সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
সুন্দরী হাঁস | Mandarin Duck | Aix galericulata
সুন্দরী হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। বোধ করি হাঁস প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরতম পাখি। প্রজাতির রূপের বর্ণনা বোঝানোর মতো নয়, বিধায় পাখি বিশারদরা সোজাসাপ্টা নামকরণ করেছেন ‘সুন্দরী হাঁস’। বলা যায় যথার্থ নামকরণ এটি। দেশে কেবলমাত্র আগমন ঘটে শীত মৌসুমে, তবে প্রতি মৌসুমেই পালা করে আগমন ঘটে না। কালেভদ্রে সিলেটের হাওরাঞ্চলে দেখা মেলে। দেখা যেত এক সময়ে সুন্দর বনাঞ্চলেও। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া ও ভিয়েতনামে অনিয়মিত দেখা যায়। খানিকটা বেশি দেখা যায় চীন, জাপান ও কোরিয়াতে। সুন্দরী হাঁস অন্য প্রজাতির সঙ্গে মিলেমিশে চলাফেরা করলেও নিজ প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে প্রায়ই। এদের বেশিরভাগ বিচরণক্ষেত্র জঙ্গলাবৃত জলাশয়ে। ঊষা এবং গোধূলিলগ্নে নিয়ম করে শিকারে বের হয়। সাঁতারে দক্ষ হলেও ডুব দিতে তেমন পারদর্শী নয়। উড়তে পারে ভালো। পুরুষ হাঁস উড়তে উড়তে ডাকে ‘হোয়েক..হোয়েক’ অপরদিকে স্ত্রী হাঁস ডাকে গ্যাগ-অ্যাগ-অ্যাগ-অ্যাগ..’ সুরে। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপন্মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত নয়। এদের মাংস তত সুস্বাদু নয় বিধায় শিকারির হাতে নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় না খুব একটা। তথাপিও দেশে খুব বেশি আগমন ঘটছে না, তার প্রধান কারণই হচ্ছে অবাধে বৃক্ষ নিধন। বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত জঙ্গলাবৃত জলাশয় সংকটের ফলে সুন্দরী হাঁস বিরলতম হয়ে উঠছে আমাদের দেশে। পাখির বাংলা নামঃ ‘সুন্দরী হাঁস’, ইংরেজি নামঃ ‘মান্ডারিন ডাক’, (Mandarin Duck), বৈজ্ঞানিক নামঃ Aix galericulata পরিযায়ী । এরা ‘মান্ডারিন হাঁস’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৪৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৪২৮-৬৯৩ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির গোল মাথাটা বাদামি রঙের। চোখ বাদামি। চোখের ওপরে চওড়া সাদা টান, যা ঘাড় অবধি ঠেকেছে। চিবুক থেকে কমলা রঙের কেশর সাদৃশ্য পালক ঘাড়ে ঠেকেছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির ডানায় কমলা রং ধারণ করে। তখন দু’পাশের ডানার পালক খাড়া থাকে নৌকার পালের মতো। প্রজনন ঋতুর বাইরে ডানা লালচে। দেহতল সাদা। ঠোঁট লাল, অগ্রভাগ সাদাটে। পা কমলা-পীতাভ। স্ত্রী পাখির রং নিষ্প্রভ। পিঠ জলপাই-বাদামি। দেহতল সাদা। বুকে সাদা ডোরা। প্রধান খাবারঃ জলজকীট, ছোট কাঁকড়া, চিড়িং, জলজ উদ্ভিদের কচিডগা। প্রজনন মৌসুম মে-আগস্ট। জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির গুহায় অথবা গাছের প্রাকৃতিক কোটরে ঘাস লতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৯-১২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 02/04/2022
পাহাড়ি টুনটুনি | Mountain Tailorbird | Orthotomus cuculatus
পাহাড়ি টুনটুনি | ছবি: ইন্টারনেট পরিচিত প্রজাতির ‘টুনটুনি’ পাখির মতো যত্রতত্র এদের দেখা মেলে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনে এবং ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। পাহাড়ি চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে লতাগুল্মের ঝোঁপে এবং বাঁশবনে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এদের মায়াবী চেহারা। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। যেন একদণ্ড বসার সুযোগ নেই কোথাও। এই আছে তো এই নেই। তবে যেখানেই থাকুক না কেন এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। জোড়ের পাখিটি সামান্য দূরে থাকলেও ডাকাডাকি করে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে নেয়। সারাদিন নেচে-গেয়ে সময় কাটায়। লেজ উঁচিয়ে নাচে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি নানা কসরত দেখায় স্ত্রী পাখির মন ভোলানোর জন্য। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে। বেশ পরিপাটি বাসা। দুটি পাতাকে একত্রিত করে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বাঁধে। অনেকটা দর্জির কাপড় সেলাই করার মতো। পাখির বাংলা নাম: ‘পাহাড়ি টুনটুনি’, ইংরেজি নাম: মাউন্টেন টেইলরবার্ড (Mountain Tailorbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotomus cuculatus | এরা ‘সোনালি মাথা টুনি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৭ গ্রাম। কপাল লালচে। মাথা সোনালি রঙের। ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজ ও ডানা লালচে। চোখের ওপরে সাদা-হলদে টান। গলা ও বুক ধূসর। পেট ও লেজতল উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট দু’পাটি ভিন্ন রঙের। ওপরের অংশ কালো, নিচের ঠোঁট কমলা রঙের হলেও গোড়া শিঙকালো। চোখ বাদামি-কালো। পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি। স্ত্রী পাখির বর্ণে সামান্য তফাৎ রয়েছে। ওদের বুকে কালো রেখার উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড় বা কীট পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে-জুলাই সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে পাতা সেলাই করে। সেলাই করা বাসার ভেতর নরম তন্তু বা তুলা দিয়ে পরিপাটি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/04/2016
দেশি গাঙচষা | Indian Skimmer | Rynchops albicollis
দেশি গাঙচষা | ছবি: ইন্টারনেট এরা বিপন্ন প্রজাতির পাখি। আইইউসিএন এ প্রজাতির পাখিকে সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে’ এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত। এক সময়ে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসে এদের দেখা যেত। সম্প্রতি এতদাঞ্চলে গাঙচষা নজরেই পড়ে না। জানা যায়, সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। ‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’ উল্লেখ করেছে বিশ্বে গাঙচষা পাখির আনুমানিক সংখ্যা ৪০০০ থেকে ৬৭০০টি। তবে বাংলাদেশে এ পাখির বিচরণ রয়েছে। শীতে পদ্মা, মেঘনার চরাঞ্চলে এবং হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেল ও দমারচরে এদের দেখা মেলে। এটি নিঃসন্দেহে পাখিপ্রেমীদের জন্য একটি সুখবর। এরা ঝাঁক বেঁধে বড় নদীর মোহনার ওপর উড়ে উড়ে শিকার খোঁজে। এ পাখির বড় গুণ হচ্ছে দেহটাকে না ভিজিয়েই শিকার ধরতে পারে। পরিশ্রান্ত হলে বালুচরে বিশ্রাম নেয় এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ওভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ভোর ও গোধূলিলগ্নে শিকার ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন ওরা উড়তে উড়তে ‘ক্যাপ-ক্যাপ-ক্যাপ..’ সুরে ডাকে। এই পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি গাঙচষা’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান স্কিমার’ (Indian Skimmer), বৈজ্ঞানিক নাম: Rynchops albicollis | লম্বায় ৪০ সেন্টিমিটার (ডানা ৩৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৭.৭ সেন্টিমিটার)। ঠোঁটের আকৃতি ছুরির মতো লম্বাটে। নিচের ঠোঁটের তুলনায় ওপরের ঠোঁট সামান্য খাটো। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল। ডগা কমলা। মাথা ও ঘাড় কালো। কপাল ও গলা সাদা। কাঁধ, ডানা, লেজের উপরিভাগ কালো। প্রজনন মৌসুমে পিঠ কালচে বাদামি দেখায়। ডানার প্রান্ত সাদা। গলার নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দেশি গাঙচষা পাখি মৎস্যভুক। মাঝেমধ্যে জলজ পোকামাকড়ও শিকার করে। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত। বাসা বাঁধে নদীর আশপাশে। সাধারণত বালি খুঁড়ে এরা বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/09/2013
লাল লতিকা হট্টিটি | Red wattled Lapwing | Vanellus indicus
