তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
বড় চিত্রা ঈগল | Greater Spotted Eagle | Aquila clanga
বড় চিত্রা ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট শিকারি পাখি। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, উত্তর-পূর্ব চীন, দক্ষিণ চীন, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত। স্বভাবে হিংস । অন্য সব ঈগলদের মতোই শিকার খোঁজে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে উঠতে সক্ষম এরা। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় চিত্রা ঈগল’| ইংরেজি নাম: ‘গ্রেটার স্পটেড ঈগল’ (Greater Spotted Eagle)| বৈজ্ঞানিক নাম: Aquila clanga| এরা ‘বড় গুটি ঈগল’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৫৯-৭১ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ১৫৭-১৭৯ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ পাখি ১.৬-২.৫ কেজি। মাথা বাদামি। ঘাড় ও পিঠ গাঢ় বাদামি। পিঠ এবং ডানায় বাদামি সাদা গুটি বা চিত্রা। লেজ কালচে বাদামি। বুক ও পেট গাঢ় বাদামি। চোখ বাদামি। ঠোঁট শিং কালো শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া এবং মুখের কিনার হলদে। পা সাদা-বাদামি পালকে আবৃত। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, ইঁদুর, সরীসৃপ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ছোট পাখি। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। ডালপালা দিয়ে বড়সড়ো অগোছালো বাসা বানায়। এক বাসায় বহু বছর যাবত ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৪০-৪৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৫৫-৬৫ দিন। প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৪-৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/03/2018
বড় বনলাটোরা | Large Woodshrike | Tephrodornis gularis
বড় বনলাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট মিশ্র পর্ণমোচী বন, বন প্রান্তর এবং চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা। স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বড় বনলাটোরার বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। দূরদর্শনে ‘পাতি বনলাটোরা’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। চেহারায়ও খুব একটা ভিন্নতা নেই। শুধু আকারে একটু বড় এরা। প্রজাতির কারোই আহামরি রূপ নেই। তবে চেহারাটা মায়াবি ধাঁচের। বিশেষ করে ওদের কাজল কালো চোখ পাখি প্রেমীদের মায়া জাগিয়ে তোলে। প্রজাতির দেখা মেলে শুষ্ক বন-বনানী কিংবা ঘন পাতার গাছগাছালির ডালে। ভাওয়াল শালবনে বেশি দেখা মেলে। স্বভাবে শান্ত। কিছুটা লাজুকও। উঁচু গাছের ঘন পাতার আড়ালে বিচরণ করে। শিকারে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। পতঙ্গভুক অন্যান্য পাখির সঙ্গেও শিকারে বের হয়। মাটিতে নেমেও শিকার খোঁজে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি সুর করে গান গায়। সুর শুনতে মন্দ নয়। উভয় প্রজাতিই কিছুটা বোকা কিছিমের। স্ত্রী পাখি যখন ডিমে তা দেয় ঠিক তখনই পুরুষ পাখি মনের আনন্দে সামান্য দূরের গাছের ডালে বসে গান গাইতে থাকে। ফলে চতুর শিকারি পাখিরা বুঝে যায় ওদের বাসার অবস্থান। এবার অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। একটি ভালো খবর দিতে চাই আপনাদের। পত্রিকায় প্রকাশিত পাখি নিয়ে আমার লেখাগুলো যারা এক সঙ্গে পেতে চান তারা https://pakhi.tottho.com ঠিকানায় ক্লিক করতে পারেন। এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন বগুড়া জেলার একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হাবিবুর রহমান। ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাকে, পাখি সংক্রান্ত সব ক’টি লেখা একত্রিত করার জন্য। এ পাখির বাংলা নাম: ‘বড় বনলাটোরা’, ইংরেজি নাম: ‘লার্জ উডশ্রাইক’ (Large Woodshrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Tephrodornis gularis| এরা ‘বড় সুধুকা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১৮-২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮-৪৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। উভয়েরই কাজল কালো চোখ। চোখের দু’প্রান্তে চওয়া কালো টান। মাথা নীল কালো। ঘাড় ও পিঠ কালচে-ছাই রঙের। ডানার প্রান্ত কালচে-বাদামি। লেজ গাঢ় খয়েরি। লেজের মধ্যখানের পালক দুটোতে ছাই রঙের ছোপ, বাইরের পালক ময়লা সাদা। গলার নিচে থেকে বুক পর্যন্ত ছাই রঙ। বুকের নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত সাদাটে। ঠোঁট সে্লট কালো। পা সিসে-কালো। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে পঙ্গপাল, ফড়িং ও ঝিঁঝিঁ পোকার প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময়ের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। বাসা বাঁধে গাছের উঁচুতে তে-ডালের ফাঁকে। ঘাস, লতাপাতা, শিকড় ও মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/11/2015
কালোমাথা টিয়া | Grey headed parakeet | Psittacula finschii
কালোমাথা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) উপজেলার শায়েস্তানগর গ্রামে। প্রয়াত স্কুল মাস্টার বড় মামার তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া করতাম। মামাতো ভাই নূরুল আলম লিটন আর আমি ছিলাম অনেকটাই মানিকজোড়ের মতো। স্কুল থেকে ফিরে দুজন টই-টই করে ঘুরে বেড়াতাম গ্রামের আনাছে-কানাছে। ঘুড়ি-নাটাই, পাখির বাসা এসব করে করে দিন কাটিয়ে দিতাম। একদিন পাখির বাসা খুঁজতে গিয়ে গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকালে গাছের কোটরে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর চেঁচিয়ে উঠলাম ডান হাতের তর্জনীর মাথা হারিয়ে। সেই স্মৃতি আজও বহন করছি আমি। পাখিটি ছিল টিয়া প্রজাতির। এরা সহজেই সরু তার কেটে ফেলতে পারে ওদের ধারালো ও শক্ত ঠোঁটের কামড়ে। তখন প্রজাতির নাম জানা ছিল না। ‘টিয়া’ নামেই চিনতাম। ওরা এখন অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে। অথচ ওরা দেশের আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। নজরকাড়া রূপ। শাল এবং মিশ্র-চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এক সময় লোকালয়ে কম-বেশি দেখা যেত, হালে তেমন একটা দেখা যায় না। এরা একাকী কিংবা ছোট-বড় দলে বিচরণ করে। বিশ্বে প্রায় ১৬ লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এদের আবাস হলেও বাংলাদেশে অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও লাওস পর্যন্ত। এ পাখির বাংলা নাম: ‘কালোমাথা টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-হেডেড প্যারাকিট’, (Grey-headed parakeet), বৈজ্ঞানিক নাম: Psittacula finschii | এরা ‘মেটেমাথা টিয়া’ নামেও পরিচিত। পুরুষ পাখি লম্বায় ৩৬ সেন্টিমিটার, লেজ ২৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী পাখি লম্বায় লেজসহ ২২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। তবে উভয় পাখির মাথা কালচে বা স্নেট কালো। মাথায় গাঢ় ধূসর অংশকে ঘিরে কালো দাগ। মাথার পেছনটায় নীলচে-সবুজ। পিঠ গাঢ় সবুজ। লেজ সবুজাভ হলুদ। মোটা লেজের পালক অর্ধেকটাই হলদেটে। দেহতল হালকা সবুজ। ঠোঁটের উপরের অংশ লাল, ডগা হলদেটে। নিচের অংশ হলদেটে। চোখের তারা হলুদ। পা কালচে। পুরুষ পাখির ডানার উপর খয়েরি-লাল বর্ণের পট্টি রয়েছে, যা স্ত্রী পাখির নেই। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির লেজ স্ত্রী পাখির তুলনায় লম্বা। প্রধান খাবার: ছোট ফল, শস্যবীজ, ফুলের মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ-এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২২ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৪০-৪৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/10/2018
