ঝুঁটি হাঁস | Tufted Duck | Aythya fuligula
ঝুঁটি হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি ‘ঝুঁটি হাঁস’। শীতে সাইবেরিয়া ও উত্তর ইউরোপ থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। আশ্রয় নেয় হাওর-বাঁওড় কিংবা বড়সড়ো জলাশয়ে। তবে যে সব জলাশয়ের গভীরতা ৩-৫ মিটারের কম, কিন্তু ১৫ মিটারের বেশি, সে সব জলাশয়ে সাধারণত এরা বিচরণ করে না। ঝুঁটি হাঁস বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। নিজ প্রজাতির বাইরের হাঁসদের সঙ্গেও দলবেঁধে শিকারে বের হয়। আবার পানকৌড়ি পাখিদের সঙ্গেও এদের সখ্য রয়েছে। এরা শিকার খুঁজে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। একেবারে জলতলে গিয়ে জলজ লতাপাতা থেকে শিকার বের করে আনে। শিকাররত অবস্থায় ‘হু-ওওও..’ সুরে ডাকে। আবার ওড়ার সময় কণ্ঠস্বর পাল্টিয়ে ‘গেরর..গেরর’ সুরে ডাকতে শোনা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং ইউরোপ-আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা স্থিতিশীল বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে আশঙ্কাহীন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও এরা শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হয় ব্যাপক। পাখির বাংলা নাম: ‘ঝুঁটি হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘টাফটেড ডাক’ (Tufted Duck), বৈজ্ঞানিক নাম: Aythya fuligula পরিযায়ী। এরা ‘টিকি হাঁস’ অথবা ‘কালো হাঁস’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪৩-৪৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৭০০-১০০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা পার্থক্য রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রঙ বদলায়। এ সময় ওদের মাথায় কালো ঝুলন্ত ঝুঁটি দেখা যায়, তা ছাড়া মাথায় স্পষ্ট সাদা ফোঁটা এবং ঘাড় কালো দেখায়। এ ছাড়াও পিঠ, ডানার নিচ, লেজ ও বুকের পালক কুচকুচে কালো রঙ ধারণ করে। কালো রঙ ধারণ করে ঠোঁটের অগ্রভাগও। এমনকি পা ও পায়ের পাতা কালচে হয়ে ওঠে। প্রজননের বাইরে পুরুষ পাখির মাথা, বুক বাদামি-কালো। ডানার নিচের দিকটা ধূসরাভ, থুতনি ও গলা সাদা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা কালচে-বাদামি। পিঠ গাঢ় বাদামি। কপাল ও ঠোঁট সাদাটে। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ছোট ব্যাঙ, শামুক, কেঁচো ও জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা ও বীজ খায়। প্রজনন মৌসুম মে মাস। এ সময় উত্তর ইউরোপ থেকে সাইবেরিয়ার নির্জন দ্বীপসমূহে অথবা নদ-নদীর তীরে শুকনো লতাপাতা জড়ো করে বাসা বাঁধে। এ ছাড়াও ভাসমান উদ্ভিদের ওপরেও বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/08/2014
লালতলা প্রিনা | Rufous vented Prinia | Prinia burnesii
লালতলা প্রিনা | ছবি: ইন্টারনেট ‘মেটেবুক প্রিনা’ নিয়ে গত সংখ্যায় লিখেছি। আজ ওদের জ্ঞাতি ভাই ‘লালতলা প্রিনা’ নিয়ে লিখছি। উভয়ই স্থানীয় প্রজাতির পাখি। স্লিম গড়ন। মায়াবী চেহারার। তবে লালতলা প্রিনা আকারে খানিকটা বড়। স্বভাবে চঞ্চল। কণ্ঠস্বর তত সুমধুর নয়। বাদবাকি আচরণ মেটেবুক প্রিনার মতো। তবে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যতীত ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। পাখির বাংলা নাম: ‘লালতলা প্রিনা’, ইংরেজি নাম: ‘রুফাস ভেন্টেড প্রিনিয়া’ (Rufous-vented Prinia), বৈজ্ঞানিক নাম: Prinia burnesii | এরা ‘জলাভূমির লেজ-তোলা টুনি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১৯ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন হলেও পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখি গাঢ় বাদামী রঙের। স্ত্রী পাখি হালকা বাদামি। উভয়ের লেজ লম্বা, কালচে বাদামি। লেজতল লালচে। দেহতল বাদামি-সাদা। ঠোঁট খাটো, জলপাই কালচে। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা হলুদাভ ত্বক বর্ণের। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম আগস্ট-সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ভূমি থেকে এক-দেড় মিটার উঁচুতে গাছেরপাতা পেঁচিয়ে কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১০-১১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/12/2017
