রাজ ধনেশ | Great Indian Hornbill | Buceros bicornis
রাজ ধনেশ | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পাখি। দেশে যত্রতত্র দেখার নজির নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের গহিন অরণ্যে কদাচিত নজরে পড়ে। বাংলাদেশ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মালেয়েশিয়া, নেপাল ও ভারতে দেখা মেলে। দেখতে যেমনি এরা অদ্ভূত গড়নের তেমনি স্বভাবেও অদ্ভূত। বিশেষ করে প্রজনন সময়ে অদ্ভূত কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। স্ত্রী পাখি স্বেচ্ছায় গাছের কোটরে ঢুকলে পুরুষ পাখি ওকে বন্দি করে রাখে। কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয় কাদামাটি দিয়ে। পুরুষ পাখি নিজেই কাদামাটি বহন করে এনে ঠোঁট দিয়ে লেপে দেয়। শুধু ছোট্ট একটি ছিদ্র রাখে বায়ু চলাচল এবং খাবারের জোগান দিতে। পুরুষ পাখিকেই খাবারের জোগান দিতে হয় তখন। ডিম-বাচ্চা ফুটলেও খাদ্যের চাহিদা মেটায় পুরুষ পাখিই। শাবক স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষ পাখিকেই খাবার জোগানে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চারা ফুরফুরে হলে ভেতর থেকে মা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে মাটির আস্তর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। তত দিনে পুরুষ পাখির অবস্থা দফারফা। দুর্বল হয়ে পড়ে অনেকটাই। এ পাখি আজীবন একই স্থানে বাস করে যদি জঙ্গলে কোনো অশান্তি না ঘটে। সবচেয়ে দৃষ্টান্তমূলক দিকটি হচ্ছে এদের জুড়ি আজীবনের জন্যই থাকে, মৃত্যু বা শিকারির হাতে ধৃত না হওয়া পর্যন্ত। এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ, ‘খক্-খক্-খক্’ শব্দে ডাকে। হঠাৎ ডানা ঝাপটালে ভয় পেয়ে লাগে। এ বিরল প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে মোটেই ভালো অবস্থানে নেই। এমনিই এদের প্রজনন সন্তোষজনক নয়। তার ওপর কবিরাজ নামক অপচিকিৎসকদের কবলে পড়ে এ পাখিগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গেছে আজ। তারা এ পাখির অবয়বটাকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের রোগের উপশম হয় এমনটি বয়ান করে ফুটপাতে ওষুধ বিক্রি করে। এ ছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িরা মাংসের লোভে এদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশালাকৃতির এ পাখি প্রথম দেখি ১৯৮৭ সালে খুলনার খালিশপুরে এক কবিরাজের কব্জায় বন্দি অবস্থায়। পাখিটার পাখার পালক কেটে তার পাশে বসিয়ে রেখেছে। উৎসুক জনতা এক নজর দেখছে, কবিরাজ তাতে মজা পাচ্ছেন আর ফন্দি আঁটছেন ওষুধ বেচার। দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি। পাখিটার বাংলা নাম: ‘রাজ ধনেশ’, ইংরেজি নাম: গ্রেট ইন্ডিয়া হরনবিল (Great Indian Hornbill), বৈজ্ঞানিক নাম: (Buceros bicornis) গোত্রের নাম: ‘বুসেরোটিদি’। এরা লম্বায় ৯৫-১০৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩-৪ কিলোগ্রাম। ঠোঁটের গড়ন অদ্ভূত, আকারে বড়। কাস্তের মতো নিচের দিকে বাঁকানো। ঠোঁটের ওপরে শক্ত বর্ম। ঠোঁটের ডগা লালচে বাকিটা হলদেটে। ঠোঁটের গোড়া, কপাল কালচে। মাথা, গলা, ঘাড় হলুদ বর্ণের। বুক, পেট কালো। ডানার অধিকাংশ পালক কালো মাঝ বরাবর সাদা পট্টি। লেজে সাদার ওপর কালো পট্টি। চোখের বলয় কালো, তারা বা মনি লাল। স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে চোখের বলয় লাল মনি সাদা। প্রধান খাবার: ফল-ফলাদি। এ ছাড়া ইঁদুর, গিরগিটি ছোট পাখি ইত্যাদি খায়। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বড় বড় গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৮-৪০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 31/05/2013
লম্বাঠোঁটি শকুন | Cinereous Vulture | Aegypius monachus
