খয়রামাথা গাঙচিল | Brown headed gull | Larus brunnicephalus
খয়রামাথা গাঙচিল | ছবি: ইন্টারনেট কেয়ারি সিন্দাবাদের সওয়ার হয়ে নাফ নদী পার হচ্ছি। গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ। কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে বসে আছি জাহাজে। মাঝে-মধ্যে জানালার কাচ সরিয়ে নাফের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ওপারে মিয়ানমারের ভূখণ্ড নজরে পড়তে অভিভূত হয়ে পড়ি। আরও অভিভূত হয়ে পড়েছি এক দঙ্গল জলচর পাখির কলকাকলিতে। ওরা ভেসে বেড়াচ্ছে নাফ নদীর জলে, আবার কিছু পাখি ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে ভেসে ডাকছে ‘কি-ই-য়া’ সুরে। বেশ পরিচিত সুশ্রী গড়নের পাখি এরা। নজর পড়লে প্রকৃতির এ বর্ণাঢ্য অলঙ্কার থেকে কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। শীত মৌসুমে ডাকাতিয়া, পদ্মা, মেঘনা, রজতরেখা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার জলে ওদের ভেসে বেড়াতে দেখেছি অসংখ্যবার। বছরখানেক আগে দেখেছি ধলেশ্বরীর বুকে জেলেদের ভাসমান ডিঙ্গিতে বেড়ানোর সময়। আজ ওই প্রজাতির পাখিগুলোকে দেখে সে কথা মনে পড়েছে। এরা পরিযায়ী হলেও সুলভ দর্শন। শীতের শুরুতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নদ-নদী কিংবা সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নেয়। ছোট-বড় দলে ভেসে বেড়ায় জলাশয়ে। দিনের বেশির ভাগ সময় উড়ে উড়ে ব্যস্ত সময় পার করে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘খয়রামাথা গাঙচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউনহেডেড গাল’,(Brown-headed gull), বৈজ্ঞানিক নাম: Larus brunnicephalus | গোত্রের নাম: ‘লারিদি’। অঞ্চলভেদে ‘গঙ্গা কৈতর’ নামেও পরিচিত। এরা লম্বায় ৩৮-৪৫ সেন্টিমিটার। প্রজনন সময়ে টুপি আকৃতির মাথাটা গাঢ় বাদামি রং ধারণ করে। শীতে রং বদলিয়ে হয় ধূসর-সাদা-কালো। পিঠ ধূসর। লেজ কালো। শরীরের বাকি অংশ ধবধবে সাদা। ঠোঁটের গোড়া রক্তিম, ডগা কালো। পা উজ্জ্বল লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। এদের প্রধান খাবার মাছ। মরা মাছের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন সময় মধ্য জুন থেকে জুলাই। তখন নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। বাসা বাঁধে লাডাখ, তুর্কিস্তান ও দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার দ্বীপাঞ্চলে। এরা সরাসরি মাটিতে ঘাস, লতা-পাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/06/2018
ধূসর সারস | Demoiselle Crane | Anthropoides virgo
ধূসর সারস | ছবি: ইবার্ড বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দেশে আগমন ঘটে শীতে। হিমালয় পাড়ি দিয়ে মাঝেমধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চলে উপস্থিত হয়। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। মরু অঞ্চলেও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা বড়সড়ো ঝাঁকে। চলার পথে কারো ফসলের খেতে দলবেঁধে নামলে মুহূর্তেই ফসল তছনছ করে দেয়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। এ সময় উভয়ে জোরে জোরে দ্বৈত সঙ্গীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, উত্তর-পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, পশ্চিম ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সঙ্কটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে ধূসর সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর সারস’, ইংরেজি নাম: ‘ডেমোজিল ক্রেন’, (Demoiselle Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthropoides virgo | দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। গড় দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৫০-১৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২-৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার তালু ধূসর। মাথার পেছন থেকে কালো রঙ শুরু করে ঘাড়, থুঁতনি ও গলা হয়ে বুকের ওপর গিয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। চোখের পেছন থেকে সাদা পালক ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। সারা দেহ গাঢ় ধূসর। ওড়ার পালক কালো। লেজে সাদা-কালো লম্বা পালক, যা ঝুলে পড়েছে নিচে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। কমলা-লাল রঙের চোখ দুটি আকারে ছোট। পা ও পায়ের পাতা ময়লা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাঁকড়া, কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-২৯ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/04/2016
চেরালেজ বাতাসি | Fork Tailed Swift | Apus pacificus
চেরালেজ বাতাসি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। চেহারায় হিংস্রতার ছাপ লক্ষ করা যায়। তবে ততটা হিংস্র নয়। আক্রান্ত হলে কেবল আক্রমণ করে। প্রাকৃতিক আবাসস্থল পার্বত্য এলাকায়। এ ছাড়াও জলাশয়ের কাছাকাছি বিচরণ করে। দেশে শীতে পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায়। ছোট-বড় দলে সারাদিন উড়ে বেড়ায়। উড়ন্ত অবস্থায় এদের ঠোঁট, মাথা ও লেজ সমান্তরাল থাকে। ফলে দূর থেকে মাথা এবং লেজ শনাক্ত করা কঠিন হয়। শুধু উড়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার কারণে মাথা-লেজ শনাক্ত করা যায়। শরীরের তুলনায় ডানা লম্বা থাকার কারণে উড়ন্ত অবস্থায় ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। লেজ মাছের লেজের মতো মধ্যখানে চেরা। কণ্ঠস্বর কর্কশ, জোরে জোরে শিস দেয়। মাঝেমধ্যে জোড়ায়ও দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘চেরালেজ বাতাসি’, ইংরেজি নাম: ‘ফর্ক-টেইলড সুইফট’ (Fork-tailed Swift), বৈজ্ঞানিক নাম: Apus pacificus। অনেকের কাছে এরা ‘পার্বত্য বাতাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৭-১৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৪৩-৫৪ সেন্টিমিটার। পুরুষ ওজন ৪২ গ্রাম। স্ত্রী ওজন ৪৪ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। কপাল কালো পালিশ করা। ঘাড় বাদামি কালো। পিঠ নীলাভ কালো। কোমর সাদা। লেজ কালো। গলা সাদাটে। দেহতল কালোর সঙ্গে সাদার মিশ্রণ, অনেকটাই মাছের আঁশের মতো দেখায়। ঠোঁট কালো, ছোট। ঠোঁটের অগ্রভাগ কিঞ্চিত বাঁকানো। পা ছোট। পায়ের তুলনায় নখ বড় এবং ধারালো। প্রধান খাদ্য: উড়ন্ত পোকামাকড়, পিঁপড়া। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। বাসা বাঁধে কাঁটাওয়ালা গাছে। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ বস্তু; বিশেষ করে সরু লতা, তন্তু দিয়ে কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। মুখের লালা দিয়ে বাসা জোড়া দেয়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/09/2017
