কালোপিঠ চেরালেজি | Black backed Forktail | Enicurus immaculatus
কালোপিঠ চেরালেজি | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা এরা। দেখতে খুবই সুন্দর। চেহারাটাও বেশ মায়াবী। আদুরে গড়ন। দূর থেকে অনেক সময় দোয়েল পাখির মতো মনে হলেও আসলে তা নয়। তবে দোয়েলের নিকটাত্তিয় এরা। গোত্রভেদেও একই। লম্বা লেজটা কেটে ফেললে সাধারণ পাখি দেখিয়েরা তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন বোধকরি। তাদের কাছে তখন দোয়েল পাখিই মনে হবে। অবশ্য এ কথা পাখি বিশেষজ্ঞদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এমন সুন্দর পাখিদের বিস্তৃতি শুধু আমাদের দেশেই নয়, যথাক্রমে ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বন ও পাহাড়ি অঞ্চলে। আমাদের দেশে যেখানে সেখানে নজরে পড়ে না। তবে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনাঞ্চলসহ পাহাড়ি ছড়ায় এদের দেখা যায় বেশি। এরা পাহাড়ি ছড়ার কাছে স্যাঁতসেঁতে স্থানে শিকার খোঁজে। একেবারে জলার ধারঘেঁষে চরে বেড়ালেও জলে পা ভেজায় না খুব একটা। এরা পছন্দ করে একাকী হাঁটতে এবং শিকার খুঁজতে। কালেভদ্রে স্ত্রী-পুরুষ পাখি একত্রিত হলেও তারা পাশাপাশি কিংবা গা-ঘেঁষে চলাফেরা করে না। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটে। হেঁটে বেড়ানোর সময় এদের লেজটা ভূমি থেকে উপরে ওঠানামা করে বিশেষ ভঙ্গিতে। দৃশ্যটি দেখার মতোই বটে। পাখিটাকে প্রথম দেখেছি সিলেটের মাধবকুণ্ডে। ঝরনার পাদদেশ থেকে সৃষ্ট ছড়ার কিনারে হেঁটে বেড়াতে দেখেছি ওকে। দেখেছি পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে। পাখিটা দেখে ভীষণ অভিভূত হয়েছি। যেমন অভিভূত হয়েছি ওর রূপ-লাবণ্যে, তেমনি আকৃষ্ট হয়েছি ওর হাঁটাচলার ভঙ্গিতে। পাখিটার শরীরে বহুবিধ বর্ণের বিন্যাস না থাকলেও সামান্য সাদা-কালো বর্ণই ওকে অপরূপ করে তুলেছে। আমি কিন্তু প্রথম দেখায় ওকে চিনতে পারিনি। ক্যামেরাবন্দি করে ঢাকায় এসে একজন পাখিবিশারদের শরণাপন্ন হলে তিনি আমাকে এ পাখি সম্পর্কে নানা তথ্য জানান। বর্তমানে এ পাখি আমাদের দেশে খুব ভালো অবস্থায় নেই। অবাধ বন-জঙ্গল বিনাশের কারণে এরা অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন রয়েছে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালোপিঠ চেরালেজি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-ব্যাকড ফর্কটেইল’ (Black-backed Forktail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘এনিকিউরাস ইম্যাকুলেটাস’ (Enicurus immaculatus), গোত্রের নাম: ‘মুস্কিকাপিদি’, উপগোত্রের নাম: ‘টার্ডিনি’। এরা লম্বায় লেজসহ ২৮ সেন্টিমিটার। এদের লেজ শরীরের তুলনায় বেশ বড় এবং লেজের প্রান্তটা চেরা। লেজের পালক কালোর ওপর সাদা ছিট। লেজের পাশ এবং অগ্রভাগ ধবধবে সাদা। কপালে চওড়া সাদা রেখা। মাথা কালো। ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত স্লেট-কালো বর্ণের। ডানা কুচকুচে কালোর ওপর সাদা টান। গলার সাদা বর্ণটা দেহের নিুাংশে গিয়ে ঠেকেছে। চঞ্চু কালো। পা, আঙুল পীত বর্ণের। কালোপিঠ চেরালেজিদের প্রিয় খাবার কীটপতঙ্গ। ভূমিজ কীটের চেয়ে জলজ কীটপতঙ্গ এদের বেশি পছন্দ। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/12/2012
ধলাগলা বাতাই | White cheeked Partridge | Arborophila atrogularis
ধলাগলা বাতাই | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। দেখতে অনেকটাই কোয়েলের মতো। তবে প্রজাতিভেদে ভিন্ন। দেশের সর্বত্র দেখার নজির নেই। কেবল বৃহত্তর সিলেট জেলার চিরসবুজ অরণ্যে দেখা মেলে। একসময় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে বিচরণ ছিল। দেখা যেত ওদের প্রিয় বিচরণ স্থান বাঁশবনে। সিলেট অঞ্চলের চিরসবুজ বনের ঝোপঝাড়ে ছোট দলে হেঁটে বেড়ায় এখনো। তবে সংখ্যায় খুবই কম। খাদ্যের সন্ধানে বেশিরভাগই খোলামাঠে বিচরণ করে। খাবার সংগ্রহ করে লতাপাতা উল্টিয়ে। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি ভাব লক্ষ্য করা যায়। সামান্য ভয় পেলে দৌড়ে ঝরা পাতার নিচে লুকিয়ে পড়ে। শুকনো পাতার সঙ্গে দেহের বর্ণ একাকার হয়ে যাওয়ায় দূর থেকে চেনার উপায় থাকে না। মন ভালো থাকলে গোধূলিলগ্নে ‘হুইও-হুইও’ সুরে গান গায়। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতিটির যৎসামান্য সাক্ষাৎ মেলে ভারত, মিয়ানমার ও চীনে। এরা বিশ্বে বিপদগ্রস্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আমাদের দেশে এ প্রজাতির পাখিগুলো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় এমন মানুষের হাতে। বিশেষ করে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকরা এদের বিভিন্ন কৌশলে শিকার করে। এ ছাড়াও প্রকৃতিতে এদের প্রধান শত্র“ হচ্ছে বেজি। আড়ালে আবডালে ঘাপটি মেরে থেকে হঠাৎ করে এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়িয়ে মাথাটা আলাদা করে ফেলে। এভাবে অপঘাতে প্রাণ হারিয়ে কোনো রকম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে প্রজাতিটি। প্রজাতিটির প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারলে যে কোনো সময় এরা আমাদের দেশ থেকে বিলীন হয়ে যেতে পারে। সিলেট অঞ্চলের প্রিয় পাঠক ভাইদের প্রতি অনুরোধ রইল এদের বাঁচিয়ে রাখার। পাখির বাংলা নাম: ‘ধলাগলা বাতাই’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট-চিকেড পারট্রিজ (White-cheeked Partridge), বৈজ্ঞানিক নাম: Arborophila atrogularis | লম্বায় ২৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২২৫ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপাল ধূসর। মাথার তালু বাদামি। ঘাড়ের পালকে রয়েছে কমলা-হলুদের মিশ্রণ। পিঠের কালো দাগে রয়েছে হালকা বাদামির মিশ্রণ। চোখের পাশে কালো ডোরা। মণি লালচে বাদামি। গলা সাদা। কাঁধ কালো-লালচে ডোরা। বুক ধূসর। তলপেট কালো। লেজের তলা সাদা। পুরুষ পাখির ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা হালকা গোলাপি। প্রধান খাবার: পোকামাকাড়, রসালো ফল, ছোট শামুক ও শস্যবীজ। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। বাসা বাঁধে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর মাটির গর্তে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/03/2014
কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া | Black naped monarch | Hypothymis azurea
কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া | ছবি: ইন্টারনেট পাখির বাংলা নাম: ‘কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া’। ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক নেপড মোনার্ক’ (Black-naped monarch)| বৈজ্ঞানিক নাম: Hypothymis azurea। প্রজাতিটি ‘কালাঘাড় রাজন’ বা ‘কালো গ্রিবা পতঙ্গভুক’ নামেও পরিচিত। এ পাখি চঞ্চল হলেও হিংস্র নয়। গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে না। বেশির ভাগই জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। মাঝে মধ্যে একাকীও দেখা যায়। শীত মৌসুমে সমতলের ঝোপ-জঙ্গলে বেশি চোখে পড়ে। লুকিয়ে-চুকিয়ে ‘চুইচ চুইচ চুউ’ সুরে ডাকাডাকি করে। মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। কোথাও একদণ্ড দাঁড়ানোর জো নেই এ পাখির। রাজ্যের ব্যস্ততা নিয়ে দিন কাটায়। উড়ন্ত অবস্থায়ই শিকার ধরে। এরা দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বিস্তৃতি। দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্লিম গড়ন। নজরকাড়া রূপ। মায়াবীও বটে। এদের দিকে নজর পড়লে নিমিষেই চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য লম্বায় ১৬ সেন্টিমিটার। ঘাড়ে কালো প্যাঁচ। গলার নিচে সরু চিলতে কালো রেখা। পুরুষ পাখির প্রধান রং লালচে নীল। তবে নীলের আধিক্য বেশি থাকায় লালচে ভাবটা খুব একটা দেখা যায় না। বুক নীল। নীলটা ফ্যাকাসে হয়ে তলপেট পর্যন্ত সাদাটে হয়ে পৌঁছেছে। চোখ কালো। ঠোঁট নীল-কালো। পা ও পায়ের আঙ্গুল নীলচে কালো। মেয়ে-পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মেয়ে পাখির বর্ণ পুরুষের তুলনায় নিষ্প্রভ। তা ছাড়া গলায় কালো রেখা দেখা যায় না। এদের প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ। প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। গাছের তে-ডালায় পেয়ালা আকৃতির মজবুত বাসা বানিয়ে তিনটি ডিম পাড়ে। ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 29/08/2018
