খয়রামাথা গাঙচিল | Brown headed gull | Larus brunnicephalus
খয়রামাথা গাঙচিল | ছবি: ইন্টারনেট কেয়ারি সিন্দাবাদের সওয়ার হয়ে নাফ নদী পার হচ্ছি। গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ। কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে বসে আছি জাহাজে। মাঝে-মধ্যে জানালার কাচ সরিয়ে নাফের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ওপারে মিয়ানমারের ভূখণ্ড নজরে পড়তে অভিভূত হয়ে পড়ি। আরও অভিভূত হয়ে পড়েছি এক দঙ্গল জলচর পাখির কলকাকলিতে। ওরা ভেসে বেড়াচ্ছে নাফ নদীর জলে, আবার কিছু পাখি ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে ভেসে ডাকছে ‘কি-ই-য়া’ সুরে। বেশ পরিচিত সুশ্রী গড়নের পাখি এরা। নজর পড়লে প্রকৃতির এ বর্ণাঢ্য অলঙ্কার থেকে কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। শীত মৌসুমে ডাকাতিয়া, পদ্মা, মেঘনা, রজতরেখা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার জলে ওদের ভেসে বেড়াতে দেখেছি অসংখ্যবার। বছরখানেক আগে দেখেছি ধলেশ্বরীর বুকে জেলেদের ভাসমান ডিঙ্গিতে বেড়ানোর সময়। আজ ওই প্রজাতির পাখিগুলোকে দেখে সে কথা মনে পড়েছে। এরা পরিযায়ী হলেও সুলভ দর্শন। শীতের শুরুতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নদ-নদী কিংবা সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নেয়। ছোট-বড় দলে ভেসে বেড়ায় জলাশয়ে। দিনের বেশির ভাগ সময় উড়ে উড়ে ব্যস্ত সময় পার করে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘খয়রামাথা গাঙচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউনহেডেড গাল’,(Brown-headed gull), বৈজ্ঞানিক নাম: Larus brunnicephalus | গোত্রের নাম: ‘লারিদি’। অঞ্চলভেদে ‘গঙ্গা কৈতর’ নামেও পরিচিত। এরা লম্বায় ৩৮-৪৫ সেন্টিমিটার। প্রজনন সময়ে টুপি আকৃতির মাথাটা গাঢ় বাদামি রং ধারণ করে। শীতে রং বদলিয়ে হয় ধূসর-সাদা-কালো। পিঠ ধূসর। লেজ কালো। শরীরের বাকি অংশ ধবধবে সাদা। ঠোঁটের গোড়া রক্তিম, ডগা কালো। পা উজ্জ্বল লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। এদের প্রধান খাবার মাছ। মরা মাছের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন সময় মধ্য জুন থেকে জুলাই। তখন নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। বাসা বাঁধে লাডাখ, তুর্কিস্তান ও দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার দ্বীপাঞ্চলে। এরা সরাসরি মাটিতে ঘাস, লতা-পাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/06/2018
সাদালেজি টি টি | White-Tailed Lapwing | Vanellus leucurus
সাদালেজি টি টি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। শীতে দক্ষিণ ভারতীয় উপমহাদেশে হাজির হয়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি উপমহাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত। বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যাওয়ার নজির নেই। বন্যপ্রাণী গবেষক ড. রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ গ্রন্থ মোতাবেক জানা যায়, ১৯৯৫ সালে রাজধানীর জিনজিরা এলাকায় রবিশস্যের ক্ষেতে ৫০টি পাখির ঝাঁক দেখা গেছে। অতঃপর কারো নজরে পড়েছে কিনা তা অদ্যাবধি জানা যায়নি। ‘সাদালেজি টি-টি’ হিংস্র নয়, চঞ্চল স্বভাবের। স্থিরতা নেই ওদের মাঝে। কোথাও একদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকার মতো সময় যেন ওদের নেই। সারাদিন দৌড়ের ওপরেই থাকে। চঞ্চল হলেও একদম ঝগড়াঝাটির ধার ধারে না। দেখতে গো-বেচারা টাইপ চেহারা। মায়াবী গড়ন। শরীরের তুলনায় পা বেশ লম্বা। প্রজাতির অন্যসব টি-টি পাখিদের মতোই নদীর অববাহিকায় বিচরণ করে। স্যাঁতসেঁতে এলাকায় পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। ছোট দলে কিংবা একাকী বিচরণ করে। খাবারের সন্ধানে অনেক সময় হাঁটুজল অবধি নেমে পড়ে। সরাসরি জলে নামতে দেখা যায় না খুব একটা বরং কাদাজলে হাঁটু অবধি নেমে খাবার খোঁজে। শুকনো ঘেসো মাঠেও বিচরণ করে। দৌড়ে দৌড়ে পোকামাকড় ধরে। সমুদ্র সৈকতেও দেখা যায়। বালুবেলায় শিকার খুঁজে বেড়ায়। