সোনাবউ | Eurasian Golden Oriole | Oriolus oriolus
সোনাবউ | ছবি: ইন্টারনেট স্লিম গড়নের অতি সুদর্শন পাখি ‘সোনাবউ’। দেখেছি দুবার মাত্র। সাক্ষাৎ ঘটেছে রায়পুর উপজেলার পূর্ব চরপাতা ও শায়েস্তানগর গ্রামে। সময় নিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি তখন। চোখের পলকেই হারিয়ে গেছে প্রতিবার। সে দেখাতে তৃপ্তি পাইনি বলা যায়। ফলে উদগ্রীব হয়ে আছি তৃতীয় দর্শনের। ফের দেখা হলে সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ইচ্ছা রয়েছে। এদের জ্ঞাতিভাই হচ্ছে কালোমাথা বেনেবউ বা ইষ্টিকুটুম পাখি। অনেকে এদের দেখলেও সহজে চিনতে পারে না। কালোমাথা বেনেবউ বলে ভুল করে বসেন। ওরা দেশের আনাচেকানাচে যথেষ্ট নজরে পড়লেও সোনাবউ বা সোনালি বেনেবউদের ক্ষেত্রে তা বিরল দর্শন। দেশে খুব বেশি দেখার নজির নেই। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে রাজশাহী অঞ্চলে প্রথম দেখার নমুনা রেকর্ড করা হয়। মূলত গ্রীষ্মকালে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচরণ করে এরা। শীতে এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে কাটিয়ে দেয়। আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে হিমালয় অঞ্চল থেকে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অল্প কিছু স্থানে নজরে পড়ে তখন। স্বভাবে লাজুক ও শান্ত। থাকে বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি আড়ালে আবডালে গিয়ে প্রেয়সীকে মুগ্ধ করতে গান বাঁধে। মিষ্টিকণ্ঠে নিচু স্বরে গান গায় ‘পিউলোলো… উইলো…’। শুনতে খুবই চমৎকার সেই সুর। খিদে পেলে ওদের বাচ্চারাও মিষ্টি সুরে কাঁদে। সেই সুর বড়ই করুণ লাগে। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘সোনাবউ’ বা ‘সোনালি বেনেবউ’, ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান গোল্ডেন ওরিওল’ (Eurasian Golden Oriole), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ওরিওলাস ওরিওলাস’ (Oriolus oriolus)| এরা ‘হলুদিয়া পাখি’ নামেও পরিচিত। দেশের পাখিবিশারদদের কেউ কেউ ‘ইউরেশীয় সোনাবউ’ নামকরণ করেছেন এদের। এরা লম্বায় ২৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির দেহের অধিকাংশ পালকই উজ্জ্বল হলুদ। কেবল ডানা ও লেজের উপরি ভাগের পালক কালো। কালো ডানায় রয়েছে হলুদ পট্টি। ঠোঁটের গোড়া থেকে শুরু করে চোখের ওপর দিয়ে গেছে কালো টান। ঠোঁট সোজা, গোলাপি-লাল। স্ত্রী পাখির বর্ণ একটু ভিন্ন। দেহের ওপরের দিকের পালক সবুজাভ হলদে। পেটের দিকে রয়েছে ফিকে হলুদ-বাদামির প্রচ্ছন্ন খাড়া রেখা। ঠোঁট সোজা, টকটকে লাল। পায়ের রঙ সিসে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পিঠের দিক জলপাই-হলুদ। গলা ও বুক সাদাটে। ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে ফিকে হলুদের ওপর কালো খাড়া রেখা। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ফুলের মধু ও ছোট ফল। প্রজনন সময় মার্চ থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত। গাছের উঁচু ডালে খড়কুটা দিয়ে দোলনা আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩ থেকে ১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/07/2018
পাতি সারস | Common Crane | Grus grus
পাতি সারস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা ছোট-বড় দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। নাচের কসরৎ দেখতে দেখতে স্ত্রী পাখি তখন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও নাচে অংশ নিয়ে প্রেমে মজে যায়। এ সময় জোরে জোরে দ্বৈত সংগীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে দেশি সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি সারস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন ক্রেন’ (Common Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Grus grus | দেশে তিন প্রজাতির সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। এরা সবাই পরিযায়ী প্রজাতির। গড় দৈর্ঘ্য ১১৫ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৮০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ৫.১-৬.১ কেজি। স্ত্রী পাখি ৪.৫-৫.৯ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। কপাল কালো। মাথার তালুর রক্ত লাল। মাথার পেছন থেকে শুরু করে ঘাড়, থুতনি ও গলা কালো। চোখের পেছন থেকে ঘাড় ও গলার কালো দ্বিখণ্ডিত হয়ে সাদায় রূপ নিয়েছে। পিঠ গাঢ় ধূসর। ডানার পালকের ওপর কালো ছোপ। ওড়ার পালক কালো। লেজ কালো। ডানার বাড়তি পালক লেজের ওপর ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। চোখের তারা লাল। পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, কাঁকড়া কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩১ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/10/2015
