ডোরা কালিপেঁচা | Asian Barred Owlet | Glaucidium cuculoides
ডোরা কালিপেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির নিশাচর পাখি। সুলভ দর্শন। প্রাকৃতিক আবাস্থল নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল কিংবা ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বন। বিশেষ করে নারিকেল, পাইন কিংবা ওক বন এদের বিচরণের ক্ষেত্র। লোকালয়ের কাছাকাছিও দেখা যায়। দেশের পূর্বাঞ্চলে কম-বেশি নজরে পড়ে। কেবল নজরে পড়ে না সুন্দরবন অঞ্চলে। চেহারায় হিংস তার ছাপ থাকলেও এরা একেবারেই নিরীহ। গলার আওয়াজ গম্ভীর বিধায় ডাকাডাকিকালীন শব্দটা ভৌতিক মনে হয়। এরা দিনে গাছের ঘন পাতার আড়ালে কিংবা গাছের কোটরে লুকিয়ে থাকে। গেছো ইঁদুর শিকার করে মানুষের উপকার করে। শিকারে বের হয় গোধূলিলগ্নে, চলে রাতভর। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। একই স্থানে একজোড়া পাখি দীর্ঘদিন অবস্থান করে। বাসাও বাঁধে একই স্থানে বারবার। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ (পূর্বাঞ্চল), ভারত, নেপাল, ভুটান, উত্তর-পূর্ব পাকিস্তান, মিয়ানমার, দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বত, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও লাওস পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকির সম্মুখীন না হলেও ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘ডোরা কালিপেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘এশিয়ান ব্যারেড আউলেট’ (Asian Barred Owlet), বৈজ্ঞানিক নাম: Glaucidium cuculoides | এরা ‘এশীয় দাগিপেঁচা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ২২-২৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও আকারে স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। পুরুষ পাখির ওজন ১৫০-১৭৬ গ্রাম। স্ত্রী পাখির ওজন ২৩০-২৪০ গ্রাম। গোলাকৃতির মুখ। মাথায় ক্ষুদ্র অসংখ্য সাদা ছিট। সমস্ত দেহে লালচে বাদামির ওপর সাদা ক্ষুদ্র সাদা ছিট। ডানার ওপর সাদা পট্টি। গোলাকার লেজে কালচে বাদামির ওপর সাদা ছিট। দেহতলে বাদামির ওপর সাদা খাড়া ডোরা। চোখের তারা হলুদ। ঠোঁট হলুদাভ হলেও গোড়ার আবরণী সবুজাভ হলুদ। পা ও আঙ্গুল হলদে। প্রধান খাবার: ইঁদুর, টিকটিকি, পোকামাকড়, পাখির ডিম ও ছোট পাখি ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে পুরনো গাছে কিংবা পর্বতের প্রাকৃতিক কোটরে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৪-৩৫ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদওপরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/12/2016
সাদালেজ ফিদ্দা | White tailed Stone Chat | Saxicola leucurus
সাদালেজ ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট প্রাকৃতিক আবাসস্থল ঝাউবন, গুল্মলতাদির ঝোঁপ। এছাড়াও জলাশয়ের কাছাকাছি ঘাসবন ও নলখাগড়ার বনে বিচরণ রয়েছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও পাকিস্তান পর্যন্ত। চেহারা বেশ আকর্ষণীয়। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি নিষ্প্রভ। বিচরণ করে একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। স্বভাবে চঞ্চল। উড়ন্ত অবস্থায় পোকামাড়ক শিকার করতে পটু। নিচে নেমেও শিকার ধরে। খেয়েদেয়ে ঘাসের ডগায় ঠোঁট ঘঁষে পরিষ্কার করে নেয়। এরা ভূমিতে খুব বেশি বিচরণ করে না। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। লম্বা ঘাসের ডগায় বসে দোল খেতে পছন্দ করে। গান গাওয়ার সময় শরীরের পেছনের অংশ দোলাতে থাকে। দেশে প্রজাতিটি বিরল দর্শন। শুধু দেখা মিলে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে। বিশেষ করে ঘাসবনে। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। আইইউসিএন এদেরকে উদ্যোগ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদালেজ ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট টেলড স্টোন চ্যাট (White-tailed Stone Chat), বৈজ্ঞানিক নাম: Saxicola leucurus | এরা ‘ধলালেজ শিলাফিদ্দা’ ‘সাদালেজি শিলাফিদ্দা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১২-১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৩০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় কালো। ঘাড়ের দু’পাশ সাদা। পিঠ কালচে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক হালকা বাদামি। লেজ সাদা-কালো। গলা কালো। বুক গাঢ় কমলা। দেহতল ফিকে সঙ্গে পীতাভ আভা। ঠোঁট ও পা কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির দেহের ওপরের দিকটায় গাঢ় ধূসর এবং নিচের দিকটায় কমলার আভা লক্ষ্য করা যায়। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গুবরেপোকা, ফড়িং, মাছি, পিঁপড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড়। এ ছাড়া শস্যবীজের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ঝাউ প্রজাতির গাছপালায়। পেয়ালা আকৃতির বাসা। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে পালক, ঘাস, তন্তু ও শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৪ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/01/2017
ভাদি হাঁস | White winged Duck | Asarcornis scutulata
ভাদি হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। কয়েক দশক আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ বনের জলাশয়ে দেখা যেত। সম্প্রতি এ প্রজাতির পাখি কারো নজরেই পড়ে না। মূলত এরা ধীরগতির সে ললগ্নে জলাশয়ের ওপর নেমে আসে এবং সারারাত ধরে শিকারের লিপ্ত থাকে। ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হলে পুনরায় গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে পুরুষ পাখি ‘ক্রংক-ক্রংক’ স্বরে আওয়াজ করে। এ প্রজাতির সঙ্গে গৃহপালিত চীনা হাঁসের আকার-আকৃতি কিংবা বর্ণের মিল ব্যাপক। পাখিবিশারদ ব্যতিরেকে অন্য কারো পক্ষে প্রজাতি শনাক্তকরণ কঠিন বৈকি। বর্তমানে এদের বিস্তৃতি বিশ্বে সন্তোষজনক নয়, শুধু এশিয়ার কিছু অঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। যতদূর জানা যায়, উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বভাগ পর্যন্ত বিস্তৃতি। বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত এ প্রজাতির পাখি। প্রধান কারণ অবাধে বৃক্ষ নিধন। বিশেষ করে উঁচু গাছগাছালি বিলীন হওয়াতে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। বিঘ্ন ঘটছে বিচরণেও। ফলে এরা আর এ দেশমুখী হচ্ছে না। বিশ্বে বিপন্ন ও বাংলাদেশে অতিবিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তাই। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত রয়েছে। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘ভাদি হাঁস’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট-উয়িংড ডাক’ (White-winged Duck), বৈজ্ঞানিক নাম: Asarcornis scutulata | এরা লম্বায় ৮০-৮২ সেন্টিমিটার (ঠোঁট ৬ সে.মি লেজ ১৫ সে.