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদালেজি টি-টি’, ইংরেজি নাম:‘ হোয়াইট টেইলড ল্যাপউইং’ (White-Tailed Lapwing), বৈজ্ঞানিক নাম: Vanellus leucurus | এরা ‘সাদালেজি টি-ট্রিভা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৬-২৯ সেন্টিমিটার। ডানার দৈর্ঘ্য ৬৭-৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ৯৯-১৯৮ গ্রাম। কপাল, ঘাড়, পিঠ ও লেজ হলুদাভ-বাদামি। ডানার কিনার কালো-সাদার লম্বা টান। লেজের প্রান্ত পালক কালো। লেজের মধ্যবর্তী অংশ সাদা। বুক হলুদাভ-বাদামি। বুকের নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত ক্রিম সাদা। ঠোঁট ও চোখ কালো। লিকলিকে লম্বা পা দুটি উজ্জ্বল হলুদ। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, শুককীট ও ফড়িং। প্রজনন মৌসুম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে মধ্য জুলাই, তবে সুদান, ইরান-ইরাক এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। যেমন রাশিয়ায় সেপ্টেম্বরে প্রজনন ঘটে। বাসা বাঁধে নদীর উপত্যকায় ঘাস-লতা বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/07/2015
কালাপেট পানচিল | Black bellied Tern | Sterna acuticauda
কালাপেট পানচিল | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। সুচালো স্লিম আকৃতির গড়ন। দেখতে মন্দ নয়। উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে এদের দেখা মিললেও মূলত এরা সামুদ্রিক পাখি। হ্রদ কিংবা নদ-নদীতে বিচরণের পাশাপাশি দেখা মেলে বালুময় দ্বীপাঞ্চলেও। এ ছাড়া কৃষিজমিতে বিচরণ রয়েছে। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। কলোনি টাইপ বাসা বাঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। তবে নিজেদের মধ্যে কমবেশি ঝগড়া বাধে। এ সময় বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’ সুরে। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদেরকে পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা দেশে মোটামুটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া পর্যন্ত। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এদের অবস্থান কিছুটা ভালো। পাখির বাংলা নাম: ‘কালাপেট পানচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-ব্যালিড টার্ন’ (Black-bellied Tern), বৈজ্ঞানিক নাম: Sterna acuticauda | এরা ‘কালো গাংচিল’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে ৩২-৩৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রজনন পালক ভিন্ন। মাথায় টুপি আকৃতির ঘন কালো পালক, যা ঘাড়ের উপরিভাগ অবধি নেমে গেছে। পিঠ, ডানা ও লেজ সাদাটে ধূসর। ডানা এবং লেজের অগ্রভাগ সরু। গলা সাদা। বুক ধূসর কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত গাঢ় কালো। ওড়ার পালক সাদা। চোখের কালো। হলুদ ঠোঁটের গোড়ার দিক মোটা হলেও প্রান্তটা সুচালো। পা ও আঙ্গুল কমলা হলুদ। প্রধান খাবার: ছোট মাছ। এ ছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড়, সরীসৃপ, শুককীট খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম ফ্রেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। জলাশয়ের কাছাকাছি বেলাভূমি এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৩ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে ৪-৫ সপ্তাহ সময় লাগে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/02/2016
কালি ময়ূর | Kalij pheasant | Lophura leucomelanos
কালি ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট প্রায় সাড়ে তিন যুগ আগেও আমাদের দেশের গহিন জঙ্গলগুলোতে এ পাখির প্রচুর বিস্তৃতি ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল এরা। আমাদের দেশের পাখি বিশারদরা জানিয়েছেন, কয়েক যুগ আগেও মধুপুরের শালবনে পাওয়া যেত এই পাখি। এখন আর নজরেই পড়ে না। শিকারিদের দৌরাত্বে পাখিটি শালবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে কালেভদ্রে নজরে পড়ে। আমি বছর দশেক আগে প্রথম এ পাখিটি দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। মাত্র দুটি পাখি দেখেছি সেদিন। মোরগাকৃতির এ পাখি দুটিকে দেখে সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। স্থানীয় লোকজনের কাছে পাখিটার নাম জানতে চেয়েছি। তারা জানিয়েছেন এগুলোর নাম ‘কালা মুরকা।’ এ-ও জানিয়েছেন তারা জঙ্গলের আশপাশে এ পাখি শিকার করতে ওঁৎ পেতে থাকেন। এগুলো খুব ভোরে ও সূর্যাস্তের সামান্য আগে জঙ্গল থেকে ফাঁকা স্থানে বেরিয়ে আসে। সে সুযোগে শিকারিরা এগুলোকে শিকার করে। এই পাখির মাংস পাহাড়িদের কাছে বেশ প্রিয়। বাংলায় এই পাখির কোনো নাম নেই। আমাদের দেশের পাখি গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালি ময়ূর।’ নামটি বেশ মানানসই বলা যায়। ইংরেজি নাম: ‘কালিজ ফেজেন্ট’, (Kalij pheasant) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লোফুরা লিউকোমেলানোস’, (Lophura leucomelanos) গোত্র: ‘ফাজিয়ানিদি’। কালি ময়ূর স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে যা পাখি বিশারদের নজর এড়াতে পারবে না। তবে সাধারণের চোখে পার্থক্যটা সহজে ধরা পড়বে না। পার্থক্যটা হচ্ছে, পুরুষ পাখি লম্বায় ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫০-৬০ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির শরীরের ওপরের দিকটার পালক চকচকে কালোর সঙ্গে ধাতব মিশ্রণ। নিুাংশ সাদাটে। চোখের চারপাশটা ও লতিকা টকটকে লাল। স্ত্রী কালি ময়ূর দেখতে হালকা বাদামি তবে কোনো কোনো অংশে গাঢ় বাদামি। ঝুঁটি বাদামি রংয়ের এবং লেজটা কাস্তের মতো বাঁকানো। দেখতে বেশ চমৎকার। কালি ময়ূরদের কণ্ঠস্বর বিশ্রী। উচ্চৈঃস্বরে ডাকলে ‘চিরপ..চিরপ’ শব্দ শোনা যায়। আর স্বাভাবিক স্বরে ডাকলে ‘কুরচি…কুরচি’ শব্দ করে। দেখতে হিংস্র মনে হলেও আসলে এরা খুবই ভীরু প্রকৃতির পাখি। কালি ময়ূরের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শস্যদানা, শস্যের কচি ডগা, কীটপতঙ্গ, ছোট সরীসৃপ ইত্যাদি। এরা বন মোরগের মতো মাটি আঁচড়ে পোকামাকড় খোঁজে। এদের প্রজননের সময় মার্চ থেকে অক্টোবর। মাটির ওপরে ঘাস কিংবা শুকনো লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/09/2012
বড় সুইচোরা | Blue bearded Bee eater | Nyctyornis athertoni
বড় সুইচোরা | ছবি: ইন্টারনেট সুইচোরা, পুরো নাম ‘বড় সুইচোরা’। দুর্লভ আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। সুদর্শনও বটে। চাহনি রুক্ষ হলেও স্বভাবে অহিংস। যত্রতত্র দেখা মেলে না। মাঝে-মধ্যে এদের খোঁজ মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আর্দ্র পাতাঝরা ও চিরসবুজ অরণ্যের স্রোতধারায়। আবাদযোগ্য জমির আশপাশেও দেখা যায়। সুইচোরা অরণ্যের ভেতর ফাঁকা স্থানে বা জলাশয়ের কিনারে গাছের ওপর একাকী বসে থাকে শিকারের প্রতীক্ষায়। তবে যেখানেই বসুক না কেন, আশপাশটা ঝাপ-জঙ্গল-লতাপাতা কিংবা ঘন ডালপালাবিহীন মুক্তাঞ্চল হওয়া চাই-ই। যাতে কিছু সময় পর পর উড়তে সুবিধা হয়। সব ধরনের সুইচোরা পাখি উড়ন্ত অবস্থায়ই পতঙ্গ শিকার করে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে যে কোনো ধরনের কীটপতঙ্গ দেখলেই ছোঁ মেরে ধরে ফেলে এ পাখি। জলপানেও রয়েছে এদের বৈচিত্র্যতা। জলের ওপর উড়ে উড়ে ছোঁ মেরে এরা জল পান করে। স্থিরতা এদের মাঝে খুবই কম। কোথাও একদণ্ড বসে থাকার ফুরসত নেই যেন। বিরক্ত হলে ‘কর-র-র…কর-রর…’ কণ্ঠে আওয়াজ করে। বাংলাদেশ ছাড়া সুইচোরার বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ত পর্যন্ত। আইইউসিএনের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পাখি অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণিতে রয়েছে। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় সুইচোরা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্লুবারডেড বী-ইটার’ (Blue-bearded Bee-eater), বৈজ্ঞানিক নাম: Nyctyornis athertoni | এরা ‘নীলদাড়ি সুইচোর’ বা ‘পাহাড়ি সুইচোরা’ নামেও পরিচিত। সুইচোরা লম্বায় ৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তফাৎ নেই। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপাল নীল। ঘাড়, পিঠ ও লেজ সবুজ। লেজের নিচের দিক হলুদাভ। লেজের ডগা ভোঁতা। ডানার নিচের পালক হলুদাভ-পীতাভ। গলায় রয়েছে দাড়িসদৃশ নীল রঙের পালক, যা বুকের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। বুক কালচে নীল। পেট হলুদাভ-পীতাভ ডোরা। বাঁকানো ঠোঁট শিঙ বাদামি রঙের। নিচের ঠোঁটের গোড়া ধূসর। চোখ উজ্জ্বল সোনালি-কমলা। পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে সবুজ। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নীলদাড়ি থাকে না। প্রধান খাবার: মৌমাছি, ফড়িং, বোলতা, গুবরে পোকা ইত্যাদি। ফুলের মধুর প্রতি যথেষ্ট আসক্তি রয়েছে। এদের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট। বন-জঙ্গল বেষ্টিত জলাধারের খাড়া কিনারে অথবা পাহাড়ের গায়ে এরা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/10/2018
