লালগলা ডুবুরি | Red necked Grebe | Podiceps grisegena
লালগলা ডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। শীতে দেখা মেলে। বিচরণ করে স্বাদুজলে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট দলেও নজরে পড়ে। হ্রদ কিংবা বড় জলাশয়ে দেখা মেলে। সাঁতারে খুব পটু। পানকৌড়িদের মতো ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডুব সাঁতার দিয়ে বাসায় পৌঁছে। এদের লেজ নেই। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুঁচালো। নিজ বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে পিঠে চড়িয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, উত্তর-পশ্চিম ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, জাপান, পূর্ব চীন সাগর, মঙ্গোলিয়া, পশ্চিম সাইবেরিয়া, পশ্চিম কানাডা, উত্তর-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘লালগলা ডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘রেড-নেকেড গ্রিব’ (Red-necked Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps grisegena | এরা ‘লালঘাড় ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৪৩-৫৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬১-৮৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৬৯২-৯২৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অভিন্ন। কপাল ও মাথার তালু কুচকুচে কালো। মাথার পেছনের পালক সামান্য লম্বা। ঘাড় ও গলা মরিচা লাল। ঘাড়ের মাঝ বরাবর কালো চওড়া টান দেখা যায়। চোখের নিচ থেকে অর্থাৎ থুঁতনি ও গাল ময়লা সাদা রঙের। পিঠ কালচে বাদামি। বুক লালচে বাদামি। পেট ধূসর সাদা। লেজ খাটো, নেই বললেই চলে। সুঁচালো ঠোঁটের উপরের অংশ কালচে। নিচের অংশ হলুদ রঙের। চোখের বলয় কালো। চোখের তারা গাঢ় বাদমি। পা সবজেটে। পায়ের পাতা চওড়া এবং চেপ্টা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এ ছাড়াও ছোট চিড়িং, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ২-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/02/2016
পাতি চখাচখি | Common Shelduck | Tadorna tadorna
পাতি চখাচখি | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, চীন, তিব্বত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান ও ইরাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও সুলভ দর্শন। দর্শনীয় চেহারাও বটে। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশের প্রায় বিভাগেরই নদ-নদীতে কম-বেশি বিচরণ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে কিংবা মোহনাতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যের সন্ধানে বড় বড় দলে বিচরণ করে অগভীর জলাশয়ে। শিকার কৌশল দেশীয় গোত্রের পাতি হাঁসের মতো। সাধারণত এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের কলহ-বিবাদ ঘটায় না। বলা যায় সারাদিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। পুরুষ পাখি পারতপক্ষে তেমন ডাকাডাকিও করে না। স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নিচু গলায় শিস কাটে। সঙ্গী জবাব দেয় তখন ‘গ্যাগ-গ্যা-গ্যা’ সুরে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতিটি দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা আরেকটু সদয় হলে বোধ করি এদের আগমন আরো বেশি বেশি ঘটবে দেশে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি চখাচখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন শেল ডাক’ (Common Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না টাডোর্না’, (Tadorna tadorna) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। অনেকে ‘শাহ চখা বা সাচ্কা’ নামেও ডাকে। দেশে দুই প্রজাতির চখাচখি নজরে পড়ে। যথা: খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। এরা লম্বায় ৫৮-৬৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১ কেজি। কপাল, মাথা ও গলা ধাতব সবুজ। ঠোঁট রক্ত লাল, গোড়া স্ফীত লাল পুঁটলি। বুক ও ঘাড়ে সাদার ওপর পাটকিলে চওড়া বন্ধনী। পিঠ ধবধবে সাদা। ডানা কুচকুচে কালো। লেজ ও কোমর সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা মেটে-লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী পাখি খানিকটা ছোট। এ ছাড়াও স্ত্রী পাখির বুকে পাটকিলে বর্ণের প্রান্তটা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার তালু, গলার পেছন ও পিট কালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: জলজ কীট, ছোট শামুক, চিংড়ি, ধান, শৈবাল, কেঁচো, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। মধ্য এশিয়ার পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে প্রাকৃতিক ফাটলে কিংবা মাটির প্রাকৃতিক গর্তে পালক দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/04/2014
