কাঠ শালিক | Chestnut tailed Starling | Sturnus malabaricus
কাঠ শালিক | ছবি: ইন্টারনেট এ প্রজাতির অন্যান্য পাখি আমাদের প্রতিবেশী হলেও এদের ভেতর মানুষকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। যার ফলে পরিচিত এ পাখি সর্বসাধারণের কাছে অপরিচিত রয়ে গেছে অদ্যাবধি। এদের বিচরণ অপেক্ষাকৃত হালকা বন-বনানীতে। আবার শহরের দর-দালানেও বসত করে। তবে ভূমিতে খুব একটা বিচরণ করে না। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে প্রায়ই দেখি এ পাখিদের। আমার কাছে এদের বেশ সুদর্শন পাখি মনে হয়। গায়ের বর্ণ অতি উজ্জ্বল না হলেও দেখতে ভালোই লাগে। চলাফেরা করে এরা দল বেঁধে আবার জোড়ায়-জোড়ায় কিংবা একাকীও বিচরণ করে। মানুষকে এড়িয়ে চললেও মাঝেমধ্যে বিচরণ করে কোলাহল সম্পূর্ণ এলাকায়। এদের নিয়ে কথা বলতেই প্রসঙ্গক্রমে দেশের বিশিষ্ট পাখি বিশারদ শরীফ খান জানিয়েছেন, এরা দেশে সন্তোষজনকহারে বিচরণ করছে। বিচরণ করছে ঢাকা-শহরেও। তিনি আরো জানিয়েছেন, খিলগাঁও রেল গেটের কাছে একজোড়া পাখিকে বাসা বানিয়ে ডিম-বাচ্চা ফোটাতে দেখছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। এদের বাংলা নাম: ‘কাঠ শালিক’ ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাটটেইলড স্টার্লিং’(Chestnut-tailed Starling), বৈজ্ঞানিক নাম:‘স্টুরনাস মালাবারিকাস’ (Sturnus malabaricus), গোত্রের নাম: ‘স্টুরনিদি’। আমাদের দেশে প্রায় ৬-৭ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে : ভাত শালিক, গোবরে শালিক, কাঠ শালিক, বামন শালিক, ঝুঁটি শালিক ও গাং শালিক। ‘চিত্রা শালিক’ নামে এক প্রজাতির শালিক সম্পর্কে জেনেছি ড. রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামক গ্রন্থে’। পাখিটা সচরাচর দেখা যায় না। দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। সৌভাগ্যটা অর্জন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করব। কাঠ শালিক লম্বায় ২০-২৩ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ধূসরাভ-রুপালি। থুতনি-গলা সাদা। ঠোঁটের গোড়া নীল, মাঝখানটা সবুজ এবং ডগাটা হলুদ। পিঠ রুপালি ধূসরের ওপর হালকা খয়েরি। ডানার প্রান্তটা কালো। গলা ফিকে লালচের ওপর সাদাটে ধূসরের টান। বুক, পেট পাটকিলে। পা হলদেটে। লেজের উপরিভাগ ধূসর, তলদেশ পাটকিলে। কাঠ শালিকের খাদ্য তালিকায় রয়েছে কীটপতঙ্গ, ছোট ফল, ফুলের মধু ইত্যাদি। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। নরম লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিমে তা দেয় শুধু স্ত্রী পাখি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 31/10/2012
উদয়ী পাপিয়া | Oriental cuckoo | Cuculus saturatus
উদয়ী পাপিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অনিয়মিত পান্থ পরিযায়ী পাখি (চলার পথের পরিযায়ী)। অতি বিরল দর্শন। কোকিল গোত্রের পাখি। কালেভদ্রে বসন্তকালে সিলেটের চা বাগানে দেখা মেলে। এ সময় চা বাগান হয়ে হিমালয় কিংবা মিয়ানমার যাতায়াত করে ওরা। বলা হচ্চে উদয়ী পাপিয়ার কথা। মূলত ওরা মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এ ছাড়াও খোলা বনভূমি অথবা ফলের বাগানে বিচরণ রয়েছে। পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। বিচরণ করে একাকী। স্বভাবে লাজুক। গাছের পাতা কিংবা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। সহসা কারও নজরে পড়ে না, তবে ডাক শোনা যায়। সুরে মাদকতা আছে। প্রজনন মুহূর্তে পুরুষ পাখি ডাকে ‘উউপ…উউপ’ সুরে। স্ত্রী ডাকে ‘কুঁইকুঁই কুঁইকুঁই’ সুরে। প্রজনন ক্ষণ ঊষা কিংবা গোধূলিলগ্ন। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, মিয়ানমার ও চীন পর্যন্ত। তবে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে শীতে দেখা যায়। বিশ্বে ভালো অবস্থানে রয়েছে, ফলে আই ইউ সি এন প্রজাতিটিকে বিপদমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘উদয়ী পাপিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘ওরিয়েন্টাল কুক্কু’, (Oriental cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Cuculus saturatus | এরা ‘হিমালয়ের কোকিল’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৩০-৩১ সেন্টিমিটার। ওজন ৯০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথা ও পিঠ ধূসর-বাদামি ডোরা। লেজ কালচে ধূসর, অগ্রভাগ সাদা। গলা থেকে বুকের উপরিভাগ ধূসর ডোরা। নিচের দিকে পীতাভ-সাদার ওপর কালো ডোরা। স্ত্রী পাখির মাথা ও পিঠ লালচে-বাদামি, ওপর কালচে ডোরা। দেহতলে পীতাভ-সাদার ওপর কালচে বাদামি ডোরা। লেজে লালচে বাদামির ওপর কালচে ডোরা, লেজের নিচে সাদা খাঁজকাটা। উভয়ের চোখের বলয় হলুদ। চোখের মণি কমলা-লাল। ঠোঁট শিংঙ সবুজ। পা হলুদ। প্রধান খাবার: লোমশ শুঁয়োপোকা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না, বিধায় ডিম পাড়ে হরবোলা ও চুটকি পাখির বাসায়। প্রাকৃতিকভাবে ডিমের রং পালক মাতার ডিমের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। ডিম ফোটার দিনক্ষণ নির্ভর করে পালক মাতার ডিমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ধাত্রী মাতার আশ্রয়েই শাবক লালিত হয়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/11/2018
ভেকঠোঁটি রাতচরা | Hodgson’s Frogmouth | Batrachostomus hodgsoni
ভেকঠোঁটি রাতচরা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন ‘ভেকঠোঁটি রাতচরা’। বিচরণ করে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ৩০০-১৯০০ মিটার উচ্চতার পাহাড় কিংবা ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনে। এ ছাড়া মিশ্র চিরসবুজ বনে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে খুব একটা দেখার নজির নেই। আমাদের পূর্বসূরি পাখি বিশারদের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, এক সময় মধুপুর বনে এদের বিচরণ ছিল। তবে খুব বেশি দেখার তথ্য নেই। প্রজাতিটি দেখতে কুৎসিত, ভয়ঙ্কর চেহারার। মূলত এদের মুখের গঠন অনেকটাই ব্যাঙ আকৃতির। নামকরণেও সে রকমটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রজাতির দেহের বর্ণের সঙ্গে গাছের মরা ডালপালা কিংবা শুকনো লতা-পাতার যথেষ্ট মিল রয়েছে। যার ফলে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশে লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে বের করা মুশকিল। এরা নিশাচর পাখি। দিনের বেলায় ঘুমিয়ে কাটায়। রাতের আঁধার নেমে এলে কেবল শিকারে বের হয়। বেশির ভাগ একাকী শিকারে বের হয়। উড়ন্ত পোকামাকড় দেখলে ছোঁ মেরে মুখে পুরে ফেলে। প্রিয় পাঠক, ‘রাতচরা’ বা ‘নাইটজার’ প্রজাতির পাখির চেহারায় তত আকর্ষণ নেই। অনেকে এদের পেঁচা বলে ভুল করে থাকেন। আসলে এরা পেঁচাদের স্বজন নয়। আমাদের দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির রাতচরা পাখি দেখা গেলেও ব্যাঙমুখো প্রজাতির পাখি শুধু এরাই। পর্যায়ক্রমে আমরা রাতচরা প্রজাতির অন্যদের নিয়েও লেখার চেষ্টা করব। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিরল দর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ভেকঠোঁটি রাতচরা’, ইংরেজি নাম: ‘হজসন’স ফ্রগমাউথ’(Hodgson’s Frogmouth), বৈজ্ঞানিক নাম: Batrachostomus hodgsoni | এরা ‘হজসনি ব্যাঙমুখো’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৬-২৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির ঘাড় এবং গলায় সাদা ফোঁটা। পিঠ ধূসরাভ-বাদামি। পেটের দিকে এলোমেলো সাদা। লেজের ওপর ধূসর বলয়। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির ঘাড়ে সাদা ফোঁটা। পিঠ গাঢ় লালচে-বাদামি। পেটে অসংখ্য সাদা ফোঁটা। দেহের অন্যত্র দাগ বা ফোঁটা নেই। উভয়ের ডানা খাটো, লেজ লম্বা এবং মুখ-মাথায় সামান্য লোম দেখা যায়। চোখ বাদামি। ঠোঁট বাদামি-কালচে। প্রধান খাবার: উড়ন্ত পতঙ্গ বা পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের ডালে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/03/2015
ভাদি হাঁস | White winged Duck | Asarcornis scutulata