চিতিপাক গোশালিক | Spot winged Starling | Saroglossa spiloptera
চিতিপাক গোশালিক | ছবি: ইন্টারনেট বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাস্থল পরিষ্কার বনপ্রান্ত, খোলা বন, কৃষিজমি। এ ছাড়াও পর্বতের ৭০০-১০০০ মিটার উঁচুতে দেখা যায়। দেশে যত্রতত্র দেখা যায় না। বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। বিচরণ করে ছোট দলেও। স্বভাবে অন্যসব শালিকের মতোই ঝগড়াটে। সারাদিন খুনসুটি করে কাটায়। তবে ওদের ঝগড়া খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় না, কিচির-মিচির পর্যন্তই ঝগড়া। পরক্ষণে আবার মিলেও যায়। আবার শুরু। এভাবেই দিন কাটে। পারতপক্ষে কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি। বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘চিতিপাক গোশালিক’, ইংরেজি নাম: ‘স্পট-উইংড স্টার্লিং’ (Spot-winged Starling), বৈজ্ঞানিক নাম: Saroglossa spiloptera। এরা ‘লালচেগলা শালিক’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১০ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে: গো-শালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, পাতি কাঠশালিক, গোলাপি কাঠশালিক, চিতিপাখ গোশালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, বামুন কাঠশালিক ও ধলাতলা শালিক। এরা লম্বায় ১৯-২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা বাদামি। ঘাড় ও পিঠ ধূসর এবং কালো-বাদামি। ডানার প্রান্ত নীলাভ কালো। লেজ লালচে বাদামি। গলা লালচে। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদাটে। বুকের দু’পাশ শেয়ালে লাল। ঠোঁট নীলাভ কালো। চোখের বলয় সাদা। পা বেগুনি কালো। দেখতে একই রকম মনে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ। আকারেও সামান্য ছোট। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, পিঁপড়া, ছোট ফল, ফুলের মধু। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। বাসা বাঁধে ৬-১০ মিটার উচ্চতার গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, লতাপাতা, দড়ি, কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/08/2017
বাদামি ঈগল | Steppe Eagle | Aquila nipalensis
বাদামি ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট শিকারি পাখি। শীতে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া পূর্ব ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, রাশিয়া, রুমানিয়া, মঙ্গোলিয়া, উত্তর-পূর্ব চীন, দক্ষিণ তিব্বত, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকা (শীতকাল) পর্যন্ত। স্বভাবে হিংস্র। অন্যসব ঈগলদের মতোই শিকার খোঁজে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএ প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামি ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘স্টেপ ঈগল’ (Steppe Eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: Aquila nipalensis | কোনো কোনো পাখি বিশারদের কাছে এরা ‘নেপালি ঈগল’ নামে পরিচিত। তবে কেন এ নামকরণ তা বিস্তারিত জানা যায়নি। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৬২-৮১ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ১৬০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ২-৩.৫ কেজি। স্ত্রী পাখি ২.৩-৪.৯ কেজি। মাথা ও গলা কপি বাদামি। পিঠ পাঁশুটে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ক্রিম সাদা। ওড়ার পালক কালচে। কোমরের পালক ক্রিম সাদা। লেজ কালচে বাদামি। বুক ও পেট পাঁশুটে বাদামি। ঠোঁট শিং কালো শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া এবং মুখের কিনার হলুদ। পা বাদামি পালকে আবৃত। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, ইঁদুর, সরীসৃপ ও ছোট পাখি। এ ছাড়াও সব ধরনের টাটকা এবং গলিত মাংস খায়। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুলাই। তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। ডালপালা দিয়ে বড়সড়ো অগোছালো বাসা বানায়। এক বাসায় বহু বছর ধরে ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৪০-৪৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৫৫-৬৫ দিন। প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৪-৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/10/2016