কালিবক | Black bittern | Ixobrychus flavicollis
কালিবক | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশানিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা যায়। বিশ্বের প্রায় ৮৬ লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাব্যাপী এদের বিস্তৃতি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এদের অল্প-বিস্তর সাক্ষাৎ মেলে। সাক্ষাৎ মেলে হাওরাঞ্চলেও। অন্যান্য স্থানেও তেমন সন্তোষজনক নয় এদের অবস্থান। গত কয়েক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতির বক পাখি সংরক্ষিত। এরাও শিকারি পাখি। তবে বেশ চালাক-চতুর এবং তুখোড় শিকারি এরা। নলখাঘড়া বা হোগলার বন এদের দারুণ পছন্দ। নিজেদেরকে আত্মগোপন করতে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয় এসব এলাকা। বিপদের গন্ধ পেলে এতদ এলাকায় এরা ঘাড়-মাথা-ঠোঁট সমান্তরালে রেখে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। শত্র“ কাছাকাছি এলে উপরের দিকে লাফ মারে। ঊর্ধ্বমুখী লাফে প্রায় চার থেকে সাড়ে চারফুট পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে। বিপদ কেটে গেলে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসে। এদের প্রধান শত্রু মানুষ। সামান্য মাংসের লোভে ফাঁদ পেতে শিকারিরা শিকার করে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিচ্ছে। এ ছাড়াও ভোঁদড় বা বেজি এদেরকে যথেষ্ট বিরক্ত করে। সুযোগ পেলে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। শিকারে বের হয় নিয়ম মেনে, ভোর এবং গোধূলিলগ্নে। দেশের একজন পাখি বিশারদ জানিয়েছেন, এরা জোসনালোকেও নাকি শিকারে বের হয়। তবে সে রকম দৃশ্য অবলোকন করতে সক্ষম হইনি এখনো। পাখির বাংলা নাম: ‘কালিবক’, ইংরেজি নাম:‘ব্লাক বিটার্ন’(Black bittern), বৈজ্ঞানিক নাম: Ixobrychus flavicollis | এরা ‘কালা বগলা’ নামেও পরিচিত। কালিবক লম্বায় ৪৮ সেন্টিমিটার। মাথার তালু চকচকে স্লেট বর্ণের। ঘাড়, গলা হয়ে পিঠে কালো রঙ ছড়িয়ে গেছে। গলার নিচ দিয়ে কমলা-নীল চওড়া রেখা ঘাড়ের পাশ হয়ে বুকে এসে মিশেছে। বুকে খাড়া কালচে টান। ঠোঁট লালচে ধূসর। পা ও পায়ের পাতা গাঢ় বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, ফড়িং ইত্যাদি। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল। জলাশয়ের কাছাকাছি গাছের ডালে চিকন ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/12/2013
বাদা তিতির | Swamp Francolin | Francolinus gularis
বাদা তিতির | ছবি: ইন্টারনেট দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। পূর্বে ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের তৃণভূমিতে দেখা যেত। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। এরা সাধারণত নলবনে বা নদীর কাছাকাছি ঝোপে অথবা তৃণভূমিতে বিচরণ করে। একাকী খুব একটা দেখা যায় না। জোড়ায় অথবা ৫-১০টি দলে দেখা যায়। খুব ভোরে ও গোধূলিলগ্নে জলজ তৃণভূমি ও জোয়ারেসিক্ত ভূমিতে খাবার খোঁজে। এ সময় মাঝে মধ্যে কর্কশ কণ্ঠে ‘চুক্রির..চুক্রির’ সুরে ডেকে ওঠে। ভয় পেলে স্বর পাল্টে যায়। মাঝে মাঝে তীক্ষèস্বরে গান গায়। খুব বেশি উড়তে পারে না। কিছুক্ষণ জোরে-সোরে ডানা ঝাঁপটিয়ে বাতাসে ভেসে থাকার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত ও নেপালের তৃণভূমি অঞ্চলে। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার আরো কিছু অঞ্চলে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। প্রজাতিটি বিশ্বে সংকটাপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে। এরা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। প্রিয় পাঠক, ইতিপূর্বে তিতির নিয়ে লেখা হয়েছে কয়েকবারই। দেখতে একই রকম মনে হলেও প্রজাতিভেদে ওরা ভিন্ন। আশা করি বিষয়টি নিয়ে আপনাদের বিভ্রান্তি কেটে যাবে। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদা তিতির’, ইংরেজি নাম: সায়াম্প ফ্রানকলিন (Swamp Francolin), বৈজ্ঞানিক নাম: Francolinus gularis | এরা ‘জলার তিতির’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৩৭ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় পার্থক্য নেই। উভয়ের মাথার চাঁদি ও ঘাড় বাদামির সঙ্গে পীত বর্ণের মিশ্রণ। গলা ও ঘাড়ের উপরের অংশ কমলা। ভ্রু রেখা পীত বর্ণের। পিঠে বাদামি ডোরা ও লালচে বাদামি পট্টি। লেজ তামাটে। লেজের প্রান্ত পালক ফিকে। দেহতল বাদামির সঙ্গে সাদা ডোরা। ঠোঁট পাটকিলে। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদ। পুরুষ পাখির পায়ে শক্ত খাড়া নখ যা স্ত্রী পাখির নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, শস্যদানা, ঘাসের কচিডগা ও আগাছার বীজ। উইপোকা প্রিয় খাবার। রসালো ফলের প্রতি আসক্তি রয়েছে। সুযোগ পেলে ছোট সাপও শিকার করে। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মে। জলাশয়ের পাশের জঙ্গলে কিংবা গাছের নিচে মাটিতে লতাগুল্ম বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/05/2015
লালশির হাঁস | Eurasian wigeon | Anas penelope
লালশির হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট শীতের পরিযায়ী পাখি। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নদী এবং হাওর অঞ্চলে দেখা যায়। দেখা যায় অগভীর নদী-নালা, জোয়ার-ভাটার খাঁড়ি, লবণের ঘের এলাকায়ও। এসব অঞ্চলে এরা বড় বড় ঝাঁকে বিচরণ করে। খাদ্যের সন্ধানে জলাশয়ের কিনারে হেঁটে বেড়ায়। আবার মাথা ডুবিয়েও খাদ্য সংগ্রহ করে। জলাশয়ের উপরাংশের খাবার এদের বেশি পছন্দ। যেমন তা হতে পারে জলজ উদ্ভিদ কিংবা কচি ঘাসের ডগা। এরা যেমনি হাঁটতে পারে দ্রুত, তেমনি দ্রুত গতিতে উড়তেও সক্ষম। ওড়ার সময় ‘শন শন’ শব্দ শোনা যায়। পুরুষ পাখি ডাকে ‘হুউহিও… হুউহিও…’ সুরে। স্ত্রী পাখি ডাকে ‘এরর্র… এরর্র…’ সুরে। সুলভ দর্শন এ পাখি বাংলাদেশ ছাড়াও দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও চীনে। প্রচণ্ড শীতে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সাইবেরিয়া ও আফ্রিকার উত্তরাংশ থেকে। ঠাণ্ডা কম অনুভূত হলে ফিরে যায় নিজ বাসভূমে। সংসার পাতে মাতৃভূমিতেই। জানা যায়, বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এদের বিস্তৃতি। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। তথাপিও এরা বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘লালশির’ | ইংরেজি নাম: ‘ইউরেশিয়ান ওজিয়ন’ (Eurasian wigeon) | বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস পেনিলোপ’ (Anas penelope), গোত্রের নাম: ‘অনাটিদি’। অনেকে এদেরকে ‘হলদেসিঁথি হাঁস’ বা ‘ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস’ নামে ডাকে। এ পাখি লম্বায় ৪২-৫২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬৫০-৬৭০ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা তামাটে। কপালের মধ্যখানে হলুদ সিঁথির মতো টান, যা কেবল প্রজনন ঋতুতে দেখা যায়। ডানায় সাদা পট্টি। ডানার নিচের দিকে ধূসর। পিঠে মিহি ধূসর রেখা। বুক হালকা বাদামি। পেট সাদা। লেজের নিচের দিকে কালো। লেজ সূচালো। স্ত্রী পাখির রঙ ভিন্ন। ওদের মাথায় হলদেসিঁথি নেই। নেই পিঠের ধূসর রেখাও। স্ত্রী পাখির দেহের অধিকাংশ পালক তামাটে। উভয়ের চোখ বাদামি। ঠোঁট ধূসর-নীল মিশ্রিত। প্রধান খাদ্য: পোকামাকড়, ভেজা ঘাস, জলজ উদ্ভিদ। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। সাইবেরিয়া অঞ্চলে বাসা বাঁধে। জলজ ঝোপের কাছাকাছি মাটিতে ঘাস বা পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৭-১২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৪-২৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/01/2014
