হলদে পা গাঙচিল | Yellow legged Gull | Larus cachinnans
হলদে পা গাঙচিল | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবলমাত্র শীতে প্রজাতির আগমন ঘটে। দেশে দেখা মেলে সুন্দরবন এলাকায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নিঝুমদ্বীপ ও মনপুরাতে। এছাড়াও খাবারের সন্ধানে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে বিচরণ করতে দেখা যায় এ সময়। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। এরা বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও বালুতটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদের। মরা মাছ খাওয়ার লোভে দ্বীপাঞ্চলের জেলে পল্লীতে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। নিজেদের মধ্যে খুঁনসুটি বেঁধে গেলে বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’। প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, ইসরাইল, সিরিয়া, তুরস্ক, সাইপ্রাস, সেনেগাল, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও ইংল্যান্ড পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে পা গাঙচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়লো-লেগড গাল’ (Yellow-legged Gull), বৈজ্ঞানিক নাম: Larus cachinnans| এরা ‘জল কবুতর’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫২-৬৮ সেন্টিমিটার। ডানা প্রসারিত অবস্থায় ১২০-১৫৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। মাথা, ঘাড় ও গলা ধবধবে সাদা। পিঠ ও ডানা ধূসর। তবে ডানায় সামান্য ফুটকি নজরে পড়ে। লেজে কালোর ওপর দু-একটি সাদা ফুটকি। দেহতল ধবধবে সাদা। ওড়ার পালক সাদা। চোখের বলয় লাল, তারা হলদেটে। ঠোঁট মোটা হলুদ। নিচের ঠোঁটের ডগা উজ্জ্বল লাল। পা ও আঙ্গুল হলুদ। প্রধান খাবার: মাছ। এছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড় খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মে পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে নিজ বাসভূমিতে। জলাশয়ের কাছাকাছি ভূমি অথবা পাথুরে এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৩১ দিন। শাবক শাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/11/2015
নীলকান মাছরাঙা | Blue eared Kingfisher | Alcedo meninting
নীলকান মাছরাঙা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির আবাসিক পাখি ‘নীলকান মাছরাঙা’। দেখতে অনেকটাই ছোট মাছরাঙাদের মতো। আকার আকৃতিও তদ্রপ। সাধারণ পাখি পর্যবেক্ষকদের পক্ষে প্রজাতি শনাক্তকরণ দুরূহ বটে। আমাদের দেশে দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের চিরসবুজ বনে। দেখা মেলে প্যারাবনেও। সাধারণত এরা একাকী বিচরণ করে। মাঝেমধ্যে জোড়ায় জোড়ায়ও দেখা যায়। নীলকান মাছরাঙার বিচরণক্ষেত্র প্রধানত চিরসবুজ বনাঞ্চলের ভেতর প্রবহমান নদ-নদীর ওপর গাছের ঝুলন্ত ডালে। শিকারের প্রতীক্ষায় দীর্ঘসময় বসে থাকে সেখানে। শিকার প্রাপ্তির বিলম্বে টেনশনে ঘন ঘন মাথা ওঠানামা করতে থাকে তখন। আবার শিকার প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিলে লেজ খাড়া করে উচ্ছ্বাসও করতে দেখা যায়। তৎসঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে ‘চিচি..চিচিচি..’ আওয়াজ করে ডাক দেয়। এরা যখন তখন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কেবলমাত্র মোক্ষম সুযোগটা পেলেই জলে ঝাঁপিয়ে শিকার ধরে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতির দেখা মেলে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে। এরা বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিরল দর্শন। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে নীলকান মাছরাঙা সংরক্ষিত রয়েছে তাই। পাখির বাংলা নাম: ‘নীলকান মাছরাঙা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্লু ইয়ার্ড কিংফিশার’ (Blue-eared Kingfisher), বৈজ্ঞানিক নাম: Alcedo meninting । এরা ‘নীলাভকান ছোট মাছরাঙা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ১৬ সেন্টিমিটার (ঠোঁট ৪.