মেটেমাথা কুরাঈগল | Grey headed Fish Eagle | Ichthyophaga ichthyaetus
মেটেমাথা কুরাঈগল | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মোহনা এবং উপকূলের কাছাকাছি জলাশয় ও নিম্নভূমির বন প্রান্তরে বিচরণ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, লাওস, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও পশ্চিম ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। প্রজাতির দেখা মেলে একাকি বা জোড়ায়। মিঠা জলের জলাশয় এদের বিচরণের জন্য উত্তম। দুর্দান্ত সাহসী ও হিংস । নিজের শরীরের সমান ওজনের মাছ বা সরীসৃপ শিকার করতে সক্ষম। শিকার খুঁজে জলাশয়ের ওপর চক্কর মেরে। ওপর থেকে নিশ্চিত হলে কেবল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছোট মাছের প্রতি আসক্তি নেই বললেই চলে। আকারে বড়সড়ো মাছ দেখলে নিশানা ঠিক করে বিশাল ডানা মেলে মাছের পিঠ বা ঘাড়ে থাবা বসিয়ে দেয়। এ থেকে বাদ যায় না জলচর সাপও। দেশে এদের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। জলাশয় সংকুচিত এবং উঁচু গাছের অভাবে এরা হুমকির মুখে পড়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মেটেমাথা কুরাঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-হেডেড ফিস ঈগল, (Grey-headed Fish Eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: (Ichthyophaga ichthyaetus)। এরা ‘মাছ মুরাল’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৬১-৭৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য ৪২-৪৫.৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৬ কেজি। স্ত্রী পাখির প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য ৪৪.৫-৫১.৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২.৩-২.৭ কেজি। দেহের তুলনায় মাথা খাটো। মাথা বাদামি ধূসর। ঘাড় ও গলা লালচে বাদামি। পিঠ কালচে-বাদামি। বুক লালচে-বাদামি। পেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত সাদা। লেজ বাদামি, বৃত্তাকার এবং খাটো। ঠোঁট শিং কালো। শক্ত-মজবুত ধারালো ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। চোখ হলুদ-বাদামি। পা খাটো, নখ তীক্ষ, ধূসর-কালচে। স্ত্রী-পুরুষের চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রধান খাবার: মাছ। এ ছাড়া সাপ, ইঁদুর, খরগোশসহ বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ শিকার করে। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। জলাশয়সংলগ্ন উঁচু গাছের তে-ডালে সরু ডালপালা দিয়ে মস্তবড় বাসা বাঁধে। বাসা অগোছালো। একই বাসায় ফি বছরেও ঘর বাঁধতে দেখা যায়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৬৫-৭০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/08/2016
হিমালয়ী কাঠঠোকরা | Himalayan Goldenback | Dinopium shorii
হিমালয়ী কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট অসুলভ দর্শন আবাসিক পাখি। সুশ্রী গড়ন। দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে। বিচরণ করে মিশ্র-চিরসবুজ ও পাতাঝরা বনে। এরা পারিবারিক দলে এবং একাকী বিচরণ করে। পিঁপড়া খেতে মাঝে মধ্যে মাটিতে নামে। হাঁটে লাফিয়ে। গাছের কাণ্ডের চারদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে শিকার খোঁজে। কণ্ঠস্বর কর্কশ। শিকাররত অবস্থায় ঘনঘন ‘ক্লাক-ক্লাক-ক্লাক…’ সুরে ডাকাডাকি করে। প্রজনন মৌসুমে হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় ‘কি-কি-কি-কি’ সুরে ডাকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান পর্যন্ত। বিশেষ করে হিমালয়াঞ্চল থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত অধিক নজরে পড়ে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্নমুক্ত। বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এদের সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। পাখির বাংলা নাম: হিমালয়ী কাঠঠোকরা, ইংরেজি নাম: হিমলয়ান গোল্ডেনব্যাক, (Himalayan Goldenback), বৈজ্ঞানিক নাম: Dinopium shorii | লম্বায় ৩০-৩১ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথার চাঁদি ও চূড়া টকটকে লাল। অপরদিকে স্ত্রী পাখির কপাল ও চাঁদির সামনের অংশ বাদামি কালো, চূড়া লম্বা সাদাডোরাসহ কালো। উভয়ের পিঠ সোনালি-হলুদ। ডানার প্রান্ত পালক কালো। লেজ কালো। ঘাড় কালো। গলার মধ্যভাগ বাদামি-পীতাভ। কোমর উজ্জ্বল লাল। দেহতল কালোর ওপর খাড়া দাগ। চোখ ও ঘাড়ের মাঝে ফ্যাকাসে বাদামি অস্পষ্ট কালো ডোরা। চোখের পেছন থেকে প্রশস্ত সাদা ভ্রƒ ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। ঠোঁট কালচে। চোখ লালচে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: পোকামাকড় এবং পিঁপড়া। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। গাছের মোটাসোটা ডালে নিজেরা খোড়ল বানিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, ০৮/০৫/২০১৫
কালিম পাখি | Purple Swamphen | Porphyrio porphyrio
কালিম পাখি | ছবি: ইন্টারনেট অনেকের ধারণা এরা অতিথি পাখি। ধারণাটি রটিয়ে দেয়ার জনক পাখি শিকারিরাই। কারণ অতিথি পাখির নাম শুনলে ভোজন রসিকদের জিভে জল আসে। তখন বিক্রি করতে সুবিধা হয়। দাম-টামও বেশি পাওয়া যায়। প্রকৃত তথ্যটি হচ্ছে, এরা আমাদের দেশীয় জলচর পাখি। স্বভাবে বুনো হলেও মোটামুটি পোষ মানে। মুক্ত অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। আবার একাকী বা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করে। ওদের বিচরণের ক্ষেত্র জলাশয়ের জলদামের ওপর। আবার জলেও সাঁতার কাটে, তবে তুলনামূলকভাবে কম। জলকেলি ওদের ভীষণ পছন্দ। জলের ছোঁয়ায় রূপের ঝলক আরো বেড়ে যায়। এ সুন্দর প্রজাতির পাখিদের বছর ত্রিশেক আগেও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাশয়ে কিংবা হাওর অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত। বর্তমানে এদের সাক্ষাৎ ওভাবে মেলে না। গত বর্ষায় আমি দেখেছি বিক্রমপুরের রামপালে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাখি দেখতে বেরিয়েছি এক বিকেলে। হাঁটতে হাঁটতে রাজা বল্লাল সেনের দিঘির পাড়ে হাজির হলাম। দেখতে পেলাম দিঘিটার আকার আকৃতি আগের মতো নেই। জলজ উদ্ভিদ বা জলদামের কারণে এটি এখন বিলে পরিণত হয়েছে। তার পরও এখানে কিছু জলচর পাখির দেখা মেলে। পাখি বিশেষজ্ঞরাও মাঝে মধ্যে এখানে পাখি পর্যবেক্ষণে আসেন। মাঝে মধ্যে আমিও যাই। সেদিনও গিয়েছি। কয়েক প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেলেও এ পাখির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে বেশি। দূর থেকে দেখতে পেয়েছি দুটি জলচর পাখি জলদামের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর পর বিরতি নিয়ে ওড়াউড়ি করছে। দৃশ্যটি বেশ লেগেছে আমার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়ে ওদের প্রজাতি শনাক্ত করে নিয়েছি। পাখিগুলো পূর্ব পরিচিত বিধায় ওদের পেছন আর অযথা সময় নষ্ট করিনি। বলতে দ্বিধা নেই, এ পাখি আমি নিজেও ক’দিন পুষেছি। আবার খাঁচার দরজা উন্মুক্ত করে ওদের প্রকৃতির কোলে ফিরিয়েও দিয়েছি। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালিম,’ ইংরেজি নাম: ‘পার্পল সোয়াম্পহেন’(Purple Swamphen) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পরফাইরিও পরফাইরিও’ (Porphyrio porphyrio), গোত্রের নাম: ‘রাললিদি’। এরা লম্বায় ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার। ঠোট, কপাল পালকহীন উজ্জ্বল লাল। মাথা থেকে গলা হালকা নীলাভ বর্ণ। এ ছাড়া সমস্ত শরীরের পালক বেগুনি-নীলের মিশেল। লেজের তলা সাদা। পা ময়লা লাল। পায়ের আঙ্গুল তুলনামূলকভাবে বড়। দেখতে নোংরা মনে হয়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এরা ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। ডিমে তা দেয়ার দায়িত্ব স্ত্রী পাখির ওপরে বর্তালেও ওই সময়ে পুরুষ পাখিটি বাসার কাছাকাছি থেকে স্ত্রী পাখিকে সঙ্গ দেয়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/11/2012
