বাবুই পাখি | Baya weaver | Ploceus philippinus
বাবুই পাখি | ছবি: ইন্টারনেট অতিসুলভ দর্শন পাখি এরা। এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ব্যাপার-স্যাপারও। অনেক গান, কবিতাও রচিত হয়েছে এ পাখি নিয়ে। গ্রামেগঞ্জে কিংবা মফস্বল এলাকায় ব্যাপক নজরে পড়ে এখনো। দলবদ্ধভাবে বাস করে। সারাদিন চেঁচামেচি করে কাটায়। সামান্যতেই রেগে যায়। নিজেদের মধ্যে কোলাহল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাখিটা অতি সহজে কারো দৃষ্টিতে না পড়লেও ওদের বাসাটা ঠিকই সবার নজর কাড়ে। তাল, নারকেল কিংবা খেজুর গাছে সারিবদ্ধভাবে ঝুলতে দেখা যায়। সেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এ পাখির বাসা বানানোর কৌশল রীতিমতো বিস্ময়কর বটে। সুনিপুণ কারিগর বলা যায় এদের। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে পুরুষ পাখি খেজুর, নলখাগড়া, নারিকেল অথবা তালপাতার পাশ থেকে চিকন লম্বা অংশ ঠোঁট দিয়ে কেটে নেয়। অতঃপর সেটি বয়ে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে জুড়ে দেয়। এভাবেই বাসা তৈরির সূত্রপাত ঘটায়। তারপর ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে তৈরি করে বলয়। বলয়ের চারপাশটা চিকন পাতা দিয়ে সেলাই করে চোঙ্গাকৃতির বাসা বানায়। নিজস্ব শৈল্পিকগুণে তৈরি করে দৃষ্টিনন্দন বাসা। বাসার ওপর-নিচ থাকে খানিকটা সরু আর মধ্যখানটা থাকে মোটাসোটা। বাসার মুখ থাকে নিচের দিকে। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে তা দিলেও পুরুষ পাখি থাকে অন্য ধান্ধায়। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ পাখির বাসা এতই মনোমুগ্ধকর যে, মানুষ তাদের ড্রইংরুমে ঝুলিয়ে রাখতে গর্ববোধ করেন। ঝুলিয়ে রাখে নামিদামি আবাসিক হোটেলগুলোতেও। বলা যায় অনেকটা শোপিসে পরিণত হয়েছে এদের বাসা। প্রিয়পাঠক, এ পাখির বাংলা নাম: ‘বাবুই’, ইংরেজি নাম: ‘বায়া উইভার’ (Baya weaver), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘প্লসিয়াস ফিলিপপিনাস’ (Ploceus philippinus), গোত্রের নাম: ‘পাসেরিদি’। অঞ্চলভেদে ‘বাউই’ নামেও পরিচিত। বাবুই পাখি লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। প্রজনন সময় পেরিয়ে গেলে স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হয়। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে দেহের রং বদলায়। তখন পুরুষ পাখির মাথা হলুদ আকৃতি ধারণ করে। ঘাড়ের ওপর বন্ধনী তৈরি হয়ে বুকে গিয়ে ছড়িয়ে যায়। কপাল, কান, থুতনি ও গলার বর্ণ হয় কালচে-বাদামি। অপরদিকে ওই সময় স্ত্রী পাখির ওপরের দিক হলুদাভ-বাদামি রং ধারণ করে। তার ওপর থাকে বেশ কিছু গাঢ় বাদামি রেখা। ভ্রু, ঘাড়ের পাশ এবং বুক হলুদাভ-বাদামি। নিচের দিকে হলুদের আভাযুক্ত। তবে কোনো রেখা বা ডোরা থাকে না। বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য শস্যবীজ। ধান, কাউন প্রিয়। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে তাল, খেজুর, নারিকেল গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/04/2013
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
খয়রাগলা নাকুটি | Brown throated Martin | Riparia paludicola
খয়রাগলা নাকুটি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি হলেও যত্রতত্র দেখা মেলে না। চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। প্রাকৃতিক আবাস্থল খোলা মাঠ-প্রান্তর, তৃণভূমি, কৃষি জমি এবং জলাশয়ের আশপাশ। পোকামাকড়ের আধিক্যের কারণে জলাশয়ের আশপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়াউড়ি করে। আবার পত্র-পল্লবহীন গাছেও ঝাঁকে ঝাঁকে বসে বিশ্রাম নেয়। প্রজনন মুহূর্তে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। এরা বাসাও বাঁধে দলবদ্ধ হয়ে। টানেল আকৃতির বাসা। পাহাড়, নদ-নদীর পাড়ে মাটির