ছোট ধলা বক | Little egret | Egretta garzetta
ছোট ধলা বক | ছবি: ইন্টারনেট জলচর পাখিদের আনাগোনাটা ছিল লক্ষণীয়। এর মধ্যে ‘ছোট বক’-এর দেখা পেয়েছি যত্রতত্র। এরা শিকারের প্রতীক্ষায় কচুরিপানা কিংবা জলদামের ওপরে সাধুসন্ন্যাসীর বেশে দাঁড়িয়ে শিকার খুঁজছে। একটা ধবধবে সাদা ছোট বককে ভেসাল জালের ওপরে উড়ে উড়ে শিকার ধরতে দেখেছি। সাধারণত এ রকমটি খুব কমই দেখা যায়। কারণটা হচ্ছে এদের প্রভূত ধৈর্যশীলতা। পারতপক্ষে হন্যে হয়ে শিকার খোঁজে না এরা। তাই অন্যসব জলচর পাখির চেয়ে ওর প্রতি আমার আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল বোধকরি। ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে নেমে শুকনো ভূমিতে দাঁড়িয়ে পাখিটার কীর্তি দেখেছি কিছুটা সময় লাগিয়ে। বিষয়টা মনে গেঁথে রেখে পাখিটার পরিচিতি তুলে ধরেছি পাঠকদের কাছে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট বক’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল ইগ্রেট’ (Little egret). বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ইগ্রেটা গারজেটা’ (Egretta garzetta), গোত্রের নাম: ‘আরডিদি’। এরা ‘ছোট ধলা বক’ নামেও পরিচিত। দেশে পরিজায়ীসহ প্রায় ১৫-১৮ প্রজাতির বক নজরে পড়ে। এরা লম্বায় ৫৫-৫৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৫০-৪০০ গ্রাম। দেহের গড়ন লম্বাটে চিকন। দেহের সমস্ত পালক ধবধবে সাদা। ঠোঁট সরু, লম্বা ও কালো। পা লম্বা, কালো। প্রজনন মৌসুমে মাথার ঝুঁটির পালক পিঠের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়ে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মৎস্যভুক পাখি এরা। এ ছাড়াও ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় ও ঘাসফড়িং শিকার করে। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয়ের কাছাকাছি গাছগাছালিতে দলবদ্ধ হয়ে বাসা বাঁধে। কলোনি টাইপ বাসা। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন শুকনো ডালপালা। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৫ দিন। শাবক সাবলম্বী হতে সময় নেয় ৪০-৪৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/08/2013
মেঠো কাঠঠোকরা | Eurasian Wryneck | Jynx torquilla
মেঠো কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিরা মাটিতে দাঁড়ালে অনেকটাই গুইসাপের শাবকের মতো মনে হয়। গলার নিচটায়ও রয়েছে সে ধরনের আঁকিবুঁকি চিহ্ন। আর ওদের পিঠের দিকে তাকালে অজগর সাপের চিত্রটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এমনই অদ্ভুত গড়নের পাখি এরা। খুব চতুরও এ পাখি। মাটিতে বিচরণ করেও বন্যপ্রাণীর শিকারে পরিণত হয় না খুব একটা। বরং বিপদে পড়লে অভিনয় করে পার পেয়ে যায়। হঠাৎ করে এরা যদি কোনো মানুষের নজরে পড়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়টাকে ১৮০ ডিগ্রি কোনে ঘোরাতে থাকে আর চোখ উল্টিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে মাটিতে শুয়ে পড়ে। ভাবটা এমন দেখায় মনে হচ্ছে বুঝি ওর ঘাড়টা মচকে গেছে এখন প্রচণ্ড ব্যথায় কোকাচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষ ওদের বেগতিক ভাবসাব দেখে থমকে যায় বা ধরতে ইতস্ততবোধ করে। ঠিক তখনই ডানায় বাতাস লাগিয়ে ফুরুৎ। এরা পরিযায়ী পাখি। শীতকালে চীন, সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছায়। থাকে বসন্তকাল অবধি। তবে এদের মূল বাসভূমি ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। ডাকে নাকি সুরে ‘খেক্-খেক্-খেক্’ শব্দে। এ ধরনের পাখি বহু বছর আগে দেখেছি মিরপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে। দেখেছি