হলদে বক | Yellow Bittern | Ixobrychus sinensis
হলদে বক | ছবি: ইন্টারনেট জলচর পাখি। আকারে তেমন একটা বড় নয়। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র দেখা যায় না। সংখ্যায় অপ্রতুল, তার ওপর স্বভাবে লাজুক। লুকিয়ে-চুকিয়ে থাকে কচুরিপানা, ঢোলকলমি, নলবন, ধানক্ষেত কিংবা জলার ধারের ঝোপজঙ্গলে। দেখতে কিছুটা কানি বকের মতো মনে হলেও এদের গায়ের রঙ ভিন্ন। গায়ের রঙের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের মিল থাকার দরুন খুব সহজে এরা ঝোপজঙ্গলের ভেতর লুকাতে সক্ষম হয়। বিচরণ করে একাকী। স্থান পরিবর্তনের সময় ‘কেকের-কেকের বা কাকাক-কাকাক’ স্বরে ডেকে ওঠে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতির দেখা মেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। সংখ্যায় স্থিতিশীল বিধায় বিশ্বে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি ‘হলদে বক’ এখনো। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে বক’, ইংরেজি নাম: ‘ইয়েলো বিটার্ন’ (Yellow Bittern), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ইক্সোব্রাইকাস সিনেনসিস’ (Ixobrychus sinensis)। হলদে বক লম্বায় ৩৬-৩৮ সেন্টিমিটার। গলা খয়েরি, আকারে খাটো। ঠোঁট লম্বা, শক্ত মজবুত ও ধারালো। চোখের বলয় হলুদ, মণি কালো। পুরুষ পাখির মাথায় কালো টুপি। দেহের উপরের দিক হলুদ বাদামি। নিচের দিকটা হালকা হলুদ। ডানার পালক হলুদাভ বাদামি হলেও ডানার প্রান্তের পালক কালো। পিঠ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক কালো। লেজের পালক কালচে। স্ত্রী পাখির মাথায় লালচে বাদামি রেখাযুক্ত পালকে আবৃত। উভয়ের পা ও পায়ের পাতা হলদে-সবুজ। শাবক দেখতে মায়ের মতো হলেও দেহের নিচের দিকে বাদামি রেখা বেশি দেখা যায়। প্রধান খাবার: ছোট মাছ ও জলজ কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয় সংলগ্ন ঝোপজঙ্গল, কচুরিপানা কিংবা ধানগাছের আড়ালে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/08/2014
বড়ঠোঁটি গাংচিল | Gull billed tern | Gelochelidon nilotica
বড়ঠোঁটি গাংচিল | ছবি: ইন্টারনেট ভবঘুরে প্রজাতির পাখি। স্লিম গড়ন। উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে দেখা মেলে। বিচরণ করতে দেখা যায় বালুবেলাতেও। এছাড়া কৃষি জমিতে বিচরণ রয়েছে। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। কলোনি টাইপ বাসা বাঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। তবে নিজেদের মধ্যে কমবেশি ঝগড়া বাধে। এ সময় বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রাআ’ সুরে। প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ব্যতীত এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি, পূর্ব এশিয়ার উপকূল, উত্তর আমেরিকার, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, নিউজিল্যান্ডে ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে একমাত্র এন্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া বাদবাকি সব মহাদেশেই কমবেশি নজরে পড়ে। পাখির বাংলা নাম: ‘বড়ঠোঁটি গাংচিল’, ইংরেজি নাম: ‘গাল-বিল্ড টার্ন’ (Gull billed tern), বৈজ্ঞানিক নাম: Gelochelidon nilotica | এরা ‘কালাঠোঁট পানচিল’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৭৬-৯১ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০-২৯২ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রজনন পালক ভিন্ন। মাথায় টুপি আকৃতির ঘন কালো পালক, যা ঘাড় অবধি নেমে গেছে। ঘাড়ে মিশে যাওয়া কালো অংশ ছাড়া ঘাড়ের দু’পাশ সাদা দেখায়। পিঠ ও ডানা ধূসর। লেজ গাঢ় ধূসর। দেহতল ধবধবে সাদা। ওড়ার পালক সাদা। চোখের বলয় কালো। ঠোঁট মোটা কালো। পা ও আঙ্গুল কালো। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, সামুদ্রিক কৃমি। এছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড়, সরীসৃপ, শুককীট খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মে পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। জলাশয়ের কাছাকাছি বেলাভূমি এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৩ দিন। শাবক শাবলম্বী হতে সময় লাগে ২৮-৩৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/12/2015
পাহাড়ি টুনটুনি | Mountain Tailorbird | Orthotomus cuculatus