মি)। ওজন প্রায় ৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির আকারে ও বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় সাদার ওপর ছোট ছোট কালো দাগ। কাঁধে সাদা পট্টি। পিঠ কালচের সঙ্গে তামাটের মিশ্রণ। ডানায় নীলাভ কালো বন্ধনী। ডানার কনুইয়ের প্রান্তে খাড়া নখর বিদ্যমান। স্ত্রী পাখি আকারে খানিকটা ছোট। দেহের পালক অনুজ্জ্বল। মাথায় ঘন কালো দাগ। ঠোঁট কমলা। পুরুষ পাখির ঠোঁটের গোড়ায় মাংসপিণ্ড স্ফীত রয়েছে। এটি প্রজনন মৌসুমে আরো স্ফীত হয়। পা ও পায়ের পাতা কমলা হলুদের মিশ্রণ। পায়ের পেছনের আঙুল সামান্য ছড়ানো। প্রধান খাবার: শামুক, ছোট মাছ, পোকামাকড় ও জলজ উদ্ভিদের কচিপাতা। প্রজনন সময় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। আম, উরি, সিভিট, ছুন্ডুল ইত্যাদি গাছের ৩০ মিটার উঁচুতে প্রাকৃতিক কোটরে ঘাস বা লতাপাতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৭-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/12/2013
হলুদ পা হরিয়াল | Yellow Footed Green Pegion | Treron phoenicoptera
হলুদ পা হরিয়াল | ছবি: ইন্টারনেট সবুজে আচ্ছাদিত গ্রামটির নাম চরপাতা। আয়তনে বিশাল। ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিম নাম ধারণ করেছে। নামকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রায়পুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কটি। এটি গ্রামের বুক চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে গিয়ে মিলিত হয়েছে চাঁদপুর শহরে। বছর ত্রিশেক আগেও রাস্তাটি ছিল কাঁচা। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়েছিল বেশকিছু মোটাসোটা গাছ। তন্মধ্যে রেইনট্রি গাছ ছিল বেশি। ছিল বট-পাকুড় গাছও। এখন নেই। তো তেমনি দুটি পাকুড় গাছ ছিল ‘সিংহপুল’ নামক স্থানে। বিকেলে গ্রামের ছেলে-বুড়োরা সিংহপুলে এসে আড্ডা জমাতেন। কিশোর ছিলাম তখন আমি। তথাপিও যেতাম সেখানে মাঝেমধ্যে। আড্ডা দিতে নয়। পাকুড় ফল খেতে আসা হলুদাভ সবুজ রঙের পাখিগুলোকে একনজর দেখতে। প্রত্যহ গাছে একঝাঁক পাখি দেখা যেত পাকুড় পাকলে। দৃশ্যটি ছিল ভারি চমৎকার। গ্রামের প্রত্যেকেই উপভোগ করতেন সেটি। তাই বড়রা ওদের কখনো বিরক্ত করেননি। পাখিগুলো দেখতে অনেকটা কবুতরের মতো হলেও সৌন্দর্য বিচারে কবুতরের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে। নিজচোখে না দেখলে এ পাখির রূপের বর্ণণা দেয়া খুবই কঠিন। অনেকটা ‘অন্ধের হস্তি’ দর্শনের মতো। একটা সময় দেশের গ্রামগঞ্জে সুলভ দর্শন ছিল এ পাখি। নির্জন কোনো জঙ্গলে অথবা ছোট পাকা ফলবান বৃক্ষের নিচে গেলে ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। বর্তমানে খুব একটা নজরে পড়ছে না। ব্যাপকহারে ফলবান বৃক্ষ নিধনের ফলে এরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে প্রজননেও। এ পাখি আজ অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। এরা আজীবন বৃক্ষচারী। জলপান ব্যতিরেকে মাটিতে নামে না খুব একটা। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। স্বভাবে শান্ত। গায়ে পড়ে অন্য প্রজাতি তো দূরের কথা নিজেদের কারো সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়ায় লিপ্ত হয় না। পাখিটার বাংলা নাম: ‘হলুদ পা হরিয়াল’, ইংরেজি নাম: ‘ইএয়এলা ফুএটড গিণ্ঠন পিজিয়ন’ (Yellow Footed Green Pegion), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ট্রেরন ফোনিকোপটেরা’ (Treron phoenicoptera), গোত্রের নাম: ‘কলাম্বিদি’। অঞ্চলভেদে এরা ‘হরিকল বা বটকল’ নামে পরিচিত। লম্বায় এরা ৩২-৩৪ সেন্টিমিটার। হরিয়ালের গায়ের বর্ণ জলপাই সবুজের সঙ্গে ছাই-ধূসর মিশ্রণ। মাথা ধূসর। ঘাড়ে লালচে ছোপ। ডানা সবুজাভ কালোর ওপর হলদে টান। বুক এবং বুকের দুই পাশ ও বুকের নিুাংশ ধূসর। চোখের বলয় গোলাপি। পা ও আঙুল উজ্জ্বল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট এবং গায়ের রঙ পুরুষ পাখির চেয়ে সামান্য ফিকে। হরিয়ালের প্রধান খাদ্য ছোট ফল। বিশেষ করে বট-পাকুড় ফলের প্রতি আসক্তি বেশি। এ ছাড়া অন্যান্য ছোট ফল এদের প্রিয়। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল। বাসা বাঁধে গাছের উঁচু শাখায় ঘনপাতার আড়ালে। ডিমপাড়ে ২টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/04/2013
