পাকড়া কাঠঠোকরা | Fulvous breasted woodpecker | Dendrocopos macei
পাকড়া কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি ‘পাকড়া কাঠঠোকরা’। দৃষ্টিনন্দন চেহারা। প্রজাতির অন্যদের মতো চোখ ভয়ঙ্কর দর্শন নয়। নেই খাড়া ঝুঁটিও। দেখা মেলে যত্রতত্র। গ্রাম-গঞ্জের পাশাপাশি শহরেও নজরে পড়ে। নজরে পড়ে রাজধানীতেও। বিচরণ করে খোলামেলা বনবনানী কিংবা লোকালয়ের গাছগাছালিতে। এমনকি কোলাহলপূর্ণ রাস্তার পাশে গাছেও লাফাতে দেখা যায়। এরা সুযোগ পেলেই গাছের গায়ে কুঠারের মতো শক্ত চঞ্চু চালিয়ে ওদের অবস্থান জানান দেয়। খাদ্যের সন্ধান ব্যতিরেকেও স্বভাবসুলভ আচরণগত কারণে গাছের গায়ে কুঠার চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। শিকারের সন্ধান পেলে জোরে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ‘পিক…পিক…’ সুরে। বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। অনেক সময় পরিবারের সবাই মিলে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়। প্রজাতির অন্যদের মতোই এরাও গাছের কাণ্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে খাড়া হাঁটে। পারতপক্ষে মাটি স্পর্শ করে না। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি ঘাড় দুলিয়ে স্ত্রী পাখির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। দেশে এদের সংখ্যা সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘পাকড়া কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘ফালভাস-ব্রেস্টেড উডপেকার’(Fulvous-breasted woodpecker) বৈজ্ঞানিক নাম: Dendrocopos macei | এরা ‘বাতাবি কাঠঠোকরা’ এবং ‘জরদ কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ১৯ সেন্টিমিটার। ওজন ৪৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথার চাঁদি লাল। কাঁধ ফ্যাকাসে, কাঁধ ঢাকনি কালো। চোখ ও ঘাড়ের মধ্যখানে কালো ডোরা। পিঠ এবং ডানায় সাদা-কালো ডোরা। লেজের আচ্ছাদক কালো, নিন্মাংশ উজ্জ্বল লাল। গলা ফ্যাকাসে লাল-বাদামি। দেহতল ফ্যাকাসে লাল-বাদামির ওপর কালচে সরু ডোরা। চোখ বাদামি। ঠোঁটের উপরের অংশ শিঙ-বাদামি, নিচের অংশ ফ্যাকাসে স্নেট। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ স্নেট। স্ত্রী পাখির মাথার চাঁদি কালো। বাদবাকি পুরুষ পাখির মতোই। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির দেহবর্ণ ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, এ ছাড়াও পিউপা, বিছাপোকা, পিঁপড়ার ডিম এবং ফুলের মধু খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। নিজেরা গাছের কাণ্ডে গর্ত বানিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/11/2018
ছোট লেজি খাটোডানা | Lesser Shortwing | Brachypteryx leucophrys
ছোট লেজি খাটোডানা | ছবি: ইন্টারনেট মূলত পরিযায়ী পাখি। প্রাকৃতিক আবাসস্থল স্যাঁতসেঁতে লতাগুল্মের জঙ্গল এবং আর্দ্র চওড়া পাতার বনাঞ্চল। বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। আমুদে স্বভাবের। অস্থিরভাবে বিচরণ করে। লেজ ঘুরিয়ে গান গায়। কণ্ঠস্বর সুমধুর। কণ্ঠ বাঁশির সুরের মতো তীক্ষ্ণ শুনতে বেশ লাগে। থেমে থেমে শিস কেটে জোড়ের পাখিটাকে প্রেম নিবেদন করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও আইইউসিএন ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট লেজি খাটোডানা’, ইংরেজি নাম: ‘লেসার শর্টউইং’ (Lesser Shortwing), বৈজ্ঞানিক নাম: Brachypteryx leucophrys | এরা ‘খুদে খাটোডানা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১১-১৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রঙে তফাৎ রয়েছে। তবে আকার আকৃতিতে তেমন তফাৎ নেই। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড় ও পিঠ জলপাই রঙের সঙ্গে হালকা বাদামীর মিশ্রণ। ডানা ও লেজ গাঢ় বাদামীর হলেও জলপাই আভা বের হয়। দেহতল জলপাই সবজেটে। চোখ বাদামী। ঠোঁট ও পা জলপাই কালচে। স্ত্রী পাখির মাথা, ঘাড় ও পিঠ বাদামী। ডানা ও লেজ বাদামীর সঙ্গে কালচে। দেহতল বাদামীর সঙ্গে সাদা ছোপ। চোখের ওপর সাদা টান যা পুরুষ পাখির নেই। উভয়ের লেজ খাটো। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। গম্বুজ আকৃতির বাসা বাঁধে সরু লতা, তন্তু দিয়ে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। বাদবাকি তথ্যাদি জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/12/2017