ভাদি হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। কয়েক দশক আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ বনের জলাশয়ে দেখা যেত। সম্প্রতি এ প্রজাতির পাখি কারো নজরেই পড়ে না। মূলত এরা ধীরগতির সে ললগ্নে জলাশয়ের ওপর নেমে আসে এবং সারারাত ধরে শিকারের লিপ্ত থাকে। ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হলে পুনরায় গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে পুরুষ পাখি ‘ক্রংক-ক্রংক’ স্বরে আওয়াজ করে। এ প্রজাতির সঙ্গে গৃহপালিত চীনা হাঁসের আকার-আকৃতি কিংবা বর্ণের মিল ব্যাপক। পাখিবিশারদ ব্যতিরেকে অন্য কারো পক্ষে প্রজাতি শনাক্তকরণ কঠিন বৈকি। বর্তমানে এদের বিস্তৃতি বিশ্বে সন্তোষজনক নয়, শুধু এশিয়ার কিছু অঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। যতদূর জানা যায়, উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বভাগ পর্যন্ত বিস্তৃতি। বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত এ প্রজাতির পাখি। প্রধান কারণ অবাধে বৃক্ষ নিধন। বিশেষ করে উঁচু গাছগাছালি বিলীন হওয়াতে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। বিঘ্ন ঘটছে বিচরণেও। ফলে এরা আর এ দেশমুখী হচ্ছে না। বিশ্বে বিপন্ন ও বাংলাদেশে অতিবিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তাই। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত রয়েছে। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘ভাদি হাঁস’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট-উয়িংড ডাক’ (White-winged Duck), বৈজ্ঞানিক নাম: Asarcornis scutulata | এরা লম্বায় ৮০-৮২ সেন্টিমিটার (ঠোঁট ৬ সে.মি লেজ ১৫ সে.মি)। ওজন প্রায় ৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির আকারে ও বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় সাদার ওপর ছোট ছোট কালো দাগ। কাঁধে সাদা পট্টি। পিঠ কালচের সঙ্গে তামাটের মিশ্রণ। ডানায় নীলাভ কালো বন্ধনী। ডানার কনুইয়ের প্রান্তে খাড়া নখর বিদ্যমান। স্ত্রী পাখি আকারে খানিকটা ছোট। দেহের পালক অনুজ্জ্বল। মাথায় ঘন কালো দাগ। ঠোঁট কমলা। পুরুষ পাখির ঠোঁটের গোড়ায় মাংসপিণ্ড স্ফীত রয়েছে। এটি প্রজনন মৌসুমে আরো স্ফীত হয়। পা ও পায়ের পাতা কমলা হলুদের মিশ্রণ। পায়ের পেছনের আঙুল সামান্য ছড়ানো। প্রধান খাবার: শামুক, ছোট মাছ, পোকামাকড় ও জলজ উদ্ভিদের কচিপাতা। প্রজনন সময় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। আম, উরি, সিভিট, ছুন্ডুল ইত্যাদি গাছের ৩০ মিটার উঁচুতে প্রাকৃতিক কোটরে ঘাস বা লতাপাতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৭-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/12/2013
ধুসরাভ মেঠো চিল | Montagu’s Harrier | Circus pygargus
ধুসরাভ মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট শীত মৌসুমে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে পরিযায়ী হয়ে আসে। নরওয়ে, গ্রেট ব্রিটেন, পর্তুগাল, রাশিয়া, (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) বেলারুশ, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। দেখতে ভয়ঙ্কর দর্শন হলেও মূলত এরা তত হিংস্র নয়। প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। প্রাকৃতিক আবাসস্থল কাঁটাওয়ালা চিরহরিৎ গুল্ম। বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উন্মুক্ত বনভূমি, বালিয়াড়ি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ। ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতায়ও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক (ডিটিটি) ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ধুসরাভ মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘মন্টেগুয়াস হ্যারিয়ার’ (Montagu’s Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus pygargus | এরা ‘মন্টেগুর কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪৩-৪৭ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৭-১১৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড়। গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ২৬৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৩৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড় ও পিঠ সুরমা ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালচে। লেজ কালচে ধূসর। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক হলদে বাদামি। দেহতল গাঢ় বাদামি। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, ছোট পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ঝোঁপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৪০ দিন। শাবক শাবলম্বী ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ২-৩ বছর। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/01/2017