হলদে পা নাটাবটের | Yellow Legged Buttonquail | Turnix tanki
হলদে পা নাটাবটের | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির আবাসিক পাখি। উনিশ শতকের দিকে চট্টগ্রাম বিভাগে দেখা গেছে। সম্প্রতি ঢাকা ও সিলেট বিভাগে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড ও কোরিয়া পর্যন্ত। হলদে পা নাটাবটের বিশ্বে বিপন্মুক্ত বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। দেশের বন্যপ্রাণী আইনে এদের সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। প্রজাতিটি স্বভাবে হিংসুটে নয়। স্বগোত্রীয়দের আগমনে বিরক্ত হয় না। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় তৃণভূমিতে বিচরণ করে। খুব সাবধানে হেঁটে বেড়ায়। প্রজননকালীন সময়ে হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় জোরে জোরে ডাকে ‘হু-ওন… হু-ওন…’ সুরে। প্রজাতিটি দেশের সর্বত্র যত্রতত্র দেখা না গেলেও খুলনা, বাগেরহাট, ফকিরহাট, যশোর, কুষ্টিয়ার আখমহালে দেখা মেলে। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে পা নাটাবটের’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়োলো লেগড বাটন কোয়েল’ (Yellow-legged Buttonquail), বৈজ্ঞানিক নাম: Turnix tanki | বাংলাদেশে তিন প্রজাতির নাটাবটের সাক্ষাৎ মেলে। যেমন দাগি নাটাবটের, হলদে পা নাটাবটের, ছোট নাটাবটের। লম্বায় ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৪০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রং ভিন্ন। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রং বদলায়। এ সময় মাথার তালু পীতাভ ডোরাসহ কালচে দেখায়। পিঠ বাদামি-ধূসর। ডানার কোভার্ট পীতাভ। পিঠ, বুকের পাশ ও বগলে কালো চিতি। থুঁতনি ও গলা সাদাটে। অপরদিকে স্ত্রী পাখির ঘাড় লালচে। গলা ও ঘাড়ের পাশ এবং বুক লাল-কমলা। অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী পাখির মাথার তালুতে পীতাভ ডোরা থাকে। তা ছাড়া ঘাড় থাকে লাল-ধূসর। লেজের গোড়ার দিকের পালক ধূসরাভ। উভয়ের চোখ সাদা। ঠোঁট, পা ও পায়ের পাতা হলুদ। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, পিঁপড়া ও পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে নভেম্বর। ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর মাটির ওপর ঘাস-লতা দিয়ে গম্বুজ আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/02/2015
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
জিরিয়া | Kentish plover | Charadrius alexandrinus
জিরিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অতি সুলভ দর্শন, পান্থ পরিযায়ী পাখি (চলার পথের প্রজাতি)। শীত আগমনের পূর্বেই পরিযায়ী হয়ে আসে উত্তর ও মধ্য এশিয়া থেকে। মূলত এরা সৈকতচারী পাখি। ঠিক অক্টোবরের দিকে আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নেয় উপকূলীয় এলাকার বনাঞ্চলের জলাশয়ের কাছাকাছি কিংবা মোহনা ও দ্বীপাঞ্চলের বালুকারাশিতে। বিচরণ করে পাহাড়ি এলাকার ঝর্ণার ধারেও। অনেক সময় উপকূলীয় এলাকার লোকালয়ের হালচাষ করা জমিতেও বিচরণ করতে দেখা যায়। এরা ছোট-বড় কিংবা মিশ্র দলে শিকারে বের হয়। দলে অনেক সময় হাজারখানেক পাখিও দেখা যায়। সারাদিন বালুকারাশি বা বালুকাদাময় এলাকায় পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। খাদ্যের সন্ধানে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করতে দেখা যায়। চলার পথে মাঝে মাঝে ‘টুউ-ইট টুউ-ইট ইট্টাপ ইট্টাপ’ সুরে ডাকে। সুর তেমন