লাল বুক টিয়া | Red Breasted Parakeet | Psittacula alexandri
লাল বুক টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা হলেও শালবনে বেশি দেখা যায়। লোকালয়েও দেখা মেলে, তবে কম। স্থানীয় প্রজাতির হলেও সুলভ দর্শন অঞ্চলভেদে। যেমন: সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক নজরে পড়ে। বিচরণ করে ছোট-বড় দলে। কৃষকের ধান, গম, ভুট্টাক্ষেতে দল বেঁধে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করে, যা খায় তারচেয়ে বেশি নষ্ট করে। দেখতে ভীষণ সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর কর্কশ। সামাজিক পাখি, দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের যে কেউ বিপদের গন্ধ পেলে ‘ক্যাঁক..ক্যাঁক’ স্বরে ডেকে সবাইকে সতর্ক করে। বিপৎসংকেত পেয়ে সঙ্গীরা ঝটপট ডানা মেলে নিরাপদে পৌঁছায়। এত সতর্ক থাকার পরেও এরা শিকারিদের কবলে পড়ছে দেদার- যার ফলে আজ প্রজাতিটি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল বুক টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘রেড ব্রেসটেড প্যারাকিট’ (Red-Breasted Parakeet), বৈজ্ঞানিক: Psittacula alexandri | নাম: ‘সিট্টিসিদি’। এরা ‘তোতা ও মদনা’ নামে পরিচিত। প্রজাতি লম্বায় লেজসহ ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষের মাথা বেগুনি-ধূসর, কপালের ওপর কালো পট্টি, যা চোখের কাছে গিয়ে মিশেছে। ডানায় সোনালি আভা। গলা থেকে বুক পর্যন্ত গোলাপি। পেট নীলচে-সবুজ, তলপেট থেকে লেজের নিচ হলদেটে-সবুজ। লেজের ওপরের দিক নীলচে-সবুজ। লেজের ডগার কিনারটা হলদেটে। শক্ত মজবুত ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের বর্ণ ওপরের দিকে রক্ত লাল, নিচের অংশ কালো। স্ত্রী পাখির মাথা নীলচে-সবুজ। বুকের দিক গাঢ় গোলাপি। ঠোঁটের ওপরাংশ কালো, নিচের অংশ পাটকিলে-কালো। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির কনীনিকা ফিকে-হলুদ, স্ত্রী পাখির সাদাটে-হলুদ। উভয়ের পা ও আঙ্গুল ধূসরাভ-সবুজের সঙ্গে হলটে মিশ্রণ । প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ফুল, ফল, মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। পোষা তোতাদের দুধ-ভাত, কলা, বাদামের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।প্রকাশ: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/06/2017 এবং দৈনিক যুগান্তর, 31/08/2013
কালাঘাড় ডুবুরি | Black necked Grebe | Podiceps nigricollis
কালাঘাড় ডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবল প্রচণ্ড শীতে সিলেটের হাওরাঞ্চলে অল্পবিস্তর দেখা মেলে। স্বাদুজলে বিচরণ করে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট দলেও নজরে পড়ে। সাঁতারে খুব পটু। ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি, ভীতুও সাংঘাতিক। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডুব সাঁতার দিয়ে বাসায় পৌঁছে। এরা লেজহীন পাখি। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুচালো। নিজ বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে পিঠে চড়িয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বাংলা নাম: ‘কালাঘাড় ডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-নেকেড গ্রিব’ (Black-necked Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps nigricollis | এরা ‘কালোমাথা ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ২৮-৩৪ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৩৬০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে অভিন্ন। কপাল, মাথার তালু ও ঘাড় কুচকুচে কালো। মাথা খাড়া। কান পশম সোনালি-হলুদ, যা চোখের পেছন দিক থেকে শুরু করে ঘাড়ের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ কালো। পিঠের দু’পাশ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। বুক কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদা। লেজ খাটো, নেই বললেই চলে। ঠোঁট সুচালো কুচকুচে কালো। চোখের বলয় লাল। চোখের তারা প্রবাল লাল। পা কালচে। পায়ের পাতা চওড়া এবং চেপ্টা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এছাড়াও ছোট চিড়িং, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। শরীরে পালক গজাতে সময় লাগে ১০-১১ সপ্তাহ। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/01/2016
