লক্ষ্মীপেঁচা | Barn Owl | Tyto alba
লক্ষ্মীপেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিদের মুখাবয়ব অনেকটাই মানবশিশুর মতো। গোলাকৃতির মুখ, বড় বড় চোখ এবং চেপ্টা ঠোঁটটি মানুষের নাকের আদলে হওয়ায় এমনটি মনে হয়। একটা সময় এ পাখি আমাদের দেশে সুলভ দর্শন ছিল। বর্তমানে এদের বাসস্থান সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এরা কালেভদ্রে নজরে পড়লেও উৎসুক মানুষের কাছে নাজেহাল হয় খানিকটা। অবশ্য যারা এদের চেনেন, তারা মোটামুটি পাখিটাকে নিরাপদে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরাও মানুষকে কিছুটা নিরাপদ মনে করে। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এ পাখি। গভীর জঙ্গল এদের অপছন্দ। পুরনো দোর-দালান কিংবা গাছের কোটরে এদের বাসস্থান। নিরাপদ মনে হলে একই বাসায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। এরা নিশাচর হলেও খুব ভোরে এবং গোধূলি লগ্নে শিকারে বের হয়। কখনো মানুষের কোনো ধরনের অনিষ্ট করে না এরা; বরং কিছুটা উপকারেই আসে। ইঁদুর খেয়ে মানুষের ফসল রক্ষা করে। প্রতিদানে মানুষও এদের আগলে রাখার চেষ্টা করে। এদের মাংস ভক্ষণে অরুচি থাকায় শিকারিরাও এ পাখি শিকার করে না খুব একটা। এত কিছুর পরও ওরা আজ অস্তিত্ব সংকটে। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। খাদ্য সংকটও আরেকটি কারণ। তার ওপর রয়েছে গাছের প্রাকৃতিক কোটর স্বল্পতা এবং পুরনো দর-দালান হ্রাস পাওয়াতে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে চিরচেনা এসব পাখি সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল অচেনা হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ জেলায় অমনটি ঘটেছে। এ প্রজাতির একটি পাখি ছয়তলা ভবনে ঢুকে পড়লে ওটাকে অক্ষত অবস্থায় ধরে চিড়িয়াখানায় পাঠানোর উদ্যাগ নেয়া হয়। এ ধরনের প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায় আমাদের দেশে। এতে ওই পাখিটা নিরাপদ হতে পারলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায় ওদের পরিবারের। প্রথমত ওর জুড়ি পাখিটার আহাজারি, অবশেষে এলাকা পরিত্যাগ। দ্বিতীয়ত যদি ওই পাখির ডিম অথবা শাবক থেকে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমেয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বিরল বন্যপ্রাণী অথবা যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে ওকে চিড়িয়াখানায় না পাঠিয়ে বরং চিকিৎসা দিয়ে ওর পরিবেশেই ওকে উন্মুক্ত করে দেয়া। এ পাখির বাংলা নাম: লক্ষ্মীপেঁচা, ইংরেজি নাম: বার্ন আউল (Barn Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: টাইটো আলবা (Tyto alba), গোত্রের নাম: টাইটোনিদি। এরা লম্বায় ৩৪-৩৫ সেন্টিমিটার। এদের গোলাকৃতি মুখটি ধবধবে সাদা। ঘাড় ও ডানা হলদে-বাদামি। দেহের উপরের দিকটা সোনালি-বাদামি। গলা, পেট, বুক থেকে নিচের দিকে সামান্য চিতি। লম্বা ঠোঁটটি মাংসল সাদা। ঠোঁটের গোড়ার দিকে চেপ্টা মোমের মতো উন্মুক্ত ঝিল্লি মাংসল। চোখ গোলাকৃতির। লেজ খাটো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। লক্ষ্মীপেঁচার প্রধান খাবার ছোট সরীসৃপ, ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ইত্যাদি। জানা যায়, খাদ্য ও বাসস্থান ঠিকঠাক থাকলে বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করতে সক্ষম লক্ষ্মীপেঁচা দম্পতি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 11/01/2013
কালো পেঁচা | Brown Hawk owl | Ninox scutulata
