উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস | Northern Pintail | Anas acuta
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। সুলভ দর্শন। শীতে দেশের উপকূলীয় এলাকার নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিল-ঝিলে ছোট-বড় ঝাঁকে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারত পর্যন্ত এর বিচরণ ক্ষেত্র। বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। এরা ভোরে ও গোধূলিলগ্নে শিকারে ব্যস্ত থাকে। শিকার খোঁজে মাথা ডুবিয়ে, লম্বা লেজটা উঁচানো থাকে তখন। পুরুষ পাখি ডাকে, প্রিউ…প্রিউ সুরে। স্ত্রী পাখির সুর ভিন্ন। ডাকে, কিউয়্যাহ…কিউয়্যাহ সুরে। স্বভাবে শান্ত। প্রজনন মৌসুমে নিজ বাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। পাখির বাংলা নাম: ‘উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘নর্দার্ন পিনটেইল’(Northern Pintail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস আক্যুটা’(Anas acuta), গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। পিনাকৃতির লেজের কারণে এদেরকে অনেকে ‘পিনপুচ্ছ’ নামেও ডাকে। লম্বায় পুরুষ পাখি ৫৯ থেকে ৭৬ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫১ থেকে ৬৪ সেন্টিমিটার। গলা সরু। পুরুষ পাখির লেজ লম্বা ও চোখা। প্রজনন মৌসুমে রঙ বদলায় পুরুষ পাখির। তখন মাথা, মুখ ও ঘাড় চকোলেট-বাদামি রঙ ধারণ করে। ঘাড়ের দু’পাশ দিয়ে সাদা পট্টি সরু থেকে চওড়া হয়ে বুক পেট অবধি নেমেছে। পিঠ তামাটে।ডানার কিনারের পালক তামাটে-সবুজ মিশ্রণ। ডানার ঢাকনি কালো। দেহের পাশ থেকে দেখা যায় মিহি ধূসরাভ রেখাবৃত। বস্তিপ্রদেশ কালো। স্ত্রী পাখির রঙ ও আকার ভিন্ন। মাথা ও ঘাড় বাদামি। শরীর সামান্য পীতাভ রঙের ওপর চিত্রবিচিত্র আঁকা। আকারে ছোট। উভয়ের ঠোঁট সিসে-ধূসর। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদ। ছোট পোকামাকড়েও অরুচি নেই। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। সাইবেরিয়া-মঙ্গোলিয়ার উত্তরাঞ্চলের আর্দ্রভূমিতে ঘাস-লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৭-৯টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/11/2013
খয়রা কাস্তেচরা | Glossy ibist | Plegadis falcinellus
খয়রা কাস্তেচরা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল পরিযায়ী পাখি। দেশে কালেভদ্রে দেখা মিলে। এই প্রজাতির বিস্তৃতি উত্তর-দক্ষিণ-মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়া পর্যন্ত। বাংলাদেশে প্রচণ্ড শীতে দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। তবে বাংলাদেশে আসার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে না এরা। আকৃতিতে বেশ বড়সড়ো। দেখতেও চমৎকার। ভারিক্কি চলন-বলন। স্বভাবে শান্ত। কণ্ঠস্বর কর্কশ। সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলের মিঠা পানির অগভীর জলাশয়ে কিংবা মোহনাতে বিচরণ করে। বিশেষ করে জলজ উদ্ভিদ অথবা কৃষি জমিতে একাকী বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। ঘন উদ্ভিদ সমৃদ্ধ জলাশয় এড়িয়ে চলে। স্যাঁতসেঁতে তৃণভূমিতেও শিকার খোঁজে। শিকার খুঁজতে গিয়ে হাঁটু জলের বেশি নামে না। এরা ঝাঁক বেঁধেও বিচরণ করে। রাতে অন্যসব প্রজাতির সঙ্গে একই গাছে বিশ্রাম নেয় ঝাঁক বেঁধে। বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয়। বিশেষ করে কৃষি জমিতে অধিক কীটনাশকের ব্যবহার এবং এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে প্রজাতিটি হুমকির মুখে রয়েছে। সব মিলিয়ে বিবেচনা করে প্রজাতিটিকে আইইউসিএন ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘খয়রা কাস্তেচরা’, ইংরেজি নাম: ‘গ্লসি