ডোরাকাটা ছোট বুনো ছাতারে | Striated Yuhina | Yuhina castaniceps
ডোরাকাটা ছোট বুনো ছাতারে | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। দেখতে খানিকটা বুলবুলি পাখির মতো। চটপটেও সেরকম। আমুদে পাখি বলতে যা বোঝায়, তাই এরা। সোজা কথা স্বভাবে ভারি চঞ্চল। প্রাকৃতিক আবাসস্থল চিরহরিৎ বনের ঝোপজঙ্গলে। লোকালয়ে খুব একটা দেখা যায় না। চিরহরিৎ বনের মাঝারি আকৃতির পরিচ্ছন্ন গাছ-গাছালির ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। এ ছাড়াও ফুল লেগেছে এমন গাছের উঁচু শাখে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। গাছের ডালের বাকল ঠুকরিয়ে পোকামাকড় শিকার করে। এরা বেশিরভাগই বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। ছোট-বড় দলেও দেখা যায়। দলের সবাই মিলে ফূর্তি করে। গোসলও করে বেশ আমুদ করে। কণ্ঠস্বর তীক্ষè হলেও সুমধুর। দুই ধরনের কণ্ঠস্বরে ডাকতে পারে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান মোটামুটি সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘ডোরাকাটা ছোট বুনো ছাতারে’| ইংরেজি নাম: ‘স্টিরিয়েটেড উহিনা’ (Striated Yuhina)| বৈজ্ঞানিক নাম: Yuhina castaniceps| এরা ‘দাগি উহিনা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির দৈর্ঘ্য ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ১০-১৭ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথায় ধূসর ঝুঁটি। মাথা লালচে বাদামীর সঙ্গে সাদা ছিট। পিঠ বাদামী। লেজ ও ডানার প্রান্ত পালক গাঢ় বাদামী। দেহতল সাদা। ঠোঁট বাদামী। চোখের মণি কালচে বাদামী। পা হলদেটে। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ছোট ফল, ফুলের মধু, ঘাস বীজ । প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা, তন্তু, ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী vবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/03/2018
পাতি পাপিয়া | Common Cuckoo | Cuculus canorus
পাতি পাপিয়া | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। শুধুমাত্র গ্রীষ্মে পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশে। মাঝে মধ্যে শরৎ এবং বসন্তকালে দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। সমগ্র দেশে দেখা না গেলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। সাধারণত এরা চিরসবুজ বন অথবা আর্দ্র পাতাঝরা বনে বিচরণ করে। এছাড়াও পর্বতের পাদদেশে তৃণভূমিতে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। বনের গাছ-গাছালির উঁচু ডালে নিজেদের আড়াল করে রাখে। বেশিরভাগ সময় একাকী বিচরণ করে। ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে কর্মচঞ্চলতা বেড়ে যায়। স্বভাবে কিছুটা লাজুক। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে ‘কুক-কু…কুক-কু..’ সুরে ডাকতে থাকে। স্ত্রী পাখি ডাকে সাড়া দেয় ‘হুয়িহুয়িহুয়ি..’ সুরে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত (সমস্ত ভারতে বিচরণ রয়েছে) এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ পর্যন্ত। বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশে এদের অবস্থান মোটেও সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি পাপিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘কমন কুক্কু’ (Common Cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Cuculus canorus | এরা ‘গায়ক কোকিল’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির দৈর্ঘ্য কম বেশি ৩৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৯০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির থুতনি, গলা ফ্যাকাশে ছাই রঙের। পিঠ ধূসর। বুক ফ্যাকাশে ছাই। পেট সাদা। লেজের নিচের কোর্ভাটের ওপর কালো সরু ডোরা। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের প্রান্ত পালক সাদা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা দু’ধরনের। একটি কলিজা রঙের। পিঠ কালচে-বাদামি ডোরা এবং দেহতল কালচে ডোরা। অন্যটির চেহারায় ধূসর, বুকের নিচে লালচে। এছাড়া পুরুষ পাখির সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের ঠোঁটের গোড়া হলদে এবং ডগা শিং-বাদামি। চোখ হলুদ। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঘাড়ের পেছন দিকে সাদা চিতি এবং পালকে সাদা পাড়। প্রধান খাবার: লোমশ শুঁয়োপোকা ও অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। হিমালয় ও সাইবেরিয়াঞ্চলে ডিম পাড়ে। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। ডিম পাড়ে তুলিকা, খঞ্জন, জাড়ফিদ্দা ও চটকের বাসায়। পালক মাতাদের অগোচরে মিনিট খানেকের মধ্যেই ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এরা খুব সহজে পালক মাতার ডিমের সঙ্গে নিজেদের ডিমের রঙ মিলিয়ে পাড়তে পারে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/05/2015
কালো লেজ জৌরালি | Black Tailed Godwit | Limosa limosa
কালো লেজ জৌরালি | ছবি: ইন্টারনেট পাখি প্রথম দর্শন ঘটে মেঘনায় নৌবিহারকালে। নদীর কিনারে কাদামিশ্রিত এলাকায় শিকার খুঁজছে অনেক পাখি দলবদ্ধ হয়ে। কেউ পায়চারি করছে আপন মনে, কেউ গলা উঁচিয়ে দেখছে আগন্তুকদের হাবভাব। এসবই কিন্তু দেখা হচ্ছে দূর থেকে বাইনোকুলারে চোখ রেখে। স্বল্প সময়ের পর্যবেক্ষণেই ওদের জাত নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছি। পূর্বের ধারণাটা কাজে লাগিয়েছি সেই দিন, ফলে সহজ হয়ে গেছে এদের পরিচিতি লাভ। এ পাখি একটা সময়ে প্রচুর দেখা যেত আমাদের দেশে। খুব বেশি এখন আর নজরে পড়ছে না। স্বভাবে পরিযায়ী এরা। উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের দেশে চলে আসে। আশ্রয় নেয় জোয়ার-ভাটা হয় এমন নদ-নদীর কিনারে। বিচরণ করে ছোট কিংবা বড় দলেও। শিকারের জন্য বেছে নেয় কাদামাটি এলাকা এবং বালুকারাশিতে খুঁজে বেড়ায় ভূমিজ কীট। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো লেজ জৌরালি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্লাক টেইল্ড গডউইট’ (Black Tailed Godwit), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লিমোসা লিমোসা’ (Limosa limosa), গোত্রের নাম: ‘স্কোলোপাসিদি’। লম্বায় পুরুষ পাখি ৪১ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫০ সেন্টিমিটার (১০ সেন্টিমিটার লম্বা ঠোঁটসহ)। ঠোঁটের গোড়া লালচে, ডগা কালচে। মাথা, ঘাড়, বুক লালচে-বাদামি। পিঠ কালচে-বাদামি ফোঁটাযুক্ত। ডানার ওপরে রয়েছে সাদা মোটা ডোরা যা উড়লে নজরে পড়ে। ডানার নিচের অংশ বেশিরভাগই সাদা। বুকের কাছ থেকে লেজের নিচ পর্যন্ত সাদা। লেজ খাটো, কালো। পা লম্বা, ধূসর-সবুজাভ। চোখের বলয় হলদেটে। ভ্রƒ সাদাটে। প্রজননের সময় রঙ বদলায়। এই সময় মাথা থেকে বুক লালচে এবং পেটের সাদা অংশ কালচে দেখায়। কালো লেজ জৌরালির প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদের বীজ এবং ভূমিজ কীটও খায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। নিজ বাসভূমিতে ফিরে বাসা বাঁধে। মাটির খোড়লে ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিম ফোটতে সময় লাগে ২২-২৪ দিন। শাবক উড়তে শেখে ২৫-৩০ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/05/2013