পাতি চখাচখি | Common Shelduck | Tadorna tadorna
পাতি চখাচখি | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, চীন, তিব্বত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান ও ইরাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও সুলভ দর্শন। দর্শনীয় চেহারাও বটে। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশের প্রায় বিভাগেরই নদ-নদীতে কম-বেশি বিচরণ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে কিংবা মোহনাতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যের সন্ধানে বড় বড় দলে বিচরণ করে অগভীর জলাশয়ে। শিকার কৌশল দেশীয় গোত্রের পাতি হাঁসের মতো। সাধারণত এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের কলহ-বিবাদ ঘটায় না। বলা যায় সারাদিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। পুরুষ পাখি পারতপক্ষে তেমন ডাকাডাকিও করে না। স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নিচু গলায় শিস কাটে। সঙ্গী জবাব দেয় তখন ‘গ্যাগ-গ্যা-গ্যা’ সুরে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতিটি দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা আরেকটু সদয় হলে বোধ করি এদের আগমন আরো বেশি বেশি ঘটবে দেশে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি চখাচখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন শেল ডাক’ (Common Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না টাডোর্না’, (Tadorna tadorna) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। অনেকে ‘শাহ চখা বা সাচ্কা’ নামেও ডাকে। দেশে দুই প্রজাতির চখাচখি নজরে পড়ে। যথা: খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। এরা লম্বায় ৫৮-৬৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১ কেজি। কপাল, মাথা ও গলা ধাতব সবুজ। ঠোঁট রক্ত লাল, গোড়া স্ফীত লাল পুঁটলি। বুক ও ঘাড়ে সাদার ওপর পাটকিলে চওড়া বন্ধনী। পিঠ ধবধবে সাদা। ডানা কুচকুচে কালো। লেজ ও কোমর সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা মেটে-লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী পাখি খানিকটা ছোট। এ ছাড়াও স্ত্রী পাখির বুকে পাটকিলে বর্ণের প্রান্তটা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার তালু, গলার পেছন ও পিট কালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: জলজ কীট, ছোট শামুক, চিংড়ি, ধান, শৈবাল, কেঁচো, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। মধ্য এশিয়ার পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে প্রাকৃতিক ফাটলে কিংবা মাটির প্রাকৃতিক গর্তে পালক দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/04/2014
সাদা ডানা লালগির্দি | Daurian Redstart | Phoenicurus auroreus
সাদা ডানা লালগির্দি | ছবি: ইন্টারনেট শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়া পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নদ-নদীর কাছাকাছি ঘন ঝোপ-জঙ্গল। এরা দোয়েল আকৃতির পাখি। পুরুষ পাখি দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্ত্রী পাখির চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির মনে হয়। প্রজাতির কণ্ঠস্বর সুমধুর। এদের খাদ্য গ্রহণে বাছবিচার রয়েছে। যেমন গ্রীষ্মে পোকামাকড় এবং শীতে বীজ বা উদ্ভিজ খাবার খায়। সমগ্র বিশ্বে প্রজাতির অবস্থান তত সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে প্রজাতিটি হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাডানা লালগির্দি’, ইংরেজি নাম: ‘ডাউরিয়ান রেডস্টার্ট’ (Daurian Redstart), বৈজ্ঞানিক নাম: Phoenicurus auroreus | এরা ‘ডাউরিয়ান গির্দি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১১-২০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা, গলা, ঘাড় ও পিঠ নীলাভ ধূসর। ডানা কালো, মধ্যখানে সাদা চওড়া টান। লেজে লালচে কমলার সঙ্গে নীলাভ কালচে পালক। দেহতল কমলা লালচে। চোখ নীলচে কালো। ঠোঁট ও পা নীলচে কালো। স্ত্রী পাখির মাথা, গলা ঘাড় ও পিঠ বাদামি-ধূসর। ডানার পালক কালচে ধূসর, মধ্যখানে সাদাটান। কোমর শেয়ালে লাল। দেহতল ধূসর কমলা। বাদ বাকি পুরুষের মতো। যুবাদের রং ভিন্ন। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ছোট ফল, বীজ ইত্যাদি। প্রজনন সাইবেরিয়া অঞ্চলে এপ্রিল-জুন। মঙ্গোলিয়া, তিব্বতে মে-আগস্ট। অন্যান্য স্থানেও প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা কাপ আকৃতির। বাসা বাঁধার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, শৈবাল, তন্তু আর সরু লতাপাতা। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ফুটতে সময় লাগে সপ্তাহ দুয়েক। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/11/2017
