কোকিল | Asian Cuckoo | Eudynamys scolopaceus
কোকিল | ছবি: ইন্টারনেট আদতেই এ পাখি এতটা ভদ্র নয়। বড়রা মোটামুটি ধাড়িবাজ। ধূর্ত কাকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওদের বাসায় ডিম পেড়ে নিজের বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। ‘সুসময়ের বন্ধু’ পাখি নামে পরিচিত, বলা হয় বসন্তের দূতও। বসন্তকালে লোকালয়ে চলে আসে ওরা। পুরুষ পাখি ‘কুহু-কুহু-কুহু’ ডেকে মানুষের মন মাতিয়ে তোলে। সুরে এক ধরনের মাদকতা রয়েছে। স্ত্রী পাখির কণ্ঠ তত সুরেলা নয়। কর্কশ। ডাকে ‘খিক্-খিক্-খিক্’ স্বরে। বৃক্ষচারী পাখি এরা। পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে বিবাদ বাধায় না। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কোকিল বা কুলি’| ইংরেজি নাম: ‘এশিয়ান কুক্কু’ (Asian Cuckoo)| বৈজ্ঞানিক নাম: (Eudynamys scolopaceus), গোত্রের নাম: ‘কুকুলিদি’। এরা লম্বায় ৩৯-৪৬ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির বর্ণ কুচকুচে কালো হলেও উজ্জ্বল সবুজের আভা বের হয় শরীর থেকে। চোখের তারা টকটকে লাল (কাক-কোকিলের মধ্যে বড় তফাত এটি)। স্ত্রী পাখির বর্ণ কালোর ওপর বাদামি ফোঁটাযুক্ত। সমস্ত পিঠে অসংখ্য বাদামি ফোঁটা। এদের নিচের দিকটা সাদাটে বর্ণের ওপর বাদামি ফোঁটা। লেজের ওপর সাদা ফোঁটার সঙ্গে স্পষ্ট ডোরাদাগ। উভয় পাখির ঠোঁট নীলচে-সবুজ এবং পা পায়ের পাতা কালচে। কোকিলের প্রিয় খাবার ফল-ফলাদি। ফুলের মধু, খেজুরের রস এবং কীটপতঙ্গেও ভাগ বসায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না বিধায় পরের বাসায় ডিম পাড়ে। বিশেষ করে কাক, সাতভায়লা পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশের খবর, 07/03/2018
তুলিকা | Olive-backed pipit | Anthus hodgsoni
তুলিকা | ছবি: ইন্টারনেট দেখতে চড়–ই পাখির মতো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এরা চড়–ই নয়। পরিযায়ী পাখি এরা। প্রচণ্ড শীতে ইউরেশিয়া থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। শীত মৌসুমে দেশের সর্বত্রই এদের বিচরণ হলেও সংখ্যায় সন্তোষজনক নয়। বলা যায় অসুলভ। ঢাকা শহরেও দেখা যায়। বিশেষ করে মিরপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে মাঝে মাঝে নজরে পড়ে। হালকা বনাঞ্চল এলাকা এদের প্রিয়। আম-বাঁশ বাগানে বেশি নজরে পড়ে। জলপানের তৃষ্টা না পেলে জলাশয়ের ধারে-কাছে পারতপক্ষে ভিড়ে না। এরা ভীতু প্রকৃতির পাখি হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যের সন্ধানে মাটিতে নামে। এমতাবস্থায় ভয় পেলে ‘ছিস’ আওয়াজ করে উড়ে যায়। ভয় কেটে গেলে পুনরায় মাটিতে নেমে খাবার খায়। গান গায় ‘ছিপ-ছিপ-ছিয়া-ছিয়া’ সুরে। এ পাখি ছোট-বড় দলে আলো-আঁধারি ভূমির ওপর পোকামাকড় খোঁজে। বিশেষ করে মাঠে-ময়দানে দৌড়ে দৌড়ে শিকার ধরে। খঞ্জন পাখির মতো এরাও লেজ নাচায়। সারাক্ষণ নয়, মাঝে মধ্যে নাচায়। প্রথম সাক্ষাতে লেজ নাচানো অবস্থায় দেখি মিরপুরের চিড়িয়াখানায়। বন্দি অবস্থায় নয়। মুক্ত। চিড়িয়াখানার ফাঁকা জায়গায় ৩-৪টি পাখিকে খাবারের সন্ধানে দেখি কোনো এক শীতে। সময়টা নব্বই দশকের প্রথমার্ধে। তখনো পাখি পর্যবেক্ষণ করতে বনে-বাদাড়ে প্রবেশ করিনি। চোখের সামনে পড়লে দেখে নেই এ পর্যন্তই। আর বড়জোর চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশু-পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে নোট খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখি। সত্যি বলতে কি সে থেকেই মূলত আমি পাখি পর্যবেক্ষণ করার উৎসাহ বোধ করি। সে যাই হোক, পাখিটাকে দেখে প্রথমত খঞ্জন প্রজাতির পাখি ভেবেছি এবং আমার নোট খাতায় ওদের নাম ‘খঞ্জন পাখি’ লিখে রাখি। পরে ভুলটা শুধরে নিয়েছি রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামক গ্রন্থের শরণাপন্ন হয়ে। গ্রন্থ পাঠে জেনেছি ওদের সঠিক বাংলা নামটিও। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তুলিকা’, ইংরেজি নাম: ‘অলিভ ব্যাকেড পিপিট’(Olive-backed pipit), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthus hodgsoni| লম্বায় এরা ১৫ সেন্টিমিটার। লেজ ৬ সেন্টিমিটার। গলার পাশে কালো ডোরা। ঠোঁট ছোট। দেহের অধিকাংশ পালক সবুজাভ-জলপাই। তার ওপর চওড়া, খাটো ডোরা দাগ। ডানায় স্পষ্ট সাদা বন্ধনী। তলপেটের দিকে কোনো ধরনের রেখা নেই। লেজের তলার দিকটা সাদাটে। আবার লেজের দু’পাশের পালকও সাদাটে। চোখের বলয় সবুজাভ-জলপাই। ভ্রুর ওপরে সাদা ডোরা। পা হলুদাভ-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ঘাসবীজ ইত্যাদি। প্রজনন সময় মে-জুলাই। বাসা বানায় সরু-নরম লতা দিয়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/05/2013
লটকন টিয়া | Vernal hanging parrot | Loriculus vernalis
লটকন টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট মাধবকুণ্ড পৌঁছাতে তখনো প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার পথ বাকি। ঠিক এ মুহূর্তেই গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে তাই জলপ্রপাতের উদ্দেশে হাঁটতে লাগলাম। কিছু দূর যেতেই এক সঙ্গী হাতের তর্জনী উঁচিয়ে রাস্তার পাশের জঙ্গলের দিকে ইঙ্গিত করলেন। দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলাম দুটি বুনো খরগোশ খাবার খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম ছবি তুলতে আর তখনই ওরা লাফিয়ে জঙ্গলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওদের পিছু নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম, ‘চি-ট-ট, চি-ট-ট’ সুর কানে যেতেই। সুরটা গাছের উপরের মগডাল থেকে আসছে। পরিচিত সুর। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে বাইনোকুলার বের করে আইপিচে চোখ রাখলাম। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম ৭-৮টি পাখি বুনো ফল ঠোকরে খাচ্ছে আর মৃদু স্বরে আওয়াজ করছে। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্থানীয় প্রজাতির পাখি হলেও এরা এখন সুলভ থেকে অসুলভ হয়ে পড়েছে। দেশে খুব একটা নজরে পড়ে না আজকাল। শিকারিদের খপ্পরে পড়ে বন্দীদশায় কাটাতে হচ্ছে এদের। মিশ্র চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা এরা। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার ও সিলেটের সমতল এবং পাহাড়ের পাদদেশের গাছগাছালিতে দেখা যায়। দেখা যায় চা-বাগানাঞ্চলেও। রাতে গাছের মগডালে বাদুরের মতো ঝুলে ঘুমায়। ওদের নামকরণের পেছনে স্বভাবটি যোগ হয়েছে তাই। পাখির বাংলা নাম: ‘লটকন টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘ভারনাল হ্যাংগিং প্যারেট’,(Vernal hanging parrot), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লরিক্যুলাস ভারনালিস’,(Loriculus vernalis)। গোত্রের নাম: ‘সিট্টিসিদি'(Psittaculidae) | এরা ঝুলন টিয়া নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় সাত প্রজাতির টিয়া দেখা যায়। লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার (লেজ ৪ সেন্টিমিটার)। ঠোঁট টকটকে লাল। গলায় ফিরোজা রঙের ছোপ। দেহের উপরাংশ ঘাস-সবুজ। পিঠের শেষাংশ থেকে লেজের ওপর পর্যন্ত উজ্জ্বল লাল। দেহের নিচের পালক হলদেটে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। স্ত্রী পাখির গলায় ফিরোজা রঙের উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: ছোট নরম ফল, ফুলের মধু। এ ছাড়াও তালের রসের প্রতি আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। প্রচুর তালের রস পান করে অনেক সময় নেশাগ্রস্ত হয়ে চুপসে থাকে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে নরম লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 08/06/2018