পান্তামুখী হাঁস | Northern shoveler | Anas clypeata
পান্তামুখী হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর এশিয়ার শীতপ্রধান দেশের বাসিন্দা এ পাখি। প্রচণ্ড শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের হাওর-বাঁওড় বা নদীর মোহনায় এসে উপস্থিত হয়। বিদায় নেয় মার্চের মধ্যেই। তখন ওদের প্রজনন সময় ঘনিয়ে আসে। আমাদের দেশে এসে বেশিরভাগই বিচরণ করে কর্দমাক্ত এলাকায়। জোড়ায় কিংবা ছোট দলে মিলেমিশে শিকারে বের হয়। পরিযায়ী অন্য হাঁসের সঙ্গেও রয়েছে দারুণ সখ্য। সাঁতারে খুব দক্ষ। জলের তলের খাবারের প্রতি ওদের লোভ নেই। অর্থাৎ মাছ, গুগলি ইত্যাদির প্রতি লোভ নেই বললেই চলে। জলের উপরিভাগের খাবার খুব পছন্দ। যেমন : শ্যাওলা, পানা ইত্যাদি। পারতপক্ষে খুব একটা ডাকাডাকি করে না। পুরুষ পাখি বেশিরভাগ সময় চুপচাপ কাটিয়ে দিলেও মাঝেমধ্যে স্ত্রী পাখি নিুস্বরে আওয়াজ করে। এদের ঠোঁট বেশ আকর্ষণীয়, অদ্ভুত গড়নের। অনেকটাই হেঁসেলের খুন্তের মতো দেখায়। পুরুষ পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। স্ত্রী পাখি অনেকটাই ম্লান, দেখতে গৃহপালিত পাতিহাঁসের মতো। প্রথম দেখায় পাতিহাঁস ভেবে ভুলও করেছি। দুয়ের রঙ-রূপে এতই ব্যবধান যে, ভিন্ন গোত্রের ভাবাটাই স্বাভাবিক। এদের সম্পর্কে পূর্বধারণা না থাকলে সাধারণ পাখি দেখিয়েরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবেন। বাংলা নাম: ‘পান্তামুখী হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘নর্দান শোভেলার’ (Northern shoveler), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস ক্লাপিয়েটা’ (Anas clypeata), গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা খুন্তে হাঁস নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪৪-৫২ সেন্টিমিটার। ঠোঁট লম্বা, অগ্রভাগ খুন্তের মতো চেপ্টা। চোখ হলুদ। পুরুষ পাখির মাথা, গলা উজ্জ্বল হরিৎবর্ণ। পিঠ ধূসর-পিঙ্গল। লেজ পিঙ্গল। পার্শ্বদেশ তামাটে, লেজের নিচের পালক কালো। বুক সাদা। পেট গাঢ় খয়েরি। স্ত্রী পাখির বর্ণে বৈচিত্রতা নেই। রঙ পিঙ্গল, ডানার অল্পকিছু পালক নীলাভ-ধূসর। শরীরের আঁশ ভাবযুক্ত। পুরুষ পাখির মতো চোখ হলুদ নয়। তবে ঠোঁটের গড়ন পুরুষ পাখির মতোই চেপ্টা। প্রধান খাবার: শ্যাওলা, শস্য বীজ ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে ছোট মাছ খেতে দেখা যায়, তবে খুব একটা নয়, ঠেকায় পড়লে খায়। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। বাসা বাঁধে উত্তর এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে। জলাভূমির কাছাকাছি স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে ছোট ঘাস-লতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৯-১২টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৮ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হয় ৫২-৬৬ দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/06/2013
তামাটে লাল বেনেবউ | Maroon Oriole | Oriolus traillii