জল মুরগি | Common moorhen | Gallinula chloropus
জল মুরগি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির জলচর পাখি এরা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে বাস করে। শীত মৌসুমে আবার পরিযায়ী হয়েও অনেকে চলে আসে আমাদের দেশে। স্থানীয় প্রজাতির সাক্ষাৎ মেলে শীতেই বেশি। মৌসুমের অন্য সময়েও দেখা মেলে তবে তুলনায় একেবারেই নগণ্য। যত্রতত্র দেখা যাওয়ার নজির খুব বেশি নেই। সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হাওরাঞ্চলে। দেখতে অনেকটাই ডাহুকের মতো। ঠোঁটের গোড়ার লাল বর্ণটা বাদ দিলে ডাহুক মনে হবে যে কারো কাছেই। সম্প্রতি দেখেছি পাখিটাকে বিক্রমপুরে অবস্থিত রাজা বল্লাল সেনের দীঘির পাশের বিলটাতে। এক বন্ধু জানিয়েছেন, ওখানে নাকি একজোড়া পাখি দেখেছেন তিনি। সংবাদটা শুনে লোভ সামলাতে পারিনি, ছুটে গিয়েছি সেখানে। বিল পাড়ে গিয়েছি বিকেলের কিছু আগে। ভাগ্যটা ভালো ছিল আমাদের, খুব বেশি সময় লাগেনি ওদের সাক্ষাৎ পেতে। প্রথমে একটি পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি, জলদামের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে সে। আমার সঙ্গী ওদিকে ফিরে ক্যামেরা তাক করার আগেই জোড়ের অন্য পাখিটি ধইঞ্চা ক্ষেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে যুগলবন্দি হতে সহায়তা করেছে। এদের বাংলা নাম : ‘জল মুরগি’, ইংরেজি নাম : ‘কমন মুরহেন’ (Common moorhen), বৈজ্ঞানিক নাম : ‘গ্যাললিন্যুলা ক্লোরোপাস’ (Gallinula chloropus), গোত্রের নাম : ‘রাললিদি’। এ পাখি পান পায়রা বা ডাকাব পায়রা নামেও পরিচিত। এ পাখি লম্বায় ৩০-৩৮ সেন্টিমিটার। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল, অগ্রভাগ হলদেটে। মাথা, গলা কালো। পিঠ, ডানা পিঙ্গল। ডানা বুজানো অবস্থায় সাদা ডোরা দেখা যায়। লেজের ওপর কালচে, নিচের দিক সাদার ওপর কালো ছোপ। চোখের তারা লালচে। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ-হলুদ, হাঁটুর ওপর লালবলয়। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: ব্যাঙাচি, ছোট মাছ, ঘাস বীজ, কীট পতঙ্গ ইত্যাদি। আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবার এদের পছন্দ। বলা যায় সর্বভূক পাখি এরা। প্রজনন সময় মে থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে ঘাস বনের ভেতর অথবা জলের ওপর নুয়েপড়া গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো চিকন ডালপালা ও শুকনো ঘাস লতা। ডিম পাড়ে ৪-৭টি। ডিম ফুটে ১৮-২২ দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/06/2013
কলজেবুটি কাঠকুড়ালি | Heart spotted woodpecker | Hemicircus canente
কলজেবুটি কাঠকুড়ালি | ছবি: ইন্টারনেট অনিয়মিত ও বিরলতম পরিযায়ী পাখি। কচ্ছপ আকৃতির গোলাকার গড়ন। দেখতে মন্দ নয়। শরীরে সাদা-কালো আঁকিবুকি। পরখ করে দেখলে বোঝা যায় ডানার প্রান্তে কালো রঙের হৃৎপিণ্ড আকৃতির দাগ। যা থেকেই এদের নামকরণের সূত্রপাত। স্বভাবে চঞ্চল। অন্যসব প্রজাতির কাঠঠোকরাদের মতো যত্রতত্র দেখা যায় না। দেখা মেলে চিরসবুজ ও আর্দ্র পাতাঝরা বনে। দেখা মেলে বাঁশবনেও। বিচরণ করে একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। গাছের কাণ্ডের চারপাশে লাফিয়ে ঘুরে ঘুরে শিকার খোঁজে। এ সময় শক্ত-মজবুত ঠোঁট চালিয়ে গাছের বাকলের ভিতর থেকে কীটপতঙ্গ বের করে আনে। শিকার পেলে তীক্ষ কণ্ঠে ‘ক্লিক-ক্লিক’ সুরে ডেকে ওঠে। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে গাছের ডালের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ‘টুই-টুই-টিটিটিটিটি…’ সুরে ডাকতে থাকে। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের গহিন বনাঞ্চলে দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোচীন পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণিতে রয়েছে। এরা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। অন্যসব কাঠঠোকরার মতোই এদের শক্রসংখ্যা নগণ্য। তথাপিও এদের সংখ্যা অপ্রতুল। প্রধান কারণটি হচ্ছে অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। পাখির বাংলা নাম: ‘কলজেবুটি কাঠকুড়ালি’, ইংরেজি নাম: ‘হার্ট-স্পটেড উডপেকার’(Heart-spotted woodpecker) বৈজ্ঞানিক নাম: Hemicircus canente | এরা ‘হৃৎপিণ্ড- ফোঁটাযুক্ত কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ১৫-১৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৬ গ্রাম। পুরুষ পাখির কপাল কালো, স্ত্রী পাখির কপাল সাদা। এ ছাড়া উভয়েরই ঝুঁটি পেছনের দিকে খাড়া। ঘাড় কালো, দুই পাশ পীতাভ সাদা। শরীরের ওপরের অংশ কালোর ওপর সাদা। ডানার সাদা বাজু অংশে কালো রঙের ছোট হৃৎপিণ্ড আকারের ফোঁটা। খাটো লেজটি কালো বর্ণের। দেহতল কালচে-জলপাই। ঠোঁট শিঙ-বাদামি। চোখ জলপাই বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা অনেকটাই স্ত্রী পাখির মতো দেখতে। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, উইপোকা ও পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত। বাসা বাঁধে গাছের মরা কাণ্ডে গর্ত বানিয়ে। নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে নেয়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকন্ঠ 09/11/2018
সাদা হাঁস | Smew | Mergellus albellus
সাদা হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশে অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। বলা যায় বিরলতম প্রজাতি। দেশে খুব একটা দেখা যায় না। সর্বপ্রথম ২০০৩ সালে প্রজাতিটি বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। মূলত রাশিয়া ও তৎসংলগ্ন তুন্দ্রা অঞ্চলের বাসিন্দা ‘সাদা হাঁস’। এ ছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, চীন ও জাপানে বৈশ্বিক বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। সমগ্র বিশ্বে ১৯ লাখ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী এদের বিস্তৃতি থাকলেও প্রজাতির সংখ্যা তেমন সন্তোষজনক নয়। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। প্রজাতিটি অন্য সব জলচর পাখিদের মতোই জলাশয়ে বিচরণ করে। তবে বড় ধরনের জলাভূমি এদের বেশি পছন্দ। বিচরণ করে ছোট দলে। দিবাচর পাখি এরা। খাবার খোঁজে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। ডুবিয়ে জলের তলা স্পর্শ করে শিকার ধরে। উড়তে পারে দ্রুত। প্রায় শব্দহীনভাবে ওড়ে। প্রজননকালীন সময়ে পুরুষ পাখি উড়তে পারে না। এ সময় ওদের নতুন পালক গজায়। হাঁকডাক খুব একটা দেয় না। মাঝেমধ্যে ব্যাঙের মতো নিচু স্বরে শিস কাটে। স্বভাবে শান্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদা হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘স্মিউ’ (Smew), বৈজ্ঞানিক নাম: Mergellus albellus| লম্বায় ৩৮-৪৬ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ৬৮০ গ্রাম। বর্গাকার মাথায় সাদা ঝুলানো ঝুঁটি। ঘাড় কালো। ডানা ও বুকের পাশটা কালচে। এ ছাড়া সমস্ত দেহ ধবধবে সাদা। ঠোঁট আকারে খাটো, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। উভয়ের লেজ চুঁচালো। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী-পুরুষ পাখির তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। এ সময় পুরুষ পাখির ঠোঁটের গোড়া ও চোখের পাশ কালো রঙ ধারণ করে। বুকের পাশ এবং লেজ ধূসর দেখায়। চোখ লালচে এবং পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে দেখায়। স্ত্রী পাখির মাথায় লালচে-বাদামি টুপি এবং ঘাড় ও ঝুঁটি ধূসর বাদামি দেখায়। পা ও পায়ের পাতা সবুজ। প্রজননের বাইরে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। প্রধান খাবার: ছোট চিংড়ি, শামুক, কেঁচো, ব্যাঙ ও জলজকীট। মাছ তেমন একটা খায় না। তবে শীত ও বসন্তের শুরুতে মাছ শিকার করে। প্রজনন সময় এপ্রিল-মে। সাইবেরিয়া অঞ্চলের গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৭-৯টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/05/2014
পাতি সারস | Common Crane | Grus grus
