লালমাথা টিয়া | Plum-headed Parakeet | Psittacula cyanocephala
লালমাথা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন। কালেভদ্রে দেখা মেলে মিশ্র চিরসবুজ বনে অথবা শাল বনে। দেখা যেতে পারে গ্রামীণ বনাঞ্চলেও। সামাজিক পাখি। ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। তবে আমাদের দেশে বড় ঝাঁকে নজরে পড়ে না। গড়ন স্লিম। মনোহরণকারী রূপ। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি কিছুটা নিষ্প্রভ। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও পূর্ব ভুটান পর্যন্ত। স্বভাবে হিংস । প্রজনন মুহূর্তে স্ত্রী পাখির হিংস তা বেড়ে যায় বহুগুণ। এরা ভালো পোষ মানে। শেখালে কথাও বলতে পারে। ক্রীড়ামোদী পাখি। খাঁচায় বন্দি অবস্থায় নানা কসরত দেখায়। খেলা করে এটাসেটা নিয়ে। বল আকৃতির গোলাকার কিছু পেলে ঠোঁট দিয়ে ঠেলতে থাকে। বলা যায় সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করে তা নিয়ে। পাখির বাংলা নাম: ‘লালমাথা টিয়া’, ইংরেজি নাম: প্লাম হেডেড প্যারাকিট (Plum-headed Parakeet), বৈজ্ঞানিক নাম: Psittacula cyanocephala| এরা ‘তাল কেশ টিয়া’ নামেও পরিচিত। অনেকে এদেরকে ‘আলুবোখারা-মাথা পাখি’ নামে ডাকে। আবার হিমালয়াঞ্চলে কেউ কেউ এদেরকে ‘পুষ্প কেশ টিয়া’ নামেও ডাকে। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথা গোলাপি রক্ত বর্ণ। ঘাড়ে মালাসদৃশ কালো রেখা। পিঠ হলুদাভ সবুজ। ডানা সবুজ। ডানার গোড়ায় রয়েছে খয়েরি-লাল পট্টি যা স্ত্রী পাখির নেই। নীলাভ-সবুজ লম্বা লেজ। তন্মধ্যে সবচেয়ে লম্বা পালকের প্রান্ত সাদাটে। দেহতল হলুদাভ-সবুজ। উপরের ঠোঁট কমলা-হলুদ, নিচের ঠোঁট কালো। পা সবুজেটে। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ধূসর। ঘাড়ে হলুদাভ বন্ধনী। উপরের ঠোঁট ভুট্টা হলুদ। নিচের ঠোঁট কালচে। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ছোট ফল, ফুলের পাপড়ি। পোষা পাখি বাদাম, দুধভাত, সবজি খায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৯-২৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, , ২৯/০৫/২০১৫
লাল বুক টিয়া | Red Breasted Parakeet | Psittacula alexandri
লাল বুক টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা হলেও শালবনে বেশি দেখা যায়। লোকালয়েও দেখা মেলে, তবে কম। স্থানীয় প্রজাতির হলেও সুলভ দর্শন অঞ্চলভেদে। যেমন: সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক নজরে পড়ে। বিচরণ করে ছোট-বড় দলে। কৃষকের ধান, গম, ভুট্টাক্ষেতে দল বেঁধে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করে, যা খায় তারচেয়ে বেশি নষ্ট করে। দেখতে ভীষণ সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর কর্কশ। সামাজিক পাখি, দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের যে কেউ বিপদের গন্ধ পেলে ‘ক্যাঁক..ক্যাঁক’ স্বরে ডেকে সবাইকে সতর্ক করে। বিপৎসংকেত পেয়ে সঙ্গীরা ঝটপট ডানা মেলে নিরাপদে পৌঁছায়। এত সতর্ক থাকার পরেও এরা শিকারিদের কবলে পড়ছে দেদার- যার ফলে আজ প্রজাতিটি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল বুক টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘রেড ব্রেসটেড প্যারাকিট’ (Red-Breasted Parakeet), বৈজ্ঞানিক: Psittacula alexandri | নাম: ‘সিট্টিসিদি’। এরা ‘তোতা ও মদনা’ নামে পরিচিত। প্রজাতি লম্বায় লেজসহ ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষের মাথা বেগুনি-ধূসর, কপালের ওপর কালো পট্টি, যা চোখের কাছে গিয়ে মিশেছে। ডানায় সোনালি আভা। গলা থেকে বুক পর্যন্ত গোলাপি। পেট নীলচে-সবুজ, তলপেট থেকে লেজের নিচ হলদেটে-সবুজ। লেজের ওপরের দিক নীলচে-সবুজ। লেজের ডগার কিনারটা হলদেটে। শক্ত মজবুত ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের বর্ণ ওপরের দিকে রক্ত লাল, নিচের অংশ কালো। স্ত্রী পাখির মাথা নীলচে-সবুজ। বুকের দিক গাঢ় গোলাপি। ঠোঁটের ওপরাংশ কালো, নিচের অংশ পাটকিলে-কালো। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির কনীনিকা ফিকে-হলুদ, স্ত্রী পাখির সাদাটে-হলুদ। উভয়ের পা ও আঙ্গুল ধূসরাভ-সবুজের সঙ্গে হলটে মিশ্রণ । প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ফুল, ফল, মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। পোষা তোতাদের দুধ-ভাত, কলা, বাদামের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।প্রকাশ: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/06/2017 এবং দৈনিক যুগান্তর, 31/08/2013
লাললেজ মৌটুসি | Fire tailed Sunbird | Aethopyga ignicauda
লাললেজ মৌটুসি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। যত্রতত্র দেখা না গেলেও সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে নজরে পড়ে। মনোহর রূপ। কণ্ঠস্বরও সুমধুর। প্রথম দর্শনেই যে কেউ মুগ্ধ হবেন। তবে সেটি অবশ্যই পুরুষ পাখির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারায় বিস্তর তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি অনেকটাই নিষ্প্রভ। রূপের এমন পার্থক্য সত্ত্বেও নবীন পাখি দেখিয়েদের পক্ষে স্ত্রী-পুরুষ শনাক্ত করা কঠিন। ‘লাল লেজ মৌটুসি’ নামের এই পাখি যথেষ্ট অস্থিরমতি ও ফুর্তিবাজ। সারা দিন নেচেগেয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। যেন কোথাও একদণ্ড বসার সময় নেই ওদের। বিশেষত পুরুষ পাখির চঞ্চলতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। লাফালাফি বা নাচতে গেলে ওদের লম্বা লেজটা সোজা দাঁড়িয়ে যায়। সেই দৃশ্যটাও মনে রাখার মতোই। স্ত্রী পাখির লেজ খাটো হওয়ায় সেভাবে লেজের কারিশমা দেখাতে পারে না। প্রজনন মৌসুমে লাল লেজ মৌটুসির দেখা মেলে জোড়ায় জোড়ায়। আবার প্রজননের বাইরে একাকী দেখা যায়। মূলত এরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা। দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। ভূপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার মিটার উচ্চতায়ও এদের দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া এই পাখির বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও তিব্বত পর্যন্ত। হিমালয় অঞ্চলেও দেখা যায়। পাখির বাংলা নাম: ‘লাললেজ মৌটুসি’, ইংরেজি নাম: ‘ফায়ার-টেইলড সানবার্ড’ (Fire-tailed Sunbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Aethopyga ignicauda | এরা ‘আগুন-রঙের বৃহত্তম মৌটুসি’ নামেও পরিচিত। এই প্রজাতির পুরুষ পাখি দৈর্ঘ্যে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার ও স্ত্রী পাখি সাত থেকে আট সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথার রং নীলাভ। ঘাড় রক্ত লাল। পিঠ ও লেজ কমলা-লাল। ডানায় জলপাই রঙের সঙ্গে নীল টান। গলা নীলাভ কালচে। বুকে হলুদের ওপর কমলা-হলুদ রঙের ডিম্বাকৃতি টান। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত জলপাই হলুদ। শরীরের তুলনায় লেজ বেশ লম্বা। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ধূসর জলপাই। পিঠ গাঢ় জলপাই। ডানায় নীলচে কালো পালক। লেজ খাটো ও বাদামি রঙের। উভয়ের ঠোঁট নীলচে কালো, লম্বা ও কাস্তের মতো বাঁকানো। চোখ ও পা কালো। প্রধান খাবার: ফুলের মধূ, ছোট পোকামাকড়, মাকড়সা ইত্যাদি। পাখিটির প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত। তবে অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। মোচাকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানায় গাছের তন্তু, শ্যাওলা ও মাকড়সার জাল দিয়ে। ডিম পাড়ে দুটি। তা দিয়ে ডিম ফুটাতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/05/2018
দাগযুক্ত টুনি | Zitting Cisticola | Cisticola juncidis
দাগযুক্ত টুনি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। সুলভ দর্শন। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নলখাগড়ার বন, জলাভূমির পাড়ের ঝোপঝাড়, কাশবন এবং শনক্ষেত। এ ছাড়া কৃষি জমির আশপাশের ছোট গাছগাছালি কিংবা ঝোপজঙ্গলে বিচরণ করে। পারতপক্ষে উঁচু গাছে বিচরণ করে না। মাঝারি গাছের ন্যাড়া ডাল বেশি পছন্দ। সারাদিন ঘাসবনে নেচে গেয়ে কাটায়। মায়াবী চেহারা। স্বভাবে শান্ত হলেও চঞ্চল অস্থিরমতির পাখি এরা। গানের গলা ভালো, ‘জিট..জিট..’ সুরে গান গায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষ পাখির রঙেও খানিকটা পরিবর্তন আসে। দেখতে তখন আরো মায়াবী দেখায়। এরা অনেক সময় শরীরটাকে ফুলিয়ে গাছের ডালে বসে থাকে। তখন দূর থেকে গোলাকার কদমফুলের মতো দেখায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা পর্যন্ত। দেশে এদের অবস্থান মোটামুটি ভালো। তবে বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়; হুমকিও নয়। ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘দাগযুক্ত টুনি’, ইংরেজি নাম: ‘জিটিং কিস্টিকোলা (Zitting Cisticola), বৈজ্ঞানিক নাম: Cisticola juncidis। এরা ‘ভোমরা ছোটন’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। গড় ওজন পুরুষ পাখির ৭-১২ গ্রাম। স্ত্রী পাখি ৫-৮ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। সমস্ত শরীর হলুদাভ। মাথা বাদামি। ঘাড়, পিঠ ও ডানায় গাঢ় বাদামি দাগ। লম্বা লেজের ডগা সাদাটে। দেহতল সাদাটে-হলুদাভ। প্রজনন পালক ভিন্ন। চোখ বাদামি। ঠোঁট সরু, উপরের অংশ কালচে নিচের অংশ হলদেটে বর্ণের। পা গোলাপি ত্বক বর্ণের। প্রধান খাবার: ছোট পোকামাকড়, ফড়িং, পিঁপড়া, মথ, শুককীট ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। কাপ আকৃতির বাসা। বাসা বাঁধে নরম মাকড়সার জাল, চিকন লতা, শিকড়, তন্তু ও তুলা দিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/08/2017
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস | Northern Pintail | Anas acuta
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। সুলভ দর্শন। শীতে দেশের উপকূলীয় এলাকার নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিল-ঝিলে ছোট-বড় ঝাঁকে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারত পর্যন্ত এর বিচরণ ক্ষেত্র। বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। এরা ভোরে ও গোধূলিলগ্নে শিকারে ব্যস্ত থাকে। শিকার খোঁজে মাথা ডুবিয়ে, লম্বা লেজটা উঁচানো থাকে তখন। পুরুষ পাখি ডাকে, প্রিউ…প্রিউ সুরে। স্ত্রী পাখির সুর ভিন্ন। ডাকে, কিউয়্যাহ…কিউয়্যাহ সুরে। স্বভাবে শান্ত। প্রজনন