লাল লতিকা হট্টিটি | Red wattled Lapwing | Vanellus indicus
লাল লতিকা হট্টিটি | ছবি: ইবার্ড যেখানে বড়সড়ো জলাশয় রয়েছে, সেখানে কম-বেশি ওদের বিচরণও রয়েছে। পানিতে সম্পূর্ণ শরীরটা ডুবিয়ে শিকার খোঁজে না। বড় জোর হাঁটুসমান পানিতে নেমে শিকার খোঁজে। ফাঁকা মাঠেও দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা জ্যোসনা রাতেও খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। একা কিংবা দলবদ্ধভাবেও বিচরণ করে। দেশের সর্বত্রই এ পাখিটাকে কমবেশি দেখা যায়। আমি প্রথম দেখেছি হাসাইলে। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় পড়েছে। গিয়েছি বছর চারেক আগে। নদীভাঙন দেখতে। পদ্মার পেটে ততক্ষণে হাসাইল বাজারটা হজম পক্রিয়ার পথে রয়েছে। হাসাইলবাসীর দুঃসময়ে পদ্মার পাড়ে পাখিটিকে দেখেছি সেদিন। একটি নয় ওরা সংখ্যায় একাধিক ছিল। দেখতে সুবিধাও হয়েছে তাই। কারণ পাখিরা একাকী থাকার চেয়ে দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় বেশি সাহসী হয়। এতে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও পাওয়া যায় বেশি। পাখিটা দেখতে ভারি চমৎকার। কিন্তু কণ্ঠস্বর কর্কশ। দলের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা না হলে কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হট্টিটি..টি..টি..হট্টিট-টিট্’। স্ত্রী-পুরুষের কণ্ঠে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ কণ্ঠ একটু ভারী। কণ্ঠস্বর শুনেও স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য বোঝা যায়। পাখিটার বাংলা নাম: ‘লাল লতিকা হট্টিটি,’ ইংরেজি নাম: ‘রেড ওয়াটলড ল্যাপউইং’, (Red-wattled Lapwing) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ভ্যানেল্লাস ইন্ডিকাস’ (Vanellus indicus) গোত্রের নাম: ‘চারাড্রিআইদি’। আমাদের দেশে মোট দু’ধরনের হট্টিটি দেখা যায়। যথাক্রমে: ১. লাল লতিকা হট্টিটি, ২. হলুদ লতিকা হট্টিটি। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা। লতিকা চোখের দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গোল বৃত্তের রূপ নিয়েছে। সেটি দেখলে মনে হয় বুঝি ওরা চশমা পরে আছে। হট্টিটির গলা, বুক, মাথার তালু ও ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত লাল। চোখের পাশ থেকে ধবধবে সাদা টান ঘাড় হয়ে বুকের কিছু অংশসহ পেট ও লেজের তলা পর্যন্ত ঠেকেছে। ডানা বোজানো অবস্থায় পিঠ ও লেজের উপরি ভাগটা চকচকে বাদামির ওপর জলপাই রঙের আভা। পা বেশ লম্বা, বর্ণ হলুদ। হট্টিটি খুবই চতুর পাখি। চলাফেরায় থাকে অত্যন্ত হুঁশিয়ারি ভাব। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে বিপদ সংকেত, খুশির সংকেত, ডিমপাড়া ও বাচ্চা ফোটার সংকেত, বাচ্চা হারানোর সংকেত, বিপদ মুক্তির সংকেত। এ সুরগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কণ্ঠে তুলতে পারে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ পোকামাকড়, কেঁচো, কচি শাকসবজি ইত্যাদি । প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। মিলন শেষে মাটির অগভীর গর্তে অথবা মাঠ-প্রান্তরের নিরিবিলি স্থানে বাসা বাঁধে। বাসা দেখতে হাস্যকর। মাটির ঢেলা দিয়ে তৈরি করে। চারপাশে ছোট ছোট মাটির ঢেলা সাজিয়ে থালাকৃতির বাসা বানিয়ে মাঝখানে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। হট্টিটির বাচ্চাদের জলপান বেশ মজাদার। মা পাখিটা জলে ভেজে বাচ্চাদের কাছে এলে ওরা মায়ের ভেজা লোম চুষে জলপান করে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/09/2012
তিলা মুনিয়া | Spotted munia | Lonchura punctulata
