সাদাগলা লেজনাচানি | White throated Fantail | Rhipidura albicollis
সাদাগলা লেজনাচানি | ছবি: ইন্টারনেট আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী পাখি এরা। মানুষকে ভয় পেলেও একেবারেই ঘরের লাগোয়া গাছ-গাছালিতে এরা বিচরণ করে। গ্রাম-গঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ঝোপ-জঙ্গলে এদের কম-বেশি দেখা যায়। ছোট গাছের ডালে কিংবা মাটিতে নেচে বেড়ায় সুযোগ পেলেই। বিশেষ করে স্যাঁতস্যাঁতে ছায়াময় স্থানে এদের বেশি দেখা যায়। তার কারণও আছে অবশ্য। কারণটি হচ্ছে ওদের পছন্দের শিকার মশা-মাছি বা ছোট পতঙ্গ এতদাঞ্চলে বেশি মেলে। এ ছাড়া স্ত্রী-পুরুষ পাখিদের মধ্যে প্রেম নিবেদনের মোক্ষম স্থানও বটে। তবে যেখানেই বিচরণ করুক না কেন চুপচাপ বসে থাকার মতো পাখি নয় এরা। বরং উল্টো ওদের চরিত্র। সাংঘাতিক চঞ্চল প্রকৃতির পাখি ওরা। চোখের নিমেষেই ফুরুৎ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ করেই চোখের সামনে এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ নেচে-গেয়ে আবার ফুরুৎ। এ হচ্ছে ওদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ পাখিরা কালো ধাচের হলেও দেখতে ভারী চমৎকার। বিশেষ করে ওদের লেজটা বেশ আকর্ষণীয়। নেচে বেড়ানোর সময় লেজটাকে ছাতার মতো মেলে ধরে। ঠিক সে সময় পেখমমেলা ময়ূরের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে আসে ময়ূর দেখিয়েদের মনে। একটা সময় এ পাখিদের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা ছিল। ওদের দেখলেই কেন জানি ছুঁয়ে আদর করতে ইচ্ছে করত। অনেকবার চেষ্টাও করেছি ধরতে। ওদের বাসার ওপর সুতার ফাঁদ পেতে ধরার অহেতুক প্রচেষ্টা কম করিনি। এমনকি রাতেও অপারেশন চালিয়েছি। কামিয়াবি হতে পারিনি। খুব চতুর প্রকৃতির হওয়াতে এরা ধরাছোঁয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে বারবারই। আর হ্যাঁ, পাখি পর্যবেক্ষক হওয়ার আগ মুহূর্তেও একটি ভুল ধারণা ছিল এ পাখির প্রজতির প্রতি। তখন আমার ধারণা ছিল এরা ‘শ্যামা’ গোত্রের পাখি। পরে শ্যামা পাখির দর্শন পেয়ে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তৎসঙ্গে এ প্রজাতির পাখির সঠিক পরিচয় জানতে পেরে আমি বেশ আনন্দিতও হয়েছি। আশা করি প্রিয় পাঠকরাও সে আনন্দের ভাগিদার হবেন। প্রতিবেশী পাখির সঠিক পরিচয়টা জানতে পারবেন। এ পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাগলা লেজনাচানি’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট থ্রোটেড ফ্যানটেইল’ (White-throated Fantail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘রাইপিডুরা আলবিকল্লিস’ (Rhipidura albicollis), গোত্রের নাম: ‘রাইপডুরিনি’| এরা লম্বায় ১৬-১৮ সেন্টিমিটার। মাথাটা কালো। গলার দুই পাশে সাদা। চোখের ওপর রয়েছে সাদা টান। এ ছাড়া এদের বাদবাকি পালক ধূসর-পাটকিলে। লেজের অগ্রভাগ সাদা। ঠোঁট, পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। এরা পতঙ্গভুক পাখি। মশা, মাছি, বোলতা জাতীয় পতঙ্গের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন সময় ফেব্র“য়ারি থেকে মে। ভূমি থেকে সামান্য উঁচু গাছের দুই ডালে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে নরম চিকন ঘাস-লতা, গাছের সরু শিকড়। স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। শাবক বাসা ত্যাগ করে ১৫ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/01/2013
ডাহুক | White breasted Waterhen | Amaurornis Phoenicurus
