রজনন মৌসুম ছাড়া বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। দিনে ঘুমিয়ে কাটায়। সূর্যাস্তের খানিকটা পরেই ঝোপজঙ্গলের ভেতর থেকে ‘চিঙ্ক-চিঙ্ক-চিঙ্ক’ সুরে ডাকতে থাকে। কণ্ঠস্বর সুমধুর না হলেও সুরে তাল-লয় রয়েছে। রাত বাড়লে ডাকাডাকি বন্ধ। দেখতে মোটেও আকর্ষণীয় নয়। শারীরিক গড়নটাও একটু ব্যতিক্রম। গায়ের বর্ণ অনেকটাই গাছের মরা ডাল বা শুকনো পাতার মতো। গাছের ডালে বসলে খুব সহজে পাখি হিসেবে শনাক্ত করা যায় না। অপরদিকে মাটিতে বসে থাকলে শুকনো পাতার মতোই মনে হতে পারে। মাড়িয়ে গেলেও টের পাওয়া যায় না যে, এরা পাতা নাকি পাখি! বর্ণচোরা বিধায় নিরাপদে থাকার খানিকটা সুযোগ পায় ওরা। বাংলাদেশে প্রজাতিটি আবাস সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। আইইউসিএন এদের উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বিশ্বব্যাপী এরা হুমকির মুখে রয়েছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, হিমালয় অঞ্চল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘মেঠো রাতচরা’, ইংরেজি নাম: ‘সাভানা নাইটজার’ (Savanna Nightjar), বৈজ্ঞানিক নাম: Caprimulgus affinis | দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির ‘রাতচরা’ পাখির দেখা মেলে। দৈর্ঘ্য ২০-২৬ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির ওজন ৫৪-৮৬ গ্রাম। স্ত্রী পাখির ৭৫-১১০ গ্রাম। উভয়ের গায়ের উপরের রং বাদামি-দারুচিনি মিশ্রিত ছিট এবং কালচে ডোরাকাঁটা। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পসল্প খাড়া লোম। লেজ ও ডানা সামান্য লম্বা। বুক থেকে পেট পর্যন্ত রয়েছে আড়াআড়ি ডোরা দাগ। গলার নিচে হালকা ক্রিমসাদা ছিট। লেজ তলের পালকে বাদামি-সাদার ছিট। চোখ বাদামি। ঠোঁট কালচে, ওপরের ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রধান খাবার: ঝিঁঝিঁ পোকা, ফড়িং, গুবরে পোকা ও উড়ন্ত কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে নিশাচর কীটপতঙ্গ শিকার করে বেশি। প্রজনন মৌসুম বাংলাদেশ-ভারত এপ্রিল থেকে আগস্ট। এছাড়াও অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ছোট ছোট পাথর অথবা সরাসরি মাটির ওপরে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো লতাপাতা। ডিমের সংখ্যা ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/12/2015
বড় কাঠঠোকরা | Great Slaty Woodpecker | Mulleripicus pulverulentus
বড় কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। বিরল দর্শন। চেহারা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। কেবল দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ ও আর্দ্র পাতাঝরা বনে। প্রশস্ত পাতার বন এদের বিচরণের ক্ষেত্রে অতি উত্তম স্থান। এ ছাড়াও পাহাড়ের পাদদেশের বন-বনানীতেও বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। পাখিতাত্ত্বিকদের মতে ম্যানগ্রোভ অরণ্যেও এদের বিস্তৃতি রয়েছে। তবে আমার নজরে পড়েনি কখনো। শিকারে বের হয় একাকী, জোড়ায় কিংবা পারিবারিক দলে। দলে সাধারণত ৩-৬টি পাখির বেশি দেখা যায় না। প্রজাতির অন্যদের মতো এরা তরঙ্গাকারে না উড়ে বরং সোজাসুজি ওড়ে। ডাকাডাকি করে উড়তে উড়তেই। এ সময় ভুতুড়ে কণ্ঠে ‘ওয়িক ওয়িক ওয়িক..’ সুরে আওয়াজ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে হিমালয়াঞ্চল, ভারত, ভুটান ও ইন্দোনেশিয়ায়। বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিস্তৃতি সন্তোষজনক নয়। প্রজাতিটি বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। অবাধে চিরসবুজ অরণ্যের বড় বড় বৃক্ষ নিধনের ফলে এদের অস্তিত্ব হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মরা গাছের অভাবে এদের প্রজননে ভীষণভাবে বিঘ্ন ঘটছে। এমতাবস্থায় একমাত্র অভয়ারণ্যের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ঘটিয়ে প্রজাতিটিকে বিলীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব বলে ধারণা করছেন দেশের বন্যপ্রাণীবিশারদরা। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় মেটেকুড়ালি বা কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেট শ্লেটি উডপেকার’ (Great Slaty Woodpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মুল্লারিপাইকাস পালভেরুলেনটাস’ (Mulleripicus pulverulentus), গোত্রের নাম: ‘পাইকিদি’। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে মোট ২০ প্রজাতির কাঠঠোকরা বা কাঠ কুড়ালির সাক্ষাৎ মেলে। লম্বায় ৪৮-৫৮ সেন্টিমিটার। ঘাড় ও ঠোঁট অস্বাভাবিক লম্বা। ঘাড়-গলা পালকহীন। প্রাপ্তবয়স্কদের দেহের সমস্ত পালক স্লেট-ধূসর। থুঁতনি ও গলা ফ্যাকাসে হলুদ। ঠোঁট ফ্যাকাসে। চোখ বাদামি থেকে লালচে, চোখের বলয়ের চামড়া স্লেট রঙের। পা ও পায়ের পাতা কালচে স্লেট রঙের সঙ্গে নীলাভ আভার মিশ্রণ। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির চোখ ও ঘাড়ের মাঝামাঝি গাঢ় লাল পট্টি আছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের পিঠ অনুজ্জ্বল। পিঠে অসংখ্য ফ্যাকাসে ফুটকি। বাদবাকি স্ত্রী পাখির মতো দেখতে। প্রধান খাবার: গাছের মরা কাণ্ডের ভেতর লুকিয়ে থাকা পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। মরা গাছের কাণ্ডে নিজেরা গর্ত খুড়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে কত দিন লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/04/2014