পাতি সারস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা ছোট-বড় দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। নাচের কসরৎ দেখতে দেখতে স্ত্রী পাখি তখন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও নাচে অংশ নিয়ে প্রেমে মজে যায়। এ সময় জোরে জোরে দ্বৈত সংগীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে দেশি সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি সারস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন ক্রেন’ (Common Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Grus grus | দেশে তিন প্রজাতির সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। এরা সবাই পরিযায়ী প্রজাতির। গড় দৈর্ঘ্য ১১৫ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৮০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ৫.১-৬.১ কেজি। স্ত্রী পাখি ৪.৫-৫.৯ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। কপাল কালো। মাথার তালুর রক্ত লাল। মাথার পেছন থেকে শুরু করে ঘাড়, থুতনি ও গলা কালো। চোখের পেছন থেকে ঘাড় ও গলার কালো দ্বিখণ্ডিত হয়ে সাদায় রূপ নিয়েছে। পিঠ গাঢ় ধূসর। ডানার পালকের ওপর কালো ছোপ। ওড়ার পালক কালো। লেজ কালো। ডানার বাড়তি পালক লেজের ওপর ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। চোখের তারা লাল। পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, কাঁকড়া কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩১ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/10/2015
কালি ময়ূর | Kalij pheasant | Lophura leucomelanos
কালি ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট প্রায় সাড়ে তিন যুগ আগেও আমাদের দেশের গহিন জঙ্গলগুলোতে এ পাখির প্রচুর বিস্তৃতি ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল এরা। আমাদের দেশের পাখি বিশারদরা জানিয়েছেন, কয়েক যুগ আগেও মধুপুরের শালবনে পাওয়া যেত এই পাখি। এখন আর নজরেই পড়ে না। শিকারিদের দৌরাত্বে পাখিটি শালবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে কালেভদ্রে নজরে পড়ে। আমি বছর দশেক আগে প্রথম এ পাখিটি দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। মাত্র দুটি পাখি দেখেছি সেদিন। মোরগাকৃতির এ পাখি দুটিকে দেখে সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। স্থানীয় লোকজনের কাছে পাখিটার নাম জানতে চেয়েছি। তারা জানিয়েছেন এগুলোর নাম ‘কালা মুরকা।’ এ-ও জানিয়েছেন তারা জঙ্গলের আশপাশে এ পাখি শিকার করতে ওঁৎ পেতে থাকেন। এগুলো খুব ভোরে ও সূর্যাস্তের সামান্য আগে জঙ্গল থেকে ফাঁকা স্থানে বেরিয়ে আসে। সে সুযোগে শিকারিরা এগুলোকে শিকার করে। এই পাখির মাংস পাহাড়িদের কাছে বেশ প্রিয়। বাংলায় এই পাখির কোনো নাম নেই। আমাদের দেশের পাখি গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালি ময়ূর।’ নামটি বেশ মানানসই বলা যায়। ইংরেজি নাম: ‘কালিজ ফেজেন্ট’, (Kalij pheasant) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লোফুরা লিউকোমেলানোস’, (Lophura leucomelanos) গোত্র: ‘ফাজিয়ানিদি’। কালি ময়ূর স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে যা পাখি বিশারদের নজর এড়াতে পারবে না। তবে সাধারণের চোখে পার্থক্যটা সহজে ধরা পড়বে না। পার্থক্যটা হচ্ছে, পুরুষ পাখি লম্বায় ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫০-৬০ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির শরীরের ওপরের দিকটার পালক চকচকে কালোর সঙ্গে ধাতব মিশ্রণ। নিুাংশ সাদাটে। চোখের চারপাশটা ও লতিকা টকটকে লাল। স্ত্রী কালি ময়ূর দেখতে হালকা বাদামি তবে কোনো কোনো অংশে গাঢ় বাদামি। ঝুঁটি বাদামি রংয়ের এবং লেজটা কাস্তের মতো বাঁকানো। দেখতে বেশ চমৎকার। কালি ময়ূরদের কণ্ঠস্বর বিশ্রী। উচ্চৈঃস্বরে ডাকলে ‘চিরপ..চিরপ’ শব্দ শোনা যায়। আর স্বাভাবিক স্বরে ডাকলে ‘কুরচি…কুরচি’ শব্দ করে। দেখতে হিংস্র মনে হলেও আসলে এরা খুবই ভীরু প্রকৃতির পাখি। কালি ময়ূরের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শস্যদানা, শস্যের কচি ডগা, কীটপতঙ্গ, ছোট সরীসৃপ ইত্যাদি। এরা বন মোরগের মতো মাটি আঁচড়ে পোকামাকড় খোঁজে। এদের প্রজননের সময় মার্চ থেকে অক্টোবর। মাটির ওপরে ঘাস কিংবা শুকনো লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/09/2012