পাহাড়ি টুনটুনি | ছবি: ইন্টারনেট পরিচিত প্রজাতির ‘টুনটুনি’ পাখির মতো যত্রতত্র এদের দেখা মেলে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনে এবং ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। পাহাড়ি চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে লতাগুল্মের ঝোঁপে এবং বাঁশবনে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এদের মায়াবী চেহারা। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। যেন একদণ্ড বসার সুযোগ নেই কোথাও। এই আছে তো এই নেই। তবে যেখানেই থাকুক না কেন এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। জোড়ের পাখিটি সামান্য দূরে থাকলেও ডাকাডাকি করে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে নেয়। সারাদিন নেচে-গেয়ে সময় কাটায়। লেজ উঁচিয়ে নাচে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি নানা কসরত দেখায় স্ত্রী পাখির মন ভোলানোর জন্য। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে। বেশ পরিপাটি বাসা। দুটি পাতাকে একত্রিত করে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বাঁধে। অনেকটা দর্জির কাপড় সেলাই করার মতো। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি টুনটুনি’, ইংরেজি নাম: মাউন্টেন টেইলরবার্ড (Mountain Tailorbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotomus cuculatus | এরা ‘সোনালি মাথা টুনি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৭ গ্রাম। কপাল লালচে। মাথা সোনালি রঙের। ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজ ও ডানা লালচে। চোখের ওপরে সাদা-হলদে টান। গলা ও বুক ধূসর। পেট ও লেজতল উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট দু’পাটি ভিন্ন রঙের। ওপরের অংশ কালো, নিচের ঠোঁট কমলা রঙের হলেও গোড়া শিঙকালো। চোখ বাদামি-কালো। পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি। স্ত্রী পাখির বর্ণে সামান্য তফাৎ রয়েছে। ওদের বুকে কালো রেখার উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড় বা কীট পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে-জুলাই সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে পাতা সেলাই করে। সেলাই করা বাসার ভেতর নরম তন্তু বা তুলা দিয়ে পরিপাটি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/04/2016
গেছো চড়ই | Eurasian Tree Sparrow | Passer motanus
গেছো চড়ই | ছবি: ইন্টারনেট চেহারা হুবহু ‘পাতি চড়–ই’ অর্থাৎ আমাদের ঘরের আশপাশে যে চড়–ই দেখা যায় ওদের মতোই দেখতে। মাথার দিকে না তাকালে প্রজাতি শনাক্ত করা কঠিন। আবাসিক পাখি। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ফিলিপাইন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মাইক্রোনেশিয়া, তিউনিসিয়া, জিব্রাল্টার, মিশর, আলজেরিয়া, ইসরাইল ও দুবাই পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল কাঁটাওয়ালা চিরহরিৎ গুল্ম, খেজুর গাছ। এছাড়াও ফল বাগান এবং গৃহকোণে কমবেশি নজরে পড়ে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। ভয়ডর না থাকলেও পাতি চড়–ইদের মতো মানুষের অত কাছাকাছি আসে না। বিচরণ করে ঝাঁকে ঝাঁকে। ঝাঁক বেঁধে চলার কারণে বাজ পাখির শিকারে বেশি পরিণত এরা। তার ওপর ফসলের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলেও জীবনহানি ঘটে ব্যাপক। তথাপিও ওরা বিশ্বে ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘গেছো চড়ই’, ইংরেজি নাম:‘ইউরেশিয়ান ট্রি স্প্যারো ’(Eurasian Tree Sparrow), বৈজ্ঞানিক নাম: Passer motanus | এরা ‘লালচেমাথা চড়–ই’ বা ‘ইউরেশীয় গাছচড়–ই’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৭-৩০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা বাদামি-লালচে। ঘাড় সাদা। ঘাড়ের দু’পাশ সাদা। পিঠ বাদামি। ডানায় বাদামি-কালো রেখার সংমিশ্রণ। ডানার গোড়ার দিকে সাদা পট্টি দেহতলের ময়লা সাদার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। লেজ হালকা বাদামি। গলা ও থুতনি কালো। ঠোঁট কালো। স্ত্রী পাখির পিঠ ঝাপসা বাদামির ওপর খাড়া ডোরা। ডানায় সাদা পট্টি। দেহতল ফ্যাকাসে। ঠোঁট ত্বক বর্ণ। উভয়ের চোখ বাদামি। প্রধান খাবার: শস্যদানা। এ ছাড়াও পোকামাকড়, ঘাসের কচিডগা, ফুলের মধু ইত্যাদি খায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে দরদালান কিংবা গাছের ফাঁকফোকরে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 17/02/2017
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
লালপেট ঈগল | Rufous bellied Eagle | Hieraaetus kienerii