গেছো তুলিকা | Tree Pipit | Anthus trivialis
গেছো তুলিকা | ছবি: ইন্টারনেট শীতের পরিযায়ী। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকা পর্যন্ত। চড়–ই আকৃতির পাখি, দেখতেও তদ্রুপ। প্রজাতির অন্যদের মতো এরা সারাক্ষণ ভূমিতে বিচরণ করে না, গাছ-গাছালিতে বেশি সময় কাটায়। খাবারের সন্ধানে মাটিতে নেমে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। বাসা বাঁধে সরাসরি মাটিতেই। গানের গলা চমৎকার। গাছের উঁচুতে বসে গান গায়। খানিকটা চঞ্চল প্রকৃতির। বেশিরভাগ একাকী বিচরণ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘গেছো তুলিকা’, ইংরেজি নাম: ‘ট্রি পিপিট’ (Tree Pipit), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthus trivialis। প্রজাতির দৈর্ঘ্য ১৪-১৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ২৫-২৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষের চেহারা অভিন্ন। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ বাদামি। ডানার গোড়ায় হলদেটে সাদা দাগের সঙ্গে কালচে বাদামি দাগ লক্ষ করা যায়। গলা হলদেটে সাদা। বুকে সাদার ওপর কালো ডোরা। পেট সাদা। ঠোঁট কালচে। পা ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ঘাসবীজ ইত্যাদি। প্রজনন সময় মে-আগস্ট। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে নিজ বাসভূমে। বাসা বানায় মাটিতে, সরু-নরম লতা বিছিয়ে। ডিমের সংখ্যা ৪-৮টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/07/2017
লাল লতিকা হট্টিটি | Red wattled Lapwing | Vanellus indicus
লাল লতিকা হট্টিটি | ছবি: ইবার্ড যেখানে বড়সড়ো জলাশয় রয়েছে, সেখানে কম-বেশি ওদের বিচরণও রয়েছে। পানিতে সম্পূর্ণ শরীরটা ডুবিয়ে শিকার খোঁজে না। বড় জোর হাঁটুসমান পানিতে নেমে শিকার খোঁজে। ফাঁকা মাঠেও দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা জ্যোসনা রাতেও খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। একা কিংবা দলবদ্ধভাবেও বিচরণ করে। দেশের সর্বত্রই এ পাখিটাকে কমবেশি দেখা যায়। আমি প্রথম দেখেছি হাসাইলে। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় পড়েছে। গিয়েছি বছর চারেক আগে। নদীভাঙন দেখতে। পদ্মার পেটে ততক্ষণে হাসাইল বাজারটা হজম পক্রিয়ার পথে রয়েছে। হাসাইলবাসীর দুঃসময়ে পদ্মার পাড়ে পাখিটিকে দেখেছি সেদিন। একটি নয় ওরা সংখ্যায় একাধিক ছিল। দেখতে সুবিধাও হয়েছে তাই। কারণ পাখিরা একাকী থাকার চেয়ে দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় বেশি সাহসী হয়। এতে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও পাওয়া যায় বেশি। পাখিটা দেখতে ভারি চমৎকার। কিন্তু কণ্ঠস্বর কর্কশ। দলের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা না হলে কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হট্টিটি..টি..টি..