পাহাড়ি নীলকণ্ঠ | Dollarbird | Eurystomus orientalis
পাহাড়ি নীলকণ্ঠ | ছবি: ইন্টারনেট দুর্লভ দর্শন। পরিযায়ী পাখি। আমাদের দেশে প্রজনন সময়ে (গ্রীষ্মকালে) দেখা মেলে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেটের চিরসবুজ অরণ্যে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনিতে পরিযায়ী পাখির বিস্তৃতি রয়েছে। এরা আমাদের দেশে মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত হয়েছে। তবে বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত রয়েছে। এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। ডাকে ‘ক্যাক.. ক্যাক’ সুরে। ওড়ার সময় ডাকে ‘ক-চক-চক-চক’ সুরে। পাখিটাকে প্রথম দেখি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। চা বাগানের ভেতরে উঁচু একটা গাছের মগডালে বসে রয়েছে। দেখতে খানিকটা সমস্যা বোধ করেছি। বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়েও প্রজাতি শনাক্ত করতে কষ্ট হয়েছে। পরক্ষণে চিনতে পেরে বেশ উত্তেজিত বোধ করেছি সেদিন। অধিক উত্তেজনা নিয়েই দ্রুত টুকিটাকি লিখে নিয়েছি। নোট নেয়া শেষ হতেই অসুস্থ শরীরে সুস্থতার ইঙ্গিত পেয়ে গেছি মহূর্তেই। পাখির বাংলা নামঃ পাহাড়ি নীলকণ্ঠ, ইংরেজি নামঃ ডলারবার্ড (Dollarbird), বৈজ্ঞানিক নামঃ Eurystomus orientalis, পরিযায়ী। আমাদের দেশে নীলকণ্ঠ এবং পাহাড়ি নীলকণ্ঠ নামক দুই প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। লম্বায় ৩০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০ গ্রাম। ঠোঁট কমলা লাল। মাথা কালচে-বাদামি। গলা থেকে নীলাভ আভা ঠিকরে বের হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের পালক কালচে নীল। ওড়ার পালক কালচে-বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকের গোড়া রূপালী-সাদা। চোখের বলয় হলদে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা লাল। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। এদের ঠোঁট অনুজ্জ্বল। প্রধান খাবারঃ উড়ন্ত পোকামাকড়। এরা উড়ে উড়েই শিকার ধরে। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে কিংবা পাহাড়ের প্রাকৃতিক গর্তে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-২০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩০-৩৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 09/04/2022
লাল বুক টিয়া | Red Breasted Parakeet | Psittacula alexandri
লাল বুক টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা হলেও শালবনে বেশি দেখা যায়। লোকালয়েও দেখা মেলে, তবে কম। স্থানীয় প্রজাতির হলেও সুলভ দর্শন অঞ্চলভেদে। যেমন: সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক নজরে পড়ে। বিচরণ করে ছোট-বড় দলে। কৃষকের ধান, গম, ভুট্টাক্ষেতে দল বেঁধে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করে, যা খায় তারচেয়ে বেশি নষ্ট করে। দেখতে ভীষণ সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর কর্কশ। সামাজিক পাখি, দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের যে কেউ বিপদের গন্ধ পেলে ‘ক্যাঁক..ক্যাঁক’ স্বরে ডেকে সবাইকে সতর্ক করে। বিপৎসংকেত পেয়ে সঙ্গীরা ঝটপট ডানা মেলে নিরাপদে পৌঁছায়। এত সতর্ক থাকার পরেও এরা শিকারিদের কবলে পড়ছে দেদার- যার ফলে আজ প্রজাতিটি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল বুক টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘রেড ব্রেসটেড প্যারাকিট’ (Red-Breasted Parakeet), বৈজ্ঞানিক: Psittacula alexandri | নাম: ‘সিট্টিসিদি’। এরা ‘তোতা ও মদনা’ নামে পরিচিত। প্রজাতি লম্বায় লেজসহ ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষের মাথা বেগুনি-ধূসর, কপালের ওপর কালো পট্টি, যা চোখের কাছে গিয়ে মিশেছে। ডানায় সোনালি আভা। গলা থেকে বুক পর্যন্ত গোলাপি। পেট নীলচে-সবুজ, তলপেট থেকে লেজের নিচ হলদেটে-সবুজ। লেজের ওপরের দিক নীলচে-সবুজ। লেজের ডগার কিনারটা হলদেটে। শক্ত মজবুত ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের বর্ণ ওপরের দিকে রক্ত লাল, নিচের অংশ কালো। স্ত্রী পাখির মাথা নীলচে-সবুজ। বুকের দিক গাঢ় গোলাপি। ঠোঁটের ওপরাংশ কালো, নিচের অংশ পাটকিলে-কালো। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির কনীনিকা ফিকে-হলুদ, স্ত্রী পাখির সাদাটে-হলুদ। উভয়ের পা ও আঙ্গুল ধূসরাভ-সবুজের সঙ্গে হলটে মিশ্রণ । প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ফুল, ফল, মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। পোষা তোতাদের দুধ-ভাত, কলা, বাদামের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।প্রকাশ: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/06/2017 এবং দৈনিক যুগান্তর, 31/08/2013
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
বাদামি কোকিল | Anas strepera | Phaenivophaeus leschenaultia
বাদামি কোকিল | ছবি: ইন্টারনেট বিপন্ন প্রজাতির পাখি ‘বাদামি কোকিল’। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয় এরা। প্রাক্তন পরিযায়ী পাখি। কয়েক দশক আগে চট্টগ্রাম বিভাগে দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। হালে দেশের কোথাও দেখার নজির নেই। বছর খানেক আগে শ্রীমঙ্গলের একজন পাঠক দাবি করেছেন তিনি বাদামি কোকিলের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাখিটির ছবি ই-মেল করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। প্রজাতিটি শনাক্ত করে দেখি যে, সেটি আসলে ‘সাতভায়লা’ পাখি। চেহারা কাছাকাছি বিধায় তিনি ওই ভুলটি করেছেন। বাদামি কোকিল ভারত উপমহাদেশের শুষ্ক অঞ্চলে যৎসামন্য নজরে পড়ে। এরা সাধারণত শুষ্ক পাতাঝরা বনের ঝোপজঙ্গলে কিংবা প্রস্তরময় এলাকার ঝোপে বিচরণ করে। বেশিরভাগই একা বিচরণ করলেও মাঝেমধ্যে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বাদামি কোকিল ঝোপজঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহ করলেও মাটিতে নেমে পাতা উল্টিয়ে কীটপতঙ্গ শিকার করতে দেখা যায়। মাটিতে বিচরণকালীন ভয় পেলে দৌড়াতে থাকে, উড়ার চেষ্টা করে না মোটেও। কোকিলের জ্ঞাতি ভাই হলেও অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে না, নিজেরাই হ-য-ব-র-ল টাইপ বাসা বাঁধে। আবার হাঁকডাকও করে না খুব একটা দেশি কোকিলের মতো। মাঝেমধ্যে ‘কেক-কেক-কেক-কেরেক-কেরেক-কেরেক’ সুরে ডাকে। সুর শ্রুতিমধুর নয়, কর্কশ। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত হয়েছে বাদামি কোকিল। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামি কোকিল’, ইংরেজি নাম: Anas strepera, বৈজ্ঞানিক নাম: Phaenivophaeus leschenaultia, গোত্রের নাম: কুকুলিদি। এরা ‘মেটে মালকোআ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪২ সেন্টিমিটার (তন্মধ্যে লেজ ২২ সেন্টিমিটার)। মাথার তালু গাঢ় ধূসর। গলা ও বুকের উপরাংশ পীতাভ, এছাড়াও কালো ডোরা দেখা যায়। পেটের দিকটা লালচে-পীতাভ। লেজের নিচটা পর্যায়ক্রমে সজ্জিত। লেজের অগ্রভাগ সাদা। এছাড়াও সব দেহ বালিময় ধূসর-বাদামি। ঠোঁট লালচে, অগ্রভাগ হলুদ। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট-বাদামি। প্রধান খাবার: টিকটিকি, ছোট সাপ, ফড়িং, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে আগস্ট। মাটি থেকে খানিকটা উপরে ঝোপজঙ্গল বা গুল্মলতাদির ভেতর শুকনো পাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের বর্ণ ধবধবে সাদা। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে তা জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/06/2014