লালশির হাঁস | Eurasian wigeon | Anas penelope
লালশির হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট শীতের পরিযায়ী পাখি। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নদী এবং হাওর অঞ্চলে দেখা যায়। দেখা যায় অগভীর নদী-নালা, জোয়ার-ভাটার খাঁড়ি, লবণের ঘের এলাকায়ও। এসব অঞ্চলে এরা বড় বড় ঝাঁকে বিচরণ করে। খাদ্যের সন্ধানে জলাশয়ের কিনারে হেঁটে বেড়ায়। আবার মাথা ডুবিয়েও খাদ্য সংগ্রহ করে। জলাশয়ের উপরাংশের খাবার এদের বেশি পছন্দ। যেমন তা হতে পারে জলজ উদ্ভিদ কিংবা কচি ঘাসের ডগা। এরা যেমনি হাঁটতে পারে দ্রুত, তেমনি দ্রুত গতিতে উড়তেও সক্ষম। ওড়ার সময় ‘শন শন’ শব্দ শোনা যায়। পুরুষ পাখি ডাকে ‘হুউহিও… হুউহিও…’ সুরে। স্ত্রী পাখি ডাকে ‘এরর্র… এরর্র…’ সুরে। সুলভ দর্শন এ পাখি বাংলাদেশ ছাড়াও দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও চীনে। প্রচণ্ড শীতে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সাইবেরিয়া ও আফ্রিকার উত্তরাংশ থেকে। ঠাণ্ডা কম অনুভূত হলে ফিরে যায় নিজ বাসভূমে। সংসার পাতে মাতৃভূমিতেই। জানা যায়, বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এদের বিস্তৃতি। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। তথাপিও এরা বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘লালশির’ | ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান ওজিয়ন’ (Eurasian wigeon) | বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস পেনিলোপ’ (Anas penelope), গোত্রের নাম: ‘অনাটিদি’। অনেকে এদেরকে ‘হলদেসিঁথি হাঁস’ বা ‘ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস’ নামে ডাকে। এ পাখি লম্বায় ৪২-৫২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬৫০-৬৭০ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা তামাটে। কপালের মধ্যখানে হলুদ সিঁথির মতো টান, যা কেবল প্রজনন ঋতুতে দেখা যায়। ডানায় সাদা পট্টি। ডানার নিচের দিকে ধূসর। পিঠে মিহি ধূসর রেখা। বুক হালকা বাদামি। পেট সাদা। লেজের নিচের দিকে কালো। লেজ সূচালো। স্ত্রী পাখির রঙ ভিন্ন। ওদের মাথায় হলদেসিঁথি নেই। নেই পিঠের ধূসর রেখাও। স্ত্রী পাখির দেহের অধিকাংশ পালক তামাটে। উভয়ের চোখ বাদামি। ঠোঁট ধূসর-নীল মিশ্রিত। প্রধান খাদ্য: পোকামাকড়, ভেজা ঘাস, জলজ উদ্ভিদ। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। সাইবেরিয়া অঞ্চলে বাসা বাঁধে। জলজ ঝোপের কাছাকাছি মাটিতে ঘাস বা পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৭-১২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৪-২৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/01/2014
কালাঘাড় ডুবুরি | Black necked Grebe | Podiceps nigricollis
কালাঘাড় ডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবল প্রচণ্ড শীতে সিলেটের হাওরাঞ্চলে অল্পবিস্তর দেখা মেলে। স্বাদুজলে বিচরণ করে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট দলেও নজরে পড়ে। সাঁতারে খুব পটু। ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি, ভীতুও সাংঘাতিক। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডুব সাঁতার দিয়ে বাসায় পৌঁছে। এরা লেজহীন পাখি। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুচালো। নিজ বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে পিঠে চড়িয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বাংলা নাম: ‘কালাঘাড় ডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-নেকেড গ্রিব’ (Black-necked Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps nigricollis | এরা ‘কালোমাথা ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ২৮-৩৪ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৩৬০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে অভিন্ন। কপাল, মাথার তালু ও ঘাড় কুচকুচে কালো। মাথা খাড়া। কান পশম সোনালি-হলুদ, যা চোখের পেছন দিক থেকে শুরু করে ঘাড়ের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ কালো। পিঠের দু’পাশ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। বুক কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদা। লেজ খাটো, নেই বললেই চলে। ঠোঁট সুচালো কুচকুচে কালো। চোখের বলয় লাল। চোখের তারা প্রবাল লাল। পা কালচে। পায়ের পাতা চওড়া এবং চেপ্টা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এছাড়াও ছোট চিড়িং, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। শরীরে পালক গজাতে সময় লাগে ১০-১১ সপ্তাহ। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/01/2016