কালো পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত ‘প্রকৃতি বার্তা’র (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়) পেঁচা নিয়ে ফিচার পাঠে জানতে পারি যে, একটি পেঁচা বছরে প্রায় ৭০০টি ইঁদুর খেতে সক্ষম। আর একটি ইঁদুর বছরে ১০ কেজি ফসল সাবাড় করতে সক্ষম। অথচ সেই উপকারী বন্ধু পেঁচাকে অলুক্ষণে বলে গালি দেই আমরা। আর ‘কালো পেঁচা’ হলে তো কথাই নেই, বেশি বেশি অলুক্ষণে বলি ওদের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরের কারণে। ওরা এক নাগাড়ে ‘কু-উক-কু-উু-কু-উক’ সুরে ডাকতে থাকলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে। মানুষের ধারণা এই বুঝি কোনো বিপদ হানা দিচ্ছে পেঁচার ডাকে। অথচ ভুল সবই ভুল! এরা আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুর্লভ দর্শনও বটে। গ্রামীণ বন-বাদাড়ের বড় গাছের পাতাল আড়ালে কিংবা বাঁশ ঝোঁপে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। সাঁঝের বেলায় বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা একাকি। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন হাক আউল’ (Brown Hawk-owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ninox scutulata| এরা ‘খয়রা শিকারে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৭-৩৩ সেন্টিমিটার। মুখ ও মাথা কালচে-বাদামি। ঘাড় লালচে-বাদামি ফোঁটা। পিঠ গাঢ় বাদামি। দেহতল লালচে-বাদামির ওপর সাদা ডোরা টান। ঠোঁট কালচে, ঠোঁটের গোড়ায় সাদা ফোঁটা। চোখের তারা হলুদ। দূর থেকে চোখের তারা নজরে পড়লে মনে হয় বুঝি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। পা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধান খাবার: ইঁদুর, সরীসৃপ, ছোট পাখি, ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে মাসখানেক। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/03/2015
নদীচিল | River Tern | Sterna aurantia
নদীচিল | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় জলচর পাখি। স্লিম গড়ন। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। এতদাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা এরা। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে কমবেশি নজরে পড়ে। বিচরণ করে উপকূলীয় অঞ্চলের বড় নদী, মোহনা কিংবা বড় বিল-ঝিলে। বেশিরভাগই দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। দেখা যায় একাকী অথবা জোড়ায়-জোড়ায়ও। বছরের যে কোনো সময় এদের সাক্ষাৎ মেলে। জলের ওপর বিক্ষিপ্ত ওড়াউড়ি করে। স্থিরতা এদের মাঝে নেই বললে চলে। শুধুমাত্র মাছের সাক্ষাৎ পেলে ঝপাৎ করে জলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিকার করা মাছ ঠোঁটের ফাঁকে রেখে উড়তে থাকে। স্বভাবে চঞ্চল হলেও হিংস্র নয়। পারতপক্ষে খুব একটা হাঁকডাক করে না। ওড়ার সময় সামান্য আওয়াজ করে। এছাড়া ভয় পেলে মধুর কণ্ঠে ‘ক্রিয়াক… ক্রিয়াক…’ সুরে ডেকে ওঠে। পাখির বাংলা নাম: ‘নদীচিল’, ইংরেজি নাম: ‘রিভার টার্ন’, (River tern) বৈজ্ঞানিক নাম: Sterna aurantia| এরা ‘নদীয়া পানচিল’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৩৮-৪৩ সেন্টিমিটার। শীতে রং বদলায়। এ সময় মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত কালচে ফুটকির সঙ্গে সরু টান থাকে। গ্রীষ্মে কপাল, ঘাড় কালো দেখায়। দেহের উপরি ভাগ মলিন ধূসর। ডানা সুচালো। লেজ লম্বা, কাস্তের মতো বাঁকানো। লেজের উপরি অংশ কালচে ধূসর। দেহতল সাদাটে। ঠোঁট লম্বাটে হলুদ। পা খাটো, লাল। পায়ের পাতা হাঁসের পায়ের মতো জোড়া লাগোনো। প্রধান খাবার: মাছ। পচাগলা খাবারের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। বাসা বাঁধে নদীর কিনারে অথবা দ্বীপাঞ্চলে। বিশেষ করে নির্জন বালুবেলার ওপর খোদল করে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/12/2014
ছোট নাটাবটের | Kurrichane Buttonquail | Turnix sylvatica