ডাহুক | ছবি: ইন্টারনেট দেখতে অনেকটাই মুরগির মতো। শুধু আকারে খানিকটা ছোট। লেজটা অধিকাংশ সময় খাড়া থাকে। হাঁটার সময় লেজটাকে নাচিয়ে হাঁটে। জলাধারে কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে এলাকায় বেশি দেখা যায়। খাবারের খোঁজে অনেক সময় মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। তবে ধরার আগেই ফুরুৎ করে দৌড়ে পালায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের চেয়ে বাচ্চারা বেশি হুঁশিয়ারি। সহজে ধরা যায় না ওদের। বিশেষ করে জলাশয়ে বিচরণরত কালে বাচ্চাদের ধরা কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ। চতুর এ পাখি চেনেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছেন আমাদের দেশে। এমন পরিচিতি লাভের আরেকটি কারণও আছে। সেটি হচ্চে এদের নিয়ে বেশ কিছু কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। যেমন : কবি জীবনানন্দ দাশ রচনা করেছেন ‘ডাহুকী’ কবিতা। অপরদিকে কবি র্ফরুখ আহমেদ রচনা করেছেন ‘ডাহুক’ কবিতটি। বলা যায় বাংলা সাহিত্যে এ পাখির বেশ কদর রয়েছে। আমি শৈশবেই এদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি নিজ গ্রামে। ঘরের লাগোয়া ঝোপের ভেতর থেকে ‘কোয়াক-কোয়াক’ সুরে ডেকে কান ঝালাপালা করে দিত আমাদের। অতিষ্ট হয়ে ওদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে তাড়াতে চেষ্টা করতেন বড়রা। ওরা ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে ঝোপ-জঙ্গলে বসে আবার শুরু করে দিত ম্যারাথন ডাক। একটানা দীর্ঘক্ষণ ডাকতে পারে এ পাখি। রাত-বিরাতেও ডাকে। বিশেষ করে সূর্যাস্তের পর বিরতিহীন ডাকতে থাকে। এ নিয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের ভেতরে কিছু কৌতূহল রয়েছে। নানা মানুষ নানা মন্তব্য করেন। কেউ কেউ বলেন, ‘ডাকতে ডাকতে ওদের গলা থেকে রক্তের ফোঁটা বের হয়। আর সে রক্তের ফোঁটা ওদের ডিমের ওপর পড়লেই তবে ডিম ফোটে। আবার কেউ বলেন, ‘মানুষকে ওরা বিপদ সংকেত জানায়’। আসলে ওসবের কিছুই নয়। শুধু ওদের প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে প্রেমিক পাখিটি এমন আর্তনাদ করে প্রিয়াকে মজাতে চেষ্টা করে। এরা ভালো পোষ মানে। গ্রামের শিকারিরা পোষাপাখি দিয়ে এ প্রজাতির বুনোপাখি শিকার করে। এদের মাংসে কিছুটা মুরগির মাংসের স্বাদ পাওয়া যায় বিধায় শিকারিরা এ পাখি শিকারে বেশ সচেষ্ট। অধিকধৃত হওয়ার পরও এরা আমাদের দেশে মোটামুটি সুলভ। দেখা মেলে যত্রতত্র। এ পাখির বাংলা নাম: ‘ডাহুক’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন’, (White-breasted Waterhen), বৈজ্ঞানিক নাম:‘আমাররনিস ফোনিকুরাস’,(Amaurornis Phoenicurus), গোত্রের নাম: ‘রাল্লাদি’। লম্বায় ৩২-৩৩ সেন্টিমিটার। শক্ত মজবুত গড়নের ঠোঁটের বর্ণ সবুজ। ঠোঁটের গোড়া লাল। কপাল, গলা, বুক সাদা। লেজের তলা সিঁদুরে-বাদামি। শরীরের বাদবাকি পালক ছাই-কালো রঙের। পা লম্বা লিকলিকে। পায়ের আঙ্গুলের বর্ণ সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। ডাহুক পাখির প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা, ধান ইত্যাদি। পোষা ডাহুক চাল, ভাত খায়। প্রজনন সময় আষাঢ় থেকে শ্রাবণ। বাসা বাঁধে জলার ধারে ঝোপ-জঙ্গলে কিংবা জলদামের ওপর অথবা বাঁশঝাড়ে। ডিম পাড়ে ৫-৭টি। স্ত্রী-পুরুষ মিলে ডিম তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/01/2013
পাতি সারস | Common Crane | Grus grus
