পাতি পাপিয়া | Common Cuckoo | Cuculus canorus
পাতি পাপিয়া | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। শুধুমাত্র গ্রীষ্মে পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশে। মাঝে মধ্যে শরৎ এবং বসন্তকালে দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। সমগ্র দেশে দেখা না গেলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। সাধারণত এরা চিরসবুজ বন অথবা আর্দ্র পাতাঝরা বনে বিচরণ করে। এছাড়াও পর্বতের পাদদেশে তৃণভূমিতে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। বনের গাছ-গাছালির উঁচু ডালে নিজেদের আড়াল করে রাখে। বেশিরভাগ সময় একাকী বিচরণ করে। ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে কর্মচঞ্চলতা বেড়ে যায়। স্বভাবে কিছুটা লাজুক। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে ‘কুক-কু…কুক-কু..’ সুরে ডাকতে থাকে। স্ত্রী পাখি ডাকে সাড়া দেয় ‘হুয়িহুয়িহুয়ি..’ সুরে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত (সমস্ত ভারতে বিচরণ রয়েছে) এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ পর্যন্ত। বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশে এদের অবস্থান মোটেও সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি পাপিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘কমন কুক্কু’ (Common Cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Cuculus canorus | এরা ‘গায়ক কোকিল’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির দৈর্ঘ্য কম বেশি ৩৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৯০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির থুতনি, গলা ফ্যাকাশে ছাই রঙের। পিঠ ধূসর। বুক ফ্যাকাশে ছাই। পেট সাদা। লেজের নিচের কোর্ভাটের ওপর কালো সরু ডোরা। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের প্রান্ত পালক সাদা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা দু’ধরনের। একটি কলিজা রঙের। পিঠ কালচে-বাদামি ডোরা এবং দেহতল কালচে ডোরা। অন্যটির চেহারায় ধূসর, বুকের নিচে লালচে। এছাড়া পুরুষ পাখির সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের ঠোঁটের গোড়া হলদে এবং ডগা শিং-বাদামি। চোখ হলুদ। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঘাড়ের পেছন দিকে সাদা চিতি এবং পালকে সাদা পাড়। প্রধান খাবার: লোমশ শুঁয়োপোকা ও অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। হিমালয় ও সাইবেরিয়াঞ্চলে ডিম পাড়ে। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। ডিম পাড়ে তুলিকা, খঞ্জন, জাড়ফিদ্দা ও চটকের বাসায়। পালক মাতাদের অগোচরে মিনিট খানেকের মধ্যেই ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এরা খুব সহজে পালক মাতার ডিমের সঙ্গে নিজেদের ডিমের রঙ মিলিয়ে পাড়তে পারে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/05/2015
লটকন টিয়া | Vernal hanging parrot | Loriculus vernalis
লটকন টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট মাধবকুণ্ড পৌঁছাতে তখনো প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার পথ বাকি। ঠিক এ মুহূর্তেই গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে তাই জলপ্রপাতের উদ্দেশে হাঁটতে লাগলাম। কিছু দূর যেতেই এক সঙ্গী হাতের তর্জনী উঁচিয়ে রাস্তার পাশের জঙ্গলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলাম দুটি বুনো খরগোশ খাবার খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম ছবি তুলতে আর তখনই ওরা লাফিয়ে জঙ্গলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওদের পিছু নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম, ‘চি-ট-ট, চি-ট-ট’ সুর কানে যেতেই। সুরটা গাছের উপরের মগডাল থেকে আসছে। পরিচিত সুর। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে বাইনোকুলার বের করে আইপিচে চোখ রাখলাম। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম ৭-৮টি পাখি বুনো ফল ঠোকরে খাচ্ছে আর মৃদু স্বরে আওয়াজ করছে। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্থানীয় প্রজাতির পাখি হলেও এরা এখন সুলভ থেকে অসুলভ হয়ে পড়েছে। দেশে খুব একটা নজরে পড়ে না আজকাল। শিকারিদের খপ্পরে পড়ে বন্দীদশায় কাটাতে হচ্ছে এদের। মিশ্র চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা এরা। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার ও সিলেটের সমতল এবং পাহাড়ের পাদদেশের গাছগাছালিতে দেখা যায়। দেখা যায় চা-বাগানাঞ্চলেও। রাতে গাছের মগডালে বাদুরের মতো ঝুলে ঘুমায়। ওদের নামকরণের পেছনে স্বভাবটি যোগ হয়েছে তাই। পাখির বাংলা নাম: ‘লটকন টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘ভারনাল হ্যাংগিং প্যারেট’,(Vernal hanging parrot), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লরিক্যুলাস ভারনালিস’,(Loriculus vernalis)। গোত্রের নাম: ‘সিট্টিসিদি'(Psittaculidae) | এরা ঝুলন টিয়া নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় সাত প্রজাতির টিয়া দেখা যায়। লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার (লেজ ৪ সেন্টিমিটার)। ঠোঁট টকটকে লাল। গলায় ফিরোজা রঙের ছোপ। দেহের উপরাংশ ঘাস-সবুজ। পিঠের শেষাংশ থেকে লেজের ওপর পর্যন্ত উজ্জ্বল লাল। দেহের নিচের পালক হলদেটে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। স্ত্রী পাখির গলায় ফিরোজা রঙের উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: ছোট নরম ফল, ফুলের মধু। এ ছাড়াও তালের রসের প্রতি আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। প্রচুর তালের রস পান করে অনেক সময় নেশাগ্রস্ত হয়ে চুপসে থাকে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে নরম লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/06/2018
বড় গুলিন্দা | Eurasian Curlew | Numenius arquata
বড় গুলিন্দা | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পান্থ পরিযায়ী পাখি (চলার পথের পরিযায়ী)। আমাদের দেশে প্রচণ্ড শীতে আগমন ঘটে সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে। ফিরে যায় এপ্রিলের প্রথম দিকেই। দেশে ফিরেই সংসারী হয় ওরা। আমাদের দেশ সাধারণত বিচরণ করে কাদা-বালিময় সমুদ্র সৈকতে। এ ছাড়াও নদ-নদীর মোহনায়, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পাশঘেঁষা জলাশয়ে কিংবা জোয়ার-ভাটা হয় এমন স্থানেও এদের বিচরণ রয়েছে। এরা লোনা-মিঠা উভয় ধরনের জলেই বিচরণ করে। দিবাচর পাখি। গোধূলিলগ্নের পূর্বেই শিকারে বিরতি টানে। বেশির ভাগই একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায় শিকারে বের হয়। অদ্ভুত গড়নের লম্বা ঠোঁটটি নরম মাটি কিংবা পাথরের নিচে ঢুকিয়ে পোকামাকড় বের করে আনে। গর্তের ভেতর থেকে বের করে আনে ছোট ছোট কাঁকড়া। স্বভাবে হিংস্র নয়। সৈকতচারী অন্য প্রজাতির পাখিদের সঙ্গেও ঘুরেফিরে খাবার খায়। ডাকে মিষ্টি সুরে। উড়তে উড়তে ডাকে ‘ক্লু-ইট, ক্লু-ইট, কুউর-লিই, কার লিউ।’ ইংরেজি নামের শেষাংশের সঙ্গে ওদের ডাকের শেষাংশের হুবহু মিল রয়েছে। তাই অনেকে মনে করেন ‘কারলিউ’ শব্দ থেকে ইংরেজি নামের সূচনা হয়েছে। প্রজাতিটি আমাদের দেশে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। তার প্রধান কারণ শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে না এরা। এ পাখির বাংলা নাম: ‘বড় গুলিন্দা’, ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান কারলিউ’, (Eurasian Curlew), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ন্যুমেনিয়াস আরকোয়াট’ (Numenius arquata), গোত্রের নাম : ‘স্কোলোপাসিদি’। এরা ‘কারলিউ’ বা ‘ইউরেশীয় গুলিন্দা’ নামেও পরিচিত। আবার অনেকের কাছে ‘চোপ্পা’ নামে পরিচিত। দেশের বিশিষ্ট প্রাণী বিজ্ঞানী ড. রেজা খান প্রণীত ‘বাংলাদেশের পাখি’ গ্রন্থে পাখিটিকে ‘বড় গুলিন্দা’ নামে অভিহিত করেছেন। প্রজাতিটি লম্বায় ৫৮-৬০ সেন্টিমিটার এবং ঠোঁট ১৭ সেন্টিমিটার। ঠোঁট অস্বাভাবিক লম্বা, নিচের দিকে বাঁকানো। মাথা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত হালকা বাদামি, তার ওপর কালো ডোরা দাগ। তবে পিঠের অংশ সাদাটে। ডানার নিচটা সাদা। দেহতল সাদা, রেখাযুক্ত। লম্বা পা ও আঙ্গুল ধূসর। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ছোট কাঁকড়া, পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে সাইবেরিয়া অঞ্চলের জলাশয়ের আশপাশের মাটিতে। সামান্য ঘাস-লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/04/2014