হট্টিট-টিট্’। স্ত্রী-পুরুষের কণ্ঠে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ কণ্ঠ একটু ভারী। কণ্ঠস্বর শুনেও স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য বোঝা যায়। পাখিটার বাংলা নাম: ‘লাল লতিকা হট্টিটি,’ ইংরেজি নাম: ‘রেড ওয়াটলড ল্যাপউইং’, (Red-wattled Lapwing) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ভ্যানেল্লাস ইন্ডিকাস’ (Vanellus indicus) গোত্রের নাম: ‘চারাড্রিআইদি’। আমাদের দেশে মোট দু’ধরনের হট্টিটি দেখা যায়। যথাক্রমে: ১. লাল লতিকা হট্টিটি, ২. হলুদ লতিকা হট্টিটি। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা। লতিকা চোখের দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গোল বৃত্তের রূপ নিয়েছে। সেটি দেখলে মনে হয় বুঝি ওরা চশমা পরে আছে। হট্টিটির গলা, বুক, মাথার তালু ও ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত লাল। চোখের পাশ থেকে ধবধবে সাদা টান ঘাড় হয়ে বুকের কিছু অংশসহ পেট ও লেজের তলা পর্যন্ত ঠেকেছে। ডানা বোজানো অবস্থায় পিঠ ও লেজের উপরি ভাগটা চকচকে বাদামির ওপর জলপাই রঙের আভা। পা বেশ লম্বা, বর্ণ হলুদ। হট্টিটি খুবই চতুর পাখি। চলাফেরায় থাকে অত্যন্ত হুঁশিয়ারি ভাব। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে বিপদ সংকেত, খুশির সংকেত, ডিমপাড়া ও বাচ্চা ফোটার সংকেত, বাচ্চা হারানোর সংকেত, বিপদ মুক্তির সংকেত। এ সুরগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কণ্ঠে তুলতে পারে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ পোকামাকড়, কেঁচো, কচি শাকসবজি ইত্যাদি । প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। মিলন শেষে মাটির অগভীর গর্তে অথবা মাঠ-প্রান্তরের নিরিবিলি স্থানে বাসা বাঁধে। বাসা দেখতে হাস্যকর। মাটির ঢেলা দিয়ে তৈরি করে। চারপাশে ছোট ছোট মাটির ঢেলা সাজিয়ে থালাকৃতির বাসা বানিয়ে মাঝখানে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। হট্টিটির বাচ্চাদের জলপান বেশ মজাদার। মা পাখিটা জলে ভেজে বাচ্চাদের কাছে এলে ওরা মায়ের ভেজা লোম চুষে জলপান করে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/09/2012
পাতি সারস | Common Crane | Grus grus
পাতি সারস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা ছোট-বড় দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। নাচের কসরৎ দেখতে দেখতে স্ত্রী পাখি তখন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও নাচে অংশ নিয়ে প্রেমে মজে যায়। এ সময় জোরে জোরে দ্বৈত সংগীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে দেশি সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি সারস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন ক্রেন’ (Common Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Grus grus | দেশে তিন প্রজাতির সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। এরা সবাই পরিযায়ী প্রজাতির। গড় দৈর্ঘ্য ১১৫ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৮০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ৫.১-৬.১ কেজি। স্ত্রী পাখি ৪.৫-৫.৯ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। কপাল কালো। মাথার তালুর রক্ত লাল। মাথার পেছন থেকে শুরু করে ঘাড়, থুতনি ও গলা কালো। চোখের পেছন থেকে ঘাড় ও গলার কালো দ্বিখণ্ডিত হয়ে সাদায় রূপ নিয়েছে। পিঠ গাঢ় ধূসর। ডানার পালকের ওপর কালো ছোপ। ওড়ার পালক কালো। লেজ কালো। ডানার বাড়তি পালক লেজের ওপর ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। চোখের তারা লাল। পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, কাঁকড়া কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩১ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/10/2015