লালপেট ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। শীতে আগমন ঘটে। বিচরণ করে চিরহরিৎ, পর্ণমোচী বনপ্রান্তরে। এ ছাড়াও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০-১২০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে। উঁচু থেকে নামার সময় ডানা না ঝাঁপটিয়ে মেলে ধরে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। প্রজাতির দেখা মেলে একাকি বা জোড়ায়। কোনো অবস্থায় লবণজল এলাকায় বিচরণ করে না। মিঠাজল এদের বিচরণের জন্য উত্তম এলাকা। নিজের শরীরের সমান ওজনের স্তন্যপায়ী প্রাণী বা সরীসৃপ শিকার করতে সক্ষম। শিকার খোঁজে মাঠ-প্রান্তরের ওপর চক্কর মেরে। ওপর থেকে নিশ্চিত হলে কেবল ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে আর যাই করুক না কেন এরা কিন্তু শিকারের লেজের দিকে পারতপক্ষে থাবা বসায় না। এ ক্ষেত্রে টার্গেট থাকে ঘাড় বা পিঠ। বিশেষ করে এদের নখ গোলাকার এবং পায়ের পাতায় প্যাডের মতো থাকাতে পিচ্ছিল শিকারকে সহজে কাবু করে ফেলতে পারে, নড়াচড়ার তেমন একটা সুযোগ পায় না। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ চীন, ফিলিপাইন ও মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত। তবে এদের উপস্থিতি কোথাও সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লালপেট ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘রুফাস বেলিড্ ঈগল’, (Rufous-bellied Eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: (Hieraaetus kienerii)। লম্বায় ৪৬-৬১ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির ৭৩৩ গ্রাম, স্ত্রী পাখির ওজন ৮০০ গ্রাম। প্রসারিত পাখা ১০৫ থেকে ১৪০ সেন্টিমিটার। মাথা, গলা, ঘাড় ধূসর কালো। মাথায় কালো ঝুঁটি। পিঠ কালচে-বাদামি। বুক লালচে-বাদামি। পেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত লালচে। লেজের নিচে সাদার সঙ্গে কালো ডোরা। শিঙ রঙের ঠোঁটের গোড়া হলদেটে, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। চোখ লালচে বাদামি। পা হলদেটে, নখ তীক্ষè, ধুসর-কালচে। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের রং ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ। প্রজনন মৌসুম ডিসেম্বর থেকে মার্চ। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুম ভিন্ন। উঁচু গাছে সরু ডালপালা দিয়ে মস্তবড় বাসা বাঁধে। বাসা অগোছালো। একই বাসায় ফি বছরেও ঘর বাঁধতে দেখা যায়। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/07/2016
কাঠ শালিক | Chestnut tailed Starling | Sturnus malabaricus
কাঠ শালিক | ছবি: ইন্টারনেট এ প্রজাতির অন্যান্য পাখি আমাদের প্রতিবেশী হলেও এদের ভেতর মানুষকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। যার ফলে পরিচিত এ পাখি সর্বসাধারণের কাছে অপরিচিত রয়ে গেছে অদ্যাবধি। এদের বিচরণ অপেক্ষাকৃত হালকা বন-বনানীতে। আবার শহরের দর-দালানেও বসত করে। তবে ভূমিতে খুব একটা বিচরণ করে না। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে প্রায়ই দেখি এ পাখিদের। আমার কাছে এদের বেশ সুদর্শন পাখি মনে হয়। গায়ের বর্ণ অতি উজ্জ্বল না হলেও দেখতে ভালোই লাগে। চলাফেরা করে এরা দল বেঁধে আবার জোড়ায়-জোড়ায় কিংবা একাকীও বিচরণ করে। মানুষকে এড়িয়ে চললেও মাঝেমধ্যে বিচরণ করে কোলাহল সম্পূর্ণ এলাকায়। এদের নিয়ে কথা বলতেই প্রসঙ্গক্রমে দেশের বিশিষ্ট পাখি বিশারদ শরীফ খান জানিয়েছেন, এরা দেশে সন্তোষজনকহারে বিচরণ করছে। বিচরণ করছে ঢাকা-শহরেও। তিনি আরো জানিয়েছেন, খিলগাঁও রেল গেটের কাছে একজোড়া পাখিকে বাসা বানিয়ে ডিম-বাচ্চা ফোটাতে দেখছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। এদের বাংলা নাম: ‘কাঠ শালিক’ ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাটটেইলড স্টার্লিং’(Chestnut-tailed Starling), বৈজ্ঞানিক নাম:‘স্টুরনাস মালাবারিকাস’ (Sturnus malabaricus), গোত্রের নাম: ‘স্টুরনিদি’। আমাদের দেশে প্রায় ৬-৭ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে : ভাত শালিক, গোবরে শালিক, কাঠ শালিক, বামন শালিক, ঝুঁটি শালিক ও গাং শালিক। ‘চিত্রা শালিক’ নামে এক প্রজাতির শালিক সম্পর্কে জেনেছি ড. রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামক গ্রন্থে’। পাখিটা সচরাচর দেখা যায় না। দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। সৌভাগ্যটা অর্জন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করব। কাঠ শালিক লম্বায় ২০-২৩ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ধূসরাভ-রুপালি। থুতনি-গলা সাদা। ঠোঁটের গোড়া নীল, মাঝখানটা সবুজ এবং ডগাটা হলুদ। পিঠ রুপালি ধূসরের ওপর হালকা খয়েরি। ডানার প্রান্তটা কালো। গলা ফিকে লালচের ওপর সাদাটে ধূসরের টান। বুক, পেট পাটকিলে। পা হলদেটে। লেজের উপরিভাগ ধূসর, তলদেশ পাটকিলে। কাঠ শালিকের খাদ্য তালিকায় রয়েছে কীটপতঙ্গ, ছোট ফল, ফুলের মধু ইত্যাদি। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। নরম লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিমে তা দেয় শুধু স্ত্রী পাখি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 31/10/2012