শঙ্খচিল | Brahminy Kite | Haliastur indus
শঙ্খচিল | ছবি: ইন্টারনেট অনেক পরিচিত পাখি এরা। এদের নিয়ে অনেক কবিতা, উপন্যাস রচিত হয়েছে। গাঁও-গ্রামের সবাই এ পাখিকে চেনেন। দেশের সর্বত্রই কম-বেশি এদের বিচরণ রয়েছে। এমনকি শহরের বাসিন্দারাও এদের সঙ্গে পরিচিত। এরা জোড়ায় জোড়ায় জলাশয়ের পাশে, গাছের ডালে শিকারের উদ্দেশ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। হাঁস-মুরগির ছানার প্রতি এদের লোভ কম। যার কারণে গৃহস্থবাড়ির আশপাশে ওড়াওড়ি করে সময় নষ্ট করে না। আবার সুযোগ পেলে তা হাতছাড়াও করে না। তবে অন্যান্য প্রজাতির চিলের মতো এরা অত হিংস্র নয়। এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। ‘আঁ-হা-আঁ-হা’ সুরে ডাকে। কণ্ঠস্বরে এক ধরনের আর্তনাদ ফুটে ওঠে। ওদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছে সেই ছোট বেলায়। রায়পুরের (লক্ষ্মীপুর) ডাকাতিয়া নদীর তীরে। রায়পুর বাজারসংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীর ওপর তখন কাঠেরপুল ছিল। ভাঙা সেই কাঠেরপুলের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের স্কুলে যাতায়াত করতে হতো। সেই সুবাদে ওদের প্রায়ই দেখতাম শিকারের নেশায় নদীর ওপর চক্কর দিতে। আবার নদীর পাড়ে নানা ধরনের গাছ-গাছালির ডালে বসে থাকতেও দেখা যেত। এখন আর ওখানে এ পাখি দেখা যায় না। মাস তিনেক আগেও গিয়েছি সেখানে। কিন্তু এদের দেখা পাইনি। পাখিটার বাংলা নাম: ‘শঙ্খচিল,’ ইংরেজি নাম: ‘ব্রাহ্মণী কাইট’ (Brahminy Kite), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘হালিয়াস্টুর ইন্ডাস’ (Haliastur indus)। এদের বহুবিদ নাম রয়েছে। যেমন: চণ্ডীচিল, সোনালি ডানাচিল, মদনচিল, ফতাচিল ইত্যাদি। অনেকে শঙ্করচিল নামেও ডাকে। এ চিল লম্বায় ৪৬-৪৮ সেন্টিমিটার। এদের ঠোঁট গোড়া থেকে বাঁকানো চ্যাপ্টা গড়নের। বর্ণ ধূসর-নীলচে। মাথা, ঘাড়, গলা, বুক, পেটের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাদা। তার ওপর সরু মরিচা ধরা খাড়া টান। ডানা লালচে। লেজ, ডানার প্রান্ত কালো। তলপেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত লালচে। পা, আঙ্গুল ময়লা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, গিরগিটি, ব্যাঙ। এরা মৃত পচা মাছও খায়। তাছাড়া যে কোনো ধরনের পচাগলার প্রতি এদের আকর্ষণ রয়েছে। বলা যায় সর্বভূক পাখিদের কাতারে রয়েছে ওরা। প্রজনন সময় ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। বড়সড়ো গাছের উঁচু ডালে সরু ডাল-পালা দিয়ে বাসা বাঁধে। স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫-২৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/11/2012
চিতিপাক গোশালিক | Spot winged Starling | Saroglossa spiloptera
চিতিপাক গোশালিক | ছবি: ইন্টারনেট বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাস্থল পরিষ্কার বনপ্রান্ত, খোলা বন, কৃষিজমি। এ ছাড়াও পর্বতের ৭০০-১০০০ মিটার উঁচুতে দেখা যায়। দেশে যত্রতত্র দেখা যায় না। বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। বিচরণ করে ছোট দলেও। স্বভাবে অন্যসব শালিকের মতোই ঝগড়াটে। সারাদিন খুনসুটি করে কাটায়। তবে ওদের ঝগড়া খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় না, কিচির-মিচির পর্যন্তই ঝগড়া। পরক্ষণে আবার মিলেও যায়। আবার শুরু। এভাবেই দিন কাটে। পারতপক্ষে কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি। বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘চিতিপাক গোশালিক’, ইংরেজি নাম: ‘স্পট-উইংড স্টার্লিং’ (Spot-winged Starling), বৈজ্ঞানিক নাম: Saroglossa spiloptera। এরা ‘লালচেগলা শালিক’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১০ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে: গো-শালিক, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, পাতি কাঠশালিক, গোলাপি কাঠশালিক, চিতিপাখ গোশালিক, খয়রালেজ কাঠশালিক, বামুন কাঠশালিক ও ধলাতলা শালিক। এরা লম্বায় ১৯-২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা বাদামি। ঘাড় ও পিঠ ধূসর এবং কালো-বাদামি। ডানার প্রান্ত নীলাভ কালো। লেজ লালচে বাদামি। গলা লালচে। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদাটে। বুকের দু’পাশ শেয়ালে লাল। ঠোঁট নীলাভ কালো। চোখের বলয় সাদা। পা বেগুনি কালো। দেখতে একই রকম মনে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ। আকারেও সামান্য ছোট। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, পিঁপড়া, ছোট ফল, ফুলের মধু। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। বাসা বাঁধে ৬-১০ মিটার উচ্চতার গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, লতাপাতা, দড়ি, কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/08/2017
মরচেরং ভূতিহাঁস | Ferruginous pochard | Aythya nyroca
মরচেরং ভূতিহাঁস | ছবি: ইন্টারনেট ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। শীত মৌসুমে পরিযায়ী হয়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে আশ্রয় নেয়। তখন দেশের বড় বড় বিল অথবা হাওরাঞ্চলে সাঁতরে বেড়াতে দেখা যায়। এ পাখি বিশ্বে কিছুটা বিপদগ্রস্ত হলেও আমাদের দেশে সুলভ দর্শন। আন্তর্জাতিক পাখি শুমারির তথ্য মোতাবেক জানা যায়, সমগ্র বিশ্বে এ প্রজাতির পাখির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। তন্মধ্যে আমাদের দেশেই এদের সংখ্যা মিলেছে ১ লাখের মতো। যার দরুন প্রজাতিটি বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। এরা ছোট-ছোট দলে বিচরণ করে। ডুব সাঁতারে খুবই দক্ষ। ডুব দিয়ে জলের তলে পৌঁছে শিকার ধরে। বেশির ভাগ সময় রাতে শিকারে বের হয়। দিনে বিশ্রাম নেয় জলাশয়ের আশপাশের ডাঙ্গায়। সেই সুযোগটি নেয় শিকারিরা। ওরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে অথবা বিষপ্রয়োগে এদেরকে হত্যা করে। এরা মোটামুটি শান্ত প্রজাতির পাখি। খুব বেশি হাঁকডাক না করলেও শীতে মাঝেমধ্যে কর্কশ কণ্ঠে ডাকে ‘কেররর..কেররর’ সুরে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরচেরং ভূতিহাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘ফেররুগিনাস পোচার্ড’ (Ferruginous pochard), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আইথিয়া নাইরোকা’ (Aythya nyroca)। গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা সাদা আঁখি ভূতিহাঁস নামেও পরিচিত। এ পাখি লম্বায় ৪০-৪১ সেন্টিমিটার। ওজন ৬০০ গ্রাম। শীত মৌসুমে মাথা, ঘাড় ও বুক তামাটে বাদামি রঙ ধারণ করে। বুকের নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত সাদা। ডানার তলার পালকে রয়েছে সাদা রেখা। ঠোঁট স্লেট রঙের। চোখ সাদা। পা ও পায়ের পাতা ধূসর। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড় ও বুক অনুজ্জ্বল তামাটে দেখায়। এ সময় চোখ কালচে দেখায়। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় অনেকখানি নিষ্প্রভ হলেও দেখতে একই রকম লাগে। প্রধান খাবার: জলজ পোকামাকড়, ছোট চিড়িং, কেঁচো, জলজ উদ্ভিদের কচিডগা ইত্যাদি। প্রজনন সময় মে থেকে জুলাই। ট্রান্সবৈকালিয়া থেকে উসুরি, আমুর নদীর উপত্যকায় ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের নলবনের ভেতর লতাপাতা জমিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৮-১২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫-২৭ দিন। শাবক ৫৫-৬০ দিনের ভেতর উড়তে পারে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/11/2013
পাতি সারস | Common Crane | Grus grus