তামাটে লাল বেনেবউ | ছবি: ইন্টারনেট হিমালয় এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা। পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশে। যত্রতত্র দেখা যায় না। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও তিব্বত পর্যন্ত। বিচরণ করে চিরহরিৎ বন বা আধা-চিরহরিৎ বন অথবা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র নিুভূমির বনে। বৃক্ষচারী পাখি। প্রয়োজন ছাড়া ভূমি স্পর্শ করে না। জোড়ায় কিংবা একাকী বিচরণ করে। স্বভাবে চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে বেড়ায় সারা দিন। লাফাতে লাফাতে চোখের পলকে হারিয়ে যায়। ভাবটা এমন যেন রাজ্যের ব্যস্ততা তাড়া করছে ওদের। স্লিম গড়ন। সুদর্শনও বটে। প্রথম দর্শনে যে কেউই মুগ্ধ হবেন বোধ করি। প্রজাতির রূপের বর্ণনা দিয়ে বোঝানো মুশকিল। এক কথায় দেখতে খুবই সুন্দর। গানের গলাও সুমধুর। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি আড়ালে আবডালে গিয়ে স্ত্রী পাখিকে মুগ্ধ করতে গান বাঁধে। মিষ্টি কণ্ঠে নিচু স্বরে গান গায়, ‘কো-কে-ওয়া’ সুরে। খিদে পেলে ওদের বাচ্চারাও মিষ্টি সুরে কাঁদে। সেই সুর শুনতে বড়ই করুণ লাগে। প্রজাতিটি বিশ্বে খুব ভালো অবস্থানে নেই বিধায় আইইউসিএন ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে এদের। পাখির বাংলা নামঃ তামাটে-লাল বেনেবউ, ইংরেজি নামঃ মেরুন ওরিয়োল (Maroon Oriole), বৈজ্ঞানিক নামঃ Oriolus traillii | এরা ‘তামারং বেনেবউ’ নামেও পরিচিত। দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির বেনেবউ নজরে পড়ে। যথাক্রমে- ইউরেশীয় সোনাবউ, কালাঘাড় বেনেবউ, কালামাথা বেনেবউ, তামাটে-লাল বেনেবউ ও সরুঠোঁট বেনেবউ। দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। স্ত্রী-পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ। উভয়ের মাথা, গলা, ঘাড় ও ডানা কালো। শরীরের বাদবাকি অংশ তামাটে-লাল রঙের। চোখের বলয় হলদে-সাদা, মণি কালো। ঠোঁটও ধূসর-কালচে। প্রধান খাবারঃ শুঁয়াপোকা এবং কীটপতঙ্গ। এ ছাড়াও ফুলের মধু এবং ছোট ফলের প্রতি আসক্তি রয়েছে। বিশেষ করে পাকা ডুমুর ফল বেশি প্রিয়। প্রজনন মৌসুম মার্চ-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময় ভিন্ন হয়। তবে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই ডিম-বাচ্চা তোলে। বাসা বাঁধে পেয়ালা আকৃতির। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের ছাল, তন্তু, সরু ঘাস-লতা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩ থেকে ১৫ দিন। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
ধূসরাভ ফিদ্দা | Grey Bush Chat | Saxicola ferreus
ধূসরাভ ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। প্রাকৃতিক আবাস্থল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় নিম্নভূমির বন। ঝোপ আচ্ছাদিত পাহাড় এবং পাইনবনে বিচরণ রয়েছে। পুরুষ পাখির তুলনায় স্ত্রী পাখি কিছুটা নিষ্প্রভ। পুরুষ পাখির মায়াবি চেহারা। উভয়ে স্বভাবে চঞ্চল। কণ্ঠস্বর মধুর। মাঝারি আকৃতির বৃক্ষের উচ্চশিখরে বসে গান গায়। বিচরণ করে একাকী। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও চীন পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসরাভ ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেবুশ চ্যাট’ (Grey Bush Chat), বৈজ্ঞানিক নাম: Saxicola ferreus। এরা ‘মেটে ঝাড়ফিদ্দা’ নামেও পরিচিত। গড় দৈর্ঘ্য ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৪-১৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় রুপালী ধূসর। পিঠ কালচে ধূসর। ডানার প্রান্ত পালকে কালো ধূসরের সঙ্গে সাদা টান। লেজ কালো ধূসর। লেজতল