চুনিমুখি মৌটুসি | Ruby cheeked Sunbird | Anthreptes singalensis
চুনিমুখি মৌটুসি | ছবি: ইন্টারনেট আকাশ প্রদীপ নিবুনিবু করছে। প্রাণীকুল যে যার ডেরায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিন-রাতের সন্ধিক্ষণে আকাশ কেঁপে উঠল হঠাৎ করে। নিশ্চয়ই দূরে কোথাও বজ্রপাত হয়েছে। খানিকটা ভড়কে গিয়েছি। কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবে একটু বাদেই। যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদে ফেরা চাই। কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠেনি, তার আগেই ঝড়ো হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না দেখে নিজ গাঁয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছি। আমার সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে ‘চুনিমুখি মৌটুসি’ও। জানালার কার্নিশে বসেছে পাখিটা। কাঁপছে থরথর করে। হাত বাড়িয়ে পাখিটাকে ধরলাম। উড়তে পারছে না বেচারি। ডানায় সুতা জাতীয় তন্তু পেঁচানো। ধীরে ধীরে প্যাঁচ খুলে দিতেই পাখিটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। চুনিমুখি মৌটুসি অতি পরিচিত পাখি। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দেখা মেলে গাঁওগেরামের ঝোপ-জঙ্গলে। ঝোপের ভেতর থেকে উচ্চস্বরে ‘সুইটি-টি-চি-চিউ..টিউসি-টিটসুইটি-সুইটি..সুইটি-টি-চি-চিউ..’ সুরে শিস দেয়। বেশ মধুর সুর। এরা অত্যন্ত ফূর্তিবাজ পাখি। দিনের বেশিরভাগ সময় গাছের শাখা-প্রশাখায় নেচে বেড়ায়। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পর্যন্ত। এতদাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা এরা। বিশ্বে প্রজাতির সংখ্যা স্থিতিশীল। তাই আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘চুনিমুখি মৌটুসি’, ইংরেজি নাম: ‘রুবি চিকড সানবার্ড’ (Ruby-cheeked Sunbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthreptes singalensis | প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১১-১২ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির মাথার তালু, ঘাড়, পিঠ, কোমর ও লেজের উপরিভাগ ধাতব সবুজ। ডানা ও লেজ কালচে। গাল টকটকে লাল, সূর্যালোকে বেগুনি বিচ্ছুরণ বের হয়। গলা ও বুক লালচে-কমলা। পেট উজ্জ্বল হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির পিঠের বর্ণ নিষ্প্রভ জলপাই সবুজ। গলা ও বুক লালচে-কমলা। গালে লাল রঙের উপস্থিতি নেই, নেই পেটের হলুদ বর্ণও। উভয়েরই ঠোঁট কালচে, খাটো ও সোজা। পা সবুজ-ধূসর। প্রধান খাবার: ফুলের মধু ও ছোট পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। ভূমি থেকে ২ মিটার উঁচুতে গাছের ডালে অথবা লতা আচ্ছাদিত গাছের ডালে থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২টি। ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/07/2018
পাহাড়ি টুনটুনি | Mountain Tailorbird | Orthotomus cuculatus
পাহাড়ি টুনটুনি | ছবি: ইন্টারনেট পরিচিত প্রজাতির ‘টুনটুনি’ পাখির মতো যত্রতত্র এদের দেখা মেলে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনে এবং ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। পাহাড়ি চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে লতাগুল্মের ঝোঁপে এবং বাঁশবনে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এদের মায়াবী চেহারা। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। যেন একদণ্ড বসার সুযোগ নেই কোথাও। এই আছে তো এই নেই। তবে যেখানেই থাকুক না কেন এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। জোড়ের পাখিটি সামান্য দূরে থাকলেও ডাকাডাকি করে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে নেয়। সারাদিন নেচে-গেয়ে সময় কাটায়। লেজ উঁচিয়ে নাচে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি নানা কসরত দেখায় স্ত্রী পাখির মন ভোলানোর জন্য। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে। বেশ পরিপাটি বাসা। দুটি পাতাকে একত্রিত করে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বাঁধে। অনেকটা দর্জির কাপড় সেলাই করার মতো। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি টুনটুনি’, ইংরেজি নাম: মাউন্টেন টেইলরবার্ড (Mountain Tailorbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotomus cuculatus | এরা ‘সোনালি মাথা টুনি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৭ গ্রাম। কপাল লালচে। মাথা সোনালি রঙের। ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজ ও ডানা লালচে। চোখের ওপরে সাদা-হলদে টান। গলা ও বুক ধূসর। পেট ও লেজতল উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট দু’পাটি ভিন্ন রঙের। ওপরের অংশ কালো, নিচের ঠোঁট কমলা রঙের হলেও গোড়া শিঙকালো। চোখ বাদামি-কালো। পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি। স্ত্রী পাখির বর্ণে সামান্য তফাৎ রয়েছে। ওদের বুকে কালো রেখার উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড় বা কীট পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে-জুলাই সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে পাতা সেলাই করে। সেলাই করা বাসার ভেতর নরম তন্তু বা তুলা দিয়ে পরিপাটি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/04/2016
কালো পেঁচা | Brown Hawk owl | Ninox scutulata
কালো পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত ‘প্রকৃতি বার্তা’র (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়) পেঁচা নিয়ে ফিচার পাঠে জানতে পারি যে, একটি পেঁচা বছরে প্রায় ৭০০টি ইঁদুর খেতে সক্ষম। আর একটি ইঁদুর বছরে ১০ কেজি ফসল সাবাড় করতে সক্ষম। অথচ সেই উপকারী বন্ধু পেঁচাকে অলুক্ষণে বলে গালি দেই আমরা। আর ‘কালো পেঁচা’ হলে তো কথাই নেই, বেশি বেশি অলুক্ষণে বলি ওদের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরের কারণে। ওরা এক নাগাড়ে ‘কু-উক-কু-উু-কু-উক’ সুরে ডাকতে থাকলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে। মানুষের ধারণা এই বুঝি কোনো বিপদ হানা দিচ্ছে পেঁচার ডাকে। অথচ ভুল সবই ভুল! এরা আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুর্লভ দর্শনও বটে। গ্রামীণ বন-বাদাড়ের বড় গাছের পাতাল আড়ালে কিংবা বাঁশ ঝোঁপে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। সাঁঝের বেলায় বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা একাকি। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন হাক আউল’ (Brown Hawk-owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ninox scutulata| এরা ‘খয়রা শিকারে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৭-৩৩ সেন্টিমিটার। মুখ ও মাথা কালচে-বাদামি। ঘাড় লালচে-বাদামি ফোঁটা। পিঠ গাঢ় বাদামি। দেহতল লালচে-বাদামির ওপর সাদা ডোরা টান। ঠোঁট কালচে, ঠোঁটের গোড়ায় সাদা ফোঁটা। চোখের তারা হলুদ। দূর থেকে চোখের তারা নজরে পড়লে মনে হয় বুঝি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। পা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধান খাবার: ইঁদুর, সরীসৃপ, ছোট পাখি, ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে মাসখানেক। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/03/2015
ধূসরমাথা বামন কাঠঠোকরা | Grey capped Pygmy Woodpecker | Dendrocopos canicapillus
ধূসরমাথা বামন কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট দুর্লভ আবাসিক পাখি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের পাতাঝরা-চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। বিচরণ করে কমবেশি প্যারাবনেও। এক সময় গাজীপুর এবং মধুপুরের শালবনে ব্যাপক বিচরণ ছিল বলে জানা যায়। হালে দুর্লভ দর্শন হয়ে পড়েছে। অন্যসব কাঠঠোকরার মতোই এরা বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। অনেক সময় ছোট দলেও দেখা যায়। স্বভাবে চঞ্চল হলেও হিংস নয়। এরা হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। বেশিরভাগই গাছের বাকল জড়িয়ে ধরে ওঠানামা করে। খাবার খোঁজে গাছের বাকল ঠুকরিয়ে। এদের খাবার খোঁজার কৌশল দারুণ। ঠোঁট দিয়ে গাছের কাণ্ডে আঘাত করতে করতে নিচের দিকে নামতে থাকে। পোকামাকড় আছে এমনটা সন্দেহ হলে কেবল ঠোঁট দিয়ে উপুর্যপরি আঘাত করে। আবার শিকার শেষে গাছের মগডালের ফাঁপাস্থানে আঘাত করে ড্রাম বাজাতে