জল মুরগি | Common moorhen | Gallinula chloropus
জল মুরগি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির জলচর পাখি এরা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে বাস করে। শীত মৌসুমে আবার পরিযায়ী হয়েও অনেকে চলে আসে আমাদের দেশে। স্থানীয় প্রজাতির সাক্ষাৎ মেলে শীতেই বেশি। মৌসুমের অন্য সময়েও দেখা মেলে তবে তুলনায় একেবারেই নগণ্য। যত্রতত্র দেখা যাওয়ার নজির খুব বেশি নেই। সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হাওরাঞ্চলে। দেখতে অনেকটাই ডাহুকের মতো। ঠোঁটের গোড়ার লাল বর্ণটা বাদ দিলে ডাহুক মনে হবে যে কারো কাছেই। সম্প্রতি দেখেছি পাখিটাকে বিক্রমপুরে অবস্থিত রাজা বল্লাল সেনের দীঘির পাশের বিলটাতে। এক বন্ধু জানিয়েছেন, ওখানে নাকি একজোড়া পাখি দেখেছেন তিনি। সংবাদটা শুনে লোভ সামলাতে পারিনি, ছুটে গিয়েছি সেখানে। বিল পাড়ে গিয়েছি বিকেলের কিছু আগে। ভাগ্যটা ভালো ছিল আমাদের, খুব বেশি সময় লাগেনি ওদের সাক্ষাৎ পেতে। প্রথমে একটি পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি, জলদামের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে সে। আমার সঙ্গী ওদিকে ফিরে ক্যামেরা তাক করার আগেই জোড়ের অন্য পাখিটি ধইঞ্চা ক্ষেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে যুগলবন্দি হতে সহায়তা করেছে। এদের বাংলা নাম : ‘জল মুরগি’, ইংরেজি নাম : ‘কমন মুরহেন’ (Common moorhen), বৈজ্ঞানিক নাম : ‘গ্যাললিন্যুলা ক্লোরোপাস’ (Gallinula chloropus), গোত্রের নাম : ‘রাললিদি’। এ পাখি পান পায়রা বা ডাকাব পায়রা নামেও পরিচিত। এ পাখি লম্বায় ৩০-৩৮ সেন্টিমিটার। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল, অগ্রভাগ হলদেটে। মাথা, গলা কালো। পিঠ, ডানা পিঙ্গল। ডানা বুজানো অবস্থায় সাদা ডোরা দেখা যায়। লেজের ওপর কালচে, নিচের দিক সাদার ওপর কালো ছোপ। চোখের তারা লালচে। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ-হলুদ, হাঁটুর ওপর লালবলয়। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: ব্যাঙাচি, ছোট মাছ, ঘাস বীজ, কীট পতঙ্গ ইত্যাদি। আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবার এদের পছন্দ। বলা যায় সর্বভূক পাখি এরা। প্রজনন সময় মে থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে ঘাস বনের ভেতর অথবা জলের ওপর নুয়েপড়া গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো চিকন ডালপালা ও শুকনো ঘাস লতা। ডিম পাড়ে ৪-৭টি। ডিম ফুটে ১৮-২২ দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 14/06/2013
খয়রা কাঠকুড়ালি | Rufous Woodpecker | Celeus brachyurus
খয়রা কাঠকুড়ালি | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি। দেখতে মন্দ নয়। দেশের সর্বত্রই কম-বেশি নজরে পড়ে। চিরসবুজ, পাতাঝরা বন অথবা আর্দ্র পাতাঝরা বন, বাঁশবন, শালবন এমনকি গ্রামীণ বন-বনানীতেও বিচরণ রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে উইঢিবিতে হানা দিতে দেখা যায়। বিচরণ করে একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। একাকী বিচরণের ক্ষেত্রে জোড়ের পাখির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে। এ সময় ওরা নাকি সুরে ‘কুয়িন-কুয়িন-কুয়িন-’ আওয়াজ করে একে অপরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে যায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে মরা গাছের কাণ্ডে ঠোঁট দিয়ে জোরে জোরে ড্রাম বাজানোর মতো শব্দ করে। এ ছাড়াও ডানা জাপটিয়ে উড়ে ভন ভন আওয়াজ করে স্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়া প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্নমুক্ত। বাংলাদেশে বিপন্নমুক্ত হলেও দেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। অবশ্য এদের শত্রু সংখ্যা তেমন একটা নেই। বলা যায় আমাদের দেশে মোটামুটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘খয়রা কাঠকুড়ালি’, ইংরেজি নাম: ‘রূপাস উডপেকার (Rufous Woodpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Celeus brachyurus | এরা ‘লালচে কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১০৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। উভয়ের দেহের বর্ণে সামান্য পার্থক্য রয়েছে এবং স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য ছোট। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির দেহের রং লাল-বাদামি। মাথায় ঝুঁটি আকৃতির খাড়া পালক। পিঠে কালো আড়াআড়ি ডোরা। কাঁধ-ঢাকনি, ডানা, লেজের পালকে কালো-ডোরার উপস্থিতি রয়েছে। গলার পালক ফ্যাকাসে এবং মাছের আঁশের মতো দেখায়। স্ত্রী পাখির কান-ঢাকনি পীতাভ-ফ্যাকাসে। চোখের নিচে অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির উজ্জ্বল লাল পট্টি। উভয়ের চোখ বাদামি-লাল। ঠোঁট কালো, শক্ত-মজবুত। ঠোঁটের অগ্রভাগ সূচালো। পা ও পায়ের পাতা নীলচে সবুজ। নখ কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের বুকে ও তলপেটে আড়াআড়ি ডোরা ও অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির দাগ দেখা যায়। প্রধান খাবার: উইপোকা, গাছ পিঁপড়া, বুনো ডুমুর ও ফুলের মধু। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। মরা গাছের কাণ্ডে নিজেরা খোড়ল করে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/02/2015
ক্ষুদে ঘুঘু | Little brown dove | Streptopelia senegalensis
ক্ষুদে ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার নজির নেই। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে মাত্র দুই-তিনবার দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। ফলে এরা স্থানীয় নাকি পরিযায়ী প্রজাতির তা নিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা যায়নি। বলা যায় অতি বিরল দর্শন ‘ক্ষুদে ঘুঘু’। দেখতে অনেকটাই তিলা ঘুঘুর মতো। কণ্ঠস্বরও সেরকম। সুরে মাদকতা রয়েছে। বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। চেহারা কবুতর আদলের। দেখতে মায়াবী। স্বভাবে শান্ত। পারতপক্ষে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয় না। বিচরণ করে মাঠে-ঘাটে। তবে সেটি অবশ্য শুষ্ক শস্যভূমি হতে হবে। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে এলাকা এদের একদম অপছন্দ। জলপান ব্যতিরেকে জলাশয়ের কাছে ঘেঁষে না। গোসল করে নিয়মিত। তবে গায়ে জলের পরিবর্তে ধূলি ছিটিয়ে গোসল করে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। তখন ‘কুকু..ক্রো..ক্রো..’ সুরে ডেকে স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়া এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি পূর্ব ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইসরাইল, লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব অমিরাত, সৌদি আরব, ইরান পর্যন্ত। আফ্রিকা অঞ্চলেও দেখা যায়। তুলনামূলক এদের আবাসস্থল কিছুটা মরুময় এলাকায়। পাখির বাংলা নাম: ‘ক্ষুদে ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল ব্রাউন ডাভ’ (Little brown dove), বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia senegalensis | ইংরেজিতে এরা খধঁমযরহম উড়াব নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৬-২৭ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় গোলাপি-বাদামি। পিঠ বালু মিশ্রিত বাদামি বর্ণ। লেজের বাইরের পালক সাদা। লেজের গোড়া ও কাঁধের পালক ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালো। ওড়ার পালক কালো। বুক গোলাপি-বাদামি। পেট বালু মিশ্রিত বাদামি। চোখ বাদামি কালো। ঠোঁট শিং কালো। পা গোলাপি লাল। নখর কালো। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসের কচি ডগা ও মাটি। মাঝেমধ্যে উইপোকা খেতে যায়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। গাছের তেডালে অথবা দালানের ফাঁকে খড়কুটা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। শাবক সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে উড়তে শেখে। লেখক: আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/07/2015
কালাপেট পানচিল | Black bellied Tern | Sterna acuticauda