পাতি সারস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা ছোট-বড় দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। নাচের কসরৎ দেখতে দেখতে স্ত্রী পাখি তখন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও নাচে অংশ নিয়ে প্রেমে মজে যায়। এ সময় জোরে জোরে দ্বৈত সংগীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে দেশি সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি সারস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন ক্রেন’ (Common Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Grus grus | দেশে তিন প্রজাতির সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। এরা সবাই পরিযায়ী প্রজাতির। গড় দৈর্ঘ্য ১১৫ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৮০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ৫.১-৬.১ কেজি। স্ত্রী পাখি ৪.৫-৫.৯ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। কপাল কালো। মাথার তালুর রক্ত লাল। মাথার পেছন থেকে শুরু করে ঘাড়, থুতনি ও গলা কালো। চোখের পেছন থেকে ঘাড় ও গলার কালো দ্বিখণ্ডিত হয়ে সাদায় রূপ নিয়েছে। পিঠ গাঢ় ধূসর। ডানার পালকের ওপর কালো ছোপ। ওড়ার পালক কালো। লেজ কালো। ডানার বাড়তি পালক লেজের ওপর ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। চোখের তারা লাল। পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, কাঁকড়া কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩১ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/10/2015
ধূসর দামা | Tickell’s Thrush | Turdus unicolor
ধূসর দামা | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী, ভূচর পাখি। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে শীতে দেখা যায়। তবে এতদাঞ্চলে প্রজনন ঘটায় না। চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। প্রাকৃতিক আবাসস্থল মিশ্র পর্ণমোচী ও সুঁচালো পার্বত্য বন। পাইন বনে বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিচরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। গানের গলা ভালো। গাছের উঁচু ডালে বসে খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে গান গায়। স্বভাবে লাজুক। বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। দেখা যায় লতাগুল্মের নিচেও। আবার পাথুরে এলাকায়ও বিচরণ রয়েছে। পরিত্যক্ত বা স্যাঁতস্যাঁতে এলাকার লতাপাতা উল্টিয়ে এবং ঘন ঘন ঠোঁট চালিয়ে খাবার খোঁজে। গাছের উঁচুতে বিচরণ করে না। দেশের সর্বত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই। শীতে দেখা যায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমার পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও প্রজাতিটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘ধূসর দামা’, ইংরেজি নাম:‘ টিকেল’স থ্রাস’ (Tickell’s Thrush), বৈজ্ঞানিক নাম: Turdus unicolor | এরা ‘টিকেলের দামা’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির দামা নজরে পড়ে। গড় দৈর্ঘ্য ২০-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা। ওজন ৫৮-৭৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। দেহের ওপরের অংশ ধূসর। অনেকটাই গাঢ় ছাই বর্ণের। কেবল গলায় সামান্য সাদাটে দাগ। গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত ফ্যাকাসে ধূসর। লেজতল সাদাটে। চোখের বলয় হলুদ, মনি কালো। ঠোঁট হলুদ। পা ও পায়ের আঙুল হলুদ। যুবাদের রঙ ভিন্ন। শীত-গ্রীষ্মে রঙ বদলায়। প্রধান খাবার: কেঁচো, পোকামাকড়। মাঝেমধ্যে ছোট ফলফলাদি খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ২-৭ মিটার উঁচুতে। গভীর কাপ আকৃতির বাসা। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, শুকনো ঘাস ও লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/05/2017
সোনালি মাথা টুনি | Golden headed Cisticola | Cisticola exilis