ছোট নাটাবটের | ছবি: ইন্টারনেট দেখতে হুবহু গৃহপালিত কোয়েল পাখির মতো। এরা আমাদের দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। এক সময়ে ঢাকার আশপাশের গ্রামের তৃণভূমিতে বিচরণ ছিল। হালে বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার রেকর্ড নেই। তবে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত। এ ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের কিছু কিছু জায়গায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। এরা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। মূলত ‘ছোট নাটাবটের’ খাদ্যের সন্ধানে তৃণভূমির আশপাশের ঝোপে ঘুরে বেড়ায়। ছোটাছুটি করে ঝোপের ফাঁকফোকরে। একাকী কিংবা জোড়ায় বিচরণ করে। ঝরাপাতা উল্টিয়ে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। আবার তৃণভূমিতে ঘুরে শস্যদানা কিংবা ঘাসের বীজ খায়। এরা স্বভাবে কিছুটা হিংসুটে। নিজেদের এলাকায় স্বগোত্রীয়দের অনুপ্রবেশ সহজে মেনে নেয় না। ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনে যুদ্ধংদেহী রূপ ধারণ করলেও সহজে আক্রমণ করে না। অর্থাৎ যে করেই হোক অনুপ্রবেশকারীকে তাড়ানো চাই-ই চাই। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির মাঝে অস্থিরতা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় হাঁকডাকও। এ সময় ‘ডররর-র-র-র-র..’ সুরে ডাকতে থাকে। মজার বিষয়টি হচ্ছে, স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে কেটে পড়ে। পুরুষ পাখিকে তখন একাই ডিমে তা দিতে হয়। বাচ্চা ফুটিয়ে লালন-পালনও করতে হয় পুরুষ পাখিকে একাই। পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট নাটাবটের’, ইংরেজি নাম: ‘ক্যারিচেন বাটন কোয়েল’ (Kurrichane Buttonquail),বৈজ্ঞানিক নাম: Turnix sylvatica | লম্বায় ১৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৪০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। আকারে স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। উভয়ের মাথার চাঁদি বাদামি। ঘাড়, মরচে রঙা। পিঠ লালচে কালো। কাঁধ-ঢাকনিতে পীতাভ ডোরা। গলা সাদা। বুক কমলা-পীতাভ। লেজতল-ঢাকনি সাদাটে। ঠোঁট ফ্যাকাসে। চোখ হালকা হলুদ। পা ও পায়ের পাতা ধূসর নীল। অপ্রাপ্তবয়স্কদের পিঠ লালচে-বাদামি। দেহতল ফ্যাকাসে পীতাভ। ঘাড়ের পাশে ও বুকে কালো চিতি রয়েছে। প্রধান খাবার: শস্যদানা, ঘাস বীজ, কালো পিঁপড়া ও পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম বছরের যে কোনো সময়। নিজেরা পা দিয়ে মাটি খুঁড়ে ঘাস-লতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪টি। ডিম ফুটতে সময় ১২ দিন। শাবকের গায়ে ওড়ার পালক গজায় দুই সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/02/2015
জলপিপি | Bronze Winged Jacana | Metopidius indicus
জলপিপি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির পাখি। সুলভ দর্শন। এক সময় গ্রামের দিঘি কিংবা বিল-ঝিলে এদের প্রচুর দেখা যেত। শিকারিদের অত্যাচারে গ্রামীণ জনপদ থেকে বিতাড়িত হয়ে এরা এখন হাওর-বাঁওড়ে আশ্রয় নিয়েছে। জানা যায়, সত্তর দশকেও ঢাকার চারপাশের জলাশয়ে এদের প্রচুর বিচরণ ছিল। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার জলাশয়ে ছোট ছোট দলে দেখা যায়। ডাহুকের মতো গড়ন হলেও বেশ পার্থক্য রয়েছে চেহারায়। পা তুলনামূলক লম্বা, পায়ের আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা। অনেকটা মাকড়সার পায়ের মতো দেখায়। যার ফলে এরা জলাশয়ের ভাসমান পাতার ওপর ভর দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়াতে পারে, যা অন্য প্রজাতির জলচর পাখির পক্ষে সম্ভব নয়। সে তুলনায় খুব বেশি উড়তে পারে না। ওড়ার সময় পা ঝুলিয়ে এবং গলা সামনে বাড়িয়ে ওড়ে। বেশিরভাগ জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। মিলন ঋতুতে ডাকাডাকি করে বেশি। প্রহরে প্রহরে ‘পি-পি-পি-পি-পি-’ সুরে ডেকে ওঠে। তাই এদের নামকরণের শেষ অক্ষরের সঙ্গে নিজস্ব সুরের ‘পি-পি’ শব্দটি যোগ হয়েছে। অনেক সময় ‘সিইক-সিইক’ সুরেও ডাকে। ডাহুকের মতো এদের সুরে তাল-লয় নেই। খানিকটা কর্কশ। পাখিটা দেশে অধিক পরিচিত নয়, যেমনটি