কুড়া ঈগল | Pallas’s fish eagle | Haliaeetus leucoryphus
কুড়া ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট মূলত উপমহাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। কাশ্মীর থেকে হিমাচল, পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের হিমালয়ের ১৮০০ ফুট উচ্চতায় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ পর্যন্ত বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়াও দক্ষিণ রাশিয়া, মধ্য এশিয়া হয়ে ট্রান্স বৈকালিয়া, দক্ষিণ পারস্য উপসাগর ও উত্তর বার্মায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আমাদের দেশের বড় নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় কিংবা দিঘি-নালার আশপাশে এক সময় বেশ দেখা যেত। গত কয়েক দশক ধরে এদের উপস্থিতি অপ্রতুল্য। যতদূর জানা যায়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও এদের অবস্থা সংকটাপন্ন। সে তুলনায় বাংলাদেশে উপস্থিতি সামান্য ভালো। এদের খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও বড় বড় বৃক্ষনিধনের ফলে প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। এ পাখি উঁচু গাছের মগডালে বাসা বাঁধে। নিরাপদ মনে হলে দীর্ঘদিন একই স্থানে ডিম পাড়ে। পরবর্তী বছরগুলোতে শুধু বাসাটাকে মেরামত করে নেয়। বেশির ভাগ জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। এরা রাত-বিরাতে ডেকে ডেকে প্রহর ঘোষণা করে। ডাকে ‘অহক্ষয়-অহক্ষয়’ সুরে। আই.ইউ.সি.এন এ প্রজাতির পাখিকে বিপন্নের তালিকায় স্থান দিয়েছে। এতে করে পরিষ্কার হয়ে গেছে এদের ভূত-ভবিষ্যত আমাদের কাছে। আমি নিজ গ্রামে ছোটবেলায় এদেরকে বহুবার দেখেছি। এখনো মাঝেমধ্যে নজরে পড়ে, তবে তা কালেভদ্রে। পাখির বাংলা নাম: ‘কুড়া ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালাসেস ফিশি ঈগল’ (Pallas’s fish eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘হালিয়াইটাস লিউকরাইফাস’ (Haliaeetus leucoryphus), গোত্রের নাম: ‘এ্যাকসিপিট্রিদি’। লম্বায় ৭৬-৮৪ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ও গলা ফিকে সোনালি- পাটকিলে। পিঠ গাঢ় বাদামি। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ কালো, মাঝখানটায় সাদা বলয়। বুক থেকে নিচের দিকে ক্রমান্বয়ে ফিকে থেকে গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করেছে। ঠোঁট গাঢ় সেøট-কালো। পা হলদেটে সাদা। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, ব্যাঙ। প্রজনন সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ। বাসা বাঁধে উঁচু গাছের শিখরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ঘাস, লতাপাতা ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫-২৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/11/2013
চিত্রা ক্রেক | Spotted Crake | Porzana porzana
চিত্রা ক্রেক | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন, পরিযায়ী পাখি। দেশে খুব বেশি দেখা যাওয়ার নজির নেই। এক সময় সামান্য দেখা গেলেও হালে দেখা যাওয়ার কোনো তথ্য নেই। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসত আমাদের দেশে। এদের বিচরণ ভূমি সুপেয় জলের জলাশয়ের কিনারে। বিশেষ করে বাদা বনে এরা আশ্রয় নেয় বেশি। হোগলা বন এদের খুবই প্রিয়। হোগলা বনের ভেতর হেঁটে হেঁটে পোকামাকড় খুঁজে ব্যস্ত সময় পার করে। এ ছাড়াও বড় বড় হাওর-বাওড়ের কিনারেও এদের দেখা যেত। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির পাখি ‘চিত্রা ক্রেক’। খুব সহজে নজরে পড়ে না, লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকে সবসময়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপ, মধ্যএশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত। মূলত এরা জলাশয়ের কিনারে বিচরণ করে। স্যাঁতসেঁতে এলাকা কিংবা হাঁটুজল এবং শুষ্ক অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। একাকী অথবা জোড়ায় বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে হাঁকডাক বেড়ে যায়। রাতে গাছের ওপর অথবা ঝোঁপ-জঙ্গলের ভেতর আশ্রয় নেয়। স্বভাব অনেকটাই ডাহুকের মতো। দেখতেও তদ্রুপ এবং গোত্রভেদেও এক। চলন-বলন কিংবা খাবার-দাবার সবই ডাহুকের মতোই। এদের আরেকটি প্রজাতির নাম ‘ঘুরঘুরি বা বাদা কুক্কুট’। দেখতে হুবহু চিত্রা ক্রেকদের মতোই। দেখায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পাখি বিশারদ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে প্রজাতি শনাক্ত করা কঠিই বটে। পাখির বাংলা নাম: ‘চিত্রা ক্রেক’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ক্রেক’ (Spotted Crake), বৈজ্ঞানিক নাম: Porzana porzana | দৈর্ঘ্য কম-বেশি ১৯-২৩ সেন্টিমিটার। শক্ত মজবুত গড়নের ঠোঁটের রঙ লালচে-হলুদ। মাথা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত বাদামির ওপর সাদা রেখা, চিতি এবং কালো দাগ। লেজের নিচের দিকে লালচে-বাদামি। কান ঢাকনি বাদামি। ভ্রƒ সাদা। বুক গাঢ় ধূসর। পেট সাদা এবং বাদামির ওপর সাদা রেখা দেখা যায়। চোখ বাদামি। পা সবুজাভ-হলুদ। প্রধান খাবার: জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদের কচি পাতা খায়। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চল ভেদে প্রজনন সময়ে হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে জলজ ধান ক্ষেতে কিংবা জলাশয়ের কাছাকাছি। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৬-১৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৪৫-৫০ দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/04/2015
চিতিপেট হুতুমপেঁচা | Spot bellied eagle owl | Bubo nipalensis
চিতিপেট হুতুমপেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট রাতচরা পাখি। আকারে বড়সড়ো। স্বভাবে হিংস ন বারবার। দিনের বেলায় গাছের পাতার আড়ালে বা বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকে। রাতে ‘হুহু… হুহু’ আওয়াজ করে মানুষের পিলে চমকে দেয়। প্রাকৃতিক আবাসস্থল ঘন চিরহরিৎ এবং আর্দ্র পর্ণমোচী বন, নদীর তীরবর্তী ঘন বন, পাহাড়ি অঞ্চল, হিমালয় অঞ্চলসহ ট্রপিকাল রেনফরেস্ট। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। বলা যায়, অঞ্চলভেদে বিরল দর্শন। পাখির বাংলা নাম: ‘চিতিপেট হুতুমপেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘স্পট-বেলিড ঈগল আউল’ (Spot-bellied Eagle Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Bubo nipalensis | এদের অন্য নাম ‘বুনো হুতুমপেঁচা’ (ফরেস্ট ঈগল আউল)। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৫৮-৬৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৩.৭ পাউন্ড। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। মুখমণ্ডল গোলাকার। কান পশম আছে। মাথা ধূসর সাদার ওপর কালচে ফোঁটা। পিঠ হরিদ্রাভ বাদামি ওপর কালচে-বাদামি চিতি। ডানার পান্ত পালকে কালচে-বাদামি চিতি। দেহতলে ক্রিম সাদা চিতি। লেজ খাটো, কালচে বাদামি। লেজতলে সাদা-কালো ডোরা। খাটো ঠোঁট ক্রিম সাদা বড়শির মতো বাঁকানো। মার্বেলের মতো গোলাকার চোখ গাঢ় বাদামি রঙের। পা হলদে সাদা। পায়ের আঙ্গুল হরিদ্রাভ-ধূসর। পায়ে পশম আছে। প্রধান খাবার: সাপ, ইঁদুর, টিকটিকি, বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ, ছোট পাখি, মাছ ও গলিত মাংস। প্রজনন মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। ডিম পাড়ে ১টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/10/2016