বন খঞ্জন | Forest Wagtail | Dendronanthus indicus
বন খঞ্জন | ছবি: ইন্টারনেট বাংলা নাম: ‘বনখঞ্জন,’ ইংরেজি নাম: ‘ফরেস্ট ওয়াগটেল’ (Forest Wagtail), বৈজ্ঞানিক নাম: Dendronanthus indicus | এরা লম্বায় ১৬-১৮ সেন্টিমিটার। ঘাড়ের দুপাশ জলপাই রঙা। বুক ও পেট সাদা। তার ওপর চওড়া কালো দুটি দাগ। ডানার প্রান্তের পালক ময়লা হলুদ। লেজ পাটকিলে কালো। তবে লেজের দুপাশের পালক সাদা। শরীরের তুলনায় লেজটা বড়। চোখ দুটো বেশ মায়াবী। চোখের ওপরে সাদা বাঁকানো টান। পা হালকা গোলাপি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম। সব ধরনের খঞ্জনই দেখতে সুন্দর। সে তুলনায় বনখঞ্জন একটু নিষ্প্রভ। তবে চেহারাটা মায়াবী। বনখঞ্জন হিংসুটে কিংবা ঝগড়াটে নয়। বিচরণ করে একাকী। এরা পরিযায়ী পাখি। শীত শুরু হওয়ার আগেই উপমহাদেশে চলে আসে। থেকে যায় গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। অন্যসব খঞ্জন সাধারণত মাঠ-প্রান্তরে বিচরণ করলেও এরা বনে জঙ্গলে বেশি বিচরণ করে। তুলনামূলকভাবে ফাঁকা জঙ্গল এদের পছন্দ। সাধারণত আমাদের দেশে প্রায় আট প্রজাতির খঞ্জন দেখা যায়। বনখঞ্জন, সাদা খঞ্জন, বড় পাকড়া খঞ্জন, পাকড়া খঞ্জন, ধূসর খঞ্জন, হলুদ খঞ্জন, হলদে মাথা খঞ্জন, কালো মাথা খঞ্জন। বড় পাকড়া খঞ্জন ছাড়া অন্যরা পরিযায়ী হয়ে আসে। কয়েক প্রজাতি এ দেশে ডিম বাচ্চাও ফোটায়। সব ধরনের খঞ্জনই চঞ্চল প্রকৃতির। স্থিরতা এদের মাঝে নেই বললেই চলে। নাচের ভঙ্গিতে লেজ দোলাতে থাকে সর্বক্ষণ। অবশ্য কোমরের গড়ন ভিন্নতার কারণে কোমরটা সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে। ফলে মনে হয় এরা বুঝি সারাদিন নেচে বেড়ায়। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সব ধরনের খঞ্জনের প্রিয় খাবার পোকামাকড়। বনখঞ্জনরাও তদ্রুপ বনপ্রান্তরে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খেয়ে থাকে। প্রজনন সময় মে-জুলাই। বাসা বাঁধে ঘাসবনে অথবা গাছের গোড়ার খোঁদলে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, নরম লতাপতা। বাসার আকৃতি লম্বাটে। ডিমের সংখ্যা ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৭-১৯ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/10/2012
তামাপিঠ লাটোরা | IdeanBay backed shrike | Lanius vittatus
তামাপিঠ লাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও তুরস্ক পর্যন্ত। বিচরণ করে আবাদি জমি, বনপ্রান্তরের খোলা মাঠে এবং ঝোপ-জঙ্গলের কাছাকাছি এলাকায়। পতঙ্গ শিকারের উদ্দেশ্যে এতদস্থানে ওড়াউড়ি করে। এ ছাড়াও বাঁশের খুঁটি কিংবা গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষায় সময় কাটায়। স্বভাবে হিংসুটে। স্বজাতির কেউ নিজ সীমানার কাছাকাছি এলে সহ্য করতে পারে না, চেঁচিয়ে বিদায় করে। পাখিটির বাংলা নাম: ‘তামাপিঠ লাটোরা’, ইংরেজি নাম: ইন্ডিয়ান বে-ব্যাকড শ্রাইক (IdeanBay-backed shrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Lanius vittatus | এরা ‘লালচে-পিঠ কসাই’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ১৭-১৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২০-২৮ গ্রাম। কপাল কালো। মাথা ফিকে ধূসর, ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠের মধ্যখানটা তামাটে বাদামি। পাশের দিকে কালোর ওপর সাদা ছোপ। লেজ কালো। গলা সাদাটে। দেহতল বাদামি সাদা। স্ত্রী পাখির কপালের কালো অংশটুকু সরু। উভয়ের চোখ বাদামি। কালচে বাদামি। পা ময়লা কালচে। প্রধান খাবার: ফড়িং, পঙ্গপাল, ঝিঁঝিঁ পোকা, টিকটিকি ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ৪ মিটার উচ্চতায় গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, পশম, মাকড়সার জাল ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/02/2016