ডাহুক। স্থানীয় লোকের কাছে ‘পিপি’ পাখি নামে পরিচিত এরা। পাখির বাংলা নাম: ‘জলপিপি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রোঞ্জ উইংড জাকানা’ (Bronze Winged Jacana), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মেটোপিডিয়াস ইন্ডিকাস’ (Metopidius indicus), গোত্রের নাম: ‘জাকানিদি’। এরা ‘দলপিপি’ নামেও পরিচিত। লম্বায় পুরুষ পাখি ২৯ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৩২ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড়, গলা, বুক উজ্জ্বল নীলাভ-কালো। চোখের ওপরের দিক থেকে চওড়া টান ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ এবং ডানা সবুজাভ-ব্রোঞ্জ। ওড়ার পালক কালচে-বাদামি। লেজ খাটো, পাটকিলে লাল। ঠোঁট সবুজাভ-হলুদ। ঠোঁটের গোড়ায় সামান্য লাল ছোপের সঙ্গে সিসে-লাল বর্মদ্বারা আচ্ছাদিত, যা কপাল পর্যন্ত ঠেকেছে। লম্বা পা, ময়লা-সবুজ বর্ণ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও ঘাসবীজ, জলজ উদ্ভিদের কচিপাতা খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় জুন থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ওপর পানা বা ঘাসপাতা দিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/10/2013
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
ক্ষুদে কাঠঠোকরা | Speckled Piculet | Picumnus innominatus
ক্ষুদে কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও দুর্লভ দর্শন ‘ক্ষুদে কাঠঠোকরা’। চেহারা অনেকটাই ‘ছোট বসন্ত বউরি’ পাখিদের মতো। পাখি পর্যবেক্ষক ব্যতীত প্রথম দর্শনে যে কেউই বসন্ত বউরি বলে ভুল করেন তাই। এরা অনেকটাই কুঁজো ধাঁচের, নাদুসনুদুস চেহারার অধিকারী। দেখা মেলে প্যারাবন, অর্ধ-চিরসবুজ বন, আর্দ্র পাতাঝরা বন কিংবা বাঁশঝাড়ে। তবে দেশে যত্রতত্র দেখা যায় না। কেবল কালেভদ্রে দেখা মেলে সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে এবং খুলনা বিভাগের প্যারাবনে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। বাংলাদেশ ছাড়াও দেখা মেলে ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও চীনে। বেশিরভাগই এরা একাকী বিচরণ করে। মাঝেমধ্যে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। বিচরণকালীন গাছের চিকন ডালের চারপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে, আর তীক্ষè কণ্ঠে ‘স্পিট..স্পিট..’ সুরে ডাকে। ক্ষুদে কাঠঠোকরা বৃক্ষচারী পাখি, প্রয়োজন ব্যতিরেকে ভূমি স্পর্শ করে না। পাখির বাংলা নাম: ‘ক্ষুদে কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘স্পেকলেড পিকুলেট’ (Speckled Piculet), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘Picumnus innominatus’। এরা ‘তিলা কুটিকুড়ালি’ নামেও পরিচিত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মোট ২০ প্রজাতির কাঠঠোকরার দেখা মেলে। প্রজাতিটি লম্বায় ১০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির কপাল অনুজ্জ্বল কমলা, মাথার চাঁদি হলুদ-জলপাই। স্ত্রী পাখির চাঁদি হলুদ-জলপাই। এ ছাড়া উভয়ের পিঠ হলদে-সবুজ। ডানার নিচে ছোট ছোট দাগ, পেছনে দিকে খাড়া চিতি যা ডোরার মতো দেখায়। দেহের নিচের দিকটা সাদাটের ওপর বড় বড় কালো ডোরা দাগ। লেজ কালো, বাইরের পালক সাদা। চোখের উপরে নিচে দুটি মোটা সাদা দাগ, যা ঘাড় হয়ে পিঠে গিয়ে ঠেকেছে। সাদা দুই দাগের মধ্যখানের দাগটি জলপাই রঙের। চোখ লালচে-বাদামি। ক্ষুদ্রাকৃতির ঠোঁটটি (১.১ সেন্টিমিটার) সেøট কালো। পা ও পায়ের পাতা অনুজ্জ্বল ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, লার্ভা ও পিউপা। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। বাসা বাঁধে গাছের খোড়লে। নিজেরাই গাছের মরা ডালে গর্ত বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১১-১২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/07/2014