শ্রুতিমধুর নয়। ডানা লম্বা এবং ছুঁচাল বিধায় উড়তে পারে বেশ দ্রুত। দৌড়াতেও পারে দ্রুতগতিতে। বেশ মিশুক পাখি। সৈকতচারী অন্য সব প্রজাতি পাখির সঙ্গে মিলেমিশে কাটিয়ে দেয়। বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশেও ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘জিরিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘কেন্টিশ প্লোভার’, (Kentish plover), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘চারাড্রিয়াস আলেকজান্ড্রিনাস’ (Charadrius alexandrinus)। এরা ‘ভাঙ্গা অঙ্গুরী বাটান’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। শীতে রং বদলায়। মাথা লালচে বাদামি। ভ্রু সাদা। ঘাড়ে সাদা বন্ধনী। বন্ধনীটা অনেক সময় অপূর্ণ দেখায়। পিঠ ও ডানা ধূসরাভ-বাদামি। ওড়ার পালক ধোঁয়াটে। বুকের পাশ কেটে বাদামি ছোপ ডানার সঙ্গে মিশেছে। যা প্রজনন মৌসুমে কালো দেখায়। বুক থেকে লেজের তলদেশ পর্যন্ত সাদা। ঠোঁট শক্তপোক্ত কালো। ডাগর ডাগর চোখ কালো রঙের। লম্বা, কালচে পা জলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে উপযোগী। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: শুককীট, ছোট কাঁকড়া ও অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। উত্তর ও মধ্য-এশিয়ার নিজস্ব বাসভূমিতে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটিতে সামান্য খোদল করে অথবা সমতল ভূমিতে বাসা বাঁধে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সরাসরি মাটিতে ডিম পাড়তে। উল্লেখ্য, পাখি পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন তারা নাকি উপমহাদেশের সিন্ধু, বেলুচিস্তান, শ্রীলঙ্কা, গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে এদের বাসা বাঁধতে দেখেছেন। এরা ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটাতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/04/2014
খাটো আঙ্গুল সাপঈগল | Short toed Snake Eagle | Circaetus gallicus
খাটো আঙ্গুল সাপঈগল | ছবি: ইন্টারনেট উপমহাদেশী অঞ্চলে শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি রাশিয়া, পূর্ব ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ, ইরান, মঙ্গোলিয়া, চীন, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল। মরু কিংবা পার্বত্য এলাকায় বিচরণ আধিক্য। খোলা মাঠপ্রান্তর, জলাভূমির আশপাশেও দেখা মেলে। সাপ ও সরীসৃপ আছে এমন এলাকায় বেশি পরিলক্ষিত হয়। হিংস প্রজাতির পাখি। দৃষ্টিশক্তি প্রখর। প্রায় ৫০০ মিটার উঁচু থেকেও শিকার নজরে পড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। পাখির বাংলা নাম: ‘খাটো আঙ্গুল সাপঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘শর্ট-টোড সেক ঈগল’ (Short-toed Snake Eagle) বৈজ্ঞানিক নাম: Circaetus gallicus | এরা ‘মাথাভারি ঈগল’ নামে পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৬২-৭০ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ১৬৬-১৮৮ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ১.২-২ কেজি। স্ত্রী পাখি ১.৩-২.৩ কেজি। মাথা, ঘাড় ও গলা সাদার ওপর বাদামি দাগ। পিঠ বাদামি, মাঝে মধ্যে সাদা টান। ডানার প্রান্ত পালক গাঢ় বাদামি। লেজ কালচে বাদামি। বুক ও পেট সাদা। চোখ কমলা-হলুদ। ঠোঁট শিং কালো শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। পা ফ্যাকাসে হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। যুবাদের রঙ ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট-বড় সাপ ও সরীসৃপ। এ ছাড়াও ব্যাঙ, ছোট পাখি, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদিও শিকার করে। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর। স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। ডালপালা দিয়ে বড়সড়ো অগোছালো বাসা বানায়। এক বসায় বহু বছর যাবৎ ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ১টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৪৫-৪৭ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৭০-৮০ দিন। প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৩-৪ বছর। গড় আয়ু ১৭ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/06/2017