কালাপেট পানচিল | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। সুচালো স্লিম আকৃতির গড়ন। দেখতে মন্দ নয়। উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে এদের দেখা মিললেও মূলত এরা সামুদ্রিক পাখি। হ্রদ কিংবা নদ-নদীতে বিচরণের পাশাপাশি দেখা মেলে বালুময় দ্বীপাঞ্চলেও। এ ছাড়া কৃষিজমিতে বিচরণ রয়েছে। মিঠা জলের চেয়ে লবণ জলে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণই এটি। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। কলোনি টাইপ বাসা বাঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাটি পছন্দ নয়। তবে নিজেদের মধ্যে কমবেশি ঝগড়া বাধে। এ সময় বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’ সুরে। শিকারি পাখি ব্যতিরেকে এদেরকে পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা দেশে মোটামুটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া পর্যন্ত। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এদের অবস্থান কিছুটা ভালো। পাখির বাংলা নাম: ‘কালাপেট পানচিল’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-ব্যালিড টার্ন’ (Black-bellied Tern), বৈজ্ঞানিক নাম: Sterna acuticauda | এরা ‘কালো গাংচিল’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে ৩২-৩৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রজনন পালক ভিন্ন। মাথায় টুপি আকৃতির ঘন কালো পালক, যা ঘাড়ের উপরিভাগ অবধি নেমে গেছে। পিঠ, ডানা ও লেজ সাদাটে ধূসর। ডানা এবং লেজের অগ্রভাগ সরু। গলা সাদা। বুক ধূসর কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত গাঢ় কালো। ওড়ার পালক সাদা। চোখের কালো। হলুদ ঠোঁটের গোড়ার দিক মোটা হলেও প্রান্তটা সুচালো। পা ও আঙ্গুল কমলা হলুদ। প্রধান খাবার: ছোট মাছ। এ ছাড়াও বালুচরে ঘুরে পোকামাকড়, সরীসৃপ, শুককীট খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম ফ্রেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। জলাশয়ের কাছাকাছি বেলাভূমি এলাকায় ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৩ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে ৪-৫ সপ্তাহ সময় লাগে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/02/2016
নীলাভবুক বটেরা | Blue Breasted Quail | Coturnix chinensis
নীলাভবুক বটেরা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। নাদুস-নুদুস চেহারা। বসারত অবস্থায় গড়ন ডিম্বাকৃতির দেখায়। দেখতে অনেকটাই বাজারে পাওয়া যায়, (খাঁচায় পালিত) কোয়েল পাখির মতো। যত্রতত্র দেখার নজির নেই। মূলত আর্দ্র তৃণভূমি এদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়াও রাস্তার আশপাশের ঘন ঝোপজঙ্গলের ভেতর বিচরণ করে। খাবারের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় কিংবা পারিবারিক ছোটদলে। খাবার খোঁজে মুরগির মতো মাটিতে আঁচড় কেটে কিংবা ঝরাপাতা উল্টিয়ে। শিকাররত অবস্থায় ডাকে ‘কুঈ-কী- কিউ’ সুরে। ভয় পেলে সুর পাল্টে যায়, তখন ‘টির..টির..টির..’ সুরে ডাকে। ‘নীলাভবুক বটেরা’ এক সময় ঢাকা ও সিলেট বিভাগের তৃণভূমিতে দেখা যেত। বিশেষ করে সিলেটের চা বাগানের ভেতর পোকামাকড় খুঁজে বেড়াত। হালে দেখা যাওয়ার রেকর্ড নেই। আমরা সে রকম জোরালো তথ্যও আজ অবধি পাইনি। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় নীলাভবুক বটেরাদের বিস্তৃতি রয়েছে। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘নীলাভবুক বটেরা’, ইংরেজি নাম: ব্লু ব্রেস্টেড কোয়েল’ (Blue-breasted Quail), বৈজ্ঞানিক নাম: Coturnix chinensis | এরা ‘রাজবটেরা’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বটেরা নজরে পড়ে। যথাক্রমে নীলাভবুক বটেরা, বৃষ্টি বটেরা বা চীনা বটেরা, বড় বটেরা। প্রজাতি লম্বায় ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির কপাল স্লেট-নীল। মাথায় অস্পষ্ট সাদা-কালো ডোরা। পিঠ বাদামি ছিট এবং লালচে-বাদামির মিশ্রণ। গলায় সাদা-কালো চওড়া দাগ। বুক স্লেট নীল। পেট ও লেজ ঢাকনি লালচে-তামাটে। ঠোঁট খাটো, শিং কালো। পা হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির কপাল লালচে। ঘাড়ের নিচ থেকে ডানা পর্যন্ত ছিট দাগ। বুক ও বগলে কালো ডোরা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির বর্ণ অনুজ্জ্বল। এদের তলপেটে তামাটে রং দেখা যায় না। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে আগস্ট। ঝোপজঙ্গলের ভেতর মাটির প্রাকৃতিক গর্তে ঘাস ও লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৫-৭টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/11/2014
খাকি ভুতুম পেঁচা | Tawny Fish Owl | Ketupa flavipes