চখা চখি | Ruddy Shelduck | Tadorna Ferruginea
চখা চখি | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পদ্মার চরে দেখেছি। তখনো বুঝতে পারিনি এরা বিশেষ আকর্ষণীয় পাখি। প্রথম দেখাতে এদের পাতি হাঁস ভেবে ভুল করেছি। আসলে কিন্তু তা নয়। এরা হাঁস গোত্রের হলেও ভিন্ন প্রজাতির পাখি। এ পাখিরা ঘনঝোপ, ঘাস অথবা আগাছা বিস্তৃত জলাশয় এড়িয়ে চলে। পলিময় উপকূল অঞ্চল, হাওর, নদ-নদীতে এদের বিচরণ। এরা নিশাচর হলেও দিনের আলোতেও বিচরণ করে। বিশেষ করে ভোর-সন্ধ্যায় বেশি বিচরণ করে। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। আবার দলবদ্ধভাবেও থাকে। ডাকে উচ্চস্বরে ‘আ-আঙ্গ আ-আঙ্গ’ সুরে। ওড়ার সময় আওয়াজ করে ‘আ-আখ..আ-আখ’ সুরে। এ পাখি শীতকালে বাংলাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। এশিয়ায় মূলত এদের বিস্তৃতি তুরস্ক থেকে জাপান পর্যন্ত। এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকার উত্তর দক্ষিণাংশে এদের দেখা মেলে। এ পাখিদের বন্ধন অত্যন্ত মধুময়। কথিত আছে, কোনো কারণে যদি এদের জোড়া থেকে একটি পাখি মারা যায় অথবা শিকারিদের শিকারে পরিণত হয় তাহলে জোড়ের অন্য পাখিটি আর্তনাদ করতে করতে মারা যায়। এমনই অটুট এদের বন্ধন। আর এ বন্ধনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এদের নামকরণ হয় চখা-চখি। বর্তমানে পৃথিবীতে ওদের অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। জানা যায়, সমগ্র পৃথিবীতে এ পাখির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত হিসেবে রয়েছে। বাংলায় পুরুষ পাখির নাম: ‘চখা’ স্ত্রী পাখির নাম:‘চখি,’ দুয়ে মিলে নাম হয়েছে চখা-চখি। ইংরেজি নাম: ‘রাড্ডি শেলডাক’ (Ruddy Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না ফেররুগিনি’ (Tadorna Ferruginea), গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা লম্বায় ৬৭-৭০ সেন্টিমিটার। ঠোঁট ৪.৩ সেন্টিমিটার। পা ৬ সেন্টিমিটার। লেজ ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। গায়ের অধিকাংশ পালকই কমলা-বাদামি বর্ণের। মাথা, গলা সাদাটে। ডানা ধাতব-সবুজ, সাদা, কালো এবং বাদামি। ঠোঁট, পা ও লেজ কালো। স্ত্রী পাখির বর্ণ সামান্য উজ্জ্বল। দেখতে প্রায় একই রকম। তবে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় প্রজনন মৌসুমে। এ সময়ে পুরুষ পাখির গলায় কালো বলয় তৈরি হয়। স্ত্রী পাখির হয় না। এরা সর্বভুক পাখি। জলজ পোকামাকড় থেকে শুরু করে ছোট মাছ, ছোট ব্যাঙ, ধান, ঘাসের কচি ডগা সবই খায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে তিব্বত ও উত্তর এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে। উঁচু মালভূমি বা জলাভূমির কাছাকাছি গর্তে পালক দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৮-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। পুরুষ পাখিটি পাশে বসে থাকে তখন। শাবক উড়তে শিখে ৫৫ দিনে। বয়োপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে প্রায় ২ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/12/2012
চিতিঠোঁট গগনবেড় | Spot billed Pelican | Pelecanus philippensis