দেশি মেটেধনেশ | Indian Grey Hornbill | Ocyceros birostris
দেশি মেটেধনেশ | ছবি: ইন্টারনেট দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি অদ্ভুত গড়নের ‘দেশি মেটেধনেশ’। এক সময় রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ বনাঞ্চলে দেখা যেত। শুষ্ক বনভূমির উঁচু গাছ-গাছালিতে বিচরণ করত। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে। বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও দেশি মেটেধনেশ বাংলাদেশে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তথাপিও প্রজাতিটিকে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। আমাদের দেশে মোট চার প্রজাতির ধনেশের সাক্ষাৎ মেলে। এদের প্রতিটি প্রজাতিরই স্বভাব কিংবা খাবার একই ধরনের। ধনেশ প্রজাতির সবাই প্রজনন সময়ে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। যেমন স্ত্রী পাখি স্বেচ্ছায় গাছের কোটরে ঢুকলে পুরুষ পাখি ওকে বন্দি করে রাখে। কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয় কাদামাটি দিয়ে। পুরুষ পাখি নিজেই কাদামাটি বহন করে এনে ঠোঁট দিয়ে লেপে দেয়। শুধু ছোট্ট একটি ছিদ্র রাখে বায়ু চলাচল এবং খাবারের জোগান দিতে। পুরুষ পাখিকেই খাবারের জোগান দিতে হয় তখন। ডিম-বাচ্চা ফুটলেও খাদ্যের চাহিদা মেটায় পুরুষ পাখিই। শাবক স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষ পাখিকেই খাবার জোগানে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চারা ফুরফুরে হলে ভেতর থেকে মা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে মাটির আস্তর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি মেটেধনেশ’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল’ (Indian Grey Hornbill), বৈজ্ঞানিক নাম: Ocyceros birostris | এরা ‘পুটিয়াল ধনেশ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৬১ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই। যেটুকু তফাত নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে, স্ত্রী পাখির ঠোঁটের ওপরের বর্ম ছোট ও ঠোঁটের ডগা অস্পষ্ট। বাদ বাকি পুরুষ পাখির মতোই। প্রজাতির পিঠ বাদামি-ধূসর। শরীরের পালকগুলো দেখতে অনেকটাই বালুকাময় মনে হয়। দেহের নিম্নাংশ কালচে ধূসর। ধূসর লম্বা লেজের মধ্য পালকের প্রান্ত সাদা। চোখের ওপরের ভ্রু প্রশস্ত সাদা। কান ঢাকনি কালচে ধূসর। ঠোঁট বাঁকানো, সূচালো। ঠোঁটের ওপর শক্তপোক্ত সেøট-কালো রঙের শিরন্ত্রাণ। পা ও পায়ের পাতা সেøট-কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঠোঁট হলুদ, শিরন্ত্রাণ নেই। প্রধান খাবার: গিরগিটি, টিকটিকি, ইঁদুর, গুবরে পোকা, ফল ও ফুলের পাপড়ি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। গাছের প্রকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৩৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/09/2014
পিয়ং হাঁস | Gadwall | Anas strepera
পিয়ং হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট শীতের পরিযায়ী পাখি। হেমন্তের শুরুতেই বাংলাদেশে চলে আসে। আশ্রয় নেয় উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন জলাশয়ে, নলবনে কিংবা হাওর-বাঁওড় বা নদ-নদীতে। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। খাদ্য সংগ্রহ করে দেশি হাঁসের মতো ডুবিয়ে ডুবিয়ে। ওড়ার সময় ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা যায় শিসের মতো। পুরুষ পাখি তেমন একটা হাঁকডাক দেয় না। শুধু প্রজনন মৌসুমে শিস দিয়ে ডাকে। স্ত্রী পাখি ডাকে ‘গ্যাক-গ্যাক’ আওয়াজ করে। স্বভাবে বেশ শান্ত। অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের সঙ্গে মিলেমিশে শিকারে বের হয়। বসন্তের শুরুতেই নিজ বাসভূমে ফিরে যায়। প্রজাতির বিস্তৃতি ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায়। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মালদ্বীপ ছাড়া প্রায় দেশেই কম-বেশি নজরে পড়ে (প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এদের বিস্তৃতি)। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এরা শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে ব্যাপক। দেখতে কিছুটা দেশি হাঁসের মতো বিধায় মানুষকে সহজে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয় শিকারিরা। পাখির বাংলা নাম: ‘পিয়ং হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘গ্যাডওয়াল’ (Gadwall), বৈজ্ঞানিক নাম: Anas strepera | পরিযায়ী এরা ‘পিয়াং হাঁস’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫০-৫১ সেন্টিমিটার। ওজন ৭৪০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রং বদলায়। এ সময় ওদের ঠোঁট ধূসর, পিঠ ধূসর-বাদামি, ডানার প্রান্তে তামাটে পট্টি, বুকে গোল রেখা, পেট সাদা এবং লেজের তলা কালো দেখায়। প্রজননের বাইরে পুরুষ পাখির পিঠ কালচে হয়। মাথা গাঢ় বাদামির সঙ্গে কালচে হয়। স্ত্রী পাখি পুরুষদের চেয়ে কিছুটা বেশি বাদামি হয়। আর ঠোঁটের দু’পাশ থাকে হলদেটে। উভয় পাখির চোখ কালচে, পা, পায়ের পাতা বাদামি-হলুদ। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদের বীজ-কচিডগা এবং জলজ কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে আগস্ট। মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জলাশয়ের কাছে মাটিতে বা ঝোপের ভেতরে শুকনো ঘাস-লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসা আরামদায়ক করতে নিজেদের ঝরা পালক দিয়ে বিছানা তৈরি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৮-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/06/2014
বড় বাজ | Jerdon’s Baza | Aviceda jerdoni
বড় বাজ | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। বাজ গোত্রের শিকারি পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর-পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। দেখা যায় হিমালয়ের পাদদেশের চিরসবুজ অরণ্যেও। বাংলাদেশে সাক্ষাত মেলে উত্তর-পূর্ব চিরসবুজ অরণ্যে। বিশেষ করে সিলেটের চিরসবুজ অরণ্যে বা চা বাগানের উঁচু গাছ-গাছালিতে দেখা মেলে। লোকালয়ে তেমন একটা দেখা যায় না। এদের মাথায় লম্বা পালকের খাড়া ঝুঁটি। দূর থেকে যা শিংয়ের মতো দেখায়। প্রজাতির চেহারায় রাগী রাগী ভাব ফুটে উঠলেও স্বভাবে অন্যসব বাজের মতো অতটা হিংস্র নয়। এরা বাতাসে উড়তে ভীষণ পছন্দ করে। খোশ মেজাজে থাকলে বাতাসে ভেসে বেড়ায় অনেক সময় লাগিয়ে। উড়তে উড়তে প্রায় ১৫০-১৭৫ মিটার ওপরে উঠে যায়। নামে ধীর গতিতে। জোড়ায় জোড়ায় বা একাকী বিচরণ করে। প্রজনন মুহূর্তে বাসা বাঁধতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাসা বানাতে গাছের ডালপালা ব্যবহার করে। শক্ত ধারালো ঠোঁট দিয়ে গাছের কাঁচা ডাল কেটে নেয়। এ ছাড়াও শুকনো ডালপালা টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলে। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় বাজা’, ইংরেজি নাম: জার্ডনস্ বাজা’, (Jerdon’s Baza), বৈজ্ঞানিক নাম: Aviceda jerdoni | এরা ‘বাদামি বাজ’ বা ‘জার্ডনের বাজ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪৬-৪৮ সেন্টিমিটার। মাথা লালচে-কালো। মাথার ওপর কালো রঙের খাড়া ঝুঁটি। ঝুঁটির পান্ত পালকে সাদা ছোপ। পিঠ গাঢ় বাদামি। লেজে পাটকেলের ওপর তিনটি কালো পট্টি। গলায় লালচে সাদার ওপর কালো টান। বুক লালচে বাদামি। বুকের নিচের অংশ লালচে টান ও বাদামি-সাদা টান। বড়শির মতো বাঁকানো ঠোঁট কালচে রঙের। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। পা হলদেটে-নীলাভ। প্রধান খাবার: গিরগিটি, টিকটিকি, সাপ, ব্যাঙ ও অন্যান্য সরীসৃপ। মাছের প্রতি তেমন একটা আসক্তি নেই। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময় ভিন্ন। গাছের উঁচু শিখরে সরু ডালপালা দিয়ে অগোছালো বাসা বাঁধে। বাসার তেমন শ্রীছাদ নেই। একই বাসায় ফি বছরও ডিম পাড়তে দেখা যায়। ডিমের সংখ্যা ২-৩টি। ডিম ফুটতে কতদিন সময় লাগে, সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/11/2014
চিতিঠোঁট গগনবেড় | Spot billed Pelican | Pelecanus philippensis
