লম্বাঠোঁটি শকুন | Cinereous Vulture | Aegypius monachus
লম্বাঠোঁটি শকুন | ছবি: ইন্টারনেট হিংস্র চেহারার মনে হলেও তত হিংস্র নয়। আকারে বড়সড়ো। অধিক ওজনের কারণে হাঁটাচলা করতে খানিকটা বেগ পেতে হয়। ভারিক্কিচালে হেলেদুলে কিংবা লাফিয়ে হাঁটাচলা করে। পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি নজরে পড়ে। দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, হিমালয় অঞ্চল, আফগানিস্তান, পর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্স, গ্রিস, স্পেন, তুরস্ক, মঙ্গোলিয়া, চীন পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘লম্বাঠোঁটি শকুন’, ইংরেজি নাম: ‘সিনেরিয়াস ভালচার’, (Cinereous Vulture) বৈজ্ঞানিক নাম: Aegypius monachus। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৯৮-১১০ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ২৫০-২৯৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৭-১২ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথা, পিঠ গাঢ় বাদামি সঙ্গে নীলচে ধূসরের মিশ্রণ রয়েছে। ঘাড় নীলচে ধূসর। ডানার পালক প্রান্ত কালচে বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। লেজ খাটো কালচে বাদামি। গলা ময়লা সাদা চামড়ায় আবৃত। দেহতল কালচে বাদামি। ঠোঁটের গোড়া নীলচে ধূসর, অগ্রভাগ কালো। ওপরের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। পা ধূসর হলেও গোলাপি আভা বের হয়। প্রধান খাবার: সব ধরনের মৃতদেহ বা উচ্ছিষ্ট খাবার শামুক, পাখির ডিম, ছোট পাখি, খরগোশ, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে উঁচু গাছের ডালে সরু লাঠি দিয়ে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৫০-৫৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/01/2018
সুরেলা ঝাড়ভরত | Singing Bush Lark | Mirafra cantillans
সুরেলা ঝাড়ভরত | ছবি: ইন্টারনেট দেশে মোট সাত প্রজাতির ‘ভরত পাখি’ দেখা যায়। তন্মধ্যে দুই প্রজাতি পরিযায়ী। বাদবাকিরা দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। এদের মধ্যে কেউ নাচিয়ে ভরত, কেউ গায়ক ভরত। তবে সব ধরনের ভরতই দেখতে চড়–ই পাখিদের মতো। আকার-আকৃতিও তদ্রুপ। এদের মধ্যে ‘সুরেলা ঝাড়ভারত’ অন্যতম গায়ক পাখি। কণ্ঠস্বর সুমধুর। দক্ষিণ এশিয়ায় কম-বেশি নজরে পড়ে। মূলত এরা শুষ্ক বেলে মাটিতে বিচরণ করে। বিশেষ করে নদ-নদীর তটে বা দ্বীপাঞ্চলের বেলাভূমিতে বেশি দেখা যায়। নিয়মিত গোসালাদি করে। ধুলোস্নান বেশি পছন্দ। ফসল কাটা হয়েছে এমন ক্ষেতেও ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করতে দেখা যায়। শরীর দুলিয়ে গান গাইতে গাইতে খাবারাদি খোঁজে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি বেশি বেশি গান গায়। বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও আইইউসিএন ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এদের। পাখির বাংলা নাম: ‘সুরেলা ঝাড়ভরত’, ইংরেজি নাম: ‘সিংগিং বুশলার্ক’ (Singing Bush Lark), বৈজ্ঞানিক নাম: Mirafra cantillans | এরা ‘গায়ক ভরত’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ১৩ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫-২১ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ ফ্যাকাসে-বাদামির সঙ্গে কালচে বাদামি ফোটা রয়েছে। লেজ খাটো। বুক, পেট ও লেজতল ফ্যাকাসে। ঠোঁট হালকা হলুদের সঙ্গে পোড়ামাটির আভা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের আঙ্গুল গোলাপি লাল। প্রধান খাবার: অমেরুদণ্ডী প্রাণী, ছোট পোকামাকড়, ঘাস বিচি, কচিঘাসের ডগা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে থেকে অক্টোবর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ঘাসবনে অথবা নলবনে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস-লতা, শুকনো ধানপাতা, খড়কুটো ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১০-১৩ দিন। শাবক উড়তে শেখে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/11/2016
হলদে পা গাঙচিল | Yellow legged Gull | Larus cachinnans