৪ সেন্টিমিটার)। পুরুষ পাখির ঠোঁটের উপরের অংশ কালচে, নিচের অংশ কালচে-কমলা মিশ্রিত, ঠোঁটের সংযোগস্থল অর্থাৎ মুখের নিচের দিকটা বাদামি-কালো। স্ত্রী পাখির ঠোঁটের নিচের অংশ লালচে হয়। এ ছাড়া স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। চোখ বাদামি। মাথা, ঘাড় ও ডানা বেগুনী-নীল। ঘাড়ের গোড়া থেকে শুরু করে পিঠ হয়ে লেজের গোড়া পর্যন্ত ফিরোজা রঙের পালক। গলা ও ঘাড়ের চারপাশে রয়েছে সাদা পট্টি। কান-ঢাকনি উজ্জ্বল নীল (অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কান-ঢাকনি লালচে-কমলা)। দেহতল গাঢ় বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কমলা রঙের। প্রধান খাবার: মাছ, ব্যাঙাচি, ঘাসফড়িং, গঙ্গাফড়িং ও জলজ পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। তবে অঞ্চলভেদে প্রজনন সময়ের হেরফের দেখা যায়। বন-জঙ্গলের সেতস্বিনী নদীর কিনারে বা পুকুর পাড়ে ১ মিটার লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-৮টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/07/2014
ধলাগলা বাতাই | White cheeked Partridge | Arborophila atrogularis
ধলাগলা বাতাই | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। দেখতে অনেকটাই কোয়েলের মতো। তবে প্রজাতিভেদে ভিন্ন। দেশের সর্বত্র দেখার নজির নেই। কেবল বৃহত্তর সিলেট জেলার চিরসবুজ অরণ্যে দেখা মেলে। একসময় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে বিচরণ ছিল। দেখা যেত ওদের প্রিয় বিচরণ স্থান বাঁশবনে। সিলেট অঞ্চলের চিরসবুজ বনের ঝোপঝাড়ে ছোট দলে হেঁটে বেড়ায় এখনো। তবে সংখ্যায় খুবই কম। খাদ্যের সন্ধানে বেশিরভাগই খোলামাঠে বিচরণ করে। খাবার সংগ্রহ করে লতাপাতা উল্টিয়ে। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি ভাব লক্ষ্য করা যায়। সামান্য ভয় পেলে দৌড়ে ঝরা পাতার নিচে লুকিয়ে পড়ে। শুকনো পাতার সঙ্গে দেহের বর্ণ একাকার হয়ে যাওয়ায় দূর থেকে চেনার উপায় থাকে না। মন ভালো থাকলে গোধূলিলগ্নে ‘হুইও-হুইও’ সুরে গান গায়। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতিটির যৎসামান্য সাক্ষাৎ মেলে ভারত, মিয়ানমার ও চীনে। এরা বিশ্বে বিপদগ্রস্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আমাদের দেশে এ প্রজাতির পাখিগুলো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় এমন মানুষের হাতে। বিশেষ করে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকরা এদের বিভিন্ন কৌশলে শিকার করে। এ ছাড়াও প্রকৃতিতে এদের প্রধান শত্র“ হচ্ছে বেজি। আড়ালে আবডালে ঘাপটি মেরে থেকে হঠাৎ করে এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়িয়ে মাথাটা আলাদা করে ফেলে। এভাবে অপঘাতে প্রাণ হারিয়ে কোনো রকম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে প্রজাতিটি। প্রজাতিটির প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারলে যে কোনো সময় এরা আমাদের দেশ থেকে বিলীন হয়ে যেতে পারে। সিলেট অঞ্চলের প্রিয় পাঠক ভাইদের প্রতি অনুরোধ রইল এদের বাঁচিয়ে রাখার। পাখির বাংলা নাম: ‘ধলাগলা বাতাই’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট-চিকেড পারট্রিজ (White-cheeked Partridge), বৈজ্ঞানিক নাম: Arborophila atrogularis | লম্বায় ২৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২২৫ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপাল ধূসর। মাথার তালু বাদামি। ঘাড়ের পালকে রয়েছে কমলা-হলুদের মিশ্রণ। পিঠের কালো দাগে রয়েছে হালকা বাদামির মিশ্রণ। চোখের পাশে কালো ডোরা। মণি লালচে বাদামি। গলা সাদা। কাঁধ কালো-লালচে ডোরা। বুক ধূসর। তলপেট কালো। লেজের তলা সাদা। পুরুষ পাখির ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা হালকা গোলাপি। প্রধান খাবার: পোকামাকাড়, রসালো ফল, ছোট শামুক ও শস্যবীজ। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। বাসা বাঁধে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর মাটির গর্তে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/03/2014