পাতি সারস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা ছোট-বড় দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। নাচের কসরৎ দেখতে দেখতে স্ত্রী পাখি তখন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও নাচে অংশ নিয়ে প্রেমে মজে যায়। এ সময় জোরে জোরে দ্বৈত সংগীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে দেশি সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি সারস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন ক্রেন’ (Common Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Grus grus | দেশে তিন প্রজাতির সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। এরা সবাই পরিযায়ী প্রজাতির। গড় দৈর্ঘ্য ১১৫ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৮০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ৫.১-৬.১ কেজি। স্ত্রী পাখি ৪.৫-৫.৯ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। কপাল কালো। মাথার তালুর রক্ত লাল। মাথার পেছন থেকে শুরু করে ঘাড়, থুতনি ও গলা কালো। চোখের পেছন থেকে ঘাড় ও গলার কালো দ্বিখণ্ডিত হয়ে সাদায় রূপ নিয়েছে। পিঠ গাঢ় ধূসর। ডানার পালকের ওপর কালো ছোপ। ওড়ার পালক কালো। লেজ কালো। ডানার বাড়তি পালক লেজের ওপর ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। চোখের তারা লাল। পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, কাঁকড়া কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩১ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/10/2015
কোড়া পাখি | Watercock | Gallicrex cinerea
কোড়া পাখি | ছবি: ইন্টারনেট কোড়া’ স্থানীয় প্রজাতির সুলভ দর্শন পাখি। অঞ্চলভেদে অসুলভ দর্শন এরা। একটা সময় দেশের জলাশয়গুলোতে ব্যাপক নজরে পড়ত, হালে সে রকমটি নজরে পড়ছে না। শিকারিদের হাতে নির্যাতিত হয়ে ক্রমান্বয়ে অসুলভ হয়ে পড়ছে প্রজাতিটি। গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, তবে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীনের দক্ষিণাংশ, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন পর্যন্ত। কোড়া পাখি স্বভাবে লাজুক হলেও প্রয়োজনে হিংস রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে পুরুষ পাখি প্রজনন মৌসুমে অন্য পুরুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে। সামনাসামনি হলে তো কথাই নেই, ভীষণ যুদ্ধ বাধিয়ে বসে ওরা। ওই সময় মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী কাছে গেলেও ওদের যুদ্ধ থামে না। ফলে সুযোগটি নেয় শিকারিরা, খপ্ করে দুটোকে ধরে ফেলে। এরা মূলত শিকারে বের হয় ঊষা ও গোধূলীলগ্নে। মেঘলা দিন এদের বেশ প্রিয় সময়। জলদামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ডাকাডাকি করে এ সময়। সুর গুরুগম্ভীর। ডাকে ‘উটুম্ব-উটুম্ব-উটুম্ব’ সুরে। কোড়া জলচর পাখি। জলজ উদ্ভিদের ওপর দিয়ে দ্রুত দৌড়াতে সক্ষম। উড়তে তেমন পারদর্শী নয়, ওড়ার সময় পা ঝুলে পড়ে। পাখির বাংলা নাম: ‘কোড়া’, ইংরেজি নাম: ‘ওয়াটার কক্’ (Watercock), বৈজ্ঞানিক নাম: Gallicrex cinerea| লম্বায় পুরুষ পাখি ৪৩ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই হলেও প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রঙ ভিন্নরূপ ধারণ করে। এ সময় পুরুষ পাখির গায়ের রঙ নীলচে কালো দেখায়। প্রজনন ঋতুর বাইরে উভয়ের দেহের উপরের দিক পাটকিলের ওপর গাঢ় রেখা দেখা যায়। দূর থেকে পিঠের পালক আঁশালো দেখায়। লেজ খাটো। দেহের নিম্নাংশ হলুদাভ-পাটকিলের ওপর সরু কালো টান। কপালে লাল ত্রিকোণ বর্ম। যা সামনে থেকে পেছনের দিকে খাড়া হয়ে মাথার উপরে উঠে গেছে। চোখের তারা গাঢ় বাদামি। পা হলুদাভ-সবুজ। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদের বীজ ও কচিডগা, জলজ পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে জুলাই। বাসা বাধে ভাসমান জলদামে অথবা ধানক্ষেতে বা আখক্ষেতে ঘাস-লতা বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 12/09/2014
ধূসরাভ ফিদ্দা | Grey Bush Chat | Saxicola ferreus