হলদে পা গাঙচিল | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবলমাত্র শীতে প্রজাতির আগমন ঘটে। দেশে দেখা মেলে সুন্দরবন এলাকায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নিঝুমদ্বীপ ও মনপুরাতে। এছাড়াও খাবারের সন্ধানে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে বিচরণ করতে দেখা যায় এ সময়। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। এরা বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও বালুতটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদের। মরা মাছ খাওয়ার লোভে দ্বীপাঞ্চলের জেলে পল্লীতে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। নিজেদের মধ্যে খুঁনসুটি বেঁধে গেলে বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’। প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, ইসরাইল, সিরিয়া, তুরস্ক, সাইপ্রাস, সেনেগাল, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও ইংল্যান্ড পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে পা গাঙচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়লো-লেগড গাল’ (Yellow-legged Gull), বৈজ্ঞানিক নাম: Larus cachinnans| এরা ‘জল কবুতর’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫২-৬৮ সেন্টিমিটার। ডানা প্রসারিত অবস্থায় ১২০-১৫৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। মাথা, ঘাড় ও গলা ধবধবে সাদা। পিঠ ও ডানা ধূসর। তবে ডানায় সামান্য ফুটকি নজরে পড়ে। লেজে কালোর ওপর দু-একটি সাদা ফুটকি। দেহতল ধবধবে সাদা। ওড়ার পালক সাদা। চোখের বলয় লাল, তারা হলদেটে। ঠোঁট মোটা হলুদ। নিচের ঠোঁটের ডগা উজ্জ্বল লাল। পা ও আঙ্গুল হলুদ। প্রধান খাবার: মাছ। এছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড় খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মে পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে নিজ বাসভূমিতে। জলাশয়ের কাছাকাছি ভূমি অথবা পাথুরে এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৩১ দিন। শাবক শাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/11/2015
নাকতা হাঁস | Knob billed duck | Sarkidiornis melanotos
নাকতা হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। হালে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। তবে সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য। বলা যায় বিরল দর্শন। অথচ একটা সময়ে এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল এরা। শীতে বর্তমানে সিলেট বিভাগের আর্দ্রভূমি এবং হাওর এলাকায় কিছু নজরে পড়ে। শুধু প্রজনন সংকটের কারণে ‘নাকতা হাঁস’ এ দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। মূলত এরা বাদাভূমি বা নলবন এলাকার বাসিন্দা। বিচরণ করে পারিবারিক দলে। দলে প্রায় ৭০-৮০টি পাখি দেখা যায়। অগভীর জলাশয়ে সাঁতরিয়ে শিকার খোঁজে। মাথা ডুবিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। বিপদ সংকেত পেলে জলে ডুবাতে থাকে। বেগতিক দেখলে গাছের ডালে গিয়ে বসে। এরা তেমন হাঁকডাকে অভ্যস্ত নয়। প্রজনন মুহূর্তে পুরুষ পাখি নিচু স্বরে ব্যাঙের মতো ডাকাডাকি করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ছাড়াও এদের দেখা যায় ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশে মহাবিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিতও রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘নাকতা হাঁস’, ইংরেজি নাম: Knob-billed duck, বৈজ্ঞানিক নাম: Sarkidiornis melanotos| এরা ‘বোঁচা হাঁস’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ৫৬-৭৬ সেন্টিমিটার। ওজন ২.২ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় ও আকারে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও গলা সাদা। গলায় সাদার ওপর ছোট ছোট কালো তিলা। ঠোঁট কালো। ঠোঁটের গোড়ায় স্ফীত মাংসের কালো লতিকা। পিঠ দেখতে কালো মনে হলেও আসলে তা নীলাভ। পিঠ থেকে সবুজ-বেগুনি আভা বের হয়। ডানা কালচে। দেহতল সাদাটে। অন্যদিকে স্ত্রী পাখি আকারে খানিকটা ছোট। পিঠে অনুজ্জ্বল ছিটানো বাদামি ফোঁটা। ঠোঁটের গোড়ায় স্ফীত মাংসের লতিকা নেই। উভয় পাখির ঠোঁট কালো ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেহের উপরাংশ অনুজ্জ্বল, দেহতল লালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকা-মাকড়, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয়ের কাছাকাছি পুরনো গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন ডালপালা, ঘাস, শুকনো পাতা ও পালক। ডিম পাড়ে ১০-১৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/06/2014