হলদেপেট ফুলঝুরি | Yellow bellied Flowerpecker | Dicaeum melanoxanthum
হলদেপেট ফুলঝুরি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির পাখি। সুদর্শন চেহারা। পুরুষ পাখির নজরকাড়া রুপ। স্ত্রী পাখি দেখতে কিছুটা নিস্প্রভ। ভিন্ন প্রজাতির মনে হতে পারে। প্রাকৃতিক আবাসস্থল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বন। এছারাও পাইন বনে দেখা মিলে। নজরে পড়ে গেরস্তেরে সাজনো বাগানেও। অথবা বাড়ির আঙ্গিনার লাউ-কুমরা কিংবা ঝিঙেলতার ঝোপে নাচানাচি করতে দেখা যায়। অর্থাৎ যেখানে ফুল সেখানেই ফুলঝুরি পাখির সমাহার। ফুলের মধু এদের প্রধান খাবার। মধুপানের নেশায় সারাদিন ব্যতিব্যস্ত সময় পার করে। স্বভাবে ভারী চঞ্চল। অস্থরিমতি পাখি কোথাও একদন্ড বসে থাকার যো নেই। ছোট গাছ-গাছালি কিংবা লতাগুল্মের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে সুমধুর কণ্ঠে শিস কাটে। উত্তেজিত হলে কণ্ঠস্বর পাল্টে ‘জিট-জিট-জিট-জিট’ সুরে ডাকতে থাকে। গাছে গাছে ছুটে বেড়ায় ছোট ফল-ফলাদি সন্ধানেও। একাকি কিংবা জোড়ায় বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় বেশি দেখা যায়; হাক ডাকও বেড়ে যায় তখন। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। ভূমি থেকে এদের বাসা কাছাকাছি বিধায় বিড়াল বা বনবিড়ালের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। তথাপিও সমগ্র বিশ্বে প্রজাতিটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদেপেট ফুলঝুরি’| ইংরেজি নাম: ইয়লো-ব্যালিড ফ্লাওয়ারপেকার’ (Yellow-bellied Flowerpecker)| বৈজ্ঞানিক নাম: Dicaeum melanoxanthum| দৈর্ঘ্য কমবেশি ১১-১৩ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৫-৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ নীলচে কালো। ডানার গোড়ায় সাদাটান। গলার দুপাশ কালো মধ্যখানে সাদা লম্বাটান; বুকের কাছে ঠেকেছে। বুক কালো। পেটে উজ্জল হলুদ। চোখের মনি বাদামি। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা, ঘাড় ও পিঠ ধূসরাভাকালো। গলার কালো-সাদা তেমন উজ্জল নয় পা নীলচে কালো। প্রধান খাবার: ফুলের মধু, ছোট ফল। মাঝে মধ্যে পোকামাকড়ও খায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে মৌসুমের হেরফের রয়েছে।ভূমিথেকে দুই-আড়াই মিটার উঁচুতে পাছের ডালে অথবা গুল্মলতা আচ্ছাদিত ঝোপে ঝুলন্ত থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে গাছের নরম তন্তু, তুলা, শ্যাওলা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩ টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশের খবর, 01/03/2018
বড় সুইচোরা | Blue bearded Bee eater | Nyctyornis athertoni
বড় সুইচোরা | ছবি: ইন্টারনেট সুইচোরা, পুরো নাম ‘বড় সুইচোরা’। দুর্লভ আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। সুদর্শনও বটে। চাহনি রুক্ষ হলেও স্বভাবে অহিংস। যত্রতত্র দেখা মেলে না। মাঝে-মধ্যে এদের খোঁজ মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আর্দ্র পাতাঝরা ও চিরসবুজ অরণ্যের স্রোতধারায়। আবাদযোগ্য জমির আশপাশেও দেখা যায়। সুইচোরা অরণ্যের ভেতর ফাঁকা স্থানে বা জলাশয়ের কিনারে গাছের ওপর একাকী বসে থাকে শিকারের প্রতীক্ষায়। তবে যেখানেই বসুক না কেন, আশপাশটা ঝাপ-জঙ্গল-লতাপাতা কিংবা ঘন ডালপালাবিহীন মুক্তাঞ্চল হওয়া চাই-ই। যাতে কিছু সময় পর পর উড়তে সুবিধা হয়। সব ধরনের সুইচোরা পাখি উড়ন্ত অবস্থায়ই পতঙ্গ শিকার করে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে যে কোনো ধরনের কীটপতঙ্গ দেখলেই ছোঁ মেরে ধরে ফেলে এ পাখি। জলপানেও রয়েছে এদের বৈচিত্র্যতা। জলের ওপর উড়ে উড়ে ছোঁ মেরে এরা জল পান করে। স্থিরতা এদের মাঝে খুবই কম। কোথাও একদণ্ড বসে থাকার ফুরসত নেই যেন। বিরক্ত হলে ‘কর-র-র…কর-রর…’ কণ্ঠে আওয়াজ করে। বাংলাদেশ ছাড়া সুইচোরার বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ত পর্যন্ত। আইইউসিএনের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পাখি অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণিতে রয়েছে। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় সুইচোরা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্লুবারডেড বী-ইটার’ (Blue-bearded Bee-eater), বৈজ্ঞানিক নাম: Nyctyornis athertoni | এরা ‘নীলদাড়ি সুইচোর’ বা ‘পাহাড়ি সুইচোরা’ নামেও পরিচিত। সুইচোরা লম্বায় ৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তফাৎ নেই। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপাল নীল। ঘাড়, পিঠ ও লেজ সবুজ। লেজের নিচের দিক হলুদাভ। লেজের ডগা ভোঁতা। ডানার নিচের পালক হলুদাভ-পীতাভ। গলায় রয়েছে দাড়িসদৃশ নীল রঙের পালক, যা বুকের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। বুক কালচে নীল। পেট হলুদাভ-পীতাভ ডোরা। বাঁকানো ঠোঁট শিঙ বাদামি রঙের। নিচের ঠোঁটের গোড়া ধূসর। চোখ উজ্জ্বল সোনালি-কমলা। পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে সবুজ। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নীলদাড়ি থাকে না। প্রধান খাবার: মৌমাছি, ফড়িং, বোলতা, গুবরে পোকা ইত্যাদি। ফুলের মধুর প্রতি যথেষ্ট আসক্তি রয়েছে। এদের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট। বন-জঙ্গল বেষ্টিত জলাধারের খাড়া কিনারে অথবা পাহাড়ের গায়ে এরা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/10/2018
কমলাপেট হরবোলা | Orange bellied Leafbird | Chloropsis hardwickii
কমলাপেট হরবোলা | ছবি: ইন্টারনেট কমলাপেট হরবোলা বাংলাদেশের আবাসিক পাখি। সুদর্শন-স্লিম গড়নের প্রজাতিটি পাহাড়ি এলাকার চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। বিচরণ করে পারিবারিক দলে। একাকীও দেখা যায় মাঝেমধ্যে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। কোথাও এক দণ্ড চুপচাপ বসে থাকতে নারাজ। একবার গাছের এ ডালে তো পরক্ষণেই ওই ডালে উড়ে বেড়ায়। ব্যস্ততায় সময় কাটিয়ে দেয় সারা দিন গাছগাছালিতে ঘুরে। অবশ্য এরই মধ্যে সংগ্রহ করে নেয় পোকামাকড় কিংবা ফুলের মধু। কমলাপেট হরবোলার বড় গুণ হচ্ছে এরা সহজে যেকোনো পাখির ডাক নকল করতে পারে (সব ধরনের হরবোলা ডাক নকল করতে পারদর্শী)। আবার নিজেরাও ডাকে সমধুর সুরে ‘শিওয়াটশিশি-শিওয়াটশিশি-শিওয়াটশিশি…’ আওয়াজে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, হংকং ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত। বাংলাদেশে যত্রতত্র দেখার নজির নেই। কেবল চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যে দেখা মেলে। বিশ্বে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এ জন্য আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত পাখি হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। পাখিটির বাংলা নাম: ‘কমলাপেট হরবোলা’| ইংরেজি নাম: হয় অরেঞ্জ বেলিড লিফবার্ড (Orange-bellied Leafbird) নামে | বৈজ্ঞানিক নাম: Chloropsis hardwickii| এরা ‘কমলাপেট পাতা বুলবুলি’ নামেও পরিচিত। যদিও বুলবুলি গোত্রের বা প্রজাতির নয়, তথাপিও ওই নামে পরিচিত অনেকের কাছেই। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির হরবোলা দেখা যায়- নীলডানা হরবোলা, কমলাপেট হরবোলা ও সোনাকপালি হরবোলা। কমলাপেট হরবোলা লম্বায় ১৮ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারায় পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির কপাল, মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছনের দিকটা হলদে-সবুজ। গলা ও বুুক কালো। পিঠ পাতা-সবুজ। ডানা সবুজ, প্রান্তপালক কালচে। লেজের পালকও কালচে। বুকের নিচ থেকে তলপেট পর্যন্ত ফিকে কমলা। ঠোঁটের রং কালো, নিচের দিকে বাঁকানো। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ও ঘাড় নীলচে। পিঠ থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত সবুজ। বুকের মধ্যখানটা কমলা হলেও দেহতল হলদে-সবুজ। ঠোঁট শিঙ-বাদামি। উভয় পাখির চোখের রং বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্করা দেখতে অনেকটাই স্ত্রী পাখির মতো। প্রধান খাবার: ছোট ফল, ফুলের মধু ও পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মে থেকে আগস্ট মাস। ভূমি থেকে ৮-১০ মিটার উঁচুতে গাছের ডালে সরু লতা, শুকনো ঘাস, গাছের আঁশ ও মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে দুই থেকে তিনটি। আর ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮ থেকে ২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 13/04/2018
মেঠো কাঠঠোকরা | Eurasian Wryneck | Jynx torquilla
মেঠো কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিরা মাটিতে দাঁড়ালে অনেকটাই গুইসাপের শাবকের মতো মনে হয়। গলার নিচটায়ও রয়েছে সে ধরনের আঁকিবুঁকি চিহ্ন। আর ওদের পিঠের দিকে তাকালে অজগর সাপের চিত্রটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এমনই অদ্ভুত গড়নের পাখি এরা। খুব চতুরও এ পাখি। মাটিতে বিচরণ করেও বন্যপ্রাণীর শিকারে পরিণত হয় না খুব একটা। বরং বিপদে পড়লে অভিনয় করে পার পেয়ে যায়। হঠাৎ করে এরা যদি কোনো মানুষের নজরে পড়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়টাকে ১৮০ ডিগ্রি কোনে ঘোরাতে থাকে আর চোখ উল্টিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে মাটিতে শুয়ে পড়ে। ভাবটা এমন দেখায় মনে হচ্ছে বুঝি ওর ঘাড়টা মচকে গেছে এখন প্রচণ্ড ব্যথায় কোকাচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষ ওদের বেগতিক ভাবসাব দেখে থমকে যায় বা ধরতে ইতস্ততবোধ করে। ঠিক তখনই ডানায় বাতাস লাগিয়ে ফুরুৎ। এরা পরিযায়ী পাখি। শীতকালে চীন, সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছায়। থাকে বসন্তকাল অবধি। তবে এদের মূল বাসভূমি ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। ডাকে নাকি সুরে ‘খেক্-খেক্-খেক্’ শব্দে। এ ধরনের পাখি বহু বছর আগে দেখেছি মিরপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে। দেখেছি মাটির ওপর বিচরণ করতে। নির্জনে খুঁটেখুঁটে পোকামাকড় খাচ্ছে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘মেঠো কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান রাইনেক’ (Eurasian Wryneck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘জাইংকস টরকিল্লা’, (Jynx torquilla) গোত্রের নাম : ‘পাইকিদি’। উল্লেখ্য, অন্যসব কাঠঠোকরা প্রজাতির পাখিদের সঙ্গে এদের চেহারার মিল না থাকাতে অনেকে এদের ‘ঘাড়ব্যথা’ পাখি নামে ডাকে। লম্বায় এরা ১৬-১৯ সেন্টিমিটার। তুলনামূলক লেজ খানিকটা লম্বা। গায়ের বর্ণ ধূসর-মেটের সঙ্গে সাদার মিশ্রণে রয়েছে ছোপ, ডোরা খাড়া দাগ। পিঠের ওপর মোটা দাগ। মাথা, গলার নিচে আড়াআড়ি কালো ডোরা দাগ, পেটের দিকটায় সাদার উপরে এলোমেলো দাগ। লেজ বলয়যুক্ত। চোখের পাশের রেখা ঘাড়ের মাঝ বরাবর চলে গেছে। ঠোঁট, পা বাদমি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও আসলে পুরুষ পাখির গায়ের বর্ণ কিছুটা উজ্জ্বল। এদের প্রধান খাবার পোকামাকড়। তবে পিঁপড়া, পিঁপড়ার ডিম এদের প্রিয়। খেঁজুরের রস খেতেও দেখা যায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে গাছের খোড়লে। অনেক সময় অন্য প্রজাতির কাঠ ঠোকরাদের পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৭-১০টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/01/2013