পাহাড়ি টুনটুনি | Mountain Tailorbird | Orthotomus cuculatus
পাহাড়ি টুনটুনি | ছবি: ইন্টারনেট পরিচিত প্রজাতির ‘টুনটুনি’ পাখির মতো যত্রতত্র এদের দেখা মেলে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনে এবং ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। পাহাড়ি চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে লতাগুল্মের ঝোঁপে এবং বাঁশবনে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এদের মায়াবী চেহারা। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। যেন একদণ্ড বসার সুযোগ নেই কোথাও। এই আছে তো এই নেই। তবে যেখানেই থাকুক না কেন এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। জোড়ের পাখিটি সামান্য দূরে থাকলেও ডাকাডাকি করে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে নেয়। সারাদিন নেচে-গেয়ে সময় কাটায়। লেজ উঁচিয়ে নাচে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি নানা কসরত দেখায় স্ত্রী পাখির মন ভোলানোর জন্য। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে। বেশ পরিপাটি বাসা। দুটি পাতাকে একত্রিত করে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বাঁধে। অনেকটা দর্জির কাপড় সেলাই করার মতো। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি টুনটুনি’, ইংরেজি নাম: মাউন্টেন টেইলরবার্ড (Mountain Tailorbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotomus cuculatus | এরা ‘সোনালি মাথা টুনি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৭ গ্রাম। কপাল লালচে। মাথা সোনালি রঙের। ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজ ও ডানা লালচে। চোখের ওপরে সাদা-হলদে টান। গলা ও বুক ধূসর। পেট ও লেজতল উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট দু’পাটি ভিন্ন রঙের। ওপরের অংশ কালো, নিচের ঠোঁট কমলা রঙের হলেও গোড়া শিঙকালো। চোখ বাদামি-কালো। পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি। স্ত্রী পাখির বর্ণে সামান্য তফাৎ রয়েছে। ওদের বুকে কালো রেখার উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড় বা কীট পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে-জুলাই সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে পাতা সেলাই করে। সেলাই করা বাসার ভেতর নরম তন্তু বা তুলা দিয়ে পরিপাটি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/04/2016
বাবুই পাখি | Baya weaver | Ploceus philippinus
বাবুই পাখি | ছবি: ইন্টারনেট অতিসুলভ দর্শন পাখি এরা। এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ব্যাপার-স্যাপারও। অনেক গান, কবিতাও রচিত হয়েছে এ পাখি নিয়ে। গ্রামেগঞ্জে কিংবা মফস্বল এলাকায় ব্যাপক নজরে পড়ে এখনো। দলবদ্ধভাবে বাস করে। সারাদিন চেঁচামেচি করে কাটায়। সামান্যতেই রেগে যায়। নিজেদের মধ্যে কোলাহল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাখিটা অতি সহজে কারো দৃষ্টিতে না পড়লেও ওদের বাসাটা ঠিকই সবার নজর কাড়ে। তাল, নারকেল কিংবা খেজুর গাছে সারিবদ্ধভাবে ঝুলতে দেখা যায়। সেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এ পাখির বাসা বানানোর কৌশল রীতিমতো বিস্ময়কর বটে। সুনিপুণ কারিগর বলা যায় এদের। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে পুরুষ পাখি খেজুর, নলখাগড়া, নারিকেল অথবা তালপাতার পাশ থেকে চিকন লম্বা অংশ ঠোঁট দিয়ে কেটে নেয়। অতঃপর সেটি বয়ে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে জুড়ে দেয়। এভাবেই বাসা তৈরির সূত্রপাত ঘটায়। তারপর ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে তৈরি করে বলয়। বলয়ের চারপাশটা চিকন পাতা দিয়ে সেলাই করে চোঙ্গাকৃতির বাসা বানায়। নিজস্ব শৈল্পিকগুণে তৈরি করে দৃষ্টিনন্দন বাসা। বাসার ওপর-নিচ থাকে খানিকটা সরু আর মধ্যখানটা থাকে মোটাসোটা। বাসার মুখ থাকে নিচের দিকে। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে তা দিলেও পুরুষ পাখি থাকে অন্য ধান্ধায়। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ পাখির বাসা এতই মনোমুগ্ধকর যে, মানুষ তাদের ড্রইংরুমে ঝুলিয়ে রাখতে গর্ববোধ করেন। ঝুলিয়ে রাখে নামিদামি আবাসিক হোটেলগুলোতেও। বলা যায় অনেকটা শোপিসে পরিণত হয়েছে এদের বাসা। প্রিয়পাঠক, এ পাখির বাংলা নাম: ‘বাবুই’, ইংরেজি নাম: ‘বায়া উইভার’ (Baya weaver), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘প্লসিয়াস ফিলিপপিনাস’ (Ploceus philippinus), গোত্রের নাম: ‘পাসেরিদি’। অঞ্চলভেদে ‘বাউই’ নামেও পরিচিত। বাবুই পাখি লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। প্রজনন সময় পেরিয়ে গেলে স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হয়। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে দেহের রং বদলায়। তখন পুরুষ পাখির মাথা হলুদ আকৃতি ধারণ করে। ঘাড়ের ওপর বন্ধনী তৈরি হয়ে বুকে গিয়ে ছড়িয়ে যায়। কপাল, কান, থুতনি ও গলার বর্ণ হয় কালচে-বাদামি। অপরদিকে ওই সময় স্ত্রী পাখির ওপরের দিক হলুদাভ-বাদামি রং ধারণ করে। তার ওপর থাকে বেশ কিছু গাঢ় বাদামি রেখা। ভ্রু, ঘাড়ের পাশ এবং বুক হলুদাভ-বাদামি। নিচের দিকে হলুদের আভাযুক্ত। তবে কোনো রেখা বা ডোরা থাকে না। বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য শস্যবীজ। ধান, কাউন প্রিয়। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে তাল, খেজুর, নারিকেল গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/04/2013
ধূসর সারস | Demoiselle Crane | Anthropoides virgo
ধূসর সারস | ছবি: ইবার্ড বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দেশে আগমন ঘটে শীতে। হিমালয় পাড়ি দিয়ে মাঝেমধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চলে উপস্থিত হয়। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। মরু অঞ্চলেও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা বড়সড়ো ঝাঁকে। চলার পথে কারো ফসলের খেতে দলবেঁধে নামলে মুহূর্তেই ফসল তছনছ করে দেয়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। এ সময় উভয়ে জোরে জোরে দ্বৈত সঙ্গীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, উত্তর-পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, পশ্চিম ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সঙ্কটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে ধূসর সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর সারস’, ইংরেজি নাম: ‘ডেমোজিল ক্রেন’, (Demoiselle Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthropoides virgo | দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। গড় দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৫০-১৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২-৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার তালু ধূসর। মাথার পেছন থেকে কালো রঙ শুরু করে ঘাড়, থুঁতনি ও গলা হয়ে বুকের ওপর গিয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। চোখের পেছন থেকে সাদা পালক ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। সারা দেহ গাঢ় ধূসর। ওড়ার পালক কালো। লেজে সাদা-কালো লম্বা পালক, যা ঝুলে পড়েছে নিচে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। কমলা-লাল রঙের চোখ দুটি আকারে ছোট। পা ও পায়ের পাতা ময়লা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাঁকড়া, কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-২৯ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/04/2016
কোটরে পেঁচা | Spotted owlet | Athene brama
সাদা মুকুট পেঙ্গা | ছবি: ইন্টারনেট গ্রামের বাড়ি (রায়পুর) যাওয়ার সুযোগ হয়নি তেমন একটা। কালেভদ্রে গেলেও বনবাদাড়ে ঘুরেই সময় কাটাই। বাড়ির আশপাশের গাছগুলোয় তীক্ষ দৃষ্টি রেখে পাখ-পাখালির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করি। তেমনি এক ছুটিতে গ্রামে গিয়ে রাতের আঁধারে ছেলেকে নিয়ে নিশাচর পাখির সন্ধানে বেরিয়েছি। গিয়েছি বাড়ির অদূরে একটি কাঠবনে। থমথমে আঁধারে অজানা আশঙ্কায় ছেলে ঘরে ফেরার তাগিদ দিচ্ছে বারবার। ঠিক ওই মুহূর্তে শুনতে পেলাম ‘চিকিক-চিকিক… চিরুর-চিরুর’ সুরের আর্তনাদ। পরিচিত সুর। থমকে দাঁড়িয়েছি তাই। আওয়াজ লক্ষ করে টর্চের আলো ছুড়ে দিয়েছি ওই দিকটায়। খুব বেশি দেরি হয়নি আওয়াজের উৎসস্থল খুঁজে পেতে। হেলেপড়া একটি গাছের ডালে একজোড়া ‘কোটরে পেঁচা’ বসে আছে জড়সড় হয়ে। টর্চের আলো গায়ে পড়তেই নড়েচড়ে বসছে দম্পতি। ডানা ঝাপটানোর আগেই আলো সরিয়ে ফেলেছি। যাতে বিরক্তবোধ না করে তা মাথায় রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু তার আগেই ওরা সটকে পড়েছে। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে পাখির কথা বলেছি, খুবই পরিচিত পাখি ওরা। স্থানীয় প্রজাতির নিশাচর পাখি। দেশে সন্তোষজনক বিস্তৃতি রয়েছে। দেখতে হিংস মনে হলেও একেবারেই নিরীহ। দিনে বড় গাছের ঘন পাতার আড়ালে কিংবা গাছের কোটরে বা পুরনো দরদালানের ফোকরে লুকিয়ে থাকে। গেছোইঁদুর শিকার করে মানুষের প্রচুর উপকার করে। মানুষও ওদের বন্ধু ভাবে তাই। শিকারে বের হয় গোধূলিলগ্নে, চলে রাতভর। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। একই স্থানে একজোড়া পাখি দীর্ঘদিন অবস্থান করে। বাসাও বাঁধে একই স্থানে বারবার। পাখির বাংলা নাম: ‘কোটরে পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড আউলেট’ (Spotted owlet), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘অ্যাথিনি ব্রামা’,(Athene brama)। গোত্রের নাম: ‘স্ট্রিগিদি’। এরা ‘খোঁড়লে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির পেঁচার দেখা মেলে। লম্বায় ৪৩ সেন্টিমিটার। গোলাকৃতির মুখ। মাথার তালুতে বাদামির ওপর ক্ষুদ্র সাদা ছিট। গলায় চওয়া বাদামি পট্টি। পিঠ, ডানা ও লেজ গাঢ় বাদামি। দেহতল সাদাটের ওপর আড়াআড়ি বাদামি রেখা যা ঠেকেছে লেজতলা পর্যন্ত। চোখের কোটর গোলাকার, চারপাশ সাদা। ঠোঁট সবুজাভ শিঙে। পা ও আঙুল হলদে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার ইঁদুর, গিরগিটি, পোকামাকড়, পাখির ছানা ও ছোট পাখি। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ। বাসা বাঁধে পুরনো গাছের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা পুরনো দরদালানের কোটরে। ডিম পাড়ে তিন-চারটি। ফুটতে সময় লাগে ৩৪-৩৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/07/2018
বড় জলকবুতর | Great Black headed Gull | Larus ichthyaetus
বড় জলকবুতর | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবল শীতে এ প্রজাতির আগমন ঘটে এ দেশে। পরিযায়ী হয়ে আসে দক্ষিণ রাশিয়া ও উত্তর-পূর্ব মঙ্গোলিয়া থেকে। আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশ ছাড়াও শীতে এ প্রজাতির সাক্ষাৎ মেলে ভারত ও পাকিস্তানে। শীত মৌসুমে খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে বিচরণ করতে দেখা যায় জলকবুতরকে। রাজধানীর পাশে বহমান বুড়িগঙ্গা নদীতেও দেখা মেলে এদের। তবে পরিযায়ী এ পাখি মিঠা পানির চেয়ে নোনা পানিতে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণ এটাই। জলকবুতর বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য একটাই, মাছ শিকার। শীতে নৌযাত্রীরা প্রায়ই দৃশ্যটি দেখার সুযোগ পেয়ে থাকে। আর সেই দৃশ্য উপভোগ করার মতোই। এ ছাড়া প্রজাতিটিকে বালুতটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বিশেষ করে দ্বীপাঞ্চলের জেলেপল্লীতে ওরা ঘুরঘুর করে। মূলত পল্লীর এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরা মাছ খাওয়ার লোভেই ওদের ঘোরাঘুরি। জলকবুতর স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাঁটি পছন্দ নয়। নিজেদের মধ্যে খুনসুটি বেধে গেলে বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’। শীত মৌসুমে এ প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ছাড়া এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানেই রয়েছে বলা যায়। পাখিটির বাংলা নাম: ‘বড় জলকবুতর’ | ইংরেজি নাম: ‘গ্রেট ব্ল্যাক-হেডেড গাল’ (Great Black-headed Gull) | বৈজ্ঞানিক নাম: Larus ichthyaetus | এরা ‘কালোশির গঙ্গা কবুতর’ নামেও পরিচিত। বড় জলকবুতর লম্বায় ৭০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। ডানার দৈর্ঘ্য প্রসারিত অবস্থায় ১৪২ থেকে ১৭০ সেন্টিমিটার। শীতে রং বদলায়। এ সময় মাথায় সাদার ওপর কালো ছোপ দেখা যায়। শীত কেটে গেলে মাথা ধীরে ধীরে কালো রং ধারণ করে। শুধু চোখের ওপরে ও নিচে অর্ধচন্দ্রাকারে সাদা ছোপ। দেহজুড়ে সাদা রঙের পালক, কেবল ডানার ওপরের দিক ও পিঠ ধূসর। ওড়ার পালকে সাদার ওপর কালো ফোঁটা। দেহতল ধূসর-ফিকে। ঠোঁট মোটা হলুদ। ঠোঁটের ডগা কালো-লালচে। পা ও আঙুল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ উভয় পাখি দেখতে একই রকম। এদের প্রধান খাবার মাছ। তবে বালুচরে ঘুরে পোকামাকড় খেতেও দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য এপ্রিল। বাসা বাঁধে জন্মভূমিতেই। জলাশয়ের কাছাকাছি ভূমিতে ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে দুই থেকে ছয়টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১ থেকে ২৭ দিন। আর বাচ্চার স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/04/2018