চিতিঠোঁট গগনবেড় | ছবি: ইন্টারনেট ভিন্ন ধাঁচের চেহারা, আকারেও বৃহৎ। শীত মৌসুমে দেখা মিলে হাওর-বাঁওড় বা সামুদ্রিক জলাশয় অঞ্চলে। বিচরণ করে একাকী, জোড়ায় কিংবা ঝাঁক বেঁধে। বাংলাদেশে খুব একটা নজরে পড়ে না; কালেভদ্রে নজরে পড়ে। ২০২০ সালে দেশের উত্তরবঙ্গে দেখা যায়। পরবর্তীতে অন্য কোথাও দেখা গেছে বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, লাওস, চীন ও দক্ষিণ কম্বোডিয়া পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বেই এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। শিকারিদের অত্যাচারে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে এরা। এ ছাড়াও জলাশয় সংকটের কারণে প্রজাতিটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা যায় এখন অতি বিরল পরিযায়ী পাখির তালিকায় রয়েছে এরা। পাখির বাংলা নামঃ ‘চিতিঠোঁট গগনবেড়’, ইংরেজি নামঃ ‘স্পট বিল্ড পেলিক্যান’, (Spot-billed Pelican)। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৫২ সেন্টিমিটার। ওজন ৪.১-৫.৭ কেজি। মাথার ঝুঁটি ও ঘাড়ের বর্র্র্ণ গাঢ় ধূসর। পিঠ সাদা। ডানার ওপরে গোলাপি আভা। বুক ও পেটের দিকে হলদেটে। ওড়ার প্রাথমিক পালক কালো। ঠোঁট বড়। ঠোঁটের নিচে কমলা-হলুদ রঙের চামড়ার থলে। উপরের ঠোঁটের মাঝে রয়েছে লম্বা প্লেট। নিচের ঠোঁটের কিনারা ধূসর। চোখের চারপাশে পালকহীন চামড়া। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। কপালে সাদা পালক, যা ওপরের ঠোঁটের গোড়ায় মিলিত হয়েছে। প্রজননের বাইরে গলার নিচের থলে গোলাপি রং ধারণ করে। তখন মাথার ঝুঁটির পালক ও গায়ে হলুদের আভা থাকে না। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির ডানায় বাদামির পরিমাণ বেশি থাকে। ঠোঁটে চিতি থাকে না, যা বয়স্ক পাখিদের থাকে। প্রধান খাবারঃ মাছ। শিকারের কৌশল বেশ মজাদার। এরা দলবদ্ধ হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে মাছ তাড়া করে নিজেদের থলেতে ঢুকিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে গিলে ফেলে। প্রজনন মৌসুম ভারতে অক্টোবর। শ্রীলঙ্কায় মার্চ থেকে এপ্রিল। এ ছাড়াও অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বড় গাছে দলবদ্ধভাবে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে সরু ডালপালা। বাসা অগোছালো। মাচা আকৃতির। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় নেয় ৬0-৯0 দিন। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ৩০ মাস। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 04/10/2021
বাজপাখি | Common Buzzard | Buteo buteo
বাজপাখি | ছবি: ইন্টারনেট শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। নজরে পড়ে খোলা মাঠ-বিল প্রান্তরে। খরগোশ, সাপ, গলিত মাংস, কীটপতঙ্গ এসব শিকার করে। পারতপক্ষে জলাশয় থেকে মাছ শিকার করে না। চাষাবাদ হয় এমন ক্ষেত-খামারের কাছাকাছি বেশি নজরে পড়ে। ফসলের ক্ষেত্রেও বিচরণ রয়েছে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। অনেক ক্ষেত্রে ১০-১৫টির দলেও দেখা যায়। আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে অনেকখানি পরিধি নিয়ে ঘুরতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ শূন্যে ভেসে থাকতে পছন্দ করে। এরা শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে তেমন হিংস নয়। প্রজাতির চারাভিযান বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপ, রাশিয়া, আফ্রিকা, তুরস্ক, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। বিশ্বে এরা ভালো অবস্থানে নেই। >পাখির বাংলা নাম: ‘বাজপাখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন বাজার্ড’ (Common Buzzard), বৈজ্ঞানিক নাম: Buteo buteo | এরা ‘পাতি তিসাবাজ’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৪০-৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৪২৭ গ্রাম। প্রসারিত পাখা ১০৯-১৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী পাখি সামান্য বড়। মাথা, ঘাড়, পিঠ, ডানা ও লেজ কালচে বাদামির সঙ্গে সাদা ছোপ। ঘাড়ে, গলায় সাদা ছোপ স্পষ্ট। বুক, পেট ও বস্তি প্রদেশ হলদে বাদামির ওপর হলদে সাদা ছিট। চোখের বলয় হলুদ। কালো মণির চারপাশ বাদামি। বড়শির মতো বাঁকানো ঠোঁট কালো, গোড়া