সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
পাহাড়ি টুনটুনি | Mountain Tailorbird | Orthotomus cuculatus
পাহাড়ি টুনটুনি | ছবি: ইন্টারনেট পরিচিত প্রজাতির ‘টুনটুনি’ পাখির মতো যত্রতত্র এদের দেখা মেলে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনে এবং ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। পাহাড়ি চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে লতাগুল্মের ঝোঁপে এবং বাঁশবনে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এদের মায়াবী চেহারা। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। যেন একদণ্ড বসার সুযোগ নেই কোথাও। এই আছে তো এই নেই। তবে যেখানেই থাকুক না কেন এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। জোড়ের পাখিটি সামান্য দূরে থাকলেও ডাকাডাকি করে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে নেয়। সারাদিন নেচে-গেয়ে সময় কাটায়। লেজ উঁচিয়ে নাচে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি নানা কসরত দেখায় স্ত্রী পাখির মন ভোলানোর জন্য। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে। বেশ পরিপাটি বাসা। দুটি পাতাকে একত্রিত করে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বাঁধে। অনেকটা দর্জির কাপড় সেলাই করার মতো। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি টুনটুনি’, ইংরেজি নাম: মাউন্টেন টেইলরবার্ড (Mountain Tailorbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotomus cuculatus | এরা ‘সোনালি মাথা টুনি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৭ গ্রাম। কপাল লালচে। মাথা সোনালি রঙের। ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজ ও ডানা লালচে। চোখের ওপরে সাদা-হলদে টান। গলা ও বুক ধূসর। পেট ও লেজতল উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট দু’পাটি ভিন্ন রঙের। ওপরের অংশ কালো, নিচের ঠোঁট কমলা রঙের হলেও গোড়া শিঙকালো। চোখ বাদামি-কালো। পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি। স্ত্রী পাখির বর্ণে সামান্য তফাৎ রয়েছে। ওদের বুকে কালো রেখার উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড় বা কীট পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে-জুলাই সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে পাতা সেলাই করে। সেলাই করা বাসার ভেতর নরম তন্তু বা তুলা দিয়ে পরিপাটি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/04/2016
সবুজ ময়ূর | Green Peafowl | Pavo muticus
সবুজ ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট প্রাক্তন আবাসিক পাখি ‘সবুজ ময়ূর’। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। ১৯৪০ সালের দিকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। চির সবুজ বনের বাসিন্দা। বনতলে ঘুরে বেড়ায়। উড়তেও পারে। তবে তেমন একটা গতি নিয়ে উড়তে পারে না। উড়তে গিয়ে বারবার নিচের দিকে নেমে পড়ে। মূলত লেজের লম্বা পালক ওড়ার গতি দাবিয়ে রাখে। তা ছাড়া শরীরের ওজনও ওড়ার গতি আটকে দেয়। অন্যসব ময়ূরের মতো এরাও ঝরা পাতা উল্টিয়ে এবং মাটি আঁচড়ে খাবার খায়। ছোট দলে বিচরণ করে। একটি ময়ূরের অধীনে ৩-৫টি ময়ূরী থাকে। কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে ভোরে এবং গোধূলীলগ্নে। মন ভালো থাকলে পুরুষ পাখি নাচানাচি করে এবং পেখম মেলে কসরত দেখায়। পুরুষ পাখির তুলনায় স্ত্রী পাখি অনেকটাই নিষ্প্রভ। কণ্ঠস্বরও কর্কশ। পুরুষ পাখি ডাকে ‘ইয়েই-অও…’ সুরে। স্ত্রী পাখি ডাকে ‘অ্যাও-অ্যা…’ সুরে। ভয় পেলে কণ্ঠস্বর পাল্টে যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বর্তমানে