ইবিস’ (Glossy ibis), বৈজ্ঞানিক নাম: Plegadis falcinellus | এরা ‘চকচকে দোচরা’ নামেও পরিচিত। গড় দৈর্ঘ্য ৪৮-৬৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৪৮৫-৫৮০ গ্রাম। মাথা গাঢ় বাদামি। মুখাবয়ব কালো। ঘাড় থেকে পিঠের মাঝ বরাবর লালচে-খয়েরি। ডানা ও লেজ চকচকে বেগুনি-সবুজ। যা থেকে উজ্জ্বল আভা বের হয় প্রতিনিয়ত। লেজ খাটো। দেহতল লালচে-খয়েরি। প্রজনন পালক ভিন্ন। হলদে-বাদামি ঠোঁটটি নিচের দিকে কাস্তের মতো বাঁকানো। লম্বা পা লালচে-বাদামি। চোখের দুই পাশে দুটি তির্যক নীলাভ টান ঠোঁটের গোড়ায় মিলিত হয়েছে। স্ত্রী-পুরুষের চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে রঙে সামান্য তফাত রয়েছে। ওদের ঘাড়ের ওপরে বেশ কিছু সাদা রেখা, গলা সাদাটে, পা কালচে দেখায়। প্রধান খাবার: শূককীট, কেঁচো, ছোট সাপ, টিকটিকিসহ বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ এবং মাঝে মধ্যে মাছও শিকার করে। এ ছাড়াও মৌসুমভেদে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনশীল। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে সময়ের হেরফের দেখা যায়। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর। জলাশয়ের কাছাকাছি গাছের উঁচু ডালে (সাত মিটারের মধ্যে) সরু কাঠি বা ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 21/09/2021
চিতিপাক গোশালিক | Spot winged Starling | Saroglossa spiloptera
চিতিপাক গোশালিক | ছবি: ইন্টারনেট বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাস্থল পরিষ্কার বনপ্রান্ত, খোলা বন, কৃষিজমি। এ ছাড়াও পর্বতের ৭০০-১০০০ মিটার উঁচুতে দেখা যায়। দেশে যত্রতত্র দেখা যায় না। বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। বিচরণ করে ছোট দলেও। স্বভাবে অন্যসব শালিকের মতোই ঝগড়াটে। সারাদিন খুনসুটি করে কাটায়। তবে ওদের ঝগড়া খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় না, কিচির-মিচির পর্যন্তই ঝগড়া। পরক্ষণে আবার মিলেও যায়। আবার শুরু। এভাবেই দিন কাটে। পারতপক্ষে কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি। বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘চিতিপাক গোশালিক’, ইংরেজি নাম: ‘স্পট-উইংড স্টার্লিং’ (Spot-winged Starling), বৈজ্ঞানিক নাম: Saroglossa spiloptera। এরা ‘লালচেগলা শালিক’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১০ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে: গো-শালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, পাতি কাঠশালিক, গোলাপি কাঠশালিক, চিতিপাখ গোশালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, বামুন কাঠশালিক ও ধলাতলা শালিক। এরা লম্বায় ১৯-২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা বাদামি। ঘাড় ও পিঠ ধূসর এবং কালো-বাদামি। ডানার প্রান্ত নীলাভ কালো। লেজ লালচে বাদামি। গলা লালচে। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদাটে। বুকের দু’পাশ শেয়ালে লাল। ঠোঁট নীলাভ কালো। চোখের বলয় সাদা। পা বেগুনি কালো। দেখতে একই রকম মনে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ। আকারেও সামান্য ছোট। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, পিঁপড়া, ছোট ফল, ফুলের মধু। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। বাসা বাঁধে ৬-১০ মিটার উচ্চতার গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, লতাপাতা, দড়ি, কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/08/2017
ভেকঠোঁটি রাতচরা | Hodgson’s Frogmouth | Batrachostomus hodgsoni