লাল লতিকা হট্টিটি | Red wattled Lapwing | Vanellus indicus
লাল লতিকা হট্টিটি | ছবি: ইবার্ড যেখানে বড়সড়ো জলাশয় রয়েছে, সেখানে কম-বেশি ওদের বিচরণও রয়েছে। পানিতে সম্পূর্ণ শরীরটা ডুবিয়ে শিকার খোঁজে না। বড় জোর হাঁটুসমান পানিতে নেমে শিকার খোঁজে। ফাঁকা মাঠেও দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা জ্যোসনা রাতেও খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। একা কিংবা দলবদ্ধভাবেও বিচরণ করে। দেশের সর্বত্রই এ পাখিটাকে কমবেশি দেখা যায়। আমি প্রথম দেখেছি হাসাইলে। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় পড়েছে। গিয়েছি বছর চারেক আগে। নদীভাঙন দেখতে। পদ্মার পেটে ততক্ষণে হাসাইল বাজারটা হজম পক্রিয়ার পথে রয়েছে। হাসাইলবাসীর দুঃসময়ে পদ্মার পাড়ে পাখিটিকে দেখেছি সেদিন। একটি নয় ওরা সংখ্যায় একাধিক ছিল। দেখতে সুবিধাও হয়েছে তাই। কারণ পাখিরা একাকী থাকার চেয়ে দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় বেশি সাহসী হয়। এতে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও পাওয়া যায় বেশি। পাখিটা দেখতে ভারি চমৎকার। কিন্তু কণ্ঠস্বর কর্কশ। দলের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা না হলে কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হট্টিটি..টি..টি..হট্টিট-টিট্’। স্ত্রী-পুরুষের কণ্ঠে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ কণ্ঠ একটু ভারী। কণ্ঠস্বর শুনেও স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য বোঝা যায়। পাখিটার বাংলা নাম: ‘লাল লতিকা হট্টিটি,’ ইংরেজি নাম: ‘রেড ওয়াটলড ল্যাপউইং’, (Red-wattled Lapwing) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ভ্যানেল্লাস ইন্ডিকাস’ (Vanellus indicus) গোত্রের নাম: ‘চারাড্রিআইদি’। আমাদের দেশে মোট দু’ধরনের হট্টিটি দেখা যায়। যথাক্রমে: ১. লাল লতিকা হট্টিটি, ২. হলুদ লতিকা হট্টিটি। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা। লতিকা চোখের দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গোল বৃত্তের রূপ নিয়েছে। সেটি দেখলে মনে হয় বুঝি ওরা চশমা পরে আছে। হট্টিটির গলা, বুক, মাথার তালু ও ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত লাল। চোখের পাশ থেকে ধবধবে সাদা টান ঘাড় হয়ে বুকের কিছু অংশসহ পেট ও লেজের তলা পর্যন্ত ঠেকেছে। ডানা বোজানো অবস্থায় পিঠ ও লেজের উপরি ভাগটা চকচকে বাদামির ওপর জলপাই রঙের আভা। পা বেশ লম্বা, বর্ণ হলুদ। হট্টিটি খুবই চতুর পাখি। চলাফেরায় থাকে অত্যন্ত হুঁশিয়ারি ভাব। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে বিপদ সংকেত, খুশির সংকেত, ডিমপাড়া ও বাচ্চা ফোটার সংকেত, বাচ্চা হারানোর সংকেত, বিপদ মুক্তির সংকেত। এ সুরগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কণ্ঠে তুলতে পারে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ পোকামাকড়, কেঁচো, কচি শাকসবজি ইত্যাদি । প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। মিলন শেষে মাটির অগভীর গর্তে অথবা মাঠ-প্রান্তরের নিরিবিলি স্থানে বাসা বাঁধে। বাসা দেখতে হাস্যকর। মাটির ঢেলা দিয়ে তৈরি করে। চারপাশে ছোট ছোট মাটির ঢেলা সাজিয়ে থালাকৃতির বাসা বানিয়ে মাঝখানে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। হট্টিটির বাচ্চাদের জলপান বেশ মজাদার। মা পাখিটা জলে ভেজে বাচ্চাদের কাছে এলে ওরা মায়ের ভেজা লোম চুষে জলপান করে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/09/2012