বিশ্বে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এরা বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সবুজ ময়ূর’, ইংরেজি নাম: গ্রীন পিফাউল’(Green Peafowl), বৈজ্ঞানিক নাম: Pavo muticus | এরা ‘বর্মী ময়ূর’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১০০-১১০ সেন্টিমিটার। পেখম ১৫০-১৯০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষ পাখির ঘাড়, গলা এবং বুকের পালক আঁশের মতো উঁচু। মাথায় সুঁচালো ঝুঁটি। চোখের পাশে কমলা-ক্রিম রঙের চামড়া। পিঠের পালক গাঢ় সবুজ এবং কালচে-নীল। ডানা ঢাকনি সবুজ। ডানার মধ্যভাগের পালক কিছুটা বাদামি। সবুজ লেজের পেখমের প্রান্তে কালো চক্রের বেগুনি ফোঁটা। দেহতল পিতল সবুজের ওপর কালো টান এবং সবুজ-বেগুনি দাগ। স্ত্রী পাখির পিঠ গাঢ় বাদামি। পিঠের শেষ ভাগ এবং কোমর কালচে-বাদামি। লেজ পীতাভ, বাদামি ও কালো রঙের ডোরা। স্ত্রী পাখির পেখম নেই। অপ্রাপ্তবয়স্কদের সবুজাভ-তামাটে কোমর ছাড়া বাদবাকি দেখতে স্ত্রী পাখির মতো। প্রধান খাবার: পোকামকড় কেঁচো, ছোট সাপ, টিকটিকি, রসালো ফল, শস্যবীজ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে মে। ঝোঁপের ভেতর মাটিতে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/06/2015
দাগিলেজ গাছআঁচড়া | Bar tailed Treecreeper | Certhia himalayana
দাগিলেজ গাছআঁচড়া | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, রাশিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরান পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল খোলা সরলবর্গীয় বন এং নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল। এরা একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। হিংস নয়। অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের পাখি। কাঠঠোকরা পাখির মতো গাছের খাড়া কাণ্ডে খুব দ্রুত হেঁটে উঠতে পারে। সারাদিন গাছের কাণ্ডে ঠোঁট চালিয়ে কীট-পতঙ্গ খুঁজে বেড়ায়। গাছ-গাছালিতে বিচরণকালে অনেক সময় ওদেরকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ওদের গায়ের বর্ণ গাছের শুকনো ডালপালার সঙ্গে মিশে যায়, যার ফলে এ ধরনের ভ্রম তৈরি হয়। প্রজাতির বিচরণ দেশে সন্তোষজনক না হলেও বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘দাগিলেজ গাছআঁচড়া’, ইংরেজি নাম: ‘বার-টেইলড ট্রিক্রিপার’ (Bar-tailed Treecreeper), বৈজ্ঞানিক নাম: Certhia himalayana, এরা ‘বাঁকা-ঠোঁট কীট-কুড়ানি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৮ গ্রাম। গায়ের রং বাদামি-সাদা-লালচে ডোরাকাটা। ডানার প্রান্ত পালক ধূসর কালো। লেজ ডোরাকাটা। দেহতল হালকা বাদামি-সাদা। ঠোঁট লম্বা বাঁকানো, কালচে রঙের। পা কালচে। প্রধান খাবার: কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড়, মাকড়সা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, তন্তু, শুকনো ঘাস, পালক ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৭ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/02/2017
উদয়ী বামনরাঙা | Oriental Dwarf Kingfisher | Ceyx erithaca
উদয়ী বামনরাঙা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, ‘দৈনিক মানবকণ্ঠ’ পত্রিকায় এটি আমার শেষ লেখা ‘মাছরাঙা’ নিয়ে। ইতিমধ্যে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে। কাজেই আর মাছরাঙা নিয়ে লেখার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের দেশে শুধুমাত্র ১২ প্রজাতির মাছরাঙাই নজরে পড়ে। অপরদিকে সমগ্র বিশ্বে নজরে পড়ে মোট ৯৫ প্রজাতির মাছরাঙা। ফলে মাছরাঙা পাখি নিয়ে লেখা ফিচারের সমাপ্তি দৈনিক মানবকণ্ঠ পত্রিকায় ঘটিয়ে দিলাম। আর হ্যাঁ, আজ যে প্রজাতিটি নিয়ে লিখছি ওদের নাম ‘উদয়ী বামনরাঙা’। এরা অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। গ্রীষ্মকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনাঞ্চলে নজরে পড়ে। বিশেষ করে পাতাঝরা অথবা চিরসবুজ বনের গাছের ছায়াময় এবং অপেক্ষাকৃত সরু নদীর উপরে উড়ে বেড়ায়। অথবা চিরসবুজ বনাঞ্চলের ভেতর প্রবহমান নদ-নদীর ওপর গাছের ঝুলন্ত ডালে শিকারের প্রতীক্ষায় দীর্ঘসময় বসে থাকে। শিকার প্রাপ্তির বিলম্বে টেনশনে ঘন ঘন মাথা ওঠানামা করতে থাকে তখন। আবার শিকার প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিলে লেজ খাড়া করে উচ্ছ্বাসও করতে দেখা যায়। বিচরণ করে একাকী। ওড়ার সময় তীক্ষ কণ্ঠে ‘চিচিচী…’ আওয়াজ করে। ‘উদয়ী বামনরাঙা’র বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদগ্রস্ত। বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। তথাপিও বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘উদয়ী বামনরাঙা’, ইংরেজি নাম: ওরিয়েন্টাল ডয়ার্ফ কিংফিশার, (Oriental Dwarf Kingfisher), বৈজ্ঞানিক নাম: Ceyx erithaca | দৈর্ঘ্য ১৩ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় কমলা-বেগুনি রঙের। পিঠ, ডানা নীলচে কালো। কোমর ও লেজ কমলা রঙের। গলা সাদা। পেট কমলা-হলুদ। চোখ গাঢ় লাল। চোখের ওপর দিয়ে সাদাটান ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। ঠোঁট প্রবাল লাল। পা ও পায়ের পাতা কমলা লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। ওদের মাথা গাঢ় কমলা। দেহ অনুজ্জ্বল। বুকে কমলা ফোটা রং। দেহতল হালকা নীল। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, কাঁকড়া, ঝিঁঝিপোকাসহ অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। নদীর খাড়া পাড়ে নিজেরা টানেল আকৃতির সুড়ঙ্গ বানিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/04/2015
কানঠুঁটি | Greater flamingo | Phoenicopterus ruber
কানঠুঁটি | ছবি: ইন্টারনেট কানঠুঁটি সারস আকৃতির পাখি। কয়েক দশক ধরে এ দেশে এদের নজরে পড়ছে না কারও। জানা যায়, ১৯৭০ সালের দিকে সর্বশেষ ভোলা জেলার মনপুরা দ্বীপে দেখা গেছে। তারও আগে সুন্দরবন অঞ্চলে এদের দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। ১৯৬০ সালের দিকে এ অঞ্চলে সন্তোষজনক বিচরণ ছিল। হালে পাখি দেখিয়েদের নজরে যদিও পড়ে সেটি হবে পান্থ পরিযায়ী প্রজাতির। বর্তমানে এদের ব্যাপক বিচরণ ক্ষেত্র আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চল, স্পেন, আলবেনিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, সাইপ্রাস, পর্তুগাল, ইতালি ও ফ্রান্সের কিছু এলাকায়। বিশ্বে এদের বিচরণ সন্তোষজনক হলেও আমাদের দেশে পদচারণ নেই বলে ধারণা করেছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা। এ পাখিরা বেশির ভাগই লোনা জলাঞ্চলে বিচরণ করে। সংখ্যায় পঞ্চাশ থেকে হাজারখানেক পাখি একত্রে দেখা যায়। জলে দাঁড়িয়ে শিকার খোঁজে ভিন্ন কৌশলে। স্বাভাবিকভাবে ঠোঁট না চালিয়ে উল্টো করে জলে ডুবিয়ে কুচা চিংড়ি বা জলজ কীট শিকার করে। আবার অনেক সময় স্বল্পজলে গর্ত খুঁড়ে ফাঁদ পেতে শিকার ধরে। এরা স্থূল দেহের হলেও উড়তে পারে দ্রুতই। আকাশে দলবদ্ধভাবে ‘ভি’ আকারে ওড়ে। সামনে লম্বা গলা বাড়িয়ে পা দুটো টান টান করে আকাশে সাঁতার কাটে। উড়তে উড়তে কর্কশ কণ্ঠে ডাকে ‘ক্রেক… ক্রেক… ক্রেক…’। অদ্ভুত গড়নের এ প্রজাতির পাখিদের সঙ্গে আমার আজও মুক্তাঞ্চলে সাক্ষাৎ ঘটেনি, সাক্ষাৎ ঘটেছে ঢাকা চিড়িয়াখানায়। যত দূর জানি পাখিগুলো আজ পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত আছে। পাখি দেখিয়েদের জন্য এটি একটি সুসংবাদ বলা যায়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘কানঠুঁটি, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেটার ফ্লেমিঙ্গো'(Greater flamingo), বৈজ্ঞানিক নাম: Phoenicopterus ruber | এরা কানমুঁথি নামেও পরিচিত। এরা লম্বায় ১৪৫ সেন্টিমিটার। ওজন চার-সাড়ে চার কেজি। পুরো দেহ সাদা-গোলাপি আভার মিশ্রণ। ওড়ার পালক সিঁদুরে লাল, ডানার বাকি অংশ কালো। গলা ও পা অস্বাভাবিক লম্বা। পা গোলাপি লাল। পায়ের পাতা হাঁসের পায়ের মতো জোড়া লাগানো। বাঁকানো ঠোঁটের ডগা কুচকুচে কালো, বাকি অংশ গোলাপি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: কুচা চিংড়ি-জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী, ছোট শামুক, গুগলি, জলজ পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। কাদামাটি দিয়ে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার উঁচু ঢিবির মতো বাসা বানায়। সূর্যের আলোতে কাদা শুকিয়ে শক্ত হলে বাসার ভেতর ঢুকে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। ডিম ফুটতে লাগে ২৭-৩১ দিন। শাবক প্রাপ্তবয়সী হতে লাগে ২-৩ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/06/2018
তামাটে লাল বেনেবউ | Maroon Oriole | Oriolus traillii
তামাটে লাল বেনেবউ | ছবি: ইন্টারনেট হিমালয় এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা। পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশে। যত্রতত্র দেখা যায় না। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও তিব্বত পর্যন্ত। বিচরণ করে চিরহরিৎ বন বা আধা-চিরহরিৎ বন অথবা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র নিুভূমির বনে। বৃক্ষচারী পাখি। প্রয়োজন ছাড়া ভূমি স্পর্শ করে না। জোড়ায় কিংবা একাকী বিচরণ করে। স্বভাবে চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে বেড়ায় সারা দিন। লাফাতে লাফাতে চোখের পলকে হারিয়ে যায়। ভাবটা এমন যেন রাজ্যের ব্যস্ততা তাড়া করছে ওদের। স্লিম গড়ন। সুদর্শনও বটে। প্রথম দর্শনে যে কেউই মুগ্ধ হবেন বোধ করি। প্রজাতির রূপের বর্ণনা দিয়ে বোঝানো মুশকিল। এক কথায় দেখতে খুবই সুন্দর। গানের গলাও সুমধুর। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি আড়ালে আবডালে গিয়ে স্ত্রী পাখিকে মুগ্ধ করতে গান বাঁধে। মিষ্টি কণ্ঠে নিচু স্বরে গান গায়, ‘কো-কে-ওয়া’ সুরে। খিদে পেলে ওদের বাচ্চারাও মিষ্টি সুরে কাঁদে। সেই সুর শুনতে বড়ই করুণ লাগে। প্রজাতিটি বিশ্বে খুব ভালো অবস্থানে নেই বিধায় আইইউসিএন ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে এদের। পাখির বাংলা নাম: ‘তামাটে-লাল বেনেবউ’, ইংরেজি নাম: মেরুন ওরিয়োল (Maroon Oriole), বৈজ্ঞানিক নাম: Oriolus traillii | এরা ‘তামারং বেনেবউ’ নামেও পরিচিত। দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির বেনেবউ নজরে পড়ে। যথাক্রমে- ইউরেশীয় সোনাবউ, কালাঘাড় বেনেবউ, কালামাথা বেনেবউ, তামাটে-লাল বেনেবউ ও সরুঠোঁট বেনেবউ। দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। স্ত্রী-পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ। উভয়ের মাথা, গলা, ঘাড় ও ডানা কালো। শরীরের বাদবাকি অংশ তামাটে-লাল রঙের। চোখের বলয় হলদে-সাদা, মণি কালো। ঠোঁটও ধূসর-কালচে। প্রধান খাবার শুঁয়াপোকা এবং কীটপতঙ্গ। এ ছাড়াও ফুলের মধু এবং ছোট ফলের প্রতি আসক্তি রয়েছে। বিশেষ করে পাকা ডুমুর ফল বেশি প্রিয়। প্রজনন মৌসুম মার্চ-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময় ভিন্ন হয়। তবে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই ডিম-বাচ্চা তোলে। বাসা বাঁধে পেয়ালা আকৃতির। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের ছাল, তন্তু, সরু ঘাস-লতা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩ থেকে ১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।