খাকি ভুতুম পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মূলত এরা নদ-নদী, হ্রদ কিংবা বড়সড় জলাশয়ের কাছাকাছি বৃক্ষে বিচরণ করে। বহমান জলাশয়ের আশপাশে বেশি দেখা যায়। বিচরণের ক্ষেত্র ক্রান্তীয় থেকে নাতিশীতোষ্ণ এলাকা বেশি পছন্দের। এছাড়াও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ মিটার উচ্চতায় দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। অন্যসব পেঁচাদের মতো এরাও দিনের বেলায় গাছ-গাছালির ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দিনের আলো ফুরিয়ে এলে বা গোধূলিলগ্নে শিকারে বের হয়। একাকী কিংবা জোড়ায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। দলবেঁধে বিচরণ করে না। দেখতে ভয়ঙ্কর দর্শন হলেও একেবারেই নিরীহ গোত্রের পাখি। স্বভাবে লাজুক। অন্যসব শিকারি পাখিদের মতো হিংস নয়। কণ্ঠস্বর ভৌতিক। ভরাট কণ্ঠে ‘ওহুহু-হুহু’ আওয়াজ করে মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, উত্তর মিয়ানমার, চীন, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। এ ছাড়াও হিমালয়ের পাদদেশে বিচরণ রয়েছে। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘খাকি ভুতুম পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘তানি ফিস আউল’ (Tawny Fish Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ketupa flavipes | এরা ‘তামাটে মেছোপেঁচা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪৮-৫৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথা ও ঘাড় তামাটে-বাদামি ডোরাযুক্ত। মাথার দু’পাশে আছে কান পশম, যা ঝুঁটি আকৃতির দেখায়। চোখের দু’পাশে কপালের ওপর সরু সাদা টান। মুখমণ্ডল তামাটে। দেহের উপরাংশ গাঢ় বাদামি রঙের সঙ্গে তামাটে মিহি রেখা। ডানার উপরে সাদাটে দাগ। লেজ খাটো, গোলাকার। দেহের নিচের দিকে তামাটে-বাদামির আড়াআড়ি রেখা। গোলাকার চোখের বলয় তামাটে-হলুদ রঙের। তারা গাঢ় বাদামি। ঠোঁট শিং রঙা, আকারে খাটো, নিচের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। পায়ের আঙ্গুল ফ্যাকাসে হলদে। প্রধান খাবার: মাছ, কাঁকড়া, সরীসৃপ, ইঁদুর, টিকটিকি, ব্যাঙ ও বাগদাচিড়িং। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। মরা গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। এ ছাড়াও গিরিখাত এবং নদীর খাড়া কিনারের গর্তে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-২৯ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে মাসখানেক সময় লেগে যায়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/06/2016
পাতি সারস | Common Crane | Grus grus
পাতি সারস | ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা ছোট-বড় দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। নাচের কসরৎ দেখতে দেখতে স্ত্রী পাখি তখন আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও নাচে অংশ নিয়ে প্রেমে মজে যায়। এ সময় জোরে জোরে দ্বৈত সংগীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে দেশি সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি সারস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন ক্রেন’ (Common Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Grus grus | দেশে তিন প্রজাতির সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। এরা সবাই পরিযায়ী প্রজাতির। গড় দৈর্ঘ্য ১১৫ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৮০-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ৫.১-৬.১ কেজি। স্ত্রী পাখি ৪.৫-৫.৯ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। কপাল কালো। মাথার তালুর রক্ত লাল। মাথার পেছন থেকে শুরু করে ঘাড়, থুতনি ও গলা কালো। চোখের পেছন থেকে ঘাড় ও গলার কালো দ্বিখণ্ডিত হয়ে সাদায় রূপ নিয়েছে। পিঠ গাঢ় ধূসর। ডানার পালকের ওপর কালো ছোপ। ওড়ার পালক কালো। লেজ কালো। ডানার বাড়তি পালক লেজের ওপর ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। চোখের তারা লাল। পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, কাঁকড়া কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি, কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩১ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/10/2015