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
পাহাড়ি ধূমকল | Mountain Imperial Pigeon | Ducula badia
পাহাড়ি ধূমকল | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র এবং সচরাচর নজরে পড়ে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের মিশ্র চিরসবুজ বনের গহীনে। বিশ্বে এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ক্রান্তীয় পার্বত্য অরণ্য ও ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্ন ভূমির বনাঞ্চল। এ ছাড়াও ম্যানগ্রোভ অরণ্যে কিছু দেখা মেলে। বাংলাদেশের ম্যাগ্রোভ অঞ্চলে দেখার নজির নেই। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত। প্রজাতির বিচরণ রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫৫০ মিটার উঁচু পর্বতের গাছের পত্রপল্লবের আড়ালে। বিচরণ রয়েছে হিমালয়ের ২২০০ মিটার উঁচুতেও। স্বভাবে খানিকটা লাজুক এবং শান্ত। গায়ে পড়ে স্বগোত্রীয় বা অন্যগোত্রীয় কারো সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় না। লাজুক বিধায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। ছোট-বড় দলে বিচরণ করে। জোড়ায় বা একাকী খুব কম দেখা যায়। বিশেষ করে ডুমুর বা বট-পাকুড় ফল পাকলে ঝাঁক বেঁধে খেতে আসে। কোনো রকম বিরক্তির শিকার না হলে ফি-বছর একই গাছে ফল খেতে আসে। রোদ পোহাতে খুব পছন্দ করে। ভোরের দিকে পাতাঝরা গাছের মগডালে ঝাঁক বেঁধে বসে রোদ পোহাতে দেখা যায়। বৃক্ষচারী এ পাখিরা জলপান ব্যতিরেকে মাটিতে নামে না খুব একটা। বাংলাদেশে বিরল দর্শন হলেও ‘পাহাড়ি ধূমকল’ বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। এ পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি ধূমকল’, ইংরেজি নাম: ‘মাউন্টেন ইম্পেরিয়েল পিজিয়ন’ (Mountain Imperial-Pigeon), বৈজ্ঞানিক নাম: Ducula badia | এরা ‘ডুকল’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪৩-৫১ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথা ও ঘাড় ধূসর-বাদামি। গলা সাদাটে। পিঠ তামাটে-বাদামি, যার ওপর রয়েছে মেরুনের আভা। ডানার প্রান্ত পালক কালচে। লেজের ডগা হালকা বাদামি। পেট হালকা ধূসর। লেজতল হলদে সাদা। ঠোঁট ও পা গোলাপী। চোখের বলয় ধূসর চামড়ায় আবৃত। তারা হলদে-সাদা, মনি কালো। প্রধন খাবার: ডুমুর, জায়ফল ইত্যাদি। এ ছাড়াও ছোট ফল-ফলাদি খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে গাছের ২০-২৫ ফুট ওপরে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে সরু ডালপালা। ডিম পাড়ে ১-২টি। তবে সচরাচর ১টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় ১৬-১৮দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/12/2015
সিঁদুরে ফুলঝুরি | Scarlet backed flowerpecker | Dicaeum cruentatum
সিঁদুরে ফুলঝুরি | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি ‘সিঁদুরে ফুলঝুরি’। শরীরে বাহারি রঙের পালক। চেহারা বেশ আকর্ষণীয়। এক কথায় সুদর্শন প্রজাতির পাখিদের কাতারে পড়ে ওরা। আকারে চড়ই পাখির চেয়েও খাটো। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র নিুভূমির জঙ্গলে অথবা বৃক্ষাচ্ছাদিত এলাকায় বিচরণ করে। বাংলাদেশে যত্রতত্র নজরে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামীণ বনাঞ্চলে বেশি দেখা যায়। দেখা যায় গেরস্তের সাজানো বাগানেও। অথবা বাড়ির আঙিনার লাউ-কুমড়া কিংবা ঝিঙেলতার ঝোপে নাচানাচি করতে দেখা যায়। অর্থাৎ যেখানে ফুল সেখানে ফুলঝুরি পাখির সমাহার। ফুলের মধু এদের প্রধান খাবার। মধুপানের নেশায় সারা দিন ব্যস্ত সময় পার করে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। অস্থিরমতি পাখি। কোথাও একদণ্ড বসে থাকার সময় নেই। ছোট গাছ-গাছালি কিংবা লতাগুল্মের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে শিস কাটে। মিষ্টি সুরে গান গায় ‘চিপ…চিপ… বা ঝিট…ঝিট…’ সুরে। সুর শুনতে মন্দ নয়। সিঁদুরে ফুলঝুরি পাখিদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। বাংলাদেশে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। ভূমি থেকে এদের বাসা কাছাকাছি বিধায় বিড়াল বা বনবিড়ালের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। তথাপিও দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে ওরা। পাখির বাংলা নাম: ‘সিঁদুরে ফুলঝুরি’, ইংরেজি নাম: ‘স্কারলেট ব্যাকেট ফ্লাওয়ারপেকার’ (Scarlet-backed flowerpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Dicaeum cruentatum | এরা ‘লালপিঠ ফুলঝুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৭-৯ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির কপাল থেকে শুরু করে ঘাড়ের মাঝ বরাবর সোজা পিঠ দিয়ে লেজ ঢাকনি পর্যন্ত সিঁদুরে লাল পালকে আবৃত। মাথার এবং ঘাড়ের দুপাশ ডানা এবং লেজ কালো। দেহের দুপাশ নীলাভ-ধূসর। দেহতল বাদামি-হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির উপরের অংশ ধূসরাভ-বাদামি। নিতম্ব লাল। উভয়ের ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার ফুলের মধু ও বিচি। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ভূমি থেকে দুই-আড়াই মিটার উঁচুতে গাছের ডালে অথবা গুল্মলতা আচ্ছাদিত ঝোপে ঝুলন্ত থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের নরম তন্তু, তুলা, শ্যাওলা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 21/12/2018
ছোট ধলা বক | Little egret | Egretta garzetta
ছোট ধলা বক | ছবি: ইন্টারনেট জলচর পাখিদের আনাগোনাটা ছিল লক্ষণীয়। এর মধ্যে ‘ছোট বক’-এর দেখা পেয়েছি যত্রতত্র। এরা শিকারের প্রতীক্ষায় কচুরিপানা কিংবা জলদামের ওপরে সাধুসন্ন্যাসীর বেশে দাঁড়িয়ে শিকার খুঁজছে। একটা ধবধবে সাদা ছোট বককে ভেসাল জালের ওপরে উড়ে উড়ে শিকার ধরতে দেখেছি। সাধারণত এ রকমটি খুব কমই দেখা যায়। কারণটা হচ্ছে এদের প্রভূত ধৈর্যশীলতা। পারতপক্ষে হন্যে হয়ে শিকার খোঁজে না এরা। তাই অন্যসব জলচর পাখির চেয়ে ওর প্রতি আমার আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল বোধকরি। ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে নেমে শুকনো ভূমিতে দাঁড়িয়ে পাখিটার কীর্তি দেখেছি কিছুটা সময় লাগিয়ে। বিষয়টা মনে গেঁথে রেখে পাখিটার পরিচিতি তুলে ধরেছি পাঠকদের কাছে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট বক’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল ইগ্রেট’ (Little egret). বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ইগ্রেটা গারজেটা’ (Egretta garzetta), গোত্রের নাম: ‘আরডিদি’। এরা ‘ছোট ধলা বক’ নামেও পরিচিত। দেশে পরিজায়ীসহ প্রায় ১৫-১৮ প্রজাতির বক নজরে পড়ে। এরা লম্বায় ৫৫-৫৬ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৫০-৪০০ গ্রাম। দেহের গড়ন লম্বাটে চিকন। দেহের সমস্ত পালক ধবধবে সাদা। ঠোঁট সরু, লম্বা ও কালো। পা লম্বা, কালো। প্রজনন মৌসুমে মাথার ঝুঁটির পালক পিঠের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়ে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মৎস্যভুক পাখি এরা। এ ছাড়াও ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় ও ঘাসফড়িং শিকার করে। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয়ের কাছাকাছি গাছগাছালিতে দলবদ্ধ হয়ে বাসা বাঁধে। কলোনি টাইপ বাসা। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন শুকনো ডালপালা। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৫ দিন। শাবক সাবলম্বী হতে সময় নেয় ৪০-৪৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/08/2013