লাল লতিকা হট্টিটি | ছবি: ইবার্ড যেখানে বড়সড়ো জলাশয় রয়েছে, সেখানে কম-বেশি ওদের বিচরণও রয়েছে। পানিতে সম্পূর্ণ শরীরটা ডুবিয়ে শিকার খোঁজে না। বড় জোর হাঁটুসমান পানিতে নেমে শিকার খোঁজে। ফাঁকা মাঠেও দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা জ্যোসনা রাতেও খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। একা কিংবা দলবদ্ধভাবেও বিচরণ করে। দেশের সর্বত্রই এ পাখিটাকে কমবেশি দেখা যায়। আমি প্রথম দেখেছি হাসাইলে। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় পড়েছে। গিয়েছি বছর চারেক আগে। নদীভাঙন দেখতে। পদ্মার পেটে ততক্ষণে হাসাইল বাজারটা হজম পক্রিয়ার পথে রয়েছে। হাসাইলবাসীর দুঃসময়ে পদ্মার পাড়ে পাখিটিকে দেখেছি সেদিন। একটি নয় ওরা সংখ্যায় একাধিক ছিল। দেখতে সুবিধাও হয়েছে তাই। কারণ পাখিরা একাকী থাকার চেয়ে দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় বেশি সাহসী হয়। এতে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও পাওয়া যায় বেশি। পাখিটা দেখতে ভারি চমৎকার। কিন্তু কণ্ঠস্বর কর্কশ। দলের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা না হলে কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হট্টিটি..টি..টি..হট্টিট-টিট্’। স্ত্রী-পুরুষের কণ্ঠে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ কণ্ঠ একটু ভারী। কণ্ঠস্বর শুনেও স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য বোঝা যায়। পাখিটার বাংলা নাম: ‘লাল লতিকা হট্টিটি,’ ইংরেজি নাম: ‘রেড ওয়াটলড ল্যাপউইং’, (Red-wattled Lapwing) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ভ্যানেল্লাস ইন্ডিকাস’ (Vanellus indicus) গোত্রের নাম: ‘চারাড্রিআইদি’। আমাদের দেশে মোট দু’ধরনের হট্টিটি দেখা যায়। যথাক্রমে: ১. লাল লতিকা হট্টিটি, ২. হলুদ লতিকা হট্টিটি। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা। লতিকা চোখের দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গোল বৃত্তের রূপ নিয়েছে। সেটি দেখলে মনে হয় বুঝি ওরা চশমা পরে আছে। হট্টিটির গলা, বুক, মাথার তালু ও ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত লাল। চোখের পাশ থেকে ধবধবে সাদা টান ঘাড় হয়ে বুকের কিছু অংশসহ পেট ও লেজের তলা পর্যন্ত ঠেকেছে। ডানা বোজানো অবস্থায় পিঠ ও লেজের উপরি ভাগটা চকচকে বাদামির ওপর জলপাই রঙের আভা। পা বেশ লম্বা, বর্ণ হলুদ। হট্টিটি খুবই চতুর পাখি। চলাফেরায় থাকে অত্যন্ত হুঁশিয়ারি ভাব। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে বিপদ সংকেত, খুশির সংকেত, ডিমপাড়া ও বাচ্চা ফোটার সংকেত, বাচ্চা হারানোর সংকেত, বিপদ মুক্তির সংকেত। এ সুরগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কণ্ঠে তুলতে পারে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ পোকামাকড়, কেঁচো, কচি শাকসবজি ইত্যাদি । প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। মিলন শেষে মাটির অগভীর গর্তে অথবা মাঠ-প্রান্তরের নিরিবিলি স্থানে বাসা বাঁধে। বাসা দেখতে হাস্যকর। মাটির ঢেলা দিয়ে তৈরি করে। চারপাশে ছোট ছোট মাটির ঢেলা সাজিয়ে থালাকৃতির বাসা বানিয়ে মাঝখানে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। হট্টিটির বাচ্চাদের জলপান বেশ মজাদার। মা পাখিটা জলে ভেজে বাচ্চাদের কাছে এলে ওরা মায়ের ভেজা লোম চুষে জলপান করে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/09/2012
দাগযুক্ত টুনি | Zitting Cisticola | Cisticola juncidis