সোনালি মাথা টুনি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ চীন ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল উপকূলীয় এলাকা, তৃণভূমি, জলাভূমির পাড়ের ঝোপঝাড়, লম্বা ঘাসবন ইত্যাদি। এ ছাড়াও কৃষি জমির আশপাশের ছোট গাছগাছালি কিংবা ঝোপজঙ্গলে বিচরণ করে। পারতপক্ষে উঁচু গাছে বিচরণ করে না। সারাদিন গুল্মলতাদির ফাঁকফোকরে নেচে গেয়ে কাটায়। স্বভাবে শান্ত হলেও চঞ্চল অস্থিরমতির পাখি এরা। গানের গলা ভালো। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষ পাখির রঙেও খানিকটা পরিবর্তন আসে। চেহারাটা বেশ আদুরে দেখায় তখন। শরীরটাকে ফুলিয়ে বসে থাকলে দূর থেকে অনেক সময় গোলাকার কদমফুলের মতো দেখায়। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও উপমহাদেশীয় অঞ্চলে যত্রতত্র দেখা যায় না। আইইউসিএন এদেরকে উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সোনালি মাথা টুনি’, ইংরেজি নাম: গোল্ডেন-হেডেড কিস্টিকোলা (Golden-headed Cisticola), বৈজ্ঞানিক নাম: Cisticola exilis | এরা ‘ধলামাথা ছোটন’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির পুরুষ পাখি দৈর্ঘ্যে ৯-১১সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৭-১০ গ্রাম। স্ত্রী পাখি দেখতে প্রায় একই রকম হলে আকারে সামান্য ছোট এবং কিছুটা নিষ্প্রভ। প্রজনন পালক ভিন্ন। এ সময় পুরুষ পাখির মাথা সোনালি কমলা, অন্য সময় মাথা ও ঘাড়ে সোনালি পালক। পিঠ ও ডানা গাঢ় বাদামি ডোরাকাটা। লেজ সোনালি বাদামির সঙ্গে কালো। দেহতল ক্রিম সোনালি। চোখ বাদামি। ঠোঁট সরু ওপরের অংশ কালচে নিচের অংশ ত্বক বর্ণের। পা গোলাপি ত্বক বর্ণের। প্রধান খাবার: ছোট পোকামাকড়, ফড়িং, পিঁপড়া, মথ, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে আগস্ট। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। কাপ আকৃতির বাসা। বাসা বাঁধে নরম চিকন লতা, শিকড়, তন্তু ও তুলা দিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/12/2016
বাদামি পিঠ সুচলেজ বাতাসি | Brown backed Needletail | Hirundapus giganteus
বাদামি পিঠ সুচলেজ বাতাসি | ছবি: ইন্টারনেট চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। দেখতে হিংস মনে হলেও তত হিংস নয় এরা। কেবলমাত্র আক্রান্ত হলে আক্রমণ করে। মানুষের হাতে বন্দি হলে ঠোঁট এবং নখের আঁচড়ে যখম করতে সক্ষম হয়। উড়ন্ত অবস্থায় এদের ঠোঁট, মাথা ও লেজ সমান্তরাল থাকে। ফলে দূর থেকে মাথা এবং লেজ শনাক্ত করা কঠিন হয়। ওড়া অবস্থায় সামনে অগ্রসর হওয়ার কারণে মাথা-লেজ শনাক্ত করা যায়। শরীরের তুলনায় ডানা লম্বা থাকার কারণে উড়ন্ত অবস্থায় ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। মূলত এরা বন পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও ফাঁকা জায়গায়ও দেখা মেলে। ভূমি থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতায়ও দেখা যায়। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। সারাদিন ওড়াওড়ি করে কাটায়। উড়ন্ত অবস্থায়ই পতঙ্গ শিকার করে। বেশ দ্রুত উড়তে পারে। ঘণ্টায় প্রায় ১৭০ কি.মি. বেগে ওড়ে। একাকী কিংবা দলবদ্ধ হয়ে ওড়াওড়ি করে। জলপান ব্যতিরেকে পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যএশিয়া, দক্ষিণ সাইবেরিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, পূর্ব ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। পশ্চিম ইউরোপেও দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে বিরল দর্শন বলা যায়। এরা বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়, তবে এদের উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে তালিকা করেছে আইইউসিএন। মূলত