দাগিলেজ গাছআঁচড়া | Bar tailed Treecreeper | Certhia himalayana
দাগিলেজ গাছআঁচড়া | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, রাশিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরান পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল খোলা সরলবর্গীয় বন এং নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল। এরা একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। হিংস নয়। অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের পাখি। কাঠঠোকরা পাখির মতো গাছের খাড়া কাণ্ডে খুব দ্রুত হেঁটে উঠতে পারে। সারাদিন গাছের কাণ্ডে ঠোঁট চালিয়ে কীট-পতঙ্গ খুঁজে বেড়ায়। গাছ-গাছালিতে বিচরণকালে অনেক সময় ওদেরকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ওদের গায়ের বর্ণ গাছের শুকনো ডালপালার সঙ্গে মিশে যায়, যার ফলে এ ধরনের ভ্রম তৈরি হয়। প্রজাতির বিচরণ দেশে সন্তোষজনক না হলেও বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘দাগিলেজ গাছআঁচড়া’, ইংরেজি নাম: ‘বার-টেইলড ট্রিক্রিপার’ (Bar-tailed Treecreeper), বৈজ্ঞানিক নাম: Certhia himalayana, এরা ‘বাঁকা-ঠোঁট কীট-কুড়ানি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৮ গ্রাম। গায়ের রং বাদামি-সাদা-লালচে ডোরাকাটা। ডানার প্রান্ত পালক ধূসর কালো। লেজ ডোরাকাটা। দেহতল হালকা বাদামি-সাদা। ঠোঁট লম্বা বাঁকানো, কালচে রঙের। পা কালচে। প্রধান খাবার: কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড়, মাকড়সা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, তন্তু, শুকনো ঘাস, পালক ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৭ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/02/2017
নিরল প্রিনা | Plain Prinia | Prinia inornata
নিরল প্রিনা | ছবি: ইন্টারনেট দেশি প্রজাতির পাখি। মায়াবী চেহারা। স্লিম গড়ন। সুলভ দর্শন। দেখা মেলে দেশের গ্রামাঞ্চলে। বিশেষ করে খাল-বিলের পাশের জঙ্গলে বা ঘাসবনে ওদের বিচরণ খানিকটা বেশি। ঘাসবন এদের খুব পছন্দও। লম্বা ঘাসের ডগায় দোল খেতে দেখা যায় দিনভর। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘাসবনে দোল খায়। স্বভাবে বেশ চঞ্চল। স্থিরতা এদের মাঝে খুবই কম। প্রজনন মৌসুমে ‘টিøলি…টিøলি’ সুরে গান গায়। সুর বেশ মধুর। শুনতে ইচ্ছে করে বারবার। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় থাকে। প্রজননের বাইরে ছোট দলে বিচরণ করে। সুযোগ পেলে দলবদ্ধ হয়ে কৃষকের ধান, কাউন, তিল, তিসি ক্ষেতে হানা দেয়। যা খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে। সুলভ দর্শনের এ পাখি ক্রমান্বয়ে যেন অসুলভ হয়ে পড়ছে গাঁয়ে। জোরগলায় বলতে পারি এটি ঘটছে শুধু খাবার সংকটের কারণেই। তবে দেশের অন্যান্য স্থানে এরা ভালোই আছে। পাখির বাংলা নাম: ‘নিরল প্রিনা’, ইংরেজি নাম: ‘প্লেইন প্রিনা’ (Plain Prinia), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘প্রিনিয়া ইনোরনাটা’, (Prinia inornata), গোত্রের নাম: ‘সিস্টিকোলিদি’। অনেকে এদেরকে ‘সাধারণ বুনো টুনি’ নামে ডাকে। এরা লম্বায় ১৩ সেন্টিমিটার (লেজ ৮ সেন্টিমিটার)। ঠোঁট তীক্ষ অগ্রভাগ কিঞ্চিৎ বাঁকানো। ঠোঁট বাদামি হলেও প্রজনন মৌসুমে বদলিয়ে কালো রং ধারণ করে। মাথা, ঘাড় ফিকে লালচে। চোখের সামনে সাদা ডোরা। মুখাবয়ব সর রঙের সাদাটে। পিঠ ও লেজ বালু-বাদামি মিশ্রিত। দেহের নিম্নাংশ ধূসর সাদা। পা ও পায়ের পাতা বাদামি হলুদাভ। প্রধান খাবার: ছোট ঘাসবীজ, ধান, কাউন, তিল, তিসি ইত্যাদি। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। বাসা বাঁধে ঘাসবনে। ভূমি থেকে এক-দেড় মিটার উঁচুতে ঘাসপাতা পেঁচিয়ে মোচাকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/10/2013