ভেকঠোঁটি রাতচরা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন ‘ভেকঠোঁটি রাতচরা’। বিচরণ করে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ৩০০-১৯০০ মিটার উচ্চতার পাহাড় কিংবা ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনে। এ ছাড়া মিশ্র চিরসবুজ বনে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে খুব একটা দেখার নজির নেই। আমাদের পূর্বসূরি পাখি বিশারদের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, এক সময় মধুপুর বনে এদের বিচরণ ছিল। তবে খুব বেশি দেখার তথ্য নেই। প্রজাতিটি দেখতে কুৎসিত, ভয়ঙ্কর চেহারার। মূলত এদের মুখের গঠন অনেকটাই ব্যাঙ আকৃতির। নামকরণেও সে রকমটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রজাতির দেহের বর্ণের সঙ্গে গাছের মরা ডালপালা কিংবা শুকনো লতা-পাতার যথেষ্ট মিল রয়েছে। যার ফলে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশে লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে বের করা মুশকিল। এরা নিশাচর পাখি। দিনের বেলায় ঘুমিয়ে কাটায়। রাতের আঁধার নেমে এলে কেবল শিকারে বের হয়। বেশির ভাগ একাকী শিকারে বের হয়। উড়ন্ত পোকামাকড় দেখলে ছোঁ মেরে মুখে পুরে ফেলে। প্রিয় পাঠক, ‘রাতচরা’ বা ‘নাইটজার’ প্রজাতির পাখির চেহারায় তত আকর্ষণ নেই। অনেকে এদের পেঁচা বলে ভুল করে থাকেন। আসলে এরা পেঁচাদের স্বজন নয়। আমাদের দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির রাতচরা পাখি দেখা গেলেও ব্যাঙমুখো প্রজাতির পাখি শুধু এরাই। পর্যায়ক্রমে আমরা রাতচরা প্রজাতির অন্যদের নিয়েও লেখার চেষ্টা করব। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিরল দর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ভেকঠোঁটি রাতচরা’, ইংরেজি নাম: ‘হজসন’স ফ্রগমাউথ’(Hodgson’s Frogmouth), বৈজ্ঞানিক নাম: Batrachostomus hodgsoni | এরা ‘হজসনি ব্যাঙমুখো’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৬-২৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির ঘাড় এবং গলায় সাদা ফোঁটা। পিঠ ধূসরাভ-বাদামি। পেটের দিকে এলোমেলো সাদা। লেজের ওপর ধূসর বলয়। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির ঘাড়ে সাদা ফোঁটা। পিঠ গাঢ় লালচে-বাদামি। পেটে অসংখ্য সাদা ফোঁটা। দেহের অন্যত্র দাগ বা ফোঁটা নেই। উভয়ের ডানা খাটো, লেজ লম্বা এবং মুখ-মাথায় সামান্য লোম দেখা যায়। চোখ বাদামি। ঠোঁট বাদামি-কালচে। প্রধান খাবার: উড়ন্ত পতঙ্গ বা পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের ডালে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/03/2015
ধলালেজ ঈগল | White-tailed Eagle | Haliaeetus albicilla
ধলালেজ ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট ধলালেজ ঈগল পরিযায়ী সামুদ্রিক পাখি। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জলাশয় নদ-নদীর মোহনায় এদের সাক্ষাৎ মেলে। দেশের বিচরণরত ঈগল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আকারে সর্ববহৎ। খানিকটা হিংস্রও। অন্যসব শিকারী পাখিদের খাবার চিনিয়ে নিতে ইতস্ততবোধ করে না। শিকারের লোভে জলের ২০-৩০ মিটার ওপরে ধীর গতিতে বৃত্তাকারে উড়ে বেড়ায়। শিকার নজরে পড়লে ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ের তীক্ষè নখে বিঁধিয়ে নিয়ে উড়ন্ত অবস্থায় খেয়ে ফেলে। এ ছাড়াও গাছের ডালে অথবা মাটিতে নেমে খাবার খেতে দেখা যায়। সুযোগ পেলে এরা গবাদি পশুর মৃতদেহও খায়। এরা অনায়াসে সমুদ্র-সমতল থেকে ১৫০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি সাইবেরিয়া, আলাস্কা, নরওয়ে, স্কল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড পর্যন্ত। দেশে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন এ প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ধলালেজ ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট টেইলড ঈগল’ (White-tailed Eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: Haliaeetus albicilla | এরা ‘সাদালেজী ঈগল’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে ৬৬-৯৪ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৪-৫ কেজি। মাথা ফ্যাকাসে বাদামি। পিঠ গাঢ় বাদামি। কোমর কালো। লেজ সাদা। বুক ও পেট ফ্যাকাসে বাদামি। ওড়ার পালক কালো। হলুদ রঙের ঠোঁট শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। পা বাদামি পালকে আবৃত। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। অপ্রাপ্ত বয়য়স্কদের রঙ ভিন্ন। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, ইঁদুর, ভোঁদড় ও পানকৌড়ি। অন্যসব পাখির চেয়ে জলচর পাখি বেশি ওদের শিকারে পরিণত হয়। প্রজনন সময় মার্চ থেকে এপ্রিল। তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। ডালপালা দিয়ে বড়সড়ো অগোছালো বাসা বানায়। এক বসায় বহু বছর ধরে ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৮-৪০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৬-১০ সপ্তাহ এবং প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৪-৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/06/2016
ছোট পানকৌড়ি | Little Cormoran | Phalacrocorax niger
ছোট পানকৌড়ি | ছবি: ইন্টারনেট পাখিটার বর্ণ কাক কালো। দূর থেকে দেখতে কাকই মনে হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। এমনকি কাক গোত্রীয়ও কেউ নয়। তারপরও নামের শেষে অনেকে যোগ করে দেয় ‘কাউয়া’। এটি দেশীয় পাখি। একযুগ আগেও আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের পুকুর কিংবা জলাশয়ে এদের উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া। বর্তমানে যত্রতত্র দেখা না গেলেও বর্ষাকালে হাওর-বাঁওড়, নদীতে সন্তোষজনকহারে বিচরণ করতে দেখা যায়। শীতকালে নদী বা জলাশয়ের তীরে কঞ্চি অথবা লাঠিসোঁটায় বসে পাখা মেলে রোদ পোহাতে দেখা যায়। কিছু সময় গায়ে রোদ লাগিয়ে ঝপাত করে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। তারপর ডুব সাঁতার দিয়ে পিছু নেয় মাছের। শিকার ধরতে পারলে ভুস করে ভেসে ওঠে জলের ওপরে। ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরা মাছটাকে গলাটানা দিয়ে গলাধঃকরণ করে। এরা একটানা দীর্ঘক্ষণ ডুবাতে পারে বলে অনেকেই এদের ডুবুরি পাখি নামে ডাকে। এ পাখিদের সঙ্গে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের একটা ব্যাপার-স্যাপারও জড়িয়ে আছে। আছে অনেক কবিতায়, উপন্যাসেও এদের চরিত্র। আমার নিজের লেখা একাধিক (বারোটি গল্প-উপন্যাসে) গ্রন্থেও এদের চরিত্র বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এতই প্রিয় এ পাখি আমার কাছে। অথচ পাখিটির বর্ণ কুচকুচে কালো। চেহারাটা মায়াবী না হলেও দেখতে বিরক্ত লাগে না। কেন জানি একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে পাখিটাকে। শিকারিরা এদের বাগাড়ে পেলে সহজে পিছু ছাড়ে না। কারণ এ পাখির মাংস বেশ মজাদার। অনেকটা হাঁসের মাংসের মতো। মাংসের লোভে নির্দয়ভাবে একবার একটি পাখিকে গুলি করে মেরেছি প্রায় দুই যুগ আগে। ক্ষমাপ্রার্থী প্রকৃতির কাছে তাই আমি। পাখিটার বাংলা নাম: ‘ছোট পানকৌড়ি’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল করমোর্যান্ট’ (Little Cormoran), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ফালাক্রোকোরাক্স নিগার’ (Phalacrocorax niger), গোত্রের নাম: ‘ফালাক্রোকোরাসিদি’। অঞ্চলভেদে এ পাখিদের ডাকা হয়, পানিকাবাডি, পানিকাউর, পানিকাউয়া, পানিকুক্কুট ইত্যাদি। আমাদের দেশে তিন ধরনের পানকৌড়ির সাক্ষাৎ মেলে। যথাক্রমে : বড় পানকৌড়ি, মাঝারি পানকৌড়ি ও ছোট পানকৌড়ি। এ পাখি লম্বায় ৪৮-৫০ সেন্টিমিটার। এদের শরীরটাই কালো পালকে আবৃত। সূর্যালোকে পিঠ থেকে নীলাভ-সবুজের আভা বের হয়। অন্য সময় ধূসর কালো দেখায়। গলা মলিন সাদা। ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো, বর্ণ কমলা হলদে তবে ডগা কালো। পা হাঁসের পায়ের পাতার মতো জোড়া লাগানো। চোখ লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার মাছ। ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড়ও খায়। প্রজনন সময় জুন থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে শুকনো ডালপালা দিয়ে। পানকৌড়িরা দলবদ্ধভাবে বাসা বাঁধে। দেখা গেছে একই গাছে অসংখ্য দম্পতি বাসা তৈরি করছে। বাসার শ্রীছাদ নেই। ডিমের সংখ্যা ৪-৫টি। ডিম ফোটে ১৭-১৯ দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/10/2012
সিঁদুরে ফুলঝুরি | Scarlet backed flowerpecker | Dicaeum cruentatum
সিঁদুরে ফুলঝুরি | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি ‘সিঁদুরে ফুলঝুরি’। শরীরে বাহারি রঙের পালক। চেহারা বেশ আকর্ষণীয়। এক কথায় সুদর্শন প্রজাতির পাখিদের কাতারে পড়ে ওরা। আকারে চড়ই পাখির চেয়েও খাটো। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র নিুভূমির জঙ্গলে অথবা বৃক্ষাচ্ছাদিত এলাকায় বিচরণ করে। বাংলাদেশে যত্রতত্র নজরে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামীণ বনাঞ্চলে বেশি দেখা যায়। দেখা যায় গেরস্তের সাজানো বাগানেও। অথবা বাড়ির আঙিনার লাউ-কুমড়া কিংবা ঝিঙেলতার ঝোপে নাচানাচি করতে দেখা যায়। অর্থাৎ যেখানে ফুল সেখানে ফুলঝুরি পাখির সমাহার। ফুলের মধু এদের প্রধান খাবার। মধুপানের নেশায় সারা দিন ব্যস্ত সময় পার করে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। অস্থিরমতি পাখি। কোথাও একদণ্ড বসে থাকার সময় নেই। ছোট গাছ-গাছালি কিংবা লতাগুল্মের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে শিস কাটে। মিষ্টি সুরে গান গায় ‘চিপ…চিপ… বা ঝিট…ঝিট…’ সুরে। সুর শুনতে মন্দ নয়। সিঁদুরে ফুলঝুরি পাখিদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। বাংলাদেশে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। ভূমি থেকে এদের বাসা কাছাকাছি বিধায় বিড়াল বা বনবিড়ালের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। তথাপিও দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে ওরা। পাখির বাংলা নাম: ‘সিঁদুরে ফুলঝুরি’, ইংরেজি নাম: ‘স্কারলেট ব্যাকেট ফ্লাওয়ারপেকার’ (Scarlet-backed flowerpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Dicaeum cruentatum | এরা ‘লালপিঠ ফুলঝুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৭-৯ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির কপাল থেকে শুরু করে ঘাড়ের মাঝ বরাবর সোজা পিঠ দিয়ে লেজ ঢাকনি পর্যন্ত সিঁদুরে লাল পালকে আবৃত। মাথার এবং ঘাড়ের দুপাশ ডানা এবং লেজ কালো। দেহের দুপাশ নীলাভ-ধূসর। দেহতল বাদামি-হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির উপরের অংশ ধূসরাভ-বাদামি। নিতম্ব লাল। উভয়ের ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার ফুলের মধু ও বিচি। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ভূমি থেকে দুই-আড়াই মিটার উঁচুতে গাছের ডালে অথবা গুল্মলতা আচ্ছাদিত ঝোপে ঝুলন্ত থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের নরম তন্তু, তুলা, শ্যাওলা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 21/12/2018