ধূসরাভ ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। প্রাকৃতিক আবাস্থল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় নিম্নভূমির বন। ঝোপ আচ্ছাদিত পাহাড় এবং পাইনবনে বিচরণ রয়েছে। পুরুষ পাখির তুলনায় স্ত্রী পাখি কিছুটা নিষ্প্রভ। পুরুষ পাখির মায়াবি চেহারা। উভয়ে স্বভাবে চঞ্চল। কণ্ঠস্বর মধুর। মাঝারি আকৃতির বৃক্ষের উচ্চশিখরে বসে গান গায়। বিচরণ করে একাকী। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও চীন পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসরাভ ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেবুশ চ্যাট’ (Grey Bush Chat), বৈজ্ঞানিক নাম: Saxicola ferreus। এরা ‘মেটে ঝাড়ফিদ্দা’ নামেও পরিচিত। গড় দৈর্ঘ্য ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৪-১৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় রুপালী ধূসর। পিঠ কালচে ধূসর। ডানার প্রান্ত পালকে কালো ধূসরের সঙ্গে সাদা টান। লেজ কালো ধূসর। লেজতল সাদা। ঠোঁটের গোড়া থেকে চোখের ওপর দিয়ে কুচকুচে চওড়া কালোটান ঘাড়ে ঠেকেছে। গলা সাদা। দেহতল ধূসর সাদা। স্ত্রী পাখির রঙ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেহের উপরের অংশ বাদামি ধূসর। তবে ডানার প্রান্ত পালকে কালো ধূসরের সঙ্গে গাঢ় বাদামির উপস্থিতি রয়েছে। দেহতল সাদাটে বাদামি। উভয়ের ঠোঁট ও চোখ কালো। পা ধূসর কালচে। প্রধান খাদ্য: কীটপতঙ্গ, মাকড়সা ও ঘাসবীজ। প্রজনন সময় মার্চ-জুলাই। শুকনো ঘাস, লতা-পাতা, চুল দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসা অনেকটাই পেয়ালা আকৃতির। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/09/2017
উদয়ী বামনরাঙা | Oriental Dwarf Kingfisher | Ceyx erithaca
উদয়ী বামনরাঙা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, ‘দৈনিক মানবকণ্ঠ’ পত্রিকায় এটি আমার শেষ লেখা ‘মাছরাঙা’ নিয়ে। ইতিমধ্যে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে। কাজেই আর মাছরাঙা নিয়ে লেখার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের দেশে শুধুমাত্র ১২ প্রজাতির মাছরাঙাই নজরে পড়ে। অপরদিকে সমগ্র বিশ্বে নজরে পড়ে মোট ৯৫ প্রজাতির মাছরাঙা। ফলে মাছরাঙা পাখি নিয়ে লেখা ফিচারের সমাপ্তি দৈনিক মানবকণ্ঠ পত্রিকায় ঘটিয়ে দিলাম। আর হ্যাঁ, আজ যে প্রজাতিটি নিয়ে লিখছি ওদের নাম ‘উদয়ী বামনরাঙা’। এরা অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। গ্রীষ্মকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনাঞ্চলে নজরে পড়ে। বিশেষ করে পাতাঝরা অথবা চিরসবুজ বনের গাছের ছায়াময় এবং অপেক্ষাকৃত সরু নদীর উপরে উড়ে বেড়ায়। অথবা চিরসবুজ বনাঞ্চলের ভেতর প্রবহমান নদ-নদীর ওপর গাছের ঝুলন্ত ডালে শিকারের প্রতীক্ষায় দীর্ঘসময় বসে থাকে। শিকার প্রাপ্তির বিলম্বে টেনশনে ঘন ঘন মাথা ওঠানামা করতে থাকে তখন। আবার শিকার প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিলে লেজ খাড়া করে উচ্ছ্বাসও করতে দেখা যায়। বিচরণ করে একাকী। ওড়ার সময় তীক্ষ কণ্ঠে ‘চিচিচী…’ আওয়াজ করে। ‘উদয়ী বামনরাঙা’র বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদগ্রস্ত। বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। তথাপিও বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘উদয়ী বামনরাঙা’, ইংরেজি নাম: ওরিয়েন্টাল ডয়ার্ফ কিংফিশার, (Oriental Dwarf Kingfisher), বৈজ্ঞানিক নাম: Ceyx erithaca | দৈর্ঘ্য ১৩ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় কমলা-বেগুনি রঙের। পিঠ, ডানা নীলচে কালো। কোমর ও লেজ কমলা রঙের। গলা সাদা। পেট কমলা-হলুদ। চোখ গাঢ় লাল। চোখের ওপর দিয়ে সাদাটান ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। ঠোঁট প্রবাল লাল। পা ও পায়ের পাতা কমলা লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। ওদের মাথা গাঢ় কমলা। দেহ অনুজ্জ্বল। বুকে কমলা ফোটা রং। দেহতল হালকা নীল। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, কাঁকড়া, ঝিঁঝিপোকাসহ অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। নদীর খাড়া পাড়ে নিজেরা টানেল আকৃতির সুড়ঙ্গ বানিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/04/2015