মাটির ওপর বিচরণ করতে। নির্জনে খুঁটেখুঁটে পোকামাকড় খাচ্ছে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘মেঠো কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান রাইনেক’ (Eurasian Wryneck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘জাইংকস টরকিল্লা’, (Jynx torquilla) গোত্রের নাম : ‘পাইকিদি’। উল্লেখ্য, অন্যসব কাঠঠোকরা প্রজাতির পাখিদের সঙ্গে এদের চেহারার মিল না থাকাতে অনেকে এদের ‘ঘাড়ব্যথা’ পাখি নামে ডাকে। লম্বায় এরা ১৬-১৯ সেন্টিমিটার। তুলনামূলক লেজ খানিকটা লম্বা। গায়ের বর্ণ ধূসর-মেটের সঙ্গে সাদার মিশ্রণে রয়েছে ছোপ, ডোরা খাড়া দাগ। পিঠের ওপর মোটা দাগ। মাথা, গলার নিচে আড়াআড়ি কালো ডোরা দাগ, পেটের দিকটায় সাদার উপরে এলোমেলো দাগ। লেজ বলয়যুক্ত। চোখের পাশের রেখা ঘাড়ের মাঝ বরাবর চলে গেছে। ঠোঁট, পা বাদমি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও আসলে পুরুষ পাখির গায়ের বর্ণ কিছুটা উজ্জ্বল। এদের প্রধান খাবার পোকামাকড়। তবে পিঁপড়া, পিঁপড়ার ডিম এদের প্রিয়। খেঁজুরের রস খেতেও দেখা যায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে গাছের খোড়লে। অনেক সময় অন্য প্রজাতির কাঠ ঠোকরাদের পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৭-১০টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/01/2013
আমুর শাহিন | Amur Falcon | Falco amurensis
আমুর শাহিন | ছবি: ইন্টারনেট পাখির নাম ‘আমুর শাহিন’। আমুরল্যান্ডে বিচরণ আধিক্য বিধায় হয়তো এই নাম ওদের। এরা উপমহাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। সুদর্শন, স্লিম গড়নের পাখি। দেখতে কিছুটা ককাটিল পাখিদের মতো। পুরুষদের চেহারা চকচকে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ; ভিন্ন বর্ণের। প্রাকৃতিক আবাসস্থল খোলা মাঠপ্রান্তর, খোলা বনাঞ্চল। শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে হিংস নয়। একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আমুরল্যান্ড, ট্রান্সবিকালিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়া, উত্তর-পূর্ব মঙ্গোলিয়া উত্তর-পূর্ব চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়, উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে আইসিইউএন এদের শনাক্ত করেছে তাই। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘আমুর শাহিন ’, ইংরেজি নাম: ‘আমুর ফ্যালকন’, (Amur Falcon), বৈজ্ঞানিক নাম: Falco amurensis | এরা ‘লালপা তুরমুতি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ৩০-৩৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৯৭-১৫৫ গ্রাম। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ গাঢ় ধূসর। ডানা খানিকটা লম্বা। দেহতল ধূসর। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত লাল। চোখের বলয় কমলা হলুদ। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালচে বাঁকানো, গোড়া কমলা হলুদ। পা লালচে কমলা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা ভিন্ন। শরীরে ধূসর, হলুদ, সাদা, বাদামির মিশ্রণ ছিট। বাদবাকি পুরুষের মতো। প্রধান খাবার: ঘাসফড়িং, পতঙ্গ, ছোট পাখি ও ছোট সরীসৃপ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। গাছের উঁচু ডালে চিকন ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। মাস খানেকের মধ্যেই শাবক স্বাবলম্বী হয় এবং বাবা-মাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/10/2017
ঘুরঘুরি | Baillon’s Crake | Porzana pusilla