ধূসর দামা | Tickell’s Thrush | Turdus unicolor
ধূসর দামা | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী, ভূচর পাখি। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে শীতে দেখা যায়। তবে এতদাঞ্চলে প্রজনন ঘটায় না। চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। প্রাকৃতিক আবাসস্থল মিশ্র পর্ণমোচী ও সুঁচালো পার্বত্য বন। পাইন বনে বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিচরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। গানের গলা ভালো। গাছের উঁচু ডালে বসে খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে গান গায়। স্বভাবে লাজুক। বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। দেখা যায় লতাগুল্মের নিচেও। আবার পাথুরে এলাকায়ও বিচরণ রয়েছে। পরিত্যক্ত বা স্যাঁতস্যাঁতে এলাকার লতাপাতা উল্টিয়ে এবং ঘন ঘন ঠোঁট চালিয়ে খাবার খোঁজে। গাছের উঁচুতে বিচরণ করে না। দেশের সর্বত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই। শীতে দেখা যায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমার পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও প্রজাতিটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘ধূসর দামা’, ইংরেজি নাম:‘ টিকেল’স থ্রাস’ (Tickell’s Thrush), বৈজ্ঞানিক নাম: Turdus unicolor | এরা ‘টিকেলের দামা’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির দামা নজরে পড়ে। গড় দৈর্ঘ্য ২০-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা। ওজন ৫৮-৭৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। দেহের ওপরের অংশ ধূসর। অনেকটাই গাঢ় ছাই বর্ণের। কেবল গলায় সামান্য সাদাটে দাগ। গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত ফ্যাকাসে ধূসর। লেজতল সাদাটে। চোখের বলয় হলুদ, মনি কালো। ঠোঁট হলুদ। পা ও পায়ের আঙুল হলুদ। যুবাদের রঙ ভিন্ন। শীত-গ্রীষ্মে রঙ বদলায়। প্রধান খাবার: কেঁচো, পোকামাকড়। মাঝেমধ্যে ছোট ফলফলাদি খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ২-৭ মিটার উঁচুতে। গভীর কাপ আকৃতির বাসা। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, শুকনো ঘাস ও লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/05/2017
কালিম পাখি | Purple Swamphen | Porphyrio porphyrio
কালিম পাখি | ছবি: ইন্টারনেট অনেকের ধারণা এরা অতিথি পাখি। ধারণাটি রটিয়ে দেয়ার জনক পাখি শিকারিরাই। কারণ অতিথি পাখির নাম শুনলে ভোজন রসিকদের জিভে জল আসে। তখন বিক্রি করতে সুবিধা হয়। দাম-টামও বেশি পাওয়া যায়। প্রকৃত তথ্যটি হচ্ছে, এরা আমাদের দেশীয় জলচর পাখি। স্বভাবে বুনো হলেও মোটামুটি পোষ মানে। মুক্ত অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। আবার একাকী বা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করে। ওদের বিচরণের ক্ষেত্র জলাশয়ের জলদামের ওপর। আবার জলেও সাঁতার কাটে, তবে তুলনামূলকভাবে কম। জলকেলি ওদের ভীষণ পছন্দ। জলের ছোঁয়ায় রূপের ঝলক আরো বেড়ে যায়। এ সুন্দর প্রজাতির পাখিদের বছর ত্রিশেক আগেও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাশয়ে কিংবা হাওর অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত। বর্তমানে এদের সাক্ষাৎ ওভাবে মেলে না। গত বর্ষায় আমি দেখেছি