খাড়া দেয়ালে গর্ত খুঁড়ে ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার টানেল করে বাসা বাঁধে। কণ্ঠস্বর শ্রুতিমধুর না হলেও বিরক্তিকর নয়। অস্থিরমতির পাখি। উড়ন্ত পতঙ্গ শিকার করে। সারাদিন বিরতিহীন ওড়াউড়ি করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, মাদাগাস্কার, পশ্চিম ইথিওপিয়া, সোয়াজিল্যান্ড, বাতসোয়ানা, তানজানিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বিশ্বে প্রজাতিটি সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন এদের লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘খয়রাগলা নাকুটি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন-থ্রোটেড মার্টিন’ (Brown-throated Martin), বৈজ্ঞানিক নাম: Riparia paludicola | এরা ‘বাদামি-গলা নাকুটি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১২ সেন্টিমিটার। ওজন ১১-১৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষের চেহারা অভিন্ন। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ গাঢ় বাদামি। ডানা বাদামি-সাদা। ডানা লম্বা, লেজের প্রান্তে মিশেছে। লেজ মাছের লেজের মতো। গলা বাদামি। বুকের নিচ থেকে বাদবাকি সাদা। চোখ বাদামি। ঠোঁট খাটো, কালো। পা কালো, নখ বড় বড়। প্রধান খাবার: উড়ন্ত পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। কলোনি টাইপ বাসা। গর্তে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ফোটে ১২-১৩ দিনে। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 17/11/2017
বাদামি কোকিল | Anas strepera | Phaenivophaeus leschenaultia
বাদামি কোকিল | ছবি: ইন্টারনেট বিপন্ন প্রজাতির পাখি ‘বাদামি কোকিল’। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয় এরা। প্রাক্তন পরিযায়ী পাখি। কয়েক দশক আগে চট্টগ্রাম বিভাগে দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। হালে দেশের কোথাও দেখার নজির নেই। বছর খানেক আগে শ্রীমঙ্গলের একজন পাঠক দাবি করেছেন তিনি বাদামি কোকিলের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাখিটির ছবি ই-মেল করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। প্রজাতিটি শনাক্ত করে দেখি যে, সেটি আসলে ‘সাতভায়লা’ পাখি। চেহারা কাছাকাছি বিধায় তিনি ওই ভুলটি করেছেন। বাদামি কোকিল ভারত উপমহাদেশের শুষ্ক অঞ্চলে যৎসামন্য নজরে পড়ে। এরা সাধারণত শুষ্ক পাতাঝরা বনের ঝোপজঙ্গলে কিংবা প্রস্তরময় এলাকার ঝোপে বিচরণ করে। বেশিরভাগই একা বিচরণ করলেও মাঝেমধ্যে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বাদামি কোকিল ঝোপজঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহ করলেও মাটিতে নেমে পাতা উল্টিয়ে কীটপতঙ্গ শিকার করতে দেখা যায়। মাটিতে বিচরণকালীন ভয় পেলে দৌড়াতে থাকে, উড়ার চেষ্টা করে না মোটেও। কোকিলের জ্ঞাতি ভাই হলেও অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে না, নিজেরাই হ-য-ব-র-ল টাইপ বাসা বাঁধে। আবার হাঁকডাকও করে না খুব একটা দেশি কোকিলের মতো। মাঝেমধ্যে ‘কেক-কেক-কেক-কেরেক-কেরেক-কেরেক’ সুরে ডাকে। সুর শ্রুতিমধুর নয়, কর্কশ। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত হয়েছে বাদামি কোকিল। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামি কোকিল’, ইংরেজি নাম: Anas strepera, বৈজ্ঞানিক নাম: Phaenivophaeus leschenaultia, গোত্রের নাম: কুকুলিদি। এরা ‘মেটে মালকোআ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪২ সেন্টিমিটার (তন্মধ্যে লেজ ২২ সেন্টিমিটার)। মাথার তালু গাঢ় ধূসর। গলা ও বুকের উপরাংশ পীতাভ, এছাড়াও কালো ডোরা দেখা যায়। পেটের দিকটা লালচে-পীতাভ। লেজের নিচটা পর্যায়ক্রমে সজ্জিত। লেজের অগ্রভাগ সাদা। এছাড়াও সব দেহ বালিময় ধূসর-বাদামি। ঠোঁট লালচে, অগ্রভাগ হলুদ। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট-বাদামি। প্রধান খাবার: টিকটিকি, ছোট সাপ, ফড়িং, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে আগস্ট। মাটি থেকে খানিকটা উপরে ঝোপজঙ্গল বা গুল্মলতাদির ভেতর শুকনো পাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের বর্ণ ধবধবে সাদা। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে তা জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/06/2014