হলুদ রঙের। মুখের কিনারটাও হলুদ। পা হলুদ ও নখ কালো। প্রধান খাবার: খরগোশ, ছোট সাপ, ইঁদুর, টিকটিকি, ব্যাঙ, কাঁকড়া, পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মধ্য এপ্রিল। গাছের উঁচু শিখরে সরু ডালপালা দিয়ে অগোছালো বাসা বাঁধে। মাটিতে বা পাথুরে এলাকায়ও বাসা বাঁধে। একই বাসা বারবার ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ২-৪টি। তিন দিন অন্তর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৩-৩৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৬-৮ সপ্তাহ। তিন বছর বয়সে বয়োপ্রাপ্ত হয়। গড় আয়ু ২৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/05/2017
বড় বনলাটোরা | Large Woodshrike | Tephrodornis gularis
বড় বনলাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট মিশ্র পর্ণমোচী বন, বন প্রান্তর এবং চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা। স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বড় বনলাটোরার বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। দূরদর্শনে ‘পাতি বনলাটোরা’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। চেহারায়ও খুব একটা ভিন্নতা নেই। শুধু আকারে একটু বড় এরা। প্রজাতির কারোই আহামরি রূপ নেই। তবে চেহারাটা মায়াবি ধাঁচের। বিশেষ করে ওদের কাজল কালো চোখ পাখি প্রেমীদের মায়া জাগিয়ে তোলে। প্রজাতির দেখা মেলে শুষ্ক বন-বনানী কিংবা ঘন পাতার গাছগাছালির ডালে। ভাওয়াল শালবনে বেশি দেখা মেলে। স্বভাবে শান্ত। কিছুটা লাজুকও। উঁচু গাছের ঘন পাতার আড়ালে বিচরণ করে। শিকারে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। পতঙ্গভুক অন্যান্য পাখির সঙ্গেও শিকারে বের হয়। মাটিতে নেমেও শিকার খোঁজে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি সুর করে গান গায়। সুর শুনতে মন্দ নয়। উভয় প্রজাতিই কিছুটা বোকা কিছিমের। স্ত্রী পাখি যখন ডিমে তা দেয় ঠিক তখনই পুরুষ পাখি মনের আনন্দে সামান্য দূরের গাছের ডালে বসে গান গাইতে থাকে। ফলে চতুর শিকারি পাখিরা বুঝে যায় ওদের বাসার অবস্থান। এবার অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। একটি ভালো খবর দিতে চাই আপনাদের। পত্রিকায় প্রকাশিত পাখি নিয়ে আমার লেখাগুলো যারা এক সঙ্গে পেতে চান তারা https://pakhi.tottho.com ঠিকানায় ক্লিক করতে পারেন। এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন বগুড়া জেলার একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হাবিবুর রহমান। ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাকে, পাখি সংক্রান্ত সব ক’টি লেখা একত্রিত করার জন্য। এ পাখির বাংলা নাম: ‘বড় বনলাটোরা’, ইংরেজি নাম: ‘লার্জ উডশ্রাইক’ (Large Woodshrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Tephrodornis gularis| এরা ‘বড় সুধুকা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১৮-২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮-৪৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। উভয়েরই কাজল কালো চোখ। চোখের দু’প্রান্তে চওয়া কালো টান। মাথা নীল কালো। ঘাড় ও পিঠ কালচে-ছাই রঙের। ডানার প্রান্ত কালচে-বাদামি। লেজ গাঢ় খয়েরি। লেজের মধ্যখানের পালক দুটোতে ছাই রঙের ছোপ, বাইরের পালক ময়লা সাদা। গলার নিচে থেকে বুক পর্যন্ত ছাই রঙ। বুকের নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত সাদাটে। ঠোঁট সে্লট কালো। পা সিসে-কালো। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে পঙ্গপাল, ফড়িং ও ঝিঁঝিঁ পোকার প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময়ের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। বাসা বাঁধে গাছের উঁচুতে তে-ডালের ফাঁকে। ঘাস, লতাপাতা, শিকড় ও মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/11/2015