কালোবুক দামা | Black breasted Thrush | Turdus dissimilis
কালোবুক দামা | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী প্রজাতির ভূচর পাখি। বিচরণ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। কিছুটা শালিকের মতো চেহারা। গানের গলা ভালো। মিষ্টি সুরে গান গায়। গাছের উঁচু ডালে বসে খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে গান গায়। স্বভাবে লাজুক। বেশিরভাগই একাকি বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। মূলত এদের প্রাকৃতিক আবাস্থল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্য। ম্যানগ্রোভ অরণ্যেও দেখা যেতে পারে। পাইন বন অথবা সুঁচালো চিরহরিৎ বনে বিচরণ। এতদাঞ্চলের পরিত্যক্ত বা স্যাঁতসেঁতে এলাকার লতাপাতা উল্টিয়ে এবং ঘন ঘন ঠোঁট চালিয়ে খাবার খোঁজে। গাছের উঁচুতে এরা বিচরণ করে না। দেশের সর্বত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চীন, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রজাতিটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যার ফলে আইইউসিএন এদের লাল তালিকাভুক্ত করেছে। প্রজাতিটির বাংলা নাম: ‘কালোবুক দামা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-ব্রেস্টেড থ্রাস’ (Black- breasted Thrush), বৈজ্ঞানিক নাম: Turdus dissimilis | এরা ‘কালাবুক দামা’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে ২২-২৩.৫ সেন্টিমিটার লম্বা। ওজন ৯০ থেকে ১০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। একই রকম হলেও রঙে সামান্য পার্থক্য আছে। পুরুষ পাখির মাথা কুচকুচে কালো। ঘাড় ধূসর কালো। পিঠ থেকে লেজ স্লেট ধূসর। ডানা বাদামি ধূসর। গলা থেকে বুক কুচকুচে কালো। দেহতল কমলা-সাদার মিশ্রণ। চোখের বলয় উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট ও পা কমলা-হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ও পিঠ ধূসর বাদামি। গলায় ঘন কালোর পরিবর্তে বাদামি সাদার ওপর চিট চিট কালো দাগ। চোখের বলয় ফ্যাকাসে। ঠোঁট ও পা পুরুষ পাখিদের মতো উজ্জ্বল হলুদ নয়। প্রধান খাবার : কেঁচো, পোকামাকড় ছোট ফল ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ১-৩ মিটার উঁচুতে। কাপ আকৃতির বাসা। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, শুকনো ঘাস ও লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/03/2016
হলদে বক | Yellow Bittern | Ixobrychus sinensis
হলদে বক | ছবি: ইন্টারনেট জলচর পাখি। আকারে তেমন একটা বড় নয়। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র দেখা যায় না। সংখ্যায় অপ্রতুল, তার ওপর স্বভাবে লাজুক। লুকিয়ে-চুকিয়ে থাকে কচুরিপানা, ঢোলকলমি, নলবন, ধানক্ষেত কিংবা জলার ধারের ঝোপজঙ্গলে। দেখতে কিছুটা কানি বকের মতো মনে হলেও এদের গায়ের রঙ ভিন্ন। গায়ের রঙের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের মিল থাকার দরুন খুব সহজে এরা ঝোপজঙ্গলের ভেতর লুকাতে সক্ষম হয়। বিচরণ করে একাকী। স্থান পরিবর্তনের সময় ‘কেকের-কেকের বা কাকাক-কাকাক’ স্বরে ডেকে ওঠে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতির দেখা মেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। সংখ্যায় স্থিতিশীল বিধায় বিশ্বে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি ‘হলদে বক’ এখনো। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে বক’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়েলো বিটার্ন’ (Yellow Bittern), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ইক্সোব্রাইকাস সিনেনসিস’ (Ixobrychus sinensis)। হলদে বক লম্বায় ৩৬-৩৮ সেন্টিমিটার। গলা খয়েরি, আকারে খাটো। ঠোঁট লম্বা, শক্ত মজবুত ও ধারালো। চোখের বলয় হলুদ, মণি কালো। পুরুষ পাখির মাথায় কালো টুপি। দেহের উপরের দিক হলুদ বাদামি। নিচের দিকটা হালকা হলুদ। ডানার পালক হলুদাভ বাদামি হলেও ডানার প্রান্তের পালক কালো। পিঠ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক কালো। লেজের পালক কালচে। স্ত্রী পাখির মাথায় লালচে বাদামি রেখাযুক্ত পালকে আবৃত। উভয়ের পা ও পায়ের পাতা হলদে-সবুজ। শাবক দেখতে মায়ের মতো হলেও দেহের নিচের দিকে বাদামি রেখা বেশি দেখা যায়। প্রধান খাবার: ছোট মাছ ও জলজ কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয় সংলগ্ন ঝোপজঙ্গল, কচুরিপানা কিংবা ধানগাছের আড়ালে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/08/2014
নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি | Blue throated Barbet | Megalaima asiatica
নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি | ছবি: ইন্টারনেট গত বসন্তে পাখিটাকে প্রথম দেখি রিকাবী বাজারের পূর্বপাড়ায়। মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম পৌরসভায় অবস্থিত বাজারটি। খানিকটা ঘনবসতি এলাকা। দালান-কোঠার ফাঁক-ফোকরে যৎসামান্য গাছ-গাছালি রয়েছে ওখানে। সে সুবাদে কিছু পাখ-পাখালির আড্ডাজমে এতদাঞ্চলে। এ পর্যন্ত বেশ ক’প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি রিকাবী বাজারের আশপাশে। তম্নধ্যে এ পাখিটাই বেশি আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আতাগাছের পাতার আড়ালে বসে আতাফল ঠুঁকরিয়ে খাওয়া অবস্থায় ওকে আমি আবিষ্কার করি। আমাকে দেখে ও গাছের শীর্ষ শাখায় অবস্থান নেয়। মুখের খাবার ফেলে দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টা টের পেয়ে আমিও সটকে পড়ি। পাখিটা দেখতে যেমনি সুন্দর তেমনি গানের গলাও। তারপরও ওরা গায়ক পাখি হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। গায় করুণ সুরে। তাল-লয়-ছন্দ মেনে গান গায়। ‘পুক্র্ক… পুক্র্ক… পুক্র্ক’ শব্দে ডাকে। পরপর তিনবার ডেকে দম নিয়ে পুনরায় অস্পষ্টভাবে ‘কুক্’ শব্দ করে। এরা একটানা বেশি সময় ধরে ডাকে না। থেমে থেমে ডাকে। ওদের গান শুনে মনে হয় বুঝি ওরা চিরদুঃখী। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সুখ-দুঃখে একই ধরনের সুরে ডাকে। তবে মজাদার বিষয় হচ্ছে ওদের সুর শুনা যায় কিন্তু সহজে দেখা যায় না। পাতার আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখে গান গায়। গানের আওয়াজ প্রায় ৬০০-৬৫০ মিটার থেকেও শুনা যায়। এরা আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাখি হলেও সহজে দেখা মেলে না, শুধুমাত্র বসন্তকালে এদের দেখা মেলে। এ সময়ে শুধু গ্রামেগঞ্জেই নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন উদ্যানে প্রবেশ করলেও গাছের শীর্ষশাখা থেকে ওদের ডাক শুনা যায়। এদের গাছে বসার ভঙ্গিটা একটু ব্যতিক্রম। খাড়া হয়ে বসে। একটানা অনেকখানি পথ এরা উড়তে পারে না। উড়ন্ত অবস্থায় ভালো মতো পরখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। মনে হয় উড়তে উড়তে বুঝি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সুন্দর এ পাখির বাংলা নাম: ‘নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি’ ইংরেজি নাম: ‘ব্লু-থ্রোটেড বারবেট,’ (Blue-throated Barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মেগালাইমা এশিয়াটিকা’ (Megalaima asiatica), গোত্রের নাম: ‘মেগালাইমিদি’। আমাদের দেশে মোট তিন ধরনের বসন্তবউরি দেখা যায়। যথা: বড় বসন্তবউরি, নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি, ছোট বসন্তবউরি। এ পাখি লম্বায় ২১-২৩ সেন্টিমিটার। এদের কপাল ও ঘাড় সিঁদুর লাল। মাথার তালু কালচে। ঘাড়ের দু’পাশে দু’টো লালফোটা। মাথার নিচ থেকে গলা পর্যন্ত নীল। বুক থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত হলদেটে সবুজ। লেজের তলার প্রান্তটা নীলচে। পিঠ ঘাস-সবুজ। ডানা বুজানো অবস্থায় সবুজ। নিচে সাদা। ঠোঁট মোটা ত্রিকোনাকৃতির। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পক’টি খাঁড়া লোম। চোখের মনি কমলা রঙের বৃত্তদ্বারা আবৃত। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। সব ধরনের বসন্তবউরিদের প্রিয় খাবারই হচ্ছে ছোট ছোট ফল-ফলাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুলাই। গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। পছন্দসই গাছ খুঁজতে ৩-৪দিন সময় লেগে যায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের বর্ণ সাদা। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ফুটতে সময় লাগে ১৭-২২ দিন। শাবক উড়তে শেখে ২৫-২৮দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/10/2012