প্রজনন পরিবেশ সংকটের কারণে এরা উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামি-পিঠ সুচ-লেজ বাতাসি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন-ব্যাকেড নিডলটেইল’ (Brown-backed Needletail) বৈজ্ঞানিক নাম: Hirundapus giganteus | এরা ‘খয়রাপিঠ সুইবাতাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১২৩-১৬৭ গ্রাম। মাথা কালচে, তালুতে সাদা ছোপ। পিঠ ও ডানা বাদামি। কোমরের দু’পাশ সাদা। লেজের অগ্রভাগ কাঁটার মতো সুচালো। দেহতল কালচে। লেজতল সাদা। ঠোঁট কালো, ছোট। ঠোঁটের অগ্রভাগ কিঞ্চিত বাঁকানো। পা ছোট। পায়ের তুলনায় নখ বড় এবং ধারালো। প্রধান খাদ্য: উড়ন্ত পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল। মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ সাইবেরিয়ার পাথুরে পাহাড়ে এবং ধ্বংসাবশেষ গাছে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/08/2016
মরুর ফিদ্দা | Desert wheatear | Oenanthe deserti
মরুর ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট শরৎকালে পরিযায়ী হয়ে আসে মরু কিংবা রুক্ষ অঞ্চল থেকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি পশ্চিম সাহারা, মিসরের পশ্চিম অংশ, চীন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান, দক্ষিণ ককেশাস, উত্তর মঙ্গোলীয়া, মরক্কো, ইরাক, ইরান, উত্তর আরব উপদ্বীপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা। ইউরোপের কিছু কিছু অঞ্চলেও দেখা যায়। প্রজাতিটি তেমন বাহারি রঙের না হলেও দেখতে মন্দ নয়। গায়ের রং বালির মতো। বালির ওপর বিচরণকালীন দূর থেকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচরণ করে একাকী। জোড়ায়ও খুব বেশি দেখা যায়। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। মরুময় কিংবা পাথুরে এলাকায় ঘুরেফিরে পোকামাকড় শিকার করে। তবে এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা যে কোনো রুক্ষ পরিবেশে অনায়াসে টিকে থাকতে পারে। তথাপিও বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে ইতিমধ্যে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরুর ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: ডেজার্ট হুইটইয়ার (Desert wheatear), বৈজ্ঞানিক নাম: Oenanthe deserti | এরা ‘ঊষর কানকালি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৪ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। গ্রীষ্মে পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় ফ্যাকাসে। চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশ কুচকুচে কালো, যা ঘাড়ের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ ফ্যাকাসে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকে কালো-সাদার মিশ্রণ। লেজের গোড়ার দিক ফ্যাকাসে বাদামি। লেজের পালক কালো। বুকের ওপর বাদামি-সাদা, দেহতল ফ্যাকাসে বাদামি। শীতে রং উজ্জ্বল হয়। স্ত্রী পাখির চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশের কালো অংশের পরিবর্তে বালি বাদামি। পিঠ বালি বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ধূসর কালো। উভয়ের চোখ গাঢ় বাদামি। ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গুবরেপোকা, মাছি, পিঁপড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড়। এছাড়া শস্যবীজের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে পাথুরে পাহাড়ের ওপর। এ ছাড়াও চিরহরিৎ কাঁটাঝোঁপের ভেতরও সংসার পাতে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৪ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/10/2015