দেখা যায়। রাতে বিশ্রাম নেয় গাছের উপরমুখী ডালের মিলনস্থলে। সকালে গাছের ডাল জড়িয়ে ধরে রোদ পোহায়। জলপান ব্যতিরেকে পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, তাইওয়ান, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও কোরিয়া পর্যন্ত। বিশ্বে এরা বিপদমুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসরমাথা বামন কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: গ্রে-ক্যাপড পিগমী উডপেকার’ (Grey-capped Pygmy Woodpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Dendrocopos canicapillus | এরা ‘মেটেটুপি বাটকুড়ালি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৪-১৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তফাৎ সামান্য। পুরুষ পাখির মাথার দু’পাশে রয়েছে লাল দাগ, স্ত্রী পাখির সেটি কালো দেখায়। ধূসরমাথা বামন কাঠঠোকরার কপাল-মাথা মলিন ধূসর। ভ্রুরেখা প্রশস্ত সাদাটে। পিঠে সাদা-কালো ডোরা। ডানা প্রশস্ত কালোর ওপর সাদা ডোরা। কোমর কালো। লেজের উপরিভাগ কালচে। থুতনি ও গলা সাদাটে। দেহতল বাদামি ডোরাসহ হালকা খয়েরি। ঠোঁটের কিছু অংশ শিঙরঙা বাদামি, কিছু অংশ ফ্যাকাসে। চোখ লালচে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার গাছ পিঁপড়া, পোকামাকড়, ফলের খোসা ও ফুলের মধু। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। গাছের খাড়া ডালে নিজেরা গর্ত করে খোড়ল বানিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/07/2015
ধূসর আবাবিল | Ashy woodswallow | Artamus fuscus
ধূসর আবাবিল | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন, স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, মালয়েশিয়া ও চীন পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি রয়েছে। দেখা মেলে দেশের সর্বত্রই। বিশেষ করে রাস্তার পাশে বিদ্যুতের তারে দল বেঁধে বসে থাকে। রাতও কাটায় দল বেঁধে। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে নেড়া বৃক্ষের ডালে বসে রাতযাপন করে। স্বভাবে সঙ্ঘচারী পাখি। শূন্যে উড়ে উড়ে পতঙ্গ শিকার করে। বৃত্তাকারে উড়তে পারদর্শী এরা। এদের শিকারের উপযুক্ত সময় ভোরবেলা এবং গোধূলীলগ্নে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সারাদিন উড়তে থাকে, আর কর্কশ কণ্ঠে ডাকাডাকি করে। সুর শ্রুতিমধুর নয়। ডাকে ‘চেক-চেক-চেক’ শব্দে। ফসলের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে যথেষ্ট উপকার করে বিধায় কৃষকের বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এরা। উপকারী এ বন্ধুরা দিন দিন অসুলভ হয়ে পড়ছে নানা কারণে। এর মধ্যে প্রধান কারণটি হচ্ছে প্রজননে বিঘ্ন ঘটা। ওদের প্রজননের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বৃক্ষের অভাব দেখা দিয়েছে। যেমনি কমে গেছে পুরনো কোটরওয়ালা গাছ তেমনি কমে গেছে বড় বড় তাল গাছের সংখ্যাও। ফলে প্রজাতির সংখ্যা স্থিতিশীল রয়েছে। এক যুগ আগেও অমনটি ছিল না। দেখেছি যেখানে সেখানে। প্রজাতিটির সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ ঘটেছে আমার। তবে খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ হয়নি বিধায় লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি এতদিন। পরিশেষে যৎসামান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করেছি নেত্রকোনা জেলার এক পাঠক বন্ধুর অনুরোধে। তিনি এ প্রজাতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর আবাবিল’, ইংরেজি নাম: ‘এ্যাশি উড সোয়ালো’ (Ashy woodswallow), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আর্টামাস ফ্যুসক্যাস’ (Artamus fuscus)। এরা ‘মেটে বনাবাবিল’ বা ‘অঞ্জন পাখি’ নামেও পরিচিত। এরা লম্বায় ১৯-২১ সেন্টিমিটার। দেহের অধিকাংশ পালকই ধূসর। কেবল বুক থেকে নিচের দিকটা গোলাপি-ধূসর। লেজের ডগা সাদা। নিতম্বের ওপর রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকার সাদা বলয়। ঠোঁট রূপালি, ত্রিকোণাকৃতির। চোখের কোণে কাজল কালির টান। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: উড়ন্ত পোকামাকড়, ফড়িং, প্রজাপতি ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে কিংবা তাল গাছের ডালের গোড়াতে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে নরম ঘাস, চিকন লতা কিংবা গাছের শিকড় দিয়ে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 10/01/2014