চিতিঠোঁট গগনবেড় | ছবি: ইন্টারনেট ভিন্ন ধাঁচের চেহারা, আকারেও বৃহৎ। শীত মৌসুমে দেখা মিলে হাওর-বাঁওড় বা সামুদ্রিক জলাশয় অঞ্চলে। বিচরণ করে একাকী, জোড়ায় কিংবা ঝাঁক বেঁধে। বাংলাদেশে খুব একটা নজরে পড়ে না; কালেভদ্রে নজরে পড়ে। ২০২০ সালে দেশের উত্তরবঙ্গে দেখা যায়। পরবর্তীতে অন্য কোথাও দেখা গেছে বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, লাওস, চীন ও দক্ষিণ কম্বোডিয়া পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বেই এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। শিকারিদের অত্যাচারে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে এরা। এ ছাড়াও জলাশয় সংকটের কারণে প্রজাতিটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা যায় এখন অতি বিরল পরিযায়ী পাখির তালিকায় রয়েছে এরা। পাখির বাংলা নামঃ ‘চিতিঠোঁট গগনবেড়’, ইংরেজি নামঃ ‘স্পট বিল্ড পেলিক্যান’, (Spot-billed Pelican)। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৫২ সেন্টিমিটার। ওজন ৪.১-৫.৭ কেজি। মাথার ঝুঁটি ও ঘাড়ের বর্র্র্ণ গাঢ় ধূসর। পিঠ সাদা। ডানার ওপরে গোলাপি আভা। বুক ও পেটের দিকে হলদেটে। ওড়ার প্রাথমিক পালক কালো। ঠোঁট বড়। ঠোঁটের নিচে কমলা-হলুদ রঙের চামড়ার থলে। উপরের ঠোঁটের মাঝে রয়েছে লম্বা প্লেট। নিচের ঠোঁটের কিনারা ধূসর। চোখের চারপাশে পালকহীন চামড়া। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। কপালে সাদা পালক, যা ওপরের ঠোঁটের গোড়ায় মিলিত হয়েছে। প্রজননের বাইরে গলার নিচের থলে গোলাপি রং ধারণ করে। তখন মাথার ঝুঁটির পালক ও গায়ে হলুদের আভা থাকে না। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির ডানায় বাদামির পরিমাণ বেশি থাকে। ঠোঁটে চিতি থাকে না, যা বয়স্ক পাখিদের থাকে। প্রধান খাবারঃ মাছ। শিকারের কৌশল বেশ মজাদার। এরা দলবদ্ধ হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে মাছ তাড়া করে নিজেদের থলেতে ঢুকিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে গিলে ফেলে। প্রজনন মৌসুম ভারতে অক্টোবর। শ্রীলঙ্কায় মার্চ থেকে এপ্রিল। এ ছাড়াও অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বড় গাছে দলবদ্ধভাবে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে সরু ডালপালা। বাসা অগোছালো। মাচা আকৃতির। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় নেয় ৬0-৯0 দিন। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ৩০ মাস। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 04/10/2021
লালমাথা টিয়া | Plum-headed Parakeet | Psittacula cyanocephala
লালমাথা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন। কালেভদ্রে দেখা মেলে মিশ্র চিরসবুজ বনে অথবা শাল বনে। দেখা যেতে পারে গ্রামীণ বনাঞ্চলেও। সামাজিক পাখি। ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। তবে আমাদের দেশে বড় ঝাঁকে নজরে পড়ে না। গড়ন স্লিম। মনোহরণকারী রূপ। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি কিছুটা নিষ্প্রভ। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও পূর্ব ভুটান পর্যন্ত। স্বভাবে হিংস । প্রজনন মুহূর্তে স্ত্রী পাখির হিংস তা বেড়ে যায় বহুগুণ। এরা ভালো পোষ মানে। শেখালে কথাও বলতে পারে। ক্রীড়ামোদী পাখি। খাঁচায় বন্দি অবস্থায় নানা কসরত দেখায়। খেলা করে এটাসেটা নিয়ে। বল আকৃতির গোলাকার কিছু পেলে ঠোঁট দিয়ে ঠেলতে থাকে। বলা যায় সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করে তা নিয়ে। পাখির বাংলা নাম: ‘লালমাথা টিয়া’, ইংরেজি নাম: প্লাম হেডেড প্যারাকিট (Plum-headed Parakeet), বৈজ্ঞানিক নাম: Psittacula cyanocephala| এরা ‘তাল কেশ টিয়া’ নামেও পরিচিত। অনেকে এদেরকে ‘আলুবোখারা-মাথা পাখি’ নামে ডাকে। আবার হিমালয়াঞ্চলে কেউ কেউ এদেরকে ‘পুষ্প কেশ টিয়া’ নামেও ডাকে। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথা গোলাপি রক্ত বর্ণ। ঘাড়ে মালাসদৃশ কালো রেখা। পিঠ হলুদাভ সবুজ। ডানা সবুজ। ডানার গোড়ায় রয়েছে খয়েরি-লাল পট্টি যা স্ত্রী পাখির নেই। নীলাভ-সবুজ লম্বা লেজ। তন্মধ্যে সবচেয়ে লম্বা পালকের প্রান্ত সাদাটে। দেহতল হলুদাভ-সবুজ। উপরের ঠোঁট কমলা-হলুদ, নিচের ঠোঁট কালো। পা সবুজেটে। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ধূসর। ঘাড়ে হলুদাভ বন্ধনী। উপরের ঠোঁট ভুট্টা হলুদ। নিচের ঠোঁট কালচে। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ছোট ফল, ফুলের পাপড়ি। পোষা পাখি বাদাম, দুধভাত, সবজি খায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৯-২৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, , ২৯/০৫/২০১৫