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
কালো ফিদ্দা | Pied Bush Chat | Saxicola caprata
কালো ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। অঞ্চলভেদে সুলভ দর্শন। পুরুষ পাখির তুলনায় স্ত্রী পাখি কিছুটা নিষ্প্রভ। পুরুষ পাখি দেখতে দোয়েলের মতো সাদা-কালো। মায়াবি চেহারা। স্ত্রী পাখি বাদামি। স্বভাবে চঞ্চল। কণ্ঠস্বর মধুর। মাঝারি আকৃতির বৃক্ষের উচ্চ শিখরে বসে গান গায়। বিচরণ করে একাকী। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি উপমহাদেশীয় অঞ্চল ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনিসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো ফিদ্দা’ ইংরেজি নাম: ‘পাইড বুশ চ্যাট’, (Pied Bush Chat), বৈজ্ঞানিক নাম: Saxicola caprata | এরা ‘কালো চ্যাট’ এবং ‘পাকড়া ঝাড়ফিদ্দা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ কালো। ডানায় সাদা টান। গলা ও বুক কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদা। স্ত্রী পাখির রং পিঠ বাদামি। উভয়ের চোখের বলয়ে সাদা ফোঁটা ফোঁটা। ঠোঁট কালো। পা ধূসর কালো। প্রধান খাবার: ভূমিজ কীটপতঙ্গ। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ঘাস, লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসা অনেকটাই পেয়ালা আকৃতির। ডিম পাড়ে ২-৫টি, ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 21/07/2017
শ্বেত শকুন | Scavenger Vulture | Neophron percnopterus
শ্বেত শকুন | ছবি: ইন্টারনেট বিপন্ন প্রজাতির পাখি ‘শ্বেত শকুন’। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশে এ পাখি দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। তবে এখন দেখা যায় না। এতদঞ্চলের মধ্যে অবশ্য এর দেখা মেলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পাখিবিশারদদের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাঝে মধ্যে পরিযায়ী হয়ে এ পাখির বাংলাদেশে আগমন ঘটলেও ঘটতে পারে। শ্বেত শকুনের বৈশ্বিক বিস্তৃতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা (আরব), দক্ষিণ মধ্যএশিয়া, উত্তর-পশ্চিম ভারত, পূর্ব-দক্ষিণ ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকা। অন্যসব প্রজাতির শকুনের মতো দেখতে এরা কদাকার নয়, সুশ্রী। ঈগলাকৃতির চেহারা। শ্বেত শুভ্র পালকের সঙ্গে কালো পালকের মিশ্রণে দেখতে দারুণ। খোলা মাঠ প্রান্তরে বিচরণ করে। বালিয়াড়ি এলাকা ওদের খানিকটা পছন্দের জায়গা। জোড়ায় কিংবা দলবেঁধে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। সব ধরনের মৃতদেহ এবং সরীসৃপ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আবার বিষাক্ত মৃতদেহ খেয়ে এদের জীবনাবসানও ঘটে। প্রজাতির অন্যদের তুলনায় এরা দীর্ঘজীবী। গড় আয়ু ৩৭ বছর। পাখির বাংলা নাম: শ্বেত শকুন। ইংরেজি নাম: স্কেভেঞ্জার ভালচার (Scavenger Vulture) | বৈজ্ঞানিক নাম: Neophron percnopterus | এরা ‘ধলা শকুন, মিসরীয় শকুন ও সাদা গিদরি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ৫৮-৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬০০- ২২০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন পার্থক্য নেই। হলুদ-কমলা রঙের চামড়ায় আবৃত মুখমণ্ডল। মাথায় কদম ফুলের রোয়ার মতো খাড়া সাদা পালক। ঘাড়, গলা, বুক ও পিঠ ময়লা মিশ্রিত সাদা। ডানার প্রান্ত পালক কালো। সাদা লেজের ডগা ত্রিকোণাকৃতির। উড়ার পালক কালো। উপরের ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো, অগ্রভাগ শিং কালো, বাদবাকি কমলা-হলুদ। চোখের বলয় হলুদ, তারা বাদামি। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মুখ ধূসর। দেখতে কালচে-বাদামি। যে কোনো ধরনের মৃতদেহ বা উচ্ছিষ্ট খাবার এদের প্রধান খাদ্য। খাদ্য তালিকা থেকে বাদ যায় না শামুক, পাখির ডিম, ছোট পাখি কিংবা সরীসৃপও। এদের প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে মাস। বাসা বাঁধে পুরনো দালানে কিংবা উঁচু গাছের ডালে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৯-৪৫ দিন। যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ৬ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/01/2019
কলজেবুটি কাঠকুড়ালি | Heart spotted woodpecker | Hemicircus canente
কলজেবুটি কাঠকুড়ালি | ছবি: ইন্টারনেট অনিয়মিত ও বিরলতম পরিযায়ী পাখি। কচ্ছপ আকৃতির গোলাকার গড়ন। দেখতে মন্দ নয়। শরীরে সাদা-কালো আঁকিবুকি। পরখ করে দেখলে বোঝা যায় ডানার প্রান্তে কালো রঙের হৃৎপিণ্ড আকৃতির দাগ। যা থেকেই এদের নামকরণের সূত্রপাত। স্বভাবে চঞ্চল। অন্যসব প্রজাতির কাঠঠোকরাদের মতো যত্রতত্র দেখা যায় না। দেখা মেলে চিরসবুজ ও আর্দ্র পাতাঝরা বনে। দেখা মেলে বাঁশবনেও। বিচরণ করে একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। গাছের কাণ্ডের চারপাশে লাফিয়ে ঘুরে ঘুরে শিকার খোঁজে। এ সময় শক্ত-মজবুত ঠোঁট চালিয়ে গাছের বাকলের ভিতর থেকে কীটপতঙ্গ বের করে আনে। শিকার পেলে তীক্ষ কণ্ঠে ‘ক্লিক-ক্লিক’ সুরে ডেকে ওঠে। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে গাছের ডালের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ‘টুই-টুই-টিটিটিটিটি…’ সুরে ডাকতে থাকে। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের গহিন বনাঞ্চলে দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোচীন পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণিতে রয়েছে। এরা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। অন্যসব কাঠঠোকরার মতোই এদের শক্রসংখ্যা নগণ্য। তথাপিও এদের সংখ্যা অপ্রতুল। প্রধান কারণটি হচ্ছে অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। পাখির বাংলা নাম: ‘কলজেবুটি কাঠকুড়ালি’, ইংরেজি নাম: ‘হার্ট-স্পটেড উডপেকার’(Heart-spotted woodpecker) বৈজ্ঞানিক নাম: Hemicircus canente | এরা ‘হৃৎপিণ্ড- ফোঁটাযুক্ত কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ১৫-১৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৬ গ্রাম। পুরুষ পাখির কপাল কালো, স্ত্রী পাখির কপাল সাদা। এ ছাড়া উভয়েরই ঝুঁটি পেছনের দিকে খাড়া। ঘাড় কালো, দুই পাশ পীতাভ সাদা। শরীরের ওপরের অংশ কালোর ওপর সাদা। ডানার সাদা বাজু অংশে কালো রঙের ছোট হৃৎপিণ্ড আকারের ফোঁটা। খাটো লেজটি কালো বর্ণের। দেহতল কালচে-জলপাই। ঠোঁট শিঙ-বাদামি। চোখ জলপাই বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা অনেকটাই স্ত্রী পাখির মতো দেখতে। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, উইপোকা ও পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত। বাসা বাঁধে গাছের মরা কাণ্ডে গর্ত বানিয়ে। নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে নেয়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকন্ঠ 09/11/2018