কালাঘাড় ডুবুরি | Black necked Grebe | Podiceps nigricollis
কালাঘাড় ডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবল প্রচণ্ড শীতে সিলেটের হাওরাঞ্চলে অল্পবিস্তর দেখা মেলে। স্বাদুজলে বিচরণ করে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট দলেও নজরে পড়ে। সাঁতারে খুব পটু। ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি, ভীতুও সাংঘাতিক। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডুব সাঁতার দিয়ে বাসায় পৌঁছে। এরা লেজহীন পাখি। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুচালো। নিজ বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে পিঠে চড়িয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বাংলা নাম: ‘কালাঘাড় ডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-নেকেড গ্রিব’ (Black-necked Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps nigricollis | এরা ‘কালোমাথা ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ২৮-৩৪ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৩৬০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে অভিন্ন। কপাল, মাথার তালু ও ঘাড় কুচকুচে কালো। মাথা খাড়া। কান পশম সোনালি-হলুদ, যা চোখের পেছন দিক থেকে শুরু করে ঘাড়ের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ কালো। পিঠের দু’পাশ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। বুক কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদা। লেজ খাটো, নেই বললেই চলে। ঠোঁট সুচালো কুচকুচে কালো। চোখের বলয় লাল। চোখের তারা প্রবাল লাল। পা কালচে। পায়ের পাতা চওড়া এবং চেপ্টা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এছাড়াও ছোট চিড়িং, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। শরীরে পালক গজাতে সময় লাগে ১০-১১ সপ্তাহ। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/01/2016
কোকিল | Asian Cuckoo | Eudynamys scolopaceus
কোকিল | ছবি: ইন্টারনেট আদতেই এ পাখি এতটা ভদ্র নয়। বড়রা মোটামুটি ধাড়িবাজ। ধূর্ত কাকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওদের বাসায় ডিম পেড়ে নিজের বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। ‘সুসময়ের বন্ধু’ পাখি নামে পরিচিত, বলা হয় বসন্তের দূতও। বসন্তকালে লোকালয়ে চলে আসে ওরা। পুরুষ পাখি ‘কুহু-কুহু-কুহু’ ডেকে মানুষের মন মাতিয়ে তোলে। সুরে এক ধরনের মাদকতা রয়েছে। স্ত্রী পাখির কণ্ঠ তত সুরেলা নয়। কর্কশ। ডাকে ‘খিক্-খিক্-খিক্’ স্বরে। বৃক্ষচারী পাখি এরা। পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে বিবাদ বাধায় না। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কোকিল বা কুলি’| ইংরেজি নাম: ‘এশিয়ান কুক্কু’ (Asian Cuckoo)| বৈজ্ঞানিক নাম: (Eudynamys scolopaceus), গোত্রের নাম: ‘কুকুলিদি’। এরা লম্বায় ৩৯-৪৬ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির বর্ণ কুচকুচে কালো হলেও উজ্জ্বল সবুজের আভা বের হয় শরীর থেকে। চোখের তারা টকটকে লাল (কাক-কোকিলের মধ্যে বড় তফাত এটি)। স্ত্রী পাখির বর্ণ কালোর ওপর বাদামি ফোঁটাযুক্ত। সমস্ত পিঠে অসংখ্য বাদামি ফোঁটা। এদের নিচের দিকটা সাদাটে বর্ণের ওপর বাদামি ফোঁটা। লেজের ওপর সাদা ফোঁটার সঙ্গে স্পষ্ট ডোরাদাগ। উভয় পাখির ঠোঁট নীলচে-সবুজ এবং পা পায়ের পাতা কালচে। কোকিলের প্রিয় খাবার ফল-ফলাদি। ফুলের মধু, খেজুরের রস এবং কীটপতঙ্গেও ভাগ বসায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না বিধায় পরের বাসায় ডিম পাড়ে। বিশেষ করে কাক, সাতভায়লা পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশের খবর, 07/03/2018