সাদা। ঠোঁটের গোড়া থেকে চোখের ওপর দিয়ে কুচকুচে চওড়া কালোটান ঘাড়ে ঠেকেছে। গলা সাদা। দেহতল ধূসর সাদা। স্ত্রী পাখির রঙ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেহের উপরের অংশ বাদামি ধূসর। তবে ডানার প্রান্ত পালকে কালো ধূসরের সঙ্গে গাঢ় বাদামির উপস্থিতি রয়েছে। দেহতল সাদাটে বাদামি। উভয়ের ঠোঁট ও চোখ কালো। পা ধূসর কালচে। প্রধান খাদ্য: কীটপতঙ্গ, মাকড়সা ও ঘাসবীজ। প্রজনন সময় মার্চ-জুলাই। শুকনো ঘাস, লতা-পাতা, চুল দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসা অনেকটাই পেয়ালা আকৃতির। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/09/2017
লেজ ঝোলা গোদা ঠোঁটি | Long tailed Broadbill | Psarisomus dalhousiae
লেজ ঝোলা গোদাঠোঁটি | ছবি: ইন্টারনেট মাথায় কালো-সাদা টুপি, গায়ে সবুজ চাদর জড়ানো। ভোলাভালা চেহারার শান্ত এ প্রজাতির পাখির নাম ‘লেজ ঝোলা গোদা-ঠোঁটি। বাংলা নামটা যুত্সই নয়। শুনতে একটু বিদ্ঘুটে ঠেকলেও দেখতে ভীষণ সুন্দর। চোখ ধাঁধানো রূপ। বার বার দেখতে ইচ্ছে করে অপরূপা এই পাখিটি। বিশ্বে মোট ১৪ প্রজাতির গোদা-ঠোঁটি পরিবারের বাস। এর মধ্যে বাংলাদেশে সাক্ষাৎ মেলে দুই প্রজাতির। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি উত্তর-পূর্ব ভারত, হিমালয়ের কিছু এলাকা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান মোটামুটি সন্তোষজনক। মূলত এরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক চিরহরিৎ বন, মিশ্র পর্ণমোচী অরণ্য এবং বাঁশবন এলাকায় বিচরণ করে। লোকালয়ে খুব একটা নজরে পড়ে না। একাকী কিংবা জোড়ায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। অবসরে গাছের ডালে চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মধ্যে মাছরাঙা পাখির মতো লম্বা লেজ উঁচিয়ে নিচের দিকে ঝাঁকি মারে। নিয়মিত গোসলাদি করে। অনেক সময় গাছের কোটরে জমানো জলে গোসল সেরে নিতে দেখা যায়। সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে এরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পাখির বাংলা নাম: ‘লেজ ঝোলা গোদা-ঠোঁটি’, ইংরেজি নাম: ‘লং টেইল্ড ব্রডবিল’ (Long-tailed Broadbill) বৈজ্ঞানিক নাম: Psarisomus dalhousiae। এরা ‘ল্যাঞ্জা মোটা ঠোঁটি’ নামেও পরিচিত। এই প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ২৩-২৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৬৪-৬৭ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথার তালু নীলচে সাদা। কপাল ও ঘাড় কুচকুচে কালো। মাথার পেছনের দু’পাশে সবুজাভ-হলুদ ছোপ। ঘাড়ের নিচ এবং গলাসহ সমস্ত মুখমণ্ডল সবুজাভ-হলুদ। পিঠ ও ডানা গাঢ় সবুজ। ডানার প্রান্ত পালক নীলচে। লম্বা লেজ নীলচে রঙের। দেহতল হালকা সবুজ। ঠোঁট মোটা, সবজেটে-হলুদ। ঠোঁটের অগ্রভাগ ফ্যাকাসে হলুদ। চোখের বলয় হলুদ। পা সবজে-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা কিছুটা ভিন্ন। প্রধান খাবার: পোকামাকড়। এ ছাড়াও ছোট ফলের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে আগস্ট। তবে অঞ্চলভেদে এর তারতম্য হয়। ভূমি থেকে দুই মিটার উঁচুতে গাছের ঝুলে থাকা চিকন ডালে এরা বাসা বাঁধে। বলতে গেলে ঝুলন্ত বাসা। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের তন্তু, চিকন লতা এবং শুকনো ছোট পাতা। ডিম পাড়ে ৫-৬টি। ফুটতে সময় ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।