তিলা মুনিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অতিপরিচিত পাখি এরা। দেখতেও বেশ সুন্দর। প্রকৃতিতে বিচরণের চেয়ে আজকাল ওদের বেশি দেখা যায় খাঁচায় বন্দি অবস্থায়। যে কোনো পাখির দোকানে গেলেই ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘কিরিটি চিরিটি চিট্টি-কিট্টি-কিটরি… কিচ কিচ’ সুরে ডাকাডাকি করে আকুতি জানায় মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে। কিন্তু দোকানির মন গলে না তাতে। সে বড়োজোর হাত বদল করতে রাজি, খাঁচার দরজা খুলে চিরতরে মুক্ত করে দিতে নারাজ। কারণ দোকানি এর পেছনে লগ্নি করেছে। পাখিশিকারিদের দাদন দিয়েছে; বিনিময়ে শিকারিরা দেশের গ্রামাঞ্চল, জলা-জঙ্গল কিংবা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে দোকানির কাছে সরবরাহ করে। সব ধরনের পাখিই তারা শিকার করে। এর মধ্যে এ পাখিই বেশি ওদের ফাঁদে পড়ে। এর অন্যতম কারণ এরা বাস করে দলবদ্ধভাবে। জালের ফাঁদ পাতলে প্রায় পুরো ঝাঁকই ধরা পড়ে যায়। খুব সহজেই ধরা পড়ে বিধায় এ পাখি মোটামুটি দামেও সস্তা। তাই ওদের প্রতি দোকানি এবং ক্রেতার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি থাকে। উপরে উল্লিখিত পাখির বাংলা নাম: ‘তিলা মুনিয়া’। ইংরেজি নাম: “স্পটেড মুনিয়া” (Spotted munia), বৈজ্ঞানিক নাম: লনচুরা পাংকটুল্যাটা (Lonchura punctulata)। গোত্রের নাম পাসেরিদি। আমাদের দেশে যে ক’প্রজাতির মুনিয়া বেশি দেখা যায়, ওরা হচ্ছে কালোমাথা মুনিয়া, সাদাগলা মুনিয়া, সাদাপিঠ মুনিয়া, তিলা মুনিয়া ও লাল মুনিয়া। মুনিয়া প্রজাতির মধ্যে লাল মুনিয়াই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তিলা মুনিয়া লম্বায় ১১-১২ সেন্টিমিটার। মাথা, চিবুক, গলা, ঘাড় কালচে বাদামি। পিঠ চকোলেট-পাটকিলে। বুক-পেট হালকা হলুদাভের ওপর কালো বৃত্তের ভেতর সাদা ছিট ছিট দাগ। তলপেটের দিকে ছিট বা কোনো ধরনের দাগ নেই। লেজের উপরের গোড়ার দিক হলুদাভ। তলার দিকটা সাদাটে। ত্রিকোণাকৃতির ঠোঁটটি নীলচে কালো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। পাখিবিশারদ ছাড়া সর্বসাধারণের পক্ষে স্ত্রী-পুরুষ নির্ণয় করা কঠিন। মুনিয়ারা মাটিতে নেমে হাঁটতে পারে না। চড়–ই পখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। বাস করে দলবদ্ধভাবে গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায়, গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে। দৃশ্যটি দেখার মতো বটে। সব ধরনের মুনিয়ার খাবার ধান, কাউন ও শস্যবীজ। এরা খোসা ছিলে শস্যদানা খায়। প্রজনন সময় জুলাই থেকে অক্টোবর। কাঁটাঝোপ, কাশবন অথবা নল-খাগড়ার বনে এরা বাসা বাঁধতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুকনো খড়, লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ৪-৬টি। তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ মিলে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ১৪-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/10/2012
বাংলা ঝাড়ভরত | Bengal Bush Lark | Mirafra assamica
বাংলা ঝাড়ভরত | ছবি: ইন্টারনেট ভরত গায়ক পাখি। খুব ভোরে গান গায়। বাসা বাঁধার সময় পুরুষ পাখি শূন্যে উড়ে মিষ্টি সুরে গাইতে থাকে। স্ত্রী পাখি তখন একদম চুপচাপ থাকে। ভরত পাখিদের বড় গুণটি হচ্ছে এরা নিজেদের গানের তালে চমৎকারভাবে নাচতে পারে। যা অন্য সব পাখির পক্ষে সম্ভব নয়। এরা ভূমিতে খুব একটা নাচে না। বেশিরভাগই নাচে শূন্যে উড়ে উড়ে। দূর থেকে দেখলে তখন মনে হয় বুঝি কেউ সুতায় বেঁধে ঝুলিয়ে নাচাচ্ছে ওদের। এরা নিয়মিত গোসালাদি করে। ধূলোস্নান বেশি পছন্দ। ফসল কাটা হয়েছে এমন ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে। প্রজাতিটি দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার পর্যন্ত। দেখতে অনেকটাই চড়ই এবং বাবুই পাখির মতো মনে হতে পারে। আকার-আকৃতিতেও সে রকম। যে পার্থক্যটা সহজে নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে এদের পা লম্বা এবং খাটো লেজ। পাখি বিশারদ ব্যতিরেকে প্রজাতি শনাক্তকরণ দুরূহ বটে। প্রজাতির অবস্থান দেশে সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘বাংলা ঝাড়ভরত’, ইংরেজি নাম: ‘বেঙ্গল বুশলার্ক’ (Bengal Bush Lark), বৈজ্ঞানিক নাম: Mirafra assamica | এরা ‘বাংলা ভরত পাখি’ নামেও পরিচিত। দেশে সাত প্রজাতির ভরত দেখা যায়। তন্মধ্যে দুই প্রজাতি পরিযায়ী। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ১৫-১৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে, যা শনাক্ত করা কঠিন। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ হলুদাভ পাটকিলের ওপর কালচে চওড়া বুটিক। বুক, পেট ও লেজতল হলুদাভ ধূসর সঙ্গে লালচে আভা। ঠোঁট হালকা হলুদের সঙ্গে পোড়ামাটির আভা। চোখ লালচে বাদামি। পা ও পায়ের আঙ্গুল হলদেটে ত্বক বর্ণের। প্রধান খাবার: ছোট পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ধান, ঘাসের বীজ, কচি ঘাসের ডগা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে আগস্ট। প্রজনন মৌসুমে দু’বার ডিম-বাচ্চা তোলে। বাসা বাঁধে ঘাসবনে অথবা নলবনে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস-লতা, শুকনো ধানপাতা, খড়কুটো ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১০-১৩ দিন। শাবক উড়তে শেখে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/08/2016
ধূসর সারস | Demoiselle Crane | Anthropoides virgo
ধূসর সারস | ছবি: ইবার্ড বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দেশে আগমন ঘটে শীতে। হিমালয় পাড়ি দিয়ে মাঝেমধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চলে উপস্থিত হয়। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। মরু অঞ্চলেও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা বড়সড়ো ঝাঁকে। চলার পথে কারো ফসলের খেতে দলবেঁধে নামলে মুহূর্তেই ফসল তছনছ করে দেয়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। এ সময় উভয়ে জোরে জোরে দ্বৈত সঙ্গীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, উত্তর-পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, পশ্চিম ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সঙ্কটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে ধূসর সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর সারস’, ইংরেজি নাম: ‘ডেমোজিল ক্রেন’, (Demoiselle Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthropoides virgo | দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। গড় দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৫০-১৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২-৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার তালু ধূসর। মাথার পেছন থেকে কালো রঙ শুরু করে ঘাড়, থুঁতনি ও গলা হয়ে বুকের ওপর গিয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। চোখের পেছন থেকে সাদা পালক ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। সারা দেহ গাঢ় ধূসর। ওড়ার পালক কালো। লেজে সাদা-কালো লম্বা পালক, যা ঝুলে পড়েছে নিচে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। কমলা-লাল রঙের চোখ দুটি আকারে ছোট। পা ও পায়ের পাতা ময়লা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাঁকড়া, কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-২৯ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/04/2016