ঘুরঘুরি | ছবি: ইন্টারনেট হিমালয় অঞ্চলের পাখি হলেও দেখা মেলে ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায়। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। বিচরণ করে সুপেয় জলের জলাশয়ের কিনারে। বিশেষ করে বাদাবনে এরা আশ্রয় নেয় বেশি। হোগলা বন এদের খুবই প্রিয়। হোগলা বনের ভেতর হেঁটে হেঁটে পোকামাকড় খুঁজে ব্যস্ত সময় পার করে। এ ছাড়াও বড় বড় হাওর-বাঁওড়ের কিনারেও এদের দেখা যায়। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির পাখি এরা। খুব সহজে নজরে পড়ে না, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে সবসময়। অন্যসব প্রজাতির মতো এরা প্রজনন মৌসুমে খুব একটা ডাকাডাকি করে না। অনেকটাই নীরবে নিভৃতে কাটিয়ে দেয় এ বিশেষ মুহূর্ত। প্রিয় পাঠক, এরা অতি বিরল প্রজাতির পাখি। দেশে খুব বেশি দেখা যায় না। এরা নির্যাতিত হলে বা শিকারির খপ্পরে পড়লে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। শুধু এদেরকে নয়, যে কোনো প্রজাতির পাখি নির্যাতিত হলে আপনারা এগিয়ে আসবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পশু-পাখির ভূমিকা অপরিসীম। কাজেই শিকারিদেরকে প্রতিহত করতে হবে। সবাই মিলে পরিবেশটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ইচ্ছে করলে তরুণসমাজ দেশ থেকে শিকারিমুক্ত করতে পারেন। পাড়া-মহল্লায় শিকারিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বোধকরি দেশ শিকারিমুক্ত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ঘুরঘুরি’, ইংরেজি নাম: ‘বেলুনস ক্রেক’ (Baillon’s Crake), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পরজানা পুসিল্লা’ (Porzana pusilla), গোত্রের নাম: ‘রাল্লাদি’। এরা ‘বেইলন গুরগুরি’ নামেও পরিচিত। বাদাবনে খানিকটা বেশি পরিলক্ষিত হয় বিধায় পাখি বিশারদদের কেউ কেউ ‘বাদা কুক্কুট’ নামে ডাকেন। মূলত এরা ডাহুক গোত্রের পাখি। দেখতেও কিছুটা সেরকম। পাখি লম্বায় ১৭-১৯ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির রঙ ভিন্ন। ওদের মাথা পাটকিলে বাদামি। মুখ, গলা ও বুক নীলাভ-ধূসর। পিঠ পাটকিলে-বাদামির ওপর সাদা-কালো ফুটকি। বুকের মাঝখান থেকে লেজের নিচের অংশ কালচে ধূসর। ঠোঁট সবুজ। পা ও পায়ের পাতা জলপাই রঙের। চোখের মণি লালচে। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় অনুজ্জ্বল। উভয়েরই ডানা ও লেজ খাটো। প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদের কচি পাতা খায়। প্রজনন সময় মে-আগস্ট। বাসা বাঁধে জলজ ধান ক্ষেতে কিংবা পাহাড়ি জলাশয়ের কাছাকাছি। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/01/2014
কালো পেঁচা | Brown Hawk owl | Ninox scutulata
কালো পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত ‘প্রকৃতি বার্তা’র (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়) পেঁচা নিয়ে ফিচার পাঠে জানতে পারি যে, একটি পেঁচা বছরে প্রায় ৭০০টি ইঁদুর খেতে সক্ষম। আর একটি ইঁদুর বছরে ১০ কেজি ফসল সাবাড় করতে সক্ষম। অথচ সেই উপকারী বন্ধু পেঁচাকে অলুক্ষণে বলে গালি দেই আমরা। আর ‘কালো পেঁচা’ হলে তো কথাই নেই, বেশি বেশি অলুক্ষণে বলি ওদের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরের কারণে। ওরা এক নাগাড়ে ‘কু-উক-কু-উু-কু-উক’ সুরে ডাকতে থাকলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে। মানুষের ধারণা এই বুঝি কোনো বিপদ হানা দিচ্ছে পেঁচার ডাকে। অথচ ভুল সবই ভুল! এরা আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুর্লভ দর্শনও বটে। গ্রামীণ বন-বাদাড়ের বড় গাছের পাতাল আড়ালে কিংবা বাঁশ ঝোঁপে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। সাঁঝের বেলায় বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা একাকি। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন হাক আউল’ (Brown Hawk-owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ninox scutulata| এরা ‘খয়রা শিকারে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৭-৩৩ সেন্টিমিটার। মুখ ও মাথা কালচে-বাদামি। ঘাড় লালচে-বাদামি ফোঁটা। পিঠ গাঢ় বাদামি। দেহতল লালচে-বাদামির ওপর সাদা ডোরা টান। ঠোঁট কালচে, ঠোঁটের গোড়ায় সাদা ফোঁটা। চোখের তারা হলুদ। দূর থেকে চোখের তারা নজরে পড়লে মনে হয় বুঝি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। পা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধান খাবার: ইঁদুর, সরীসৃপ, ছোট পাখি, ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে মাসখানেক। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/03/2015
মরাল | Bar-headed goose| Anser indicus
মরাল | ছবি: ইন্টারনেট মরাল দুর্লভ পরিযায়ী পাখি হলেও একটা সময়ে সুলভ দর্শন ছিল আমাদের দেশে। হালে দেশে খুব একটা দেখা যায় না। কালেভদ্রে দেখা মেলে শীতে। তখন পরিযায়ী হয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এরা আমাদের দেশে আসে। ওই সময় চলার পথে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট পাড়ি দিতে হয় ওদেরকে। শীত মৌসুমে বাংলাদেশে এসে উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয় নেয়। তবে ওদের বিচরণক্ষেত্র অবশ্যই নির্জন এলাকা হওয়া চাই। যার ফলে খুব কমই পাখি দেখিয়েদের নজরে পড়ে। এরা ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। সাধারণত বড় দলেই বিচরণ করে। ওড়ার সময় ‘ঠ’ আকৃতির সারি দিয়ে ওড়ে। উড়তে উড়তে ‘আঙ..আঙ..আঙ’ সুরে ডাকে। আওয়াজ অনেক দূর থেকে শোনা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, চীন, মঙ্গোলিয়া ও সাইবেরিয়া পর্যন্ত বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। বিশ্বে এরা বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে দুর্লভ দর্শন। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আমাদের দেশে এরা মোটেও নিরাপদ নয়। উপকূলীয় এলাকার শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এদেরকে পাকড়িয়ে হাটে-বাজারে নিয়ে দেশি রাজহাঁস বলে চালিয়ে দেয়। পাখির বাংলা নাম: ‘মরাল’, ইংরেজি নাম: ‘বারহেডেড গুজ’ (Bar-headed goose), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আন্সার ইন্ডিকাস’ Anser indicus| পরিযায়ী, গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা ‘দাগি রাজহাঁস’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ৭৩-৭৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৬ কেজি। মাথায় দুটি কালো ডোরা দাগ। গলা ও চিবুক ধূসর পাটকিলে, যা গলার নিচে গিয়ে ঠেকেছে। গলার দু’পাশে সাদা টান। পিঠ ও পেট ধূসর। ডানার নিচে দু’পাশ কালো। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। বাদ বাকি হলুদ। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মাথায় কালো ডোরা থাকে না। প্রধান খাবার: ধান ও জলজ উদ্ভিদের কচিডগা। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে তিব্বতের হিমালয় অংশের জলাভূমির কাছাকাছি। সমতল ভূমি থেকে যার উচ্চতা প্রায় চার হাজার তিনশ’ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। মরাল নরম মাটিতে পা দিয়ে চেপে চেপে খোদল বানিয়ে তাতে পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/07/2014
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013