বাদা তিতির | Swamp Francolin | Francolinus gularis
বাদা তিতির | ছবি: ইন্টারনেট দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। পূর্বে ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের তৃণভূমিতে দেখা যেত। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। এরা সাধারণত নলবনে বা নদীর কাছাকাছি ঝোপে অথবা তৃণভূমিতে বিচরণ করে। একাকী খুব একটা দেখা যায় না। জোড়ায় অথবা ৫-১০টি দলে দেখা যায়। খুব ভোরে ও গোধূলিলগ্নে জলজ তৃণভূমি ও জোয়ারেসিক্ত ভূমিতে খাবার খোঁজে। এ সময় মাঝে মধ্যে কর্কশ কণ্ঠে ‘চুক্রির..চুক্রির’ সুরে ডেকে ওঠে। ভয় পেলে স্বর পাল্টে যায়। মাঝে মাঝে তীক্ষèস্বরে গান গায়। খুব বেশি উড়তে পারে না। কিছুক্ষণ জোরে-সোরে ডানা ঝাঁপটিয়ে বাতাসে ভেসে থাকার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত ও নেপালের তৃণভূমি অঞ্চলে। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার আরো কিছু অঞ্চলে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। প্রজাতিটি বিশ্বে সংকটাপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে। এরা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। প্রিয় পাঠক, ইতিপূর্বে তিতির নিয়ে লেখা হয়েছে কয়েকবারই। দেখতে একই রকম মনে হলেও প্রজাতিভেদে ওরা ভিন্ন। আশা করি বিষয়টি নিয়ে আপনাদের বিভ্রান্তি কেটে যাবে। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদা তিতির’, ইংরেজি নাম: সায়াম্প ফ্রানকলিন (Swamp Francolin), বৈজ্ঞানিক নাম: Francolinus gularis | এরা ‘জলার তিতির’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৩৭ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় পার্থক্য নেই। উভয়ের মাথার চাঁদি ও ঘাড় বাদামির সঙ্গে পীত বর্ণের মিশ্রণ। গলা ও ঘাড়ের উপরের অংশ কমলা। ভ্রু রেখা পীত বর্ণের। পিঠে বাদামি ডোরা ও লালচে বাদামি পট্টি। লেজ তামাটে। লেজের প্রান্ত পালক ফিকে। দেহতল বাদামির সঙ্গে সাদা ডোরা। ঠোঁট পাটকিলে। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদ। পুরুষ পাখির পায়ে শক্ত খাড়া নখ যা স্ত্রী পাখির নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, শস্যদানা, ঘাসের কচিডগা ও আগাছার বীজ। উইপোকা প্রিয় খাবার। রসালো ফলের প্রতি আসক্তি রয়েছে। সুযোগ পেলে ছোট সাপও শিকার করে। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মে। জলাশয়ের পাশের জঙ্গলে কিংবা গাছের নিচে মাটিতে লতাগুল্ম বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/05/2015
দেশি পানকৌড়ি | Indian Cormorant | Phalacrocorax fuscicollis
দেশি পানকৌড়ি | ছবি: ইন্টারনেট প্রজাতির অন্য পানকৌড়ি সুলভ দর্শন হলেও ‘দেশি পানকৌড়ি’ বিরল দর্শন বলা যায়। যত্রতত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই। কেবল প্রচণ্ড শীতে সিলেট অঞ্চলের বড় বড় হাওর-বাঁওড় বা জলাশয়ে দেখা যায় এবং নদ-নদীতে অল্প বিস্তর দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতির দেখা মেলে ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশি পানকৌড়ির সংখ্যা সমগ্র বিশ্বে স্থিতিশীল বিধায় আইইউসিএন ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এদের স্বভাব প্রজাতির অন্যদের মতোই। শীতকালে নদী বা জলাশয়ের তীরে কঞ্চি অথবা লাঠিসোটায় বসে পাখা মেলে রোদ পোহাতে দেখা যায়। কিছু সময় গায়ে রোদ লাগিয়ে ঝপাত করে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। তার পর ডুব সাঁতার দিয়ে পিছু নেয় মাছের। শিকার ধরতে পারলে ভুস করে ভেসে ওঠে জলের ওপরে। ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরা মাছটাকে গলাটানা দিয়ে গলাধঃকরণ করে। এরা একটানা দীর্ঘক্ষণ ডুবতে পারে বলে অনেকেই এদেরকে ডুবুরি পাখি নামেও ডাকে। প্রিয় পাঠক, ইতোপূর্বে পানকৌড়ি নিয়ে বারকয়েক লেখা হয়েছে। তবে ওগুলো প্রজাতিভেদে ভিন্ন। আশা করি বিভ্রান্তিতে পড়বেন না। পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি পানকৌড়ি’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান করমোর্যান্ট’ (Indian Cormorant), বৈজ্ঞানিক নাম: Phalacrocorax fuscicollis | এরা ‘মাঝারি পানকৌড়ি’ নামেও পরিচিত। আবার অঞ্চলভেদে ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন: পানিকাবাডি, পানিকাউর, পানিকাউয়া, পানিকুক্কুট ইত্যাদি। বাংলাদেশে তিন ধরনের পানকৌড়ির সাক্ষাৎ মেলে। যথাক্রমে: বড় পানকৌড়ি, মাঝারি বা দেশি পানকৌড়ি ও ছোট পানকৌড়ি। প্রজাতির সবাইকে মানুষ এক নামেই ডাকে। লম্বায় ৬৩-৬৫ সেন্টিমিটার। এদের সমস্ত শরীর কালো পালকে আবৃত। সূর্যালোকে পিঠ থেকে নীলাভ-সবুজের আভা বের হয়। অন্য সময়ে ধূসর কালো দেখায়। গলা মলিন সাদা। প্রজনন পালক ভিন্ন। ওই সময় কানপট্টি এবং ঘাড়ের ওপর উপরের যৎসামান্য চুলসাদৃশ পালক দেখা যায়। ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো, সরু লম্বা। পা হাঁসের পায়ের পাতার মতো জোড়া লাগানো। চোখ লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার মাছ। ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড়ও খায়। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি (অঞ্চলভেদে হেরফের হয়)। বাসা কলোনিটাইপ। শুকনো ডালপালা দিয়ে অনেকেই এক গাছে বাসা বাঁধে। বাসার শ্রীছাদ নেই। ডিমের সংখ্যা ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৯ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/10/2014
লাল কপাল ছাতারে | Rufous fronted Babbler | Stachyris rufifrons
লাল কপাল ছাতারে | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। প্রাকৃতিক আবাসস্থল আর্দ্র নিম্নভূমির বন, ঘাসবন ও বাঁশবন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২১০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে। খোলা বনবাদাড়ে অল্পবিস্তর নজরে পড়ে। সুশ্রী গোবেচারা টাইপ চেহারা। বিশেষ করে কপালের লাল চওড়া টান চেহারায় বৈচিত্র্যতা এনেছে। অনেকটাই সিঁদুর রাঙা মনে হয়। স্বভাবে হিংস নয়। এরা চঞ্চল ও অস্থিরমতির হলেও বেশ সামাজিক। বিপদে-আপদে কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যায় না। সহমর্মিতা দেখায়। শত্রুর উপস্থিতি নজরে এলে একে অপরকে হুঁশিয়ার করে। এদের গানের গলা ভালো। জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। কোনো কোনো সময় ৫-৬টি পাখির ছোট দলও দেখা যায়। এরা মূলত বেশিরভাগই বাঁশবন এলাকায় বিচরণ করে। এ ছাড়াও শনবন, ঘাসবন ও নলখাগড়ার বনেও বিচরণ রয়েছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল কপাল ছাতারে’, ইংরেজি নাম: ‘রুফাস-ফ্রন্টেড ব্যবলার’ (Rufous-fronted Babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: Stachyris rufifrons | এরা দৈর্ঘ্যে ১১-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৯-১২ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। কপালে লালচে টান। মাথা ও ঘাড় বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ও লেজ গাঢ় বাদামি। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। দেহতল বাদামির ওপর হলদে আভা। চোখের মনি বাদামি। ঠোঁট ত্বক-গোলাপি। পা ত্বক-হলদে। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ। ছোট ফল-ফলাদির প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট। ভূপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারের মধ্যে গাছ-গাছালিতে বাসা বাঁধে। বিশেষ করে বাঁশবন, ঘাসবন কিংবা লতাগুল্মের ভেতর কাপ অথবা অর্ধ গম্বুজ আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/11/2017