খাকি ভুতুম পেঁচা | Tawny Fish Owl | Ketupa flavipes
খাকি ভুতুম পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মূলত এরা নদ-নদী, হ্রদ কিংবা বড়সড় জলাশয়ের কাছাকাছি বৃক্ষে বিচরণ করে। বহমান জলাশয়ের আশপাশে বেশি দেখা যায়। বিচরণের ক্ষেত্র ক্রান্তীয় থেকে নাতিশীতোষ্ণ এলাকা বেশি পছন্দের। এছাড়াও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ মিটার উচ্চতায় দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। অন্যসব পেঁচাদের মতো এরাও দিনের বেলায় গাছ-গাছালির ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দিনের আলো ফুরিয়ে এলে বা গোধূলিলগ্নে শিকারে বের হয়। একাকী কিংবা জোড়ায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। দলবেঁধে বিচরণ করে না। দেখতে ভয়ঙ্কর দর্শন হলেও একেবারেই নিরীহ গোত্রের পাখি। স্বভাবে লাজুক। অন্যসব শিকারি পাখিদের মতো হিংস নয়। কণ্ঠস্বর ভৌতিক। ভরাট কণ্ঠে ‘ওহুহু-হুহু’ আওয়াজ করে মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, উত্তর মিয়ানমার, চীন, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। এ ছাড়াও হিমালয়ের পাদদেশে বিচরণ রয়েছে। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘খাকি ভুতুম পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘তানি ফিস আউল’ (Tawny Fish Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ketupa flavipes | এরা ‘তামাটে মেছোপেঁচা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪৮-৫৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথা ও ঘাড় তামাটে-বাদামি ডোরাযুক্ত। মাথার দু’পাশে আছে কান পশম, যা ঝুঁটি আকৃতির দেখায়। চোখের দু’পাশে কপালের ওপর সরু সাদা টান। মুখমণ্ডল তামাটে। দেহের উপরাংশ গাঢ় বাদামি রঙের সঙ্গে তামাটে মিহি রেখা। ডানার উপরে সাদাটে দাগ। লেজ খাটো, গোলাকার। দেহের নিচের দিকে তামাটে-বাদামির আড়াআড়ি রেখা। গোলাকার চোখের বলয় তামাটে-হলুদ রঙের। তারা গাঢ় বাদামি। ঠোঁট শিং রঙা, আকারে খাটো, নিচের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। পায়ের আঙ্গুল ফ্যাকাসে হলদে। প্রধান খাবার: মাছ, কাঁকড়া, সরীসৃপ, ইঁদুর, টিকটিকি, ব্যাঙ ও বাগদাচিড়িং। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। মরা গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। এ ছাড়াও গিরিখাত এবং নদীর খাড়া কিনারের গর্তে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-২৯ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে মাসখানেক সময় লেগে যায়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/06/2016
কালি ময়ূর | Kalij pheasant | Lophura leucomelanos
কালি ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট প্রায় সাড়ে তিন যুগ আগেও আমাদের দেশের গহিন জঙ্গলগুলোতে এ পাখির প্রচুর বিস্তৃতি ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল এরা। আমাদের দেশের পাখি বিশারদরা জানিয়েছেন, কয়েক যুগ আগেও মধুপুরের শালবনে পাওয়া যেত এই পাখি। এখন আর নজরেই পড়ে না। শিকারিদের দৌরাত্বে পাখিটি শালবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে কালেভদ্রে নজরে পড়ে। আমি বছর দশেক আগে প্রথম এ পাখিটি দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। মাত্র দুটি পাখি দেখেছি সেদিন। মোরগাকৃতির এ পাখি দুটিকে দেখে সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। স্থানীয় লোকজনের কাছে পাখিটার নাম জানতে চেয়েছি। তারা জানিয়েছেন এগুলোর নাম ‘কালা মুরকা।’ এ-ও জানিয়েছেন তারা জঙ্গলের আশপাশে এ পাখি শিকার করতে ওঁৎ পেতে থাকেন। এগুলো খুব ভোরে ও সূর্যাস্তের সামান্য আগে জঙ্গল থেকে ফাঁকা স্থানে বেরিয়ে আসে। সে সুযোগে শিকারিরা এগুলোকে শিকার করে। এই পাখির মাংস পাহাড়িদের কাছে বেশ প্রিয়। বাংলায় এই পাখির কোনো নাম নেই। আমাদের দেশের পাখি গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালি ময়ূর।’ নামটি বেশ মানানসই বলা যায়। ইংরেজি নাম: ‘কালিজ ফেজেন্ট’, (Kalij pheasant) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লোফুরা লিউকোমেলানোস’, (Lophura leucomelanos) গোত্র: ‘ফাজিয়ানিদি’। কালি ময়ূর স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে যা পাখি বিশারদের নজর এড়াতে পারবে না। তবে সাধারণের চোখে পার্থক্যটা সহজে ধরা পড়বে না। পার্থক্যটা হচ্ছে, পুরুষ পাখি লম্বায় ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫০-৬০ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির শরীরের ওপরের দিকটার পালক চকচকে কালোর সঙ্গে ধাতব মিশ্রণ। নিুাংশ সাদাটে। চোখের চারপাশটা ও লতিকা টকটকে লাল। স্ত্রী কালি ময়ূর দেখতে হালকা বাদামি তবে কোনো কোনো অংশে গাঢ় বাদামি। ঝুঁটি বাদামি রংয়ের এবং লেজটা কাস্তের মতো বাঁকানো। দেখতে বেশ চমৎকার। কালি ময়ূরদের কণ্ঠস্বর বিশ্রী। উচ্চৈঃস্বরে ডাকলে ‘চিরপ..চিরপ’ শব্দ শোনা যায়। আর স্বাভাবিক স্বরে ডাকলে ‘কুরচি…কুরচি’ শব্দ করে। দেখতে হিংস্র মনে হলেও আসলে এরা খুবই ভীরু প্রকৃতির পাখি। কালি ময়ূরের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শস্যদানা, শস্যের কচি ডগা, কীটপতঙ্গ, ছোট সরীসৃপ ইত্যাদি। এরা বন মোরগের মতো মাটি আঁচড়ে পোকামাকড় খোঁজে। এদের প্রজননের সময় মার্চ থেকে অক্টোবর। মাটির ওপরে ঘাস কিংবা শুকনো লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/09/2012
ঘুরঘুরি | Baillon’s Crake | Porzana pusilla
ঘুরঘুরি | ছবি: ইন্টারনেট হিমালয় অঞ্চলের পাখি হলেও দেখা মেলে ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায়। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। বিচরণ করে সুপেয় জলের জলাশয়ের কিনারে। বিশেষ করে বাদাবনে এরা আশ্রয় নেয় বেশি। হোগলা বন এদের খুবই প্রিয়। হোগলা বনের ভেতর হেঁটে হেঁটে পোকামাকড় খুঁজে ব্যস্ত সময় পার করে। এ ছাড়াও বড় বড় হাওর-বাঁওড়ের কিনারেও এদের দেখা যায়। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির পাখি এরা। খুব সহজে নজরে পড়ে না, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে সবসময়। অন্যসব প্রজাতির মতো এরা প্রজনন মৌসুমে খুব একটা ডাকাডাকি করে না। অনেকটাই নীরবে নিভৃতে কাটিয়ে দেয় এ বিশেষ মুহূর্ত। প্রিয় পাঠক, এরা অতি বিরল প্রজাতির পাখি। দেশে খুব বেশি দেখা যায় না। এরা নির্যাতিত হলে বা শিকারির খপ্পরে পড়লে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। শুধু এদেরকে নয়, যে কোনো প্রজাতির পাখি নির্যাতিত হলে আপনারা এগিয়ে আসবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পশু-পাখির ভূমিকা অপরিসীম। কাজেই শিকারিদেরকে প্রতিহত করতে হবে। সবাই মিলে পরিবেশটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ইচ্ছে করলে তরুণসমাজ দেশ থেকে শিকারিমুক্ত করতে পারেন। পাড়া-মহল্লায় শিকারিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বোধকরি দেশ শিকারিমুক্ত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ঘুরঘুরি’, ইংরেজি নাম: ‘বেলুনস ক্রেক’ (Baillon’s Crake), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পরজানা পুসিল্লা’ (Porzana pusilla), গোত্রের নাম: ‘রাল্লাদি’। এরা ‘বেইলন গুরগুরি’ নামেও পরিচিত। বাদাবনে খানিকটা বেশি পরিলক্ষিত হয় বিধায় পাখি বিশারদদের কেউ কেউ ‘বাদা কুক্কুট’ নামে ডাকেন। মূলত এরা ডাহুক গোত্রের পাখি। দেখতেও কিছুটা সেরকম। পাখি লম্বায় ১৭-১৯ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির রঙ ভিন্ন। ওদের মাথা পাটকিলে বাদামি। মুখ, গলা ও বুক নীলাভ-ধূসর। পিঠ পাটকিলে-বাদামির ওপর সাদা-কালো ফুটকি। বুকের মাঝখান থেকে লেজের নিচের অংশ কালচে ধূসর। ঠোঁট সবুজ। পা ও পায়ের পাতা জলপাই রঙের। চোখের মণি লালচে। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় অনুজ্জ্বল। উভয়েরই ডানা ও লেজ খাটো। প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদের কচি পাতা খায়। প্রজনন সময় মে-আগস্ট। বাসা বাঁধে জলজ ধান ক্ষেতে কিংবা পাহাড়ি জলাশয়ের কাছাকাছি। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/01/2014
হলুদ পা হরিয়াল | Yellow Footed Green Pegion | Treron phoenicoptera
হলুদ পা হরিয়াল | ছবি: ইন্টারনেট সবুজে আচ্ছাদিত গ্রামটির নাম চরপাতা। আয়তনে বিশাল। ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিম নাম ধারণ করেছে। নামকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রায়পুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কটি। এটি গ্রামের বুক চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে গিয়ে মিলিত হয়েছে চাঁদপুর শহরে। বছর ত্রিশেক আগেও রাস্তাটি ছিল কাঁচা। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়েছিল বেশকিছু মোটাসোটা গাছ। তন্মধ্যে রেইনট্রি গাছ ছিল বেশি। ছিল বট-পাকুড় গাছও। এখন নেই। তো তেমনি দুটি পাকুড় গাছ ছিল ‘সিংহপুল’ নামক স্থানে। বিকেলে গ্রামের ছেলে-বুড়োরা সিংহপুলে এসে আড্ডা জমাতেন। কিশোর ছিলাম তখন আমি। তথাপিও যেতাম সেখানে মাঝেমধ্যে। আড্ডা দিতে নয়। পাকুড় ফল খেতে আসা হলুদাভ সবুজ রঙের পাখিগুলোকে একনজর দেখতে। প্রত্যহ গাছে একঝাঁক পাখি দেখা যেত পাকুড় পাকলে। দৃশ্যটি ছিল ভারি চমৎকার। গ্রামের প্রত্যেকেই উপভোগ করতেন সেটি। তাই বড়রা ওদের কখনো বিরক্ত করেননি। পাখিগুলো দেখতে অনেকটা কবুতরের মতো হলেও সৌন্দর্য বিচারে কবুতরের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে। নিজচোখে না দেখলে এ পাখির রূপের বর্ণণা দেয়া খুবই কঠিন। অনেকটা ‘অন্ধের হস্তি’ দর্শনের মতো। একটা সময় দেশের গ্রামগঞ্জে সুলভ দর্শন ছিল এ পাখি। নির্জন কোনো জঙ্গলে অথবা ছোট পাকা ফলবান বৃক্ষের নিচে গেলে ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। বর্তমানে খুব একটা নজরে পড়ছে না। ব্যাপকহারে ফলবান বৃক্ষ নিধনের ফলে এরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে প্রজননেও। এ পাখি আজ অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। এরা আজীবন বৃক্ষচারী। জলপান ব্যতিরেকে মাটিতে নামে না খুব একটা। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। স্বভাবে শান্ত। গায়ে পড়ে অন্য প্রজাতি তো দূরের কথা নিজেদের কারো সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়ায় লিপ্ত হয় না। পাখিটার বাংলা নাম: ‘হলুদ পা হরিয়াল’, ইংরেজি নাম: ‘ইএয়এলা ফুএটড গিণ্ঠন পিজিয়ন’ (Yellow Footed Green Pegion), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ট্রেরন ফোনিকোপটেরা’ (Treron phoenicoptera), গোত্রের নাম: ‘কলাম্বিদি’। অঞ্চলভেদে এরা ‘হরিকল বা বটকল’ নামে পরিচিত। লম্বায় এরা ৩২-৩৪ সেন্টিমিটার। হরিয়ালের গায়ের বর্ণ জলপাই সবুজের সঙ্গে ছাই-ধূসর মিশ্রণ। মাথা ধূসর। ঘাড়ে লালচে ছোপ। ডানা সবুজাভ কালোর ওপর হলদে টান। বুক এবং বুকের দুই পাশ ও বুকের নিুাংশ ধূসর। চোখের বলয় গোলাপি। পা ও আঙুল উজ্জ্বল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট এবং গায়ের রঙ পুরুষ পাখির চেয়ে সামান্য ফিকে। হরিয়ালের প্রধান খাদ্য ছোট ফল। বিশেষ করে বট-পাকুড় ফলের প্রতি আসক্তি বেশি। এ ছাড়া অন্যান্য ছোট ফল এদের প্রিয়। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল। বাসা বাঁধে গাছের উঁচু শাখায় ঘনপাতার আড়ালে। ডিমপাড়ে ২টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/04/2013
মরুর ফিদ্দা | Desert wheatear | Oenanthe deserti
মরুর ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট শরৎকালে পরিযায়ী হয়ে আসে মরু কিংবা রুক্ষ অঞ্চল থেকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি পশ্চিম সাহারা, মিসরের পশ্চিম অংশ, চীন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান, দক্ষিণ ককেশাস, উত্তর মঙ্গোলীয়া, মরক্কো, ইরাক, ইরান, উত্তর আরব উপদ্বীপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা। ইউরোপের কিছু কিছু অঞ্চলেও দেখা যায়। প্রজাতিটি তেমন বাহারি রঙের না হলেও দেখতে মন্দ নয়। গায়ের রং বালির মতো। বালির ওপর বিচরণকালীন দূর থেকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচরণ করে একাকী। জোড়ায়ও খুব বেশি দেখা যায়। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। মরুময় কিংবা পাথুরে এলাকায় ঘুরেফিরে পোকামাকড় শিকার করে। তবে এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা যে কোনো রুক্ষ পরিবেশে অনায়াসে টিকে থাকতে পারে। তথাপিও বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে ইতিমধ্যে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরুর ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: ডেজার্ট হুইটইয়ার (Desert wheatear), বৈজ্ঞানিক নাম: Oenanthe deserti | এরা ‘ঊষর কানকালি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৪ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। গ্রীষ্মে পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় ফ্যাকাসে। চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশ কুচকুচে কালো, যা ঘাড়ের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ ফ্যাকাসে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকে কালো-সাদার মিশ্রণ। লেজের গোড়ার দিক ফ্যাকাসে বাদামি। লেজের পালক কালো। বুকের ওপর বাদামি-সাদা, দেহতল ফ্যাকাসে বাদামি। শীতে রং উজ্জ্বল হয়। স্ত্রী পাখির চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশের কালো অংশের পরিবর্তে বালি বাদামি। পিঠ বালি বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ধূসর কালো। উভয়ের চোখ গাঢ় বাদামি। ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গুবরেপোকা, মাছি, পিঁপড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড়। এছাড়া শস্যবীজের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে পাথুরে পাহাড়ের ওপর। এ ছাড়াও চিরহরিৎ কাঁটাঝোঁপের ভেতরও সংসার পাতে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৪ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/10/2015
বেঘবৌ | Lineated barbet | Megalaima lineata
বেঘবৌ | ছবি: ইন্টারনেট আমাদের দেশীয় পাখি এরা। দেশের গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরেও এদের দেখা যায়। ঢাকা শহরেও এ পাখির বিচরণ রয়েছে। তবে এরা বেশিরভাগই জোড়ায় জোড়ায় থাকে। এলাকাভেদে সাধারণত এক বা দু’জোড়ার বেশি থাকে না। পশ্চিমবঙ্গেও এদের দেখা যায়। এরা ‘বসন্ত বাউরি’ পাখির জ্ঞাতি ভাই। চেহারা-সুরতও অনেকটা তেমনই। আচার-আচরণেও মিল রয়েছে বেশ খানিকটা। ডাকে ‘ক্রুয়ো-ক্রুয়ো-ক্রুয়ো’ সুরে। অনেক দূর থেকে আওয়াজটা শোনা যায়। সুরটা শুনতে মন্দ লাগে না; আর্তনাদের মতো কানে বাজে। আমি প্রথম দেখেছি মুন্সীগঞ্জ জেলার নগর কসবা এলাকায় বছর দশেক আগে। পাখিটাকে প্রথম দেখায় বসন্ত বাউরি ভেবে ভুল করেছি। দেখেছি একটা মরা গাছের খোড়লের ভেতর। মাথাটা সামান্য বের করে রেখেছে। অনেকটাই সাপের মাথার মতো লেগেছে দেখতে। ভয়ও পেয়েছি সামান্য। ভয়ের কারণ ছিল ওর বড় বড় চোখ দুটি। খোড়লের ভেতর থেকে মাথাটা ঘুরিয়ে আগে চারপাশটা দেখে নিয়েছে সে। আশপাশ নিরাপদ মনে হতেই লাফিয়ে সামনের ডালে বসেছে। ওই পাখিটা বের হতেই পেছন দিয়ে অন্য পাখিটি খোড়লে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পেরেছি, ডিমে তা দিতেই পালা করে ওরা খোড়লে ঢুকেছে। তখনো যে ডিম ফোটেনি, তা নিশ্চিত হয়েছি দু’ঠোঁটের ফাঁকে খাবার জাতীয় কিছু না দেখে। শাবক থাকলে অবশ্য খাবার নিয়েই কোটরে প্রবেশ করতে হতো। ওদের সেদিন দীর্ঘক্ষণ লাগিয়েই পর্যবেক্ষণ করেছি। যতদূর দেখেছি ওরা উড়তে তেমন পারদর্শী নয়। ডানা ঝাপটে এক গাছ থেকে অন্য গাছে গেলেও মনে হচ্ছে বুঝি নিচে পড়ে যাচ্ছে। অথবা পড়তে পড়তে গিয়ে অন্য গাছের ডালে বসছে। আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দুর্লভ কিছু দৃশ্য ভিডিও করেছিÑযা পরে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে কাজে দিতে পারে। পাখিটার বাংলা নাম: বেঘবৌ, ইংরেজি নাম: লাইনিয়েটেড বারবেট (Lineated barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: মেগালাইমা লিনিয়েটা (Megalaima lineata)। এদের আরেক নাম ‘গোরখুদ’। এ পাখি লম্বায় ২৭-২৮ সেন্টিমিটার। এদের পিঠ, ডানা থেকে লেজ পর্যন্ত ঘাড় সবুজ বর্ণ। মাথা, ঘাড়, বুকের শেষাংশ পর্যন্ত খাড়া বাদামি ডোরা, যা থেকে হলুদের আভা বের হয়। চোখ বড়। চোখের বলয় হলুদ। চঞ্চু মোটা মজবুত, ধারালো। চঞ্চুর গোড়ায় ক’টি খাড়া লোম রয়েছে। পা হলুদ। বেঘবৌদের প্রিয় খাবার যে কোনো ধরনের ছোট রসালো ফল। তবে আতা, কামরাঙ্গা, নুন ফলের প্রতি অসক্তি বেশি। খাদ্য সংকটে এদের টমেটো খেতেও দেখা যায়। সুযোগ পেলে বেঘবৌ খেজুরের রসেও ভাগ বসায়। প্রজনন সময় গ্রীষ্মকাল। এরা নিজেরাই মরা গাছের গায়ে খোড়ল বানিয়ে বাসা বাঁধে। অনেক সময় যৎসামান্য খড়কুটা খোড়লের ঢুকিয়ে বাসাটাকে আরামদায়ক করে নেয়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/12/2012
নীলাভবুক বটেরা | Blue Breasted Quail | Coturnix chinensis
নীলাভবুক বটেরা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। নাদুস-নুদুস চেহারা। বসারত অবস্থায় গড়ন ডিম্বাকৃতির দেখায়। দেখতে অনেকটাই বাজারে পাওয়া যায়, (খাঁচায় পালিত) কোয়েল পাখির মতো। যত্রতত্র দেখার নজির নেই। মূলত আর্দ্র তৃণভূমি এদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়াও রাস্তার আশপাশের ঘন ঝোপজঙ্গলের ভেতর বিচরণ করে। খাবারের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় কিংবা পারিবারিক ছোটদলে। খাবার খোঁজে মুরগির মতো মাটিতে আঁচড় কেটে কিংবা ঝরাপাতা উল্টিয়ে। শিকাররত অবস্থায় ডাকে ‘কুঈ-কী- কিউ’ সুরে। ভয় পেলে সুর পাল্টে যায়, তখন ‘টির..টির..টির..’ সুরে ডাকে। ‘নীলাভবুক বটেরা’ এক সময় ঢাকা ও সিলেট বিভাগের তৃণভূমিতে দেখা যেত। বিশেষ করে সিলেটের চা বাগানের ভেতর পোকামাকড় খুঁজে বেড়াত। হালে দেখা যাওয়ার রেকর্ড নেই। আমরা সে রকম জোরালো তথ্যও আজ অবধি পাইনি। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় নীলাভবুক বটেরাদের বিস্তৃতি রয়েছে। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘নীলাভবুক বটেরা’, ইংরেজি নাম: ব্লু ব্রেস্টেড কোয়েল’ (Blue-breasted Quail), বৈজ্ঞানিক নাম: Coturnix chinensis | এরা ‘রাজবটেরা’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বটেরা নজরে পড়ে। যথাক্রমে নীলাভবুক বটেরা, বৃষ্টি বটেরা বা চীনা বটেরা, বড় বটেরা। প্রজাতি লম্বায় ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির কপাল স্লেট-নীল। মাথায় অস্পষ্ট সাদা-কালো ডোরা। পিঠ বাদামি ছিট এবং লালচে-বাদামির মিশ্রণ। গলায় সাদা-কালো চওড়া দাগ। বুক স্লেট নীল। পেট ও লেজ ঢাকনি লালচে-তামাটে। ঠোঁট খাটো, শিং কালো। পা হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির কপাল লালচে। ঘাড়ের নিচ থেকে ডানা পর্যন্ত ছিট দাগ। বুক ও বগলে কালো ডোরা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির বর্ণ অনুজ্জ্বল। এদের তলপেটে তামাটে রং দেখা যায় না। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে আগস্ট। ঝোপজঙ্গলের ভেতর মাটির প্রাকৃতিক গর্তে ঘাস ও লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৫-৭টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/11/2014