লম্বাঠোঁটি শকুন | ছবি: ইন্টারনেট হিংস্র চেহারার মনে হলেও তত হিংস্র নয়। আকারে বড়সড়ো। অধিক ওজনের কারণে হাঁটাচলা করতে খানিকটা বেগ পেতে হয়। ভারিক্কিচালে হেলেদুলে কিংবা লাফিয়ে হাঁটাচলা করে। পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি নজরে পড়ে। দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, হিমালয় অঞ্চল, আফগানিস্তান, পর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্স, গ্রিস, স্পেন, তুরস্ক, মঙ্গোলিয়া, চীন পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘লম্বাঠোঁটি শকুন’, ইংরেজি নাম: ‘সিনেরিয়াস ভালচার’, (Cinereous Vulture) বৈজ্ঞানিক নাম: Aegypius monachus। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৯৮-১১০ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ২৫০-২৯৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৭-১২ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথা, পিঠ গাঢ় বাদামি সঙ্গে নীলচে ধূসরের মিশ্রণ রয়েছে। ঘাড় নীলচে ধূসর। ডানার পালক প্রান্ত কালচে বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। লেজ খাটো কালচে বাদামি। গলা ময়লা সাদা চামড়ায় আবৃত। দেহতল কালচে বাদামি। ঠোঁটের গোড়া নীলচে ধূসর, অগ্রভাগ কালো। ওপরের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। পা ধূসর হলেও গোলাপি আভা বের হয়। প্রধান খাবার: সব ধরনের মৃতদেহ বা উচ্ছিষ্ট খাবার শামুক, পাখির ডিম, ছোট পাখি, খরগোশ, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে উঁচু গাছের ডালে সরু লাঠি দিয়ে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৫০-৫৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/01/2018
সাতভায়লা পাখি | Jungle babbler | Turdoides striata
সাতভায়লা পাখি | ছবি: ইন্টারনেট কথিত আছে, এক গেরস্থের সাত ছেলে ছিল। ছেলেদের বিয়ের উপযোগী বয়স হলে বাবা পাত্রীর সন্ধানে ঘটক লাগালেন। ঘটক পাশের গ্রামে বাসরত সুন্দরী এক পাত্রীর সন্ধান দিলেন। কনে দেখে সাত ভাইয়েরই পছন্দ হয়ে গেল। সাতভাই প্রত্যেকেই চায় ওই পাত্রীকে বউ করে ঘরে নিতে। এ নিয়ে ওদের মাঝে বিবাদও বাধে। বিষয়টা নিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি হলে এবং তা চাউর হতেই ওই গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় পাত্রী। পাত্রী নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটা সাতভাইয়ের কানে গেলে পাগলের মতো হয়ে যায় তারা। ওরা সবাই মিলে পাত্রীকে খুঁজতে থাকে আশপাশের সব গ্রামে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় হয়রান হয়ে ওরা ওপরওয়ালার কাছে আবেদন জানায় পাখি বানিয়ে দিতে। যাতে উড়ে উড়ে তল্লাশি চালাতে পারে। সৃষ্টিকর্তা সাতভাইয়ের ফরিয়াদ কবুল করে ওদের পাখি বানিয়ে দেন। সেই থেকে ওরা পাখি হয়ে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে বিচরণ করছে আজঅবধি। হাল আমলে এরা কাউকে না খুঁজলেও ওদের চলাফেরা দেখে এখনো সে রকমটিই মনে হয়। বিচরণের সময় এরা হঠাৎ প্রচণ্ড ঝগড়ায় মেতে ওঠে আবার নিমেষেই মিলেও যায়। এমন স্বভাবটি নাকি ওরা মানুষ থাকায় অবস্থায়ও ছিল। উল্লেখ্য, এরা দলে শুধু সাতটিই নয় ১০-১৫টিও একত্রে থাকে। এ পাখির বড় গুণটি হচ্ছে এদের দলের কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে যায়। এ ছাড়া চমৎকার তথ্যটি হচ্ছে, এ পাখিদের মধ্যে কোনো জুড়ি যদি ডিম পাড়ে তাহলে অন্যরা গিয়েও সে ডিমে তা দেয়। শুধু তাই-ই নয় ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলে সবাই মিলে ওদের খাইয়ে দেয় পর্যন্ত। এরা ডাকে ‘কিচ্-কিচ্ বা কিক-কিক’ সুরে। ভালো উড়তে পারে না। মাটিতে হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। কোকিল গোত্রীয় দুই-এক প্রজাতির পাখিরা এদের বাসায় ডিম পাড়ে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘সাতভায়লা’, ইংরেজি নাম: ‘জাঙ্গল ব্যাবলার’ (Jungle babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টার্ডিডেস স্ট্রায়াটাস’(Turdoides striata) | গোত্রের নাম: ‘সিলভিআইদি’। সাতভাই নামেও এরা পরিচিত। লম্বায় এরা ২৩-২৫ সেন্টিমিটার। গায়ের সমস্ত পালক মেটে বর্ণের। শরীরে কোনো রেখা নেই। তবে ওপরে নিচের অধিকাংশ পালকের মাঝ-দণ্ড ফ্যাকাসে বিধায় পালক দ্বি-রঙবিশিষ্ট মনে হয়। এদের চোখের বলয় সাদা। ঠোঁট মজবুত ও মোটা। বর্ণ হলুদ। পায়ের বর্ণও তদ্রƒপ হলদেটে। শরীরে তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। সাতভায়লা পাখির প্রিয় খাবার ফুলের মধু ও খেজুরের রস। স্বাভাবিক খাবার কীটপতঙ্গ, কেঁচো, ছোট ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। বাসা বাঁধে ঝোপজঙ্গলের ভেতর ছোট গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস-লতা। বাসাটা দেখতে পেয়ালার মতো। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/09/2013
সাদাগলা লেজনাচানি | White throated Fantail | Rhipidura albicollis
সাদাগলা লেজনাচানি | ছবি: ইন্টারনেট আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী পাখি এরা। মানুষকে ভয় পেলেও একেবারেই ঘরের লাগোয়া গাছ-গাছালিতে এরা বিচরণ করে। গ্রাম-গঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ঝোপ-জঙ্গলে এদের কম-বেশি দেখা যায়। ছোট গাছের ডালে কিংবা মাটিতে নেচে বেড়ায় সুযোগ পেলেই। বিশেষ করে স্যাঁতস্যাঁতে ছায়াময় স্থানে এদের বেশি দেখা যায়। তার কারণও আছে অবশ্য। কারণটি হচ্ছে ওদের পছন্দের শিকার মশা-মাছি বা ছোট পতঙ্গ এতদাঞ্চলে বেশি মেলে। এ ছাড়া স্ত্রী-পুরুষ পাখিদের মধ্যে প্রেম নিবেদনের মোক্ষম স্থানও বটে। তবে যেখানেই বিচরণ করুক না কেন চুপচাপ বসে থাকার মতো পাখি নয় এরা। বরং উল্টো ওদের চরিত্র। সাংঘাতিক চঞ্চল প্রকৃতির পাখি ওরা। চোখের নিমেষেই ফুরুৎ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ করেই চোখের সামনে এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ নেচে-গেয়ে আবার ফুরুৎ। এ হচ্ছে ওদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ পাখিরা কালো ধাচের হলেও দেখতে ভারী চমৎকার। বিশেষ করে ওদের লেজটা বেশ আকর্ষণীয়। নেচে বেড়ানোর সময় লেজটাকে ছাতার মতো মেলে ধরে। ঠিক সে সময় পেখমমেলা ময়ূরের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে আসে ময়ূর দেখিয়েদের মনে। একটা সময় এ পাখিদের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা ছিল। ওদের দেখলেই কেন জানি ছুঁয়ে আদর করতে ইচ্ছে করত। অনেকবার চেষ্টাও করেছি ধরতে। ওদের বাসার ওপর সুতার ফাঁদ পেতে ধরার অহেতুক প্রচেষ্টা কম করিনি। এমনকি রাতেও অপারেশন চালিয়েছি। কামিয়াবি হতে পারিনি। খুব চতুর প্রকৃতির হওয়াতে এরা ধরাছোঁয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে বারবারই। আর হ্যাঁ, পাখি পর্যবেক্ষক হওয়ার আগ মুহূর্তেও একটি ভুল ধারণা ছিল এ পাখির প্রজতির প্রতি। তখন আমার ধারণা ছিল এরা ‘শ্যামা’ গোত্রের পাখি। পরে শ্যামা পাখির দর্শন পেয়ে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তৎসঙ্গে এ প্রজাতির পাখির সঠিক পরিচয় জানতে পেরে আমি বেশ আনন্দিতও হয়েছি। আশা করি প্রিয় পাঠকরাও সে আনন্দের ভাগিদার হবেন। প্রতিবেশী পাখির সঠিক পরিচয়টা জানতে পারবেন। এ পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাগলা লেজনাচানি’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট থ্রোটেড ফ্যানটেইল’ (White-throated Fantail), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘রাইপিডুরা আলবিকল্লিস’ (Rhipidura albicollis), গোত্রের নাম: ‘রাইপডুরিনি’| এরা লম্বায় ১৬-১৮ সেন্টিমিটার। মাথাটা কালো। গলার দুই পাশে সাদা। চোখের ওপর রয়েছে সাদা টান। এ ছাড়া এদের বাদবাকি পালক ধূসর-পাটকিলে। লেজের অগ্রভাগ সাদা। ঠোঁট, পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। এরা পতঙ্গভুক পাখি। মশা, মাছি, বোলতা জাতীয় পতঙ্গের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন সময় ফেব্র“য়ারি থেকে মে। ভূমি থেকে সামান্য উঁচু গাছের দুই ডালে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে নরম চিকন ঘাস-লতা, গাছের সরু শিকড়। স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। শাবক বাসা ত্যাগ করে ১৫ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/01/2013
কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া | Black naped monarch | Hypothymis azurea
কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া | ছবি: ইন্টারনেট পাখির বাংলা নাম: ‘কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া’। ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক নেপড মোনার্ক’ (Black-naped monarch)| বৈজ্ঞানিক নাম: Hypothymis azurea। প্রজাতিটি ‘কালাঘাড় রাজন’ বা ‘কালো গ্রিবা পতঙ্গভুক’ নামেও পরিচিত। এ পাখি চঞ্চল হলেও হিংস্র নয়। গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে না। বেশির ভাগই জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। মাঝে মধ্যে একাকীও দেখা যায়। শীত মৌসুমে সমতলের ঝোপ-জঙ্গলে বেশি চোখে পড়ে। লুকিয়ে-চুকিয়ে ‘চুইচ চুইচ চুউ’ সুরে ডাকাডাকি করে। মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। কোথাও একদণ্ড দাঁড়ানোর জো নেই এ পাখির। রাজ্যের ব্যস্ততা নিয়ে দিন কাটায়। উড়ন্ত অবস্থায়ই শিকার ধরে। এরা দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বিস্তৃতি। দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্লিম গড়ন। নজরকাড়া রূপ। মায়াবীও বটে। এদের দিকে নজর পড়লে নিমিষেই চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য লম্বায় ১৬ সেন্টিমিটার। ঘাড়ে কালো প্যাঁচ। গলার নিচে সরু চিলতে কালো রেখা। পুরুষ পাখির প্রধান রং লালচে নীল। তবে নীলের আধিক্য বেশি থাকায় লালচে ভাবটা খুব একটা দেখা যায় না। বুক নীল। নীলটা ফ্যাকাসে হয়ে তলপেট পর্যন্ত সাদাটে হয়ে পৌঁছেছে। চোখ কালো। ঠোঁট নীল-কালো। পা ও পায়ের আঙ্গুল নীলচে কালো। মেয়ে-পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মেয়ে পাখির বর্ণ পুরুষের তুলনায় নিষ্প্রভ। তা ছাড়া গলায় কালো রেখা দেখা যায় না। এদের প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ। প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। গাছের তে-ডালায় পেয়ালা আকৃতির মজবুত বাসা বানিয়ে তিনটি ডিম পাড়ে। ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 29/08/2018
পাহাড়ি নীলকণ্ঠ | Dollarbird | Eurystomus orientalis
পাহাড়ি নীলকণ্ঠ | ছবি: ইন্টারনেট দুর্লভ দর্শন। পরিযায়ী পাখি। আমাদের দেশে প্রজনন সময়ে (গ্রীষ্মকালে) দেখা মেলে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেটের চিরসবুজ অরণ্যে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনিতে পরিযায়ী পাখির বিস্তৃতি রয়েছে। এরা আমাদের দেশে মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত হয়েছে। তবে বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত রয়েছে। এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। ডাকে ‘ক্যাক.. ক্যাক’ সুরে। ওড়ার সময় ডাকে ‘ক-চক-চক-চক’ সুরে। পাখিটাকে প্রথম দেখি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। চা বাগানের ভেতরে উঁচু একটা গাছের মগডালে বসে রয়েছে। দেখতে খানিকটা সমস্যা বোধ করেছি। বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়েও প্রজাতি শনাক্ত করতে কষ্ট হয়েছে। পরক্ষণে চিনতে পেরে বেশ উত্তেজিত বোধ করেছি সেদিন। অধিক উত্তেজনা নিয়েই দ্রুত টুকিটাকি লিখে নিয়েছি। নোট নেয়া শেষ হতেই অসুস্থ শরীরে সুস্থতার ইঙ্গিত পেয়ে গেছি মহূর্তেই। পাখির বাংলা নামঃ পাহাড়ি নীলকণ্ঠ, ইংরেজি নামঃ ডলারবার্ড (Dollarbird), বৈজ্ঞানিক নামঃ Eurystomus orientalis, পরিযায়ী। আমাদের দেশে নীলকণ্ঠ এবং পাহাড়ি নীলকণ্ঠ নামক দুই প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। লম্বায় ৩০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০ গ্রাম। ঠোঁট কমলা লাল। মাথা কালচে-বাদামি। গলা থেকে নীলাভ আভা ঠিকরে বের হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের পালক কালচে নীল। ওড়ার পালক কালচে-বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকের গোড়া রূপালী-সাদা। চোখের বলয় হলদে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা লাল। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। এদের ঠোঁট অনুজ্জ্বল। প্রধান খাবারঃ উড়ন্ত পোকামাকড়। এরা উড়ে উড়েই শিকার ধরে। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে কিংবা পাহাড়ের প্রাকৃতিক গর্তে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-২০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩০-৩৫ দিন। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
পাতি চখাচখি | Common Shelduck | Tadorna tadorna
পাতি চখাচখি | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, চীন, তিব্বত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান ও ইরাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও সুলভ দর্শন। দর্শনীয় চেহারাও বটে। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশের প্রায় বিভাগেরই নদ-নদীতে কম-বেশি বিচরণ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে কিংবা মোহনাতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যের সন্ধানে বড় বড় দলে বিচরণ করে অগভীর জলাশয়ে। শিকার কৌশল দেশীয় গোত্রের পাতি হাঁসের মতো। সাধারণত এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের কলহ-বিবাদ ঘটায় না। বলা যায় সারাদিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। পুরুষ পাখি পারতপক্ষে তেমন ডাকাডাকিও করে না। স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নিচু গলায় শিস কাটে। সঙ্গী জবাব দেয় তখন ‘গ্যাগ-গ্যা-গ্যা’ সুরে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতিটি দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা আরেকটু সদয় হলে বোধ করি এদের আগমন আরো বেশি বেশি ঘটবে দেশে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি চখাচখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন শেল ডাক’ (Common Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না টাডোর্না’, (Tadorna tadorna) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। অনেকে ‘শাহ চখা বা সাচ্কা’ নামেও ডাকে। দেশে দুই প্রজাতির চখাচখি নজরে পড়ে। যথা: খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। এরা লম্বায় ৫৮-৬৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১ কেজি। কপাল, মাথা ও গলা ধাতব সবুজ। ঠোঁট রক্ত লাল, গোড়া স্ফীত লাল পুঁটলি। বুক ও ঘাড়ে সাদার ওপর পাটকিলে চওড়া বন্ধনী। পিঠ ধবধবে সাদা। ডানা কুচকুচে কালো। লেজ ও কোমর সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা মেটে-লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী পাখি খানিকটা ছোট। এ ছাড়াও স্ত্রী পাখির বুকে পাটকিলে বর্ণের প্রান্তটা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার তালু, গলার পেছন ও পিট কালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: জলজ কীট, ছোট শামুক, চিংড়ি, ধান, শৈবাল, কেঁচো, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। মধ্য এশিয়ার পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে প্রাকৃতিক ফাটলে কিংবা মাটির প্রাকৃতিক গর্তে পালক দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/04/2014