সাদা হাঁস | Smew | Mergellus albellus
সাদা হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশে অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। বলা যায় বিরলতম প্রজাতি। দেশে খুব একটা দেখা যায় না। সর্বপ্রথম ২০০৩ সালে প্রজাতিটি বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। মূলত রাশিয়া ও তৎসংলগ্ন তুন্দ্রা অঞ্চলের বাসিন্দা ‘সাদা হাঁস’। এ ছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, চীন ও জাপানে বৈশ্বিক বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। সমগ্র বিশ্বে ১৯ লাখ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী এদের বিস্তৃতি থাকলেও প্রজাতির সংখ্যা তেমন সন্তোষজনক নয়। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। প্রজাতিটি অন্য সব জলচর পাখিদের মতোই জলাশয়ে বিচরণ করে। তবে বড় ধরনের জলাভূমি এদের বেশি পছন্দ। বিচরণ করে ছোট দলে। দিবাচর পাখি এরা। খাবার খোঁজে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। ডুবিয়ে জলের তলা স্পর্শ করে শিকার ধরে। উড়তে পারে দ্রুত। প্রায় শব্দহীনভাবে ওড়ে। প্রজননকালীন সময়ে পুরুষ পাখি উড়তে পারে না। এ সময় ওদের নতুন পালক গজায়। হাঁকডাক খুব একটা দেয় না। মাঝেমধ্যে ব্যাঙের মতো নিচু স্বরে শিস কাটে। স্বভাবে শান্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদা হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘স্মিউ’ (Smew), বৈজ্ঞানিক নাম: Mergellus albellus| লম্বায় ৩৮-৪৬ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ৬৮০ গ্রাম। বর্গাকার মাথায় সাদা ঝুলানো ঝুঁটি। ঘাড় কালো। ডানা ও বুকের পাশটা কালচে। এ ছাড়া সমস্ত দেহ ধবধবে সাদা। ঠোঁট আকারে খাটো, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। উভয়ের লেজ চুঁচালো। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী-পুরুষ পাখির তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। এ সময় পুরুষ পাখির ঠোঁটের গোড়া ও চোখের পাশ কালো রঙ ধারণ করে। বুকের পাশ এবং লেজ ধূসর দেখায়। চোখ লালচে এবং পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে দেখায়। স্ত্রী পাখির মাথায় লালচে-বাদামি টুপি এবং ঘাড় ও ঝুঁটি ধূসর বাদামি দেখায়। পা ও পায়ের পাতা সবুজ। প্রজননের বাইরে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। প্রধান খাবার: ছোট চিংড়ি, শামুক, কেঁচো, ব্যাঙ ও জলজকীট। মাছ তেমন একটা খায় না। তবে শীত ও বসন্তের শুরুতে মাছ শিকার করে। প্রজনন সময় এপ্রিল-মে। সাইবেরিয়া অঞ্চলের গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৭-৯টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/05/2014
হিমালয়ী গৃধিনী | Himalayan Vulture | Gyps himalayensis
হিমালয়ী গৃধিনী | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন, পরিযায়ী পাখি। দেশে খুব কম দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, তিব্বত, চীন, আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। ঈগলাকৃতির চেহারা। খোলামাঠ প্রান্তরে বিচরণ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতায়ও এদের দেখা মেলে। একাকী, জোড়ায় কিংবা দল বেঁধে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। সব ধরনের মৃতদেহ ও সরীসৃপ এদের খাবার। যার ফলে বিষাক্ত মৃতদেহ খেয়ে ওদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। প্রজাতির অন্যদের তুলনায় এরা দীর্ঘজীবী। গড় আয়ু ৫০-৫৫ বছর। পাখির বাংলা নাম: ‘হিমালয়ী গৃধিনী’, ইংরেজি নাম: ‘হিমালয়ান ভালচার’ (Himalayan Vulture), বৈজ্ঞানিক নাম: Gyps himalayensis | এরা ‘বৃহত্তম গিদরি,’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কম-বেশি ১০০-১১০ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য ২৬০-২৯০ সেন্টিমিটার। মাথা, গলা ও ঘাড় তুলতুলে ক্রিম সাদা। পিঠ ও লেজ ঢাকনি সাদাটে আভার সঙ্গে হলদে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক এবং লেজ কালো। ওড়ার পালকও কালচে। দেহতল বাদামির ওপর অস্পষ্ট রেখা যুক্ত। শিঙ কালো রঙের ঠোঁটের উপরের অংশ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁট থেকে হলুদাভ আভা বের হয়। পা ও পায়ের পাতা ফিকে, নখ কালো। যুবাদের রঙ ভিন্ন। প্রধান খাবার: মৃতদেহ। সর্বভুক পাখি। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে মে। বাসা বাঁধে পুরনো উঁচু গাছের ডালে। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ডালপালা পশুর চুল, গাছের বাকল, হাড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৫৪-৫৮ দিন। বাবা-মায়ের সঙ্গে মাস ছয়েক কাটায়। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 17/03/2017
ধূসর সারস | Demoiselle Crane | Anthropoides virgo
ধূসর সারস | ছবি: ইবার্ড বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দেশে আগমন ঘটে শীতে। হিমালয় পাড়ি দিয়ে মাঝেমধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চলে উপস্থিত হয়। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। মরু অঞ্চলেও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা বড়সড়ো ঝাঁকে। চলার পথে কারো ফসলের খেতে দলবেঁধে নামলে মুহূর্তেই ফসল তছনছ করে দেয়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। এ সময় উভয়ে জোরে জোরে দ্বৈত সঙ্গীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, উত্তর-পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, পশ্চিম ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সঙ্কটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে ধূসর সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর সারস’, ইংরেজি নাম: ‘ডেমোজিল ক্রেন’, (Demoiselle Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthropoides virgo | দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। গড় দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৫০-১৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২-৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার তালু ধূসর। মাথার পেছন থেকে কালো রঙ শুরু করে ঘাড়, থুঁতনি ও গলা হয়ে বুকের ওপর গিয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। চোখের পেছন থেকে সাদা পালক ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। সারা দেহ গাঢ় ধূসর। ওড়ার পালক কালো। লেজে সাদা-কালো লম্বা পালক, যা ঝুলে পড়েছে নিচে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। কমলা-লাল রঙের চোখ দুটি আকারে ছোট। পা ও পায়ের পাতা ময়লা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাঁকড়া, কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-২৯ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/04/2016
কাঠ শালিক | Chestnut tailed Starling | Sturnus malabaricus
কাঠ শালিক | ছবি: ইন্টারনেট এ প্রজাতির অন্যান্য পাখি আমাদের প্রতিবেশী হলেও এদের ভেতর মানুষকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। যার ফলে পরিচিত এ পাখি সর্বসাধারণের কাছে অপরিচিত রয়ে গেছে অদ্যাবধি। এদের বিচরণ অপেক্ষাকৃত হালকা বন-বনানীতে। আবার শহরের দর-দালানেও বসত করে। তবে ভূমিতে খুব একটা বিচরণ করে না। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে প্রায়ই দেখি এ পাখিদের। আমার কাছে এদের বেশ সুদর্শন পাখি মনে হয়। গায়ের বর্ণ অতি উজ্জ্বল না হলেও দেখতে ভালোই লাগে। চলাফেরা করে এরা দল বেঁধে আবার জোড়ায়-জোড়ায় কিংবা একাকীও বিচরণ করে। মানুষকে এড়িয়ে চললেও মাঝেমধ্যে বিচরণ করে কোলাহল সম্পূর্ণ এলাকায়। এদের নিয়ে কথা বলতেই প্রসঙ্গক্রমে দেশের বিশিষ্ট পাখি বিশারদ শরীফ খান জানিয়েছেন, এরা দেশে সন্তোষজনকহারে বিচরণ করছে। বিচরণ করছে ঢাকা-শহরেও। তিনি আরো জানিয়েছেন, খিলগাঁও রেল গেটের কাছে একজোড়া পাখিকে বাসা বানিয়ে ডিম-বাচ্চা ফোটাতে দেখছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। এদের বাংলা নাম: ‘কাঠ শালিক’ ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাটটেইলড স্টার্লিং’(Chestnut-tailed Starling), বৈজ্ঞানিক নাম:‘স্টুরনাস মালাবারিকাস’ (Sturnus malabaricus), গোত্রের নাম: ‘স্টুরনিদি’। আমাদের দেশে প্রায় ৬-৭ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে : ভাত শালিক, গোবরে শালিক, কাঠ শালিক, বামন শালিক, ঝুঁটি শালিক ও গাং শালিক। ‘চিত্রা শালিক’ নামে এক প্রজাতির শালিক সম্পর্কে জেনেছি ড. রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামক গ্রন্থে’। পাখিটা সচরাচর দেখা যায় না। দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। সৌভাগ্যটা অর্জন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করব। কাঠ শালিক লম্বায় ২০-২৩ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ধূসরাভ-রুপালি। থুতনি-গলা সাদা। ঠোঁটের গোড়া নীল, মাঝখানটা সবুজ এবং ডগাটা হলুদ। পিঠ রুপালি ধূসরের ওপর হালকা খয়েরি। ডানার প্রান্তটা কালো। গলা ফিকে লালচের ওপর সাদাটে ধূসরের টান। বুক, পেট পাটকিলে। পা হলদেটে। লেজের উপরিভাগ ধূসর, তলদেশ পাটকিলে। কাঠ শালিকের খাদ্য তালিকায় রয়েছে কীটপতঙ্গ, ছোট ফল, ফুলের মধু ইত্যাদি। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। নরম লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিমে তা দেয় শুধু স্ত্রী পাখি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 31/10/2012
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
সিঁদুরে মৌটুসি | Crimson sunbird | Aethopyga siparaja
সিঁদুরে মৌটুসি | ছবি: ইন্টারনেট বাবার রেখে যাওয়া লেবু বাগানটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাগানটির সমাধি ঘটেছে ১৯৯১ সালের ঊনত্রিশ এপ্রিলে। লেবু গাছগুলোর ভরা যৌবনে দেখেছি, (ফুল ফুটলে) মৌমাছি এবং মধুলোভী ছোট পাখিদের আনাগোনা বেড়ে যেত। হরেক প্রজাতির পাখির মধ্যে দেখতাম ‘সিঁদুরে মৌটুসি’র আনাগোনাও। পাখিগুলো দেখতে ভীষণ সুন্দর! হঠাৎ দর্শনে নজর কেড়ে নিত যে কারোই। প্রজাতির রূপের বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই ঠিক, তবে এটুকু বলার আছে, প্রকৃতি নিজ হাতে ওদের শরীরে রং-তুলির আঁচড় কেটে দিয়েছেন বোধকরি। এরা অতি পরিচিত পাখি। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দেখা মেলে যত্রতত্র। গ্রামগঞ্জের ঝোপ-জঙ্গলে নিশ্চিত বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। স্বভাবে অত্যন্ত চঞ্চল ও ফুর্তিবাজ। দিনের বেশিরভাগ সময় গাছের শাখা-প্রশাখায় নেচে বেড়ায়। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও দেখা যায় ভারত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশ্বে এদের বিস্তৃতি প্রায় ৪৯ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে। বিশ্বে এ প্রজাতির সংখ্যা স্থিতিশীল। এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায়নি, বৃদ্ধিও পায়নি। আইইউসিএন এ প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশে সুলভ দর্শনের কারণে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এদের সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। পাখির বাংলা নাম: ‘সিঁদুরে মৌটুসি’, ইংরেজি নাম: ক্রিমসন সানবার্ড,(Crimson sunbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Aethopyga siparaja | এরা ‘সিঁদুরে লাল মৌটুসি’ নামেও পরিচিত। পুরুষ পাখি লম্বা ১৫ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ১০ সেন্টিমিটার। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা বড়। ঠোঁট লম্বা, বড়শির মতো বাঁকানো। পুরুষ পাখির কপাল উজ্জ্বল বেগুনি, তার ওপর হালকা ডোরা দাগ। মাথার পেছন থেকে পিঠ ও ডানার কিছু অংশ সিঁদুরে লাল। পিঠের শেষ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত হলুদাভ-জলপাই। লেজ বেগুনি। থুতনি থেকে বুক পর্যন্ত সিঁদুরে লাল। পেটের দিকটা হলুদাভ-জলপাই। স্ত্রী পাখির শরীর জলপাই রঙের। লেজের প্রান্তর সাদা। প্রধান খাবার ফুলের মধু। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। ভূমি থেকে দুই মিটার উঁচুতে গাছের ডালে অথবা গুল্মলতা আচ্ছাদিত গাছের ডালে থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/09/2018
বড় কাঠঠোকরা | Great Slaty Woodpecker | Mulleripicus pulverulentus
বড় কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। বিরল দর্শন। চেহারা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। কেবল দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ ও আর্দ্র পাতাঝরা বনে। প্রশস্ত পাতার বন এদের বিচরণের ক্ষেত্রে অতি উত্তম স্থান। এ ছাড়াও পাহাড়ের পাদদেশের বন-বনানীতেও বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। পাখিতাত্ত্বিকদের মতে ম্যানগ্রোভ অরণ্যেও এদের বিস্তৃতি রয়েছে। তবে আমার নজরে পড়েনি কখনো। শিকারে বের হয় একাকী, জোড়ায় কিংবা পারিবারিক দলে। দলে সাধারণত ৩-৬টি পাখির বেশি দেখা যায় না। প্রজাতির অন্যদের মতো এরা তরঙ্গাকারে না উড়ে বরং সোজাসুজি ওড়ে। ডাকাডাকি করে উড়তে উড়তেই। এ সময় ভুতুড়ে কণ্ঠে ‘ওয়িক ওয়িক ওয়িক..’ সুরে আওয়াজ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে হিমালয়াঞ্চল, ভারত, ভুটান ও ইন্দোনেশিয়ায়। বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিস্তৃতি সন্তোষজনক নয়। প্রজাতিটি বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। অবাধে চিরসবুজ অরণ্যের বড় বড় বৃক্ষ নিধনের ফলে এদের অস্তিত্ব হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মরা গাছের অভাবে এদের প্রজননে ভীষণভাবে বিঘ্ন ঘটছে। এমতাবস্থায় একমাত্র অভয়ারণ্যের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ঘটিয়ে প্রজাতিটিকে বিলীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব বলে ধারণা করছেন দেশের বন্যপ্রাণীবিশারদরা। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় মেটেকুড়ালি বা কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেট শ্লেটি উডপেকার’ (Great Slaty Woodpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মুল্লারিপাইকাস পালভেরুলেনটাস’ (Mulleripicus pulverulentus), গোত্রের নাম: ‘পাইকিদি’। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে মোট ২০ প্রজাতির কাঠঠোকরা বা কাঠ কুড়ালির সাক্ষাৎ মেলে। লম্বায় ৪৮-৫৮ সেন্টিমিটার। ঘাড় ও ঠোঁট অস্বাভাবিক লম্বা। ঘাড়-গলা পালকহীন। প্রাপ্তবয়স্কদের দেহের সমস্ত পালক স্লেট-ধূসর। থুঁতনি ও গলা ফ্যাকাসে হলুদ। ঠোঁট ফ্যাকাসে। চোখ বাদামি থেকে লালচে, চোখের বলয়ের চামড়া স্লেট রঙের। পা ও পায়ের পাতা কালচে স্লেট রঙের সঙ্গে নীলাভ আভার মিশ্রণ। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির চোখ ও ঘাড়ের মাঝামাঝি গাঢ় লাল পট্টি আছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের পিঠ অনুজ্জ্বল। পিঠে অসংখ্য ফ্যাকাসে ফুটকি। বাদবাকি স্ত্রী পাখির মতো দেখতে। প্রধান খাবার: গাছের মরা কাণ্ডের ভেতর লুকিয়ে থাকা পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। মরা গাছের কাণ্ডে নিজেরা গর্ত খুড়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে কত দিন লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/04/2014