দাগযুক্ত টুনি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। সুলভ দর্শন। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নলখাগড়ার বন, জলাভূমির পাড়ের ঝোপঝাড়, কাশবন এবং শনক্ষেত। এ ছাড়া কৃষি জমির আশপাশের ছোট গাছগাছালি কিংবা ঝোপজঙ্গলে বিচরণ করে। পারতপক্ষে উঁচু গাছে বিচরণ করে না। মাঝারি গাছের ন্যাড়া ডাল বেশি পছন্দ। সারাদিন ঘাসবনে নেচে গেয়ে কাটায়। মায়াবী চেহারা। স্বভাবে শান্ত হলেও চঞ্চল অস্থিরমতির পাখি এরা। গানের গলা ভালো, ‘জিট..জিট..’ সুরে গান গায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষ পাখির রঙেও খানিকটা পরিবর্তন আসে। দেখতে তখন আরো মায়াবী দেখায়। এরা অনেক সময় শরীরটাকে ফুলিয়ে গাছের ডালে বসে থাকে। তখন দূর থেকে গোলাকার কদমফুলের মতো দেখায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা পর্যন্ত। দেশে এদের অবস্থান মোটামুটি ভালো। তবে বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়; হুমকিও নয়। ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘দাগযুক্ত টুনি’, ইংরেজি নাম: ‘জিটিং কিস্টিকোলা (Zitting Cisticola), বৈজ্ঞানিক নাম: Cisticola juncidis। এরা ‘ভোমরা ছোটন’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। গড় ওজন পুরুষ পাখির ৭-১২ গ্রাম। স্ত্রী পাখি ৫-৮ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। সমস্ত শরীর হলুদাভ। মাথা বাদামি। ঘাড়, পিঠ ও ডানায় গাঢ় বাদামি দাগ। লম্বা লেজের ডগা সাদাটে। দেহতল সাদাটে-হলুদাভ। প্রজনন পালক ভিন্ন। চোখ বাদামি। ঠোঁট সরু, উপরের অংশ কালচে নিচের অংশ হলদেটে বর্ণের। পা গোলাপি ত্বক বর্ণের। প্রধান খাবার: ছোট পোকামাকড়, ফড়িং, পিঁপড়া, মথ, শুককীট ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। কাপ আকৃতির বাসা। বাসা বাঁধে নরম মাকড়সার জাল, চিকন লতা, শিকড়, তন্তু ও তুলা দিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/08/2017
সাদা ভ্রু কাঠঠোকরা | White browed piculet | Sasia ochracea
সাদা ভ্রু কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট| স্থানীয় প্রজাতির দুর্লভ পাখি ‘সাদা ভ্রু কাঠঠোকরা’। দেখতে প্রজাতির অন্য সব কাঠঠোকরাদের মতো নয় এরা। আকারে ছোট হলেও চেহারা খানিকটা মায়াবী গড়নের। বাংলাদেশে দর্শন মিলে এমন মোট ২০ প্রজাতির কাঠঠোকরার মধ্যে এ প্রজাতিটিকে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম বলা হয়। আমাদের দেশে তেমন একটা বিস্তৃতি নেই। কেবলমাত্র মাঝে-মধ্যে নজরে পড়ে দেশের উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব-দক্ষিণের মিশ্র চিরসবুজ বনে অথবা পাহাড়ি বাঁশবনে। তবে স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় এলাকার বনভূমি। বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। শিকার খোঁজে বাঁশের কঞ্চি অথবা গাছের ডালপালা ঠুকরিয়ে। শিকাররত অবস্থায় আচমকায় চেঁচিয়ে ওঠে ‘চি..রররররা..’ সুরে। স্বভাবে চঞ্চল, স্থিরতা নেই খুব একটা। খাবার খুঁজে দ্রুততার সঙ্গে। প্রজননকালীন স্ত্রী পাখি ঘাড় মোচড়াতে থাকে পুরুষ পাখির সান্নিধ্য পেতে। পুরুষ পাখি ডানা ঝাপটিয়ে স্ত্রীর আবেদনে সাড়া দেয় যথারীতি। বাংলাদেশ ছাড়াও ধলাভ্রু কুটিকুড়ালির বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদা ভ্রু কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট-ব্রাউড পিকোলেট, (White-browed piculet) বৈজ্ঞানিক নাম: Sasia ochracea | এরা ‘ধলাভ্রু কুটিকুড়ালি’ এবং ‘ক্ষুদে লাল কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ৯ সেন্টিমিটার। তন্মধ্যে ঠোঁট ১.৩ সেন্টিমিটার এবং লেজ ২.৩ সেন্টিমিটার। ওজন মাত্র ১০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষ পাখির কপাল সোনালি-হলুদ। পিঠ সবুজাভ-জলপাই। লেজ কালো, খাটো। দেহের নিুাংশ লালচে। চোখের ওপরে মোটা সাদা ভ্রু, যা মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ঘাড়ের কাছে গিয়ে ঠেকেছে। চোখের বলয় গাঢ় লাল, তারা বাদামি-লালচে। ঠোঁট শক্ত মজবুত গড়নের। ঠোঁটের উপরের অংশ কালো, নিচের অংশ ফ্যাকাসে-ধূসর। ঠোঁটের গোড়ায় শক্ত পশম রয়েছে। পা ও পায়ের পাতা হলদে-বাদামি। অপরদিকে স্ত্রী পাখির কপাল লাল। চোখের বলয় ফ্যাকাসে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেহতল ধূসর। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, পিঁপড়ার ডিম ও পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। বাসা বাঁধে বাঁশ অথবা ছোট গাছে গর্ত বানিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/10/2018