মৌসুমে নিজ বাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। পাখির বাংলা নাম: ‘উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘নর্দার্ন পিনটেইল’(Northern Pintail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস আক্যুটা’(Anas acuta), গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। পিনাকৃতির লেজের কারণে এদেরকে অনেকে ‘পিনপুচ্ছ’ নামেও ডাকে। লম্বায় পুরুষ পাখি ৫৯ থেকে ৭৬ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫১ থেকে ৬৪ সেন্টিমিটার। গলা সরু। পুরুষ পাখির লেজ লম্বা ও চোখা। প্রজনন মৌসুমে রঙ বদলায় পুরুষ পাখির। তখন মাথা, মুখ ও ঘাড় চকোলেট-বাদামি রঙ ধারণ করে। ঘাড়ের দু’পাশ দিয়ে সাদা পট্টি সরু থেকে চওড়া হয়ে বুক পেট অবধি নেমেছে। পিঠ তামাটে।ডানার কিনারের পালক তামাটে-সবুজ মিশ্রণ। ডানার ঢাকনি কালো। দেহের পাশ থেকে দেখা যায় মিহি ধূসরাভ রেখাবৃত। বস্তিপ্রদেশ কালো। স্ত্রী পাখির রঙ ও আকার ভিন্ন। মাথা ও ঘাড় বাদামি। শরীর সামান্য পীতাভ রঙের ওপর চিত্রবিচিত্র আঁকা। আকারে ছোট। উভয়ের ঠোঁট সিসে-ধূসর। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদ। ছোট পোকামাকড়েও অরুচি নেই। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। সাইবেরিয়া-মঙ্গোলিয়ার উত্তরাঞ্চলের আর্দ্রভূমিতে ঘাস-লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৭-৯টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/11/2013
কোটরে পেঁচা | Spotted owlet | Athene brama
সাদা মুকুট পেঙ্গা | ছবি: ইন্টারনেট গ্রামের বাড়ি (রায়পুর) যাওয়ার সুযোগ হয়নি তেমন একটা। কালেভদ্রে গেলেও বনবাদাড়ে ঘুরেই সময় কাটাই। বাড়ির আশপাশের গাছগুলোয় তীক্ষ দৃষ্টি রেখে পাখ-পাখালির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করি। তেমনি এক ছুটিতে গ্রামে গিয়ে রাতের আঁধারে ছেলেকে নিয়ে নিশাচর পাখির সন্ধানে বেরিয়েছি। গিয়েছি বাড়ির অদূরে একটি কাঠবনে। থমথমে আঁধারে অজানা আশঙ্কায় ছেলে ঘরে ফেরার তাগিদ দিচ্ছে বারবার। ঠিক ওই মুহূর্তে শুনতে পেলাম ‘চিকিক-চিকিক… চিরুর-চিরুর’ সুরের আর্তনাদ। পরিচিত সুর। থমকে দাঁড়িয়েছি তাই। আওয়াজ লক্ষ করে টর্চের আলো ছুড়ে দিয়েছি ওই দিকটায়। খুব বেশি দেরি হয়নি আওয়াজের উৎসস্থল খুঁজে পেতে। হেলেপড়া একটি গাছের ডালে একজোড়া ‘কোটরে পেঁচা’ বসে আছে জড়সড় হয়ে। টর্চের আলো গায়ে পড়তেই নড়েচড়ে বসছে দম্পতি। ডানা ঝাপটানোর আগেই আলো সরিয়ে ফেলেছি। যাতে বিরক্তবোধ না করে তা মাথায় রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু তার আগেই ওরা সটকে পড়েছে। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে পাখির কথা বলেছি, খুবই পরিচিত পাখি ওরা। স্থানীয় প্রজাতির নিশাচর পাখি। দেশে সন্তোষজনক বিস্তৃতি রয়েছে। দেখতে হিংস মনে হলেও একেবারেই নিরীহ। দিনে বড় গাছের ঘন পাতার আড়ালে কিংবা গাছের কোটরে বা পুরনো দরদালানের ফোকরে লুকিয়ে থাকে। গেছোইঁদুর শিকার করে মানুষের প্রচুর উপকার করে। মানুষও ওদের বন্ধু ভাবে তাই। শিকারে বের হয় গোধূলিলগ্নে, চলে রাতভর। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। একই স্থানে একজোড়া পাখি দীর্ঘদিন অবস্থান করে। বাসাও বাঁধে একই স্থানে বারবার। পাখির বাংলা নাম: ‘কোটরে পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড আউলেট’ (Spotted owlet), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘অ্যাথিনি ব্রামা’,(Athene brama)। গোত্রের নাম: ‘স্ট্রিগিদি’। এরা ‘খোঁড়লে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির পেঁচার দেখা মেলে। লম্বায় ৪৩ সেন্টিমিটার। গোলাকৃতির মুখ। মাথার তালুতে বাদামির ওপর ক্ষুদ্র সাদা ছিট। গলায় চওয়া বাদামি পট্টি। পিঠ, ডানা ও লেজ গাঢ় বাদামি। দেহতল সাদাটের ওপর আড়াআড়ি বাদামি রেখা যা ঠেকেছে লেজতলা পর্যন্ত। চোখের কোটর গোলাকার, চারপাশ সাদা। ঠোঁট সবুজাভ শিঙে। পা ও আঙুল হলদে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার ইঁদুর, গিরগিটি, পোকামাকড়, পাখির ছানা ও ছোট পাখি। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ। বাসা বাঁধে পুরনো গাছের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা পুরনো দরদালানের কোটরে। ডিম পাড়ে তিন-চারটি। ফুটতে সময় লাগে ৩৪-৩৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/07/2018
কালাগলা মানিকজোড় | Black necked Stork | Ephippiorhychus asiaticus
কালাগলা মানিকজোড় | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশে সর্বশেষ দেখা গেছে প্রায় ৬৭ বছর আগে। এদের বিচরণ হাওর-বাঁওড় জলাশয় এলাকায়। হাঁটুজলে নেমে শিকার খোঁজে। এরা দলবদ্ধ হয়ে বিচরণ করে না। সাধারণত এক জোড়ার বেশি কোথাও দেখা যায় না। তবে শিকারে বের হলে শামুকখোল পাখির সঙ্গে দল বাঁধতে দেখা যায়। খাবারে তেমন কোনো বাছবিচার নেই। পচাগলা থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবার এদের প্রিয়। রাত যাপন করে গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে। দিনের বেলা জলাশয়ের পাড়ে হাঁটুগেড়ে বিশ্রাম নেয়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওস পর্যন্ত। এ ছাড়াও পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ায় সামান্য নজরে পড়ে। পাখিবিশারদদের মতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বড়জোর এক হাজার ‘কালাগলা মানিকজোড়’ রয়েছে। সারা বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয় বিধায় আইইউসিএন এদের লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নামঃ ‘কালাগলা মানিকজোড়’, ইংরেজী নামঃ ‘ব্লাক নেকেড স্টর্ক’ (Black necked Stork) বৈজ্ঞানিক নামঃ Ephippiorhychus asiaticus। এরা ‘কালোগলা বক ও লোহারজঙ্গ’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৫০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামন্য পার্থক্য রয়েছে। পাখিবিশারদ ব্যতীত এ পার্থক্য নিরুপণ করা বড়ই কঠিন। সূক্ষ্ম সেই পার্থক্যটা হচ্ছে স্ত্রী পাখির চোখের তারা হলুদ, পুরুষ পাখির চোখের তারা বাদামি-কালো। এ ছাড়া বাদবাকি একই রকম। বলা যায়, এরা সাদা-কালো রঙের পাখি। মাথা ও গলা কালো। পিঠের মাঝখান থেকে লেজের উপরিভাগ পর্যন্ত কালো। দেহের বাকি অংশ সাদা। ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা উজ্জ্বল লাল। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের রং ভিন্ন। ওদের মাথা থেকে পিঠের দিক বাদামি। ওড়ার পালক কালচে। পা গাঢ় লাল। প্রধান খাবারঃ ছোট সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, বাইম মাছ। শিঙ-মাগুর মাছের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি গাছের উঁচু ডালের তেমাথায়। বাসা মাচা আকৃতির। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো সরু ডালপালা। ডিম পাড়ে তিন-চারটি। ফুটতে সময় লাগে ২৯-৩১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।