ছোট বাবুইবাটান | Small pratincole | Glareola lactea
ছোট বাবুইবাটান | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন, স্থানীয় প্রজাতির পাখি ‘ছোট বাবুইবাটান’। বাংলাদেশ ছাড়াও দেখা মেলে ভারত, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে বালুচরে। পদ্মা ও যমুনার চরে ব্যাপক দর্শন মেলে। এ ছাড়াও নদ-নদী কিংবা মোহনার দ্বীপাঞ্চলে অথবা সৈকতের বেলাভূমিতে শিকার খুঁজে বেড়াতে দেখা যায়। হাঁটাহাঁটি করে খুব দ্রুততার সঙ্গে। আবার অনেকে মিলে জলের কিনারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। একটা সময় এসে একেবারেই চুপচাপ থাকে, দূর থেকে দেখলে মনে হয় তখন বুঝি ওরা প্রার্থনারত রয়েছে। ওড়ে খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। তবে সোজাসুজি না উড়ে এঁকেবেঁকে ছান্দসিক তালে ওড়ে। তেমনিভাবে উড়ে উড়ে এরা শিকারের পিছু নেয়। মানুষ অথবা অন্য যে কোনো বন্যপ্রাণী ওদের বাসার কাছাকাছি গেলে মাথার ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে চক্কর দিতে থাকে। এতে করে ওরা আরো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ওদের বাসার অবস্থান শনাক্ত হয়ে যায়। আর শত্রুপক্ষ সে সুবাদে ওদের ডিম-বাচ্চার ক্ষতি করার করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়ে যায়। যার ফলে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটে ব্যাপক। ছোট বাবুইবাটানদের কণ্ঠস্বর সুমধুর নয়। ‘টিক টিক টিক… টাক টাক টাক’ আওয়াজ করে। উত্তেজিত হলে কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে। স্বর তখন আরো কর্কশ হয়ে ওঠে। পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট বাবুইবাটান’, ইংরেজি নাম: ‘স্মল প্রাটিনকোল’, (Small pratincole), বৈজ্ঞানিক নাম: Glareola lactea| লম্বায় ১৬-১৭ সেন্টিমিটার। কপাল হালকা বাদামি। চোখের কোণ থেকে ঠোঁটের গোড়া পর্যন্ত কাজলটান। ঠোঁট নীলাভ কালো, গোড়ার দু’পাশ লাল। চোখের বলয় সাদা, তারা নীলাভ। পিঠ বালুধূসর। ডানার দিকে হালকা বাদামির ওপর লালচে আভা। ডানার প্রান্ত কালো। ওড়ার পালক কালো। লেজের কিনারটা কালো। দেহতল সাদা। পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে উড়ন্ত কীটপতঙ্গের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম ডিসেম্বর থেকে মার্চ। কোনো কোনো অঞ্চলে মার্চ থেকে এপ্রিলে বাসা বাঁধে (অঞ্চলভেদে সময়ের হেরফের লক্ষ্য করা যায়)। বাসা বাঁধে বেলাভূমি কিংবা পাথুরে এলাকায়। একাকী কিংবা কলোনি টাইপের বাসা বানাতেও দেখা যায়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/09/2014
মরিচা কপাল ডোরাডানা | Rusty fronted Barwing | Actinodura egertoni
মরিচা কপাল ডোরাডানা | ছবি: ইন্টারনেট মাথায় চমৎকার ঝুঁটি। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। দেখতে বুলবুলি পাখির মতো মনে হতে পারে। আসলে এরা বুলবুলি প্রজাতির কেউ নয়। প্রজাতিটি দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র দেখা যায় না। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নাতিশীতোষ্ণ এলাকার ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্য। এ ছাড়া লতাগুল্মের ঝোপ কিংবা সুঁচালো চিরহরিৎ বনে বিচরণ রয়েছে। এরা একাকি বিচরণ করে না বললেই চলে। ছোট দলে বিচরণ করে। দলে কমপক্ষে ৬ থেকে ১২টি পাখি দেখা যায়। শুধু প্রজনন মৌসুমে দলত্যাগ করে জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। এদের চেহারা রাগীরাগী হলেও স্বভাবে হিংস নয়। দলের সবাই একত্রে বা মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল (হিমালয়ের পাদদেশ), ভুটান, পশ্চিম মিয়ানমার, চীন (ইউনান) পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান খুব বেশি সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরিচা কপাল ডোরাডানা’, ইংরেজি নাম: ‘রাস্টি ফ্রন্টেড বারউইং’ (Rusty-fronted Barwing), বৈজ্ঞানিক নাম: Actinodura egertoni | এরা ‘লালমুখ দাগিডানা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ২২-২৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৩-৩৮ গ্রাম। কপাল মরিচা লাল। মাথা ও ঝুঁটি ডার্ক-বাদামি। পিঠ পাটকিলে। ডানা পাটকিলের সঙ্গে সাদা-কালো মিশ্র ডোরাদাগ। লেজ পাটকিলে হলেও অগ্রভাগ কালচে, নিচের পালকের অগ্রভাগ সাদা। থুতনি মরিচা-লাল। দেহতল বাদামি-ধূসর। ঠোঁট খাটো হলদেটে ত্বক বর্ণ। পা ত্বক বর্ণের। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ফড়িং, বীজ, কচিপাতা। ছোট ফলের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। ভূমি থেকে ৬ মিটার উচ্চতার মধ্যে কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস-লতা, শৈবাল, ফার্ন, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদওপরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/12/2016
বালিহাঁস | Cotton Pygmy goose | Nettapus coromandelianus
বালিহাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বিশেষ করে পুরুষ পাখিটির রূপ অতুলনীয়। চেহারাটাও বেশ মায়াবী। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। এমনিতেই তো দেখতে ভীষণ সুন্দর তার ওপর আরো সুন্দর লাগে তখন। এরা উড়তে উড়তেই ডাকে। ‘ডিক ডিক, ডিরিক ডিরিক’ সুরে আওয়াজ করে জলাশয় বা গাছ-গাছালির ওপর চক্কর মারে। আমাদের দেশে এক সময়ে যত্রতত্র দেখা যেত। বর্তমানে হাওরাঞ্চল বা বড় ধরনের জলাশয় ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না। পাখি নিধনকারীদের অধিক লোভের কারণে আজ ওরা হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ একটা সময়ে এ পাখিরা যত্রতত্র বিচরণ করত দেশে। বিচরণ করতে দেখেছি আমার বাল্য বেলায় নানাবাড়ির পুকুরে। মামার মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি এ পাখির সঙ্গে তখন। এক মামা ধরার চেষ্টাও করেছেন। অধিক চাতুরিতার কারণে ফাঁদে ফেলতে পারেননি। এ পাখি সাধারণত মরা তাল, নারিকেল, খেজুর গাছের প্রাকৃতিক গর্তে বাসা বাঁধে। তবে ওদের প্রথম পছন্দ তালগাছ, দ্বিতীয় পছন্দ নারিকেল গাছের কোটর। এসব মরাগাছের মাথায় বৃষ্টির জল জমে প্রকৃতিগতভাবে গর্তের সৃষ্টি হলে এরা সেখানে বাসা বাঁধে। আমাদের দেশের বিশিষ্ট পাখি গবেষক শরীফ খান এ পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি নিজের তত্ত্বাবধানে এদের ডিম মুরগির তা দিয়ে ফুটিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাচ্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, তিনদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল।’ এ পাখির বাংলা নাম: ‘বালিহাঁস,’ ইংরেজি নাম: ‘কটন পিগমি গুজ বা কটন টিল,’ (Cotton Pygmy-goose or Cotton Teal) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘নেট্টাপাস কোরোমানডেলিয়ানাস,’ (Nettapus coromandelianus) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা বেলেহাঁস নামেও পরিচিত। বালিহাঁস লম্বায় ৩০-৩২ সেন্টিমিটার। আমাদের দেশের হাঁস প্রজাতির মধ্যে এরা সবচেয়ে ছোট আকৃতির। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাথার তালু পর্যন্ত কালো। পুরুষ পাখির গলার নিচে চওড়া কালো ফিতার মতো বন্ধনী রয়েছে। পিঠ, ডানা কালো। চোখের চারপাশ, বুক, পেট সাদা। লেজের আগা কালচে। সূর্যের আলো পড়লে উজ্জ্বল সবুজের আভা ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় অনেকখানি নিষ্প্রভ। ওদের গলায় সুদৃশ্য বন্ধনী নেই। গায়ের বর্ণ হালকা বাদামি ও সাদার মিশেল। আকারে পুরুষের চেয়ে সামান্য ছোট। বালিহাঁসের প্রিয় খাবার জলজ পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদের কচিডগা, শস্যবীজ ও ছোট মাছ। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। মরা নারিকেল, তাল, খেজুরগাছের কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৮-১২টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭দিন। ডিম থেকে বেরুলেই শাবক গাছের কোটর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে। অনেক সময় গাছের গর্ত গভীর হলে মা-বাবা ঠোঁট দিয়ে ঠেলে ওদের গর্ত থেকে বের করে দেয়। বালিহাঁসের বাচ্চারা ভীষণ দুষ্টু। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/11/2013