আমুর শাহিন | Amur Falcon | Falco amurensis
আমুর শাহিন | ছবি: ইন্টারনেট পাখির নাম ‘আমুর শাহিন’। আমুরল্যান্ডে বিচরণ আধিক্য বিধায় হয়তো এই নাম ওদের। এরা উপমহাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। সুদর্শন, স্লিম গড়নের পাখি। দেখতে কিছুটা ককাটিল পাখিদের মতো। পুরুষদের চেহারা চকচকে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ; ভিন্ন বর্ণের। প্রাকৃতিক আবাসস্থল খোলা মাঠপ্রান্তর, খোলা বনাঞ্চল। শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে হিংস নয়। একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আমুরল্যান্ড, ট্রান্সবিকালিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়া, উত্তর-পূর্ব মঙ্গোলিয়া উত্তর-পূর্ব চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়, উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে আইসিইউএন এদের শনাক্ত করেছে তাই। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘আমুর শাহিন ’, ইংরেজি নাম: ‘আমুর ফ্যালকন’, (Amur Falcon), বৈজ্ঞানিক নাম: Falco amurensis | এরা ‘লালপা তুরমুতি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ৩০-৩৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৯৭-১৫৫ গ্রাম। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ গাঢ় ধূসর। ডানা খানিকটা লম্বা। দেহতল ধূসর। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত লাল। চোখের বলয় কমলা হলুদ। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালচে বাঁকানো, গোড়া কমলা হলুদ। পা লালচে কমলা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা ভিন্ন। শরীরে ধূসর, হলুদ, সাদা, বাদামির মিশ্রণ ছিট। বাদবাকি পুরুষের মতো। প্রধান খাবার: ঘাসফড়িং, পতঙ্গ, ছোট পাখি ও ছোট সরীসৃপ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। গাছের উঁচু ডালে চিকন ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। মাস খানেকের মধ্যেই শাবক স্বাবলম্বী হয় এবং বাবা-মাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/10/2017
ধলাভ্রু চুটকি | Snowy Browed Flycatcher | Ficedula hyperythra
ধলাভ্রু চুটকি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন। প্রচণ্ড শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে দেশে। সুন্দরবন ব্যতীত দেশের প্রায় বনাঞ্চলেই যৎসামান্য নজরে পড়ে। বিচরণ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনাঞ্চলে এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পার্বত্য অরণ্যে। স্যাঁতসেঁতে এলাকা দারুণ পছন্দ এদের। বেশিরভাগ সময় একাকী বিচরণ করে। স্বভাবে মোটামুটি শান্ত। মাঝারি আকৃতির গাছের চিকন ডালে বসে অকারণে এদিক সেদিক ঘাড়টাকে ফেরাতে থাকে। কণ্ঠস্বর সুমধুর। গান গায় ‘সিট-সি-সি’ সুরে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, কম্বোডিয়া, তাইওয়ান, লাওস, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। যে পাখিটি নিয়ে লিখছি তার বাংলা নাম: ‘ধলাভ্রু চুটকি’, ইংরেজি নাম: স্নোয়ি ব্রোয়েড ফ্লাইকেচার (Snowy-browed Flycatcher), বৈজ্ঞানিক নাম: Ficedula hyperythra | এরা ‘সাদাভ্রু চটক’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কম-বেশি ১১-১৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির চোখের ওপর মোটা সাদাভ্রু। থুতনি, কপাল, চোখের সামনের দিক কালচে। মাথা পিঠ গাঢ় নীল। ডানার মধ্য পালক লালচে। গলা এবং বুক লালচে-কমলা। পেট সাদা। স্ত্রী পাখির ভ্রু কমলা-বাদামি। বুকে ফুটকি। ডানার মধ্য পালক এবং লেজ লালচে। উভয়ের ঠোঁট শিঙ কালো। পা ধূসর। প্রধান খাবার: শুককীট, মাকড়সা, কেঁচো ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে অক্টোবর। শৈবাল বা তন্তু দিয়ে গাছের ডালে কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/06/2015