বিক্রমপুরের রামপালে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাখি দেখতে বেরিয়েছি এক বিকেলে। হাঁটতে হাঁটতে রাজা বল্লাল সেনের দিঘির পাড়ে হাজির হলাম। দেখতে পেলাম দিঘিটার আকার আকৃতি আগের মতো নেই। জলজ উদ্ভিদ বা জলদামের কারণে এটি এখন বিলে পরিণত হয়েছে। তার পরও এখানে কিছু জলচর পাখির দেখা মেলে। পাখি বিশেষজ্ঞরাও মাঝে মধ্যে এখানে পাখি পর্যবেক্ষণে আসেন। মাঝে মধ্যে আমিও যাই। সেদিনও গিয়েছি। কয়েক প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেলেও এ পাখির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে বেশি। দূর থেকে দেখতে পেয়েছি দুটি জলচর পাখি জলদামের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর পর বিরতি নিয়ে ওড়াউড়ি করছে। দৃশ্যটি বেশ লেগেছে আমার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়ে ওদের প্রজাতি শনাক্ত করে নিয়েছি। পাখিগুলো পূর্ব পরিচিত বিধায় ওদের পেছন আর অযথা সময় নষ্ট করিনি। বলতে দ্বিধা নেই, এ পাখি আমি নিজেও ক’দিন পুষেছি। আবার খাঁচার দরজা উন্মুক্ত করে ওদের প্রকৃতির কোলে ফিরিয়েও দিয়েছি। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালিম,’ ইংরেজি নাম: ‘পার্পল সোয়াম্পহেন’(Purple Swamphen) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পরফাইরিও পরফাইরিও’ (Porphyrio porphyrio), গোত্রের নাম: ‘রাললিদি’। এরা লম্বায় ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার। ঠোট, কপাল পালকহীন উজ্জ্বল লাল। মাথা থেকে গলা হালকা নীলাভ বর্ণ। এ ছাড়া সমস্ত শরীরের পালক বেগুনি-নীলের মিশেল। লেজের তলা সাদা। পা ময়লা লাল। পায়ের আঙ্গুল তুলনামূলকভাবে বড়। দেখতে নোংরা মনে হয়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এরা ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। ডিমে তা দেয়ার দায়িত্ব স্ত্রী পাখির ওপরে বর্তালেও ওই সময়ে পুরুষ পাখিটি বাসার কাছাকাছি থেকে স্ত্রী পাখিকে সঙ্গ দেয়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/11/2012
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
ঝুঁটিয়াল মাছরাঙা | Crested kingfisher | Megaceryle lugubris
ঝুঁটিয়াল মাছরাঙা | ছবি: ইন্টারনেট প্রজাতির অন্যসব মাছরাঙাদের মতো চেহারায় তত আকর্ষণীয় ভাব নেই। বরং উল্টোটা। দেখা যায় হিংস্র কিংবা রাগী রাগী চেহারার। ‘ঝুঁটিয়াল মাছরাঙা’ বাংলাদেশে স্থায়ী হলেও খুব একটা দেখার নজির নেই যত্রতত্র। বলা যায় বিরল দর্শন। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ বনের প্রবাহমান নদ-নদী কিংবা ঝরনার কিনারে দেখার রেকর্ড রয়েছে। তবে সেটি দু-একবারের বেশি নয়। যতদূর জানা যায়, ওরা নিভৃতচারী পাখি। একাকী থাকতেই বেশি পছন্দ করে, শিকারেও বের হয় একাকীই। জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায় মাঝে মধ্যে। শিকার কৌশল প্রজাতির অন্যদের মতোই। তবে এরা সাধারণত গহিন অরণ্যের ভিতর প্রবাহমান নদীর ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে উড়তে উড়তে শিকার খোঁজে। আর মাঝে মধ্যে তীক্ষèকণ্ঠে ডেকে ওঠে, ‘ক্লিক…ক্লিক…ক্লিক…’। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, জাপান, লাওস, ভিয়েতনামে ও থাইল্যন্ডে। প্রজাতিটি বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণিতে রয়েছে। দেশের পাখি বিশারদরা এদেরকে বিপদাপন্নের দিকে ধাবিত হওয়ার দাবি জানিয়েছেন। পাখির বাংলা নাম: ‘ঝুঁটিয়াল মাছরাঙা’, ইংরেজি নাম: ‘ক্রেস্টেড কিংফিশার’,(crested kingfisher) বৈজ্ঞানিক নাম: Megaceryle lugubris | এরা ‘ফোঁটকা মাছরাঙা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪০-৪২ সেন্টিমিটার। ঠোঁটের গোড়া ধূসর, অগ্রভাগ কালো। মাথায় চমৎকার সাদা-কালো লম্বা ঝুঁটি। চোখের সামনে-পেছনের সাদা দাগ ঘাড়ে মিশেছে। গলাবন্ধ সাদা। ঘাড়ের গোড়া থেকে পিঠ হয়ে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত নীলাভ ধূসরের ওপর সাদা ফুটকি। ডানার নিচে রয়েছে লালচে পালক, যা কেবলমাত্র ওড়ার সময় দেখা যায়। বুকের ওপর কালো ও বাদামি ছোপযুক্ত অস্পষ্ট বলয় রয়েছে। বুকের নিচ থেকে সাদা। চোখ কালো। পা ও পায়ের পাতা ধূসরাভ-জলপাই। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই, কেবলমাত্র ডানার নিচের ফ্যাকাসে লালরঙের মাধ্যম ব্যতীত। যা স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির রয়েছে, পুরুষ পাখির গায়ে দেখা যায় না। প্রধান খাবার: মাছ। ছোট ব্যাঙ কিংবা পোকামাকড়ের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। নদ-নদীর খাড়া পাড়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে বাড়তি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে কাঁটা বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।প্রকাশ: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/10/2018
পাতি চ্যাগা | Common snipe | Gallinago gallinago
পাতি চ্যাগা | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন, পরিযায়ী পাখি। লোনা কিংবা মিঠা উভয় ধরনের জলার ধারে বিচরণ করে। উপকূলীয় অঞ্চল, বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় কিংবা পাহাড়ি এলাকার ঝর্ণার কিনারেও দেখা যায়। দেখা যায় একাকি কিংবা ছোট-বড় দলে। কাদাময় জলে ঘুরে ঘুরে লম্বা ঠোঁটের সাহায্যে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। এদের প্রধান শত্র“ সূর্যের আলো। মোটেই সইতে পারে না আলো। উত্তাপ এড়াতে খুব ভোরে অথবা শেষ বিকেলের দিকে এরা খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে পড়ে ঘাসবনে, কচুরিপানা অথবা যে কোনো ঝোপের ছায়ায়। এতদস্থানে লুকালে সহজে এদের দেখাও যায় না। পরিবেশের সঙ্গে শরীরটাকে মিশিয়ে ফেলে নিমেষেই। ফলে চট করে কারো নজরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণ করতে বেসুরো কণ্ঠে গান শোনায় ‘চিপ-পার, চিপ-পার’। সুর শুনতে কিছুটা ছাগলের ডাকের মতো বিধায় জার্মানদের এরা ‘আকাশ ছাগল’ নামে পরিচিত। তবে ভয় পেলে এ পাখির কণ্ঠস্বর পাল্টে যায়, অনেকটা নাকি সুরে ‘চেঙ্ক-চেঙ্ক’ আওয়াজ করে এঁকে-বেঁকে উড়ে মাটিতে অথবা জলজ উদ্ভিদের ওপরে নামে। ওখান থেকে কিছুটা পথ হেঁটে লুকিয়ে পড়ে নিরাপদ স্থানে। শত্র“ সরে গেলে পূর্বের জায়গায় আশ্রয় নেয়। অতঃপর লুকিয়ে-চুকিয়েই সময় পার করে। এ সময় পিঠের পালকের ভেতর ঠোঁট গুঁজে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে বা ঘুমিয়ে কাটায়। এ প্রজাতির বাংলা নাম: ‘পাতি চ্যাগা’, ইংরেজি নাম: ‘কমন স্নাইপ’ (Common snipe). বৈজ্ঞানিক নাম: ‘গাল্লিনাগো গাল্লিনাগো’ (Gallinago gallinago), গোত্রের নাম: ‘স্কোলোপাসিদি’। এরা ‘কাদাখোঁচা’ নামেও পরিচিত। এ পাখি লম্বায় ২৫-২৭ সেন্টিমিটার। গায়ের রঙ বাদামির ওপর সাদা-কালো-হলদে ছোপ। দেহতল সাদা। ঠোঁট অস্বাভাবিক লম্বা। ঠোঁটের অগ্রভাগ ঈষৎ বাঁকানো। পা খাটো। প্রধান খাবার: কাদা বা পলিমাটির নিচের শূককীট এবং ছোট কম্বোজ। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে উত্তর হিমালয়াঞ্চলে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/02/2014