হলদে পা গাঙচিল | Yellow legged Gull | Larus cachinnans
হলদে পা গাঙচিল | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবলমাত্র শীতে প্রজাতির আগমন ঘটে। দেশে দেখা মেলে সুন্দরবন এলাকায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নিঝুমদ্বীপ ও মনপুরাতে। এছাড়াও খাবারের সন্ধানে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে বিচরণ করতে দেখা যায় এ সময়। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। এরা বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও বালুতটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদের। মরা মাছ খাওয়ার লোভে দ্বীপাঞ্চলের জেলে পল্লীতে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। নিজেদের মধ্যে খুঁনসুটি বেঁধে গেলে বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’। প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, ইসরাইল, সিরিয়া, তুরস্ক, সাইপ্রাস, সেনেগাল, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও ইংল্যান্ড পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে পা গাঙচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়লো-লেগড গাল’ (Yellow-legged Gull), বৈজ্ঞানিক নাম: Larus cachinnans| এরা ‘জল কবুতর’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫২-৬৮ সেন্টিমিটার। ডানা প্রসারিত অবস্থায় ১২০-১৫৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। মাথা, ঘাড় ও গলা ধবধবে সাদা। পিঠ ও ডানা ধূসর। তবে ডানায় সামান্য ফুটকি নজরে পড়ে। লেজে কালোর ওপর দু-একটি সাদা ফুটকি। দেহতল ধবধবে সাদা। ওড়ার পালক সাদা। চোখের বলয় লাল, তারা হলদেটে। ঠোঁট মোটা হলুদ। নিচের ঠোঁটের ডগা উজ্জ্বল লাল। পা ও আঙ্গুল হলুদ। প্রধান খাবার: মাছ। এছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড় খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মে পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে নিজ বাসভূমিতে। জলাশয়ের কাছাকাছি ভূমি অথবা পাথুরে এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৩১ দিন। শাবক শাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/11/2015
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
ধূসর আবাবিল | Ashy woodswallow | Artamus fuscus
ধূসর আবাবিল | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন, স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, মালয়েশিয়া ও চীন পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি রয়েছে। দেখা মেলে দেশের সর্বত্রই। বিশেষ করে রাস্তার পাশে বিদ্যুতের তারে দল বেঁধে বসে থাকে। রাতও কাটায় দল বেঁধে। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে নেড়া বৃক্ষের ডালে বসে রাতযাপন করে। স্বভাবে সঙ্ঘচারী পাখি। শূন্যে উড়ে উড়ে পতঙ্গ শিকার করে। বৃত্তাকারে উড়তে পারদর্শী এরা। এদের শিকারের উপযুক্ত সময় ভোরবেলা এবং গোধূলীলগ্নে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সারাদিন উড়তে থাকে, আর কর্কশ কণ্ঠে ডাকাডাকি করে। সুর শ্রুতিমধুর নয়। ডাকে ‘চেক-চেক-চেক’ শব্দে। ফসলের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে যথেষ্ট উপকার করে বিধায় কৃষকের বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এরা। উপকারী এ বন্ধুরা দিন দিন অসুলভ হয়ে পড়ছে নানা কারণে। এর মধ্যে প্রধান কারণটি হচ্ছে প্রজননে বিঘ্ন ঘটা। ওদের প্রজননের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বৃক্ষের অভাব দেখা দিয়েছে। যেমনি কমে গেছে পুরনো কোটরওয়ালা গাছ তেমনি কমে গেছে বড় বড় তাল গাছের সংখ্যাও। ফলে প্রজাতির সংখ্যা স্থিতিশীল রয়েছে। এক যুগ আগেও অমনটি ছিল না। দেখেছি যেখানে সেখানে। প্রজাতিটির সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ ঘটেছে আমার। তবে খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ হয়নি বিধায় লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি এতদিন। পরিশেষে যৎসামান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করেছি নেত্রকোনা জেলার এক পাঠক বন্ধুর অনুরোধে। তিনি এ প্রজাতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর আবাবিল’, ইংরেজি নাম: ‘এ্যাশি উড সোয়ালো’ (Ashy woodswallow), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আর্টামাস ফ্যুসক্যাস’ (Artamus fuscus)। এরা ‘মেটে বনাবাবিল’ বা ‘অঞ্জন পাখি’ নামেও পরিচিত। এরা লম্বায় ১৯-২১ সেন্টিমিটার। দেহের অধিকাংশ পালকই ধূসর। কেবল বুক থেকে নিচের দিকটা গোলাপি-ধূসর। লেজের ডগা সাদা। নিতম্বের ওপর রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকার সাদা বলয়। ঠোঁট রূপালি, ত্রিকোণাকৃতির। চোখের কোণে কাজল কালির টান। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: উড়ন্ত পোকামাকড়, ফড়িং, প্রজাপতি ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে কিংবা তাল গাছের ডালের গোড়াতে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে নরম ঘাস, চিকন লতা কিংবা গাছের শিকড় দিয়ে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
তুলিকা | Olive-backed pipit | Anthus hodgsoni
তুলিকা | ছবি: ইন্টারনেট দেখতে চড়–ই পাখির মতো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা চড়–ই নয়। পরিযায়ী পাখি এরা। প্রচণ্ড শীতে ইউরেশিয়া থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। শীত মৌসুমে দেশের সর্বত্রই এদের বিচরণ হলেও সংখ্যায় সন্তোষজনক নয়। বলা যায় অসুলভ। ঢাকা শহরেও দেখা যায়। বিশেষ করে মিরপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে মাঝে মাঝে নজরে পড়ে। হালকা বনাঞ্চল এলাকা এদের প্রিয়। আম-বাঁশ বাগানে বেশি নজরে পড়ে। জলপানের তৃষ্টা না পেলে জলাশয়ের ধারে-কাছে পারতপক্ষে ভিড়ে না। এরা ভীতু প্রকৃতির পাখি হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যের সন্ধানে মাটিতে নামে। এমতাবস্থায় ভয় পেলে ‘ছিস’ আওয়াজ করে উড়ে যায়। ভয় কেটে গেলে পুনরায় মাটিতে নেমে খাবার খায়। গান গায় ‘ছিপ-ছিপ-ছিয়া-ছিয়া’ সুরে। এ পাখি ছোট-বড় দলে আলো-আঁধারি ভূমির ওপর পোকামাকড় খোঁজে। বিশেষ করে মাঠে-ময়দানে দৌড়ে দৌড়ে শিকার ধরে। খঞ্জন পাখির মতো এরাও লেজ নাচায়। সারাক্ষণ নয়, মাঝে মধ্যে নাচায়। প্রথম সাক্ষাতে লেজ নাচানো অবস্থায় দেখি মিরপুরের চিড়িয়াখানায়। বন্দি অবস্থায় নয়। মুক্ত। চিড়িয়াখানার ফাঁকা জায়গায় ৩-৪টি পাখিকে খাবারের সন্ধানে দেখি কোনো এক শীতে। সময়টা নব্বই দশকের প্রথমার্ধে। তখনো পাখি পর্যবেক্ষণ করতে বনে-বাদাড়ে প্রবেশ করিনি। চোখের সামনে পড়লে দেখে নেই এ পর্যন্তই। আর বড়জোর চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশু-পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে নোট খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখি। সত্যি বলতে কি সে থেকেই মূলত আমি পাখি পর্যবেক্ষণ করার উৎসাহ বোধ করি। সে যাই হোক, পাখিটাকে দেখে প্রথমত খঞ্জন প্রজাতির পাখি ভেবেছি এবং আমার নোট খাতায় ওদের নাম ‘খঞ্জন পাখি’ লিখে রাখি। পরে ভুলটা শুধরে নিয়েছি রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামক গ্রন্থের শরণাপন্ন হয়ে। গ্রন্থ পাঠে জেনেছি ওদের সঠিক বাংলা নামটিও। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তুলিকা’, ইংরেজি নাম: ‘অলিভ ব্যাকেড পিপিট’(Olive-backed pipit), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthus hodgsoni| লম্বায় এরা ১৫ সেন্টিমিটার। লেজ ৬ সেন্টিমিটার। গলার পাশে কালো ডোরা। ঠোঁট ছোট। দেহের অধিকাংশ পালক সবুজাভ-জলপাই। তার ওপর চওড়া, খাটো ডোরা দাগ। ডানায় স্পষ্ট সাদা বন্ধনী। তলপেটের দিকে কোনো ধরনের রেখা নেই। লেজের তলার দিকটা সাদাটে। আবার লেজের দু’পাশের পালকও সাদাটে। চোখের বলয় সবুজাভ-জলপাই। ভ্রুর ওপরে সাদা ডোরা। পা হলুদাভ-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ঘাসবীজ ইত্যাদি। প্রজনন সময় মে-জুলাই। বাসা বানায় সরু-নরম লতা দিয়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/05/2013