সোনালি গলা বসন্ত বউরি | Golden throated barbet | Megalaima franklinii
সোনালি গলা বসন্ত বউরি | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থানীয় প্রজাতির পাখি ছাড়াও পরিযায়ী প্রজাতির পাখিরাও আমাদের দেশীয় পাখির তালিকায় রয়েছে। অর্থাৎ কোনো প্রজাতির পাখি যদি একবারের জন্যও বাংলাদেশে আসে তাহলে ওই প্রজাতিটি দেশীয় পাখির তালিকায় স্থান পাচ্ছে। তেমনি তালিকায় রয়েছে, ‘সোনালিগলা বসন্ত বউরি’ পাখি। কিন্তু ওদের দেখা আমাদের দেশে মিলে না সহসাই। বসন্তের শুরু থেকেই এই প্রজাতির খোঁজে আমি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ালেও নজরে মিলেনি অদ্যাবধি। তবে বন্যপ্রাণী বিশারদ ড. রেজা খান তার লেখা ‘বাংলাদেশের পাখি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রজাতিটি দেশে দেখা যাবার তথ্য না থাকলেও দুইজন ভিনদেশী পাখি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে সোনালিগলা বসন্ত বউরি পাখির সাক্ষাত পেয়েছেন।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘প্রজাতিটি অতি বিরল। আর হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ওরা বসন্তকালের পাখি। সারা বছর আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকলেও বসন্ত বউরি পাখিরা বসন্তকালের শুরু থেকে লোকালয়ে চলে আসে। গাছের ফল-ফলাদি খেয়ে সামান্য ক্ষতি করলেও বিনিময়ে মিষ্টি করুণ সুর আমাদের কানে দিয়ে যায়। আওয়াজ করে, ‘টুক্-টুক্-টুক..’ (প্রজাতি ভেদে আওয়াজ ভিন্ন) সুরে। অনেক দূর থেকে শোনা যায় সেই আওয়াজ। হঠাৎ আওয়াজটি কানে গেলে যে কেউ কামারের হাতুড়ির আওয়াজ মনে করতে পারেন।’ বিদঘুটে আওয়াজ হলেও সুরে রয়েছে চমৎকার তাল-লয়। শোনার আগ্রহ জাগে। এরা বৃক্ষচারী পাখি। দেখতে সুশ্রী। শরীরের তুলনায় মাথা বড়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও তিব্বত পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘সোনালিগলা বসন্ত বউরি’, ইংরেজি নাম: ‘গোল্ডেন থ্রোটেড বারবেট’(Golden-throated barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: Megalaima franklinii | দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার। কপাল লাল। তালুতে সোনালি পট্টি। সমস্ত দেহ সবুজ। ডানার গোড়ার পালক নীল। কান ঢাকনি সাদাটে। গলা সোনালি। বুকের দিকে সোনালি আভা দেখা যায়। নিচের দিকে বাদবাকি সবুজ। ঠোঁট ত্রিভুজাকৃতির, শক্ত মজবুত, কালচে। পা জলপাই রঙের। প্রধান খাবার: ছোট পাকা ফল ও ফুলের মধু। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। গাছের কাণ্ডে নিজেরা খোড়ল করে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/11/2018
লম্বাঠোঁট তুলিকা | Long Billed Pipit | Anthus Similis
লম্বাঠোঁট তুলিকা | ছবি: ইন্টারনেট পাথুরে পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দা। পাহাড়ের কার্নিশে কিংবা কাঁটা গাছে বিচরণ করে। তবে গাছ-গাছালির চেয়ে বেশির ভাগই পাথুরে এলাকায় বা পাহাড়ের কার্নিশ দেখা যায়। মায়াবি চেহারা। স্লিম গড়ন। প্রজাতির অন্যদের তুলনায় সুদর্শনই বটে। তুলনামূলক ঠোঁট ও লেজ খানিকটা লম্বা। গানের গলা চমৎকার। ধীরলয়ে গান গায়। চলাফেরাও ধীরগতির। বিচরণ করে একাকী। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। যত্রতত্র দেখা মেলে না। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ব্যতীত, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ-মধ্য আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘লম্বাঠোঁট তুলিকা’, ইংরেজি নাম: ‘লং-বিল্ড পিপিট’ (Long-billed Pipit), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthus similis | প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ১৭-২০ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির ওজন ৪০-৩৫ গ্রাম। স্ত্রী পাখির ওজন ২৮-৩১ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষের চেহারা অভিন্ন। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ বেলে ধূসর। ডানায় গাঢ় বাদামি টান। চোখের ওপর ভ্রুর মতো বাঁকানো ফ্যাকাসে চওয়া টান। দেহতল ফ্যাকাসে। ঠোঁট লম্বা, উপরের অংশ বেলে ধূসর, নিচের অংশ ফ্যাকাসে পা ত্বক বর্ণের। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ, ঘাসবীজ ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে নিজ বাসভূমে। বাসা বানায় শিলা বা মাটির ওপর সরু-নরম লতা বিছিয়ে। ডিমের সংখ্যা ২-৪টি। ফুটতে সময় লাগে ১২-১৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/01/2018
পাহাড়ি কানকুয়া | Lesser Coucal | Centropus bengalensis
পাহাড়ি কানকুয়া | ছবি: ইন্টারনেট কোকিল পরিবারের সদস্য হলেও নিজেরা বাসা বানাতে সক্ষম। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃতি রয়েছে। দেশের সর্বত্রই কমবেশি দেখা যায়। স্বভাবে হিংস্র। গাছ-গাছালির চেয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বেশি দেখা যায়। ওড়াউড়ি তেমন পছন্দের নয়। অবশ্য খুব ভালো উড়তেও জানে না। ঝোপ-জঙ্গলের ভেতরে হেঁটে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করে। ক্ষণে ক্ষণে ‘বুট-বুট-বুট’ সুরে উচ্চকণ্ঠে ডেকে ওঠে। নির্জন দুপুরে কিংবা গভীর রাতে আচমকা ডেকে ওঠে মানুষের পিলে চমকে দেয়। পাখিদের কাছে এরা ডাকাত পাখি নামে পরিচিত। বিশেষ করে ছোট পাখিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। ছোট পাখিদের বাসার সন্ধান পেলে তছনছ করে দেয়। পায়ের শক্ত নখ এবং তীক্ষ ঠোঁট দিয়ে বাসা ফালা ফালা করে ডিম-বাচ্চা খায়। যেসব পাখি গাছের কোটরে ডিম পাড়ে ওদের ডিম-বাচ্চাও রেহাই পায় না। গাছের কোটরে লম্বা পা ঢুকিয়ে ডিম-বাচ্চা বের করে আনে। হিংস্রতায় অদ্বিতীয় হলেও এরা নিজেদের সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখে। নিয়ম করে প্রত্যহ গোসলাদি সেরে নেয়। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি কানকুয়া’, ইংরেজি নাম: ‘লেসার কুকাল’ (Lesser Coucal), বৈজ্ঞানিক নাম: Centropus bengalensis | অঞ্চলভেদে ‘কানাকোকা, হাঁড়িকুড়ি, কুক্কাল, বাংলা কুবো’ নামে পরিচিত। সাধারণত দুই প্রজাতির কানকুয়া দেখা যায়। বড় কানকুয়া ও পাহাড়ি কানকুয়া। দৈর্ঘ্য ৩১-৩৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৮৮ গ্রাম। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় কিছুটা বড়। চেহারায় পার্থক্য নেই। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। মাথা, ঘাড়, বুক, পেট নীলাভ কালো। পিঠ উজ্জ্বল বাদামি। লেজ ধাতব কালো। চোখ টকটকে লাল। তবে মনিটা কালো। নীলচে কালো ঠোঁটের অগ্রভাগটা বাঁকানো। পা ধাতব কালো। যুবাদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: পাখির ডিম-বাচ্চা, ছোট সাপ, গিরগিটি, ইঁদুর, কেঁচো, পঙ্গপাল, ফড়িং, লোমশ শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। বাসা বানায় বাঁশঝাড় অথবা ঘন পাতার গাছে। এছাড়াও অন্যান্য ঝোপ জঙ্গলের ভেতরেও বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে ব্যবহার করে কাঠি, বাঁশপাতাসহ নানা ধরনের লতাপাতা। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। শাবক উড়তে শেখে ৪০ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/09/2015