ক্ষুদে ঘুঘু | Little brown dove | Streptopelia senegalensis
ক্ষুদে ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার নজির নেই। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে মাত্র দুই-তিনবার দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। ফলে এরা স্থানীয় নাকি পরিযায়ী প্রজাতির তা নিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা যায়নি। বলা যায় অতি বিরল দর্শন ‘ক্ষুদে ঘুঘু’। দেখতে অনেকটাই তিলা ঘুঘুর মতো। কণ্ঠস্বরও সেরকম। সুরে মাদকতা রয়েছে। বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। চেহারা কবুতর আদলের। দেখতে মায়াবী। স্বভাবে শান্ত। পারতপক্ষে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয় না। বিচরণ করে মাঠে-ঘাটে। তবে সেটি অবশ্য শুষ্ক শস্যভূমি হতে হবে। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে এলাকা এদের একদম অপছন্দ। জলপান ব্যতিরেকে জলাশয়ের কাছে ঘেঁষে না। গোসল করে নিয়মিত। তবে গায়ে জলের পরিবর্তে ধূলি ছিটিয়ে গোসল করে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। তখন ‘কুকু..ক্রো..ক্রো..’ সুরে ডেকে স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়া এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি পূর্ব ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইসরাইল, লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব অমিরাত, সৌদি আরব, ইরান পর্যন্ত। আফ্রিকা অঞ্চলেও দেখা যায়। তুলনামূলক এদের আবাসস্থল কিছুটা মরুময় এলাকায়। পাখির বাংলা নাম: ‘ক্ষুদে ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল ব্রাউন ডাভ’ (Little brown dove), বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia senegalensis | ইংরেজিতে এরা খধঁমযরহম উড়াব নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৬-২৭ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় গোলাপি-বাদামি। পিঠ বালু মিশ্রিত বাদামি বর্ণ। লেজের বাইরের পালক সাদা। লেজের গোড়া ও কাঁধের পালক ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালো। ওড়ার পালক কালো। বুক গোলাপি-বাদামি। পেট বালু মিশ্রিত বাদামি। চোখ বাদামি কালো। ঠোঁট শিং কালো। পা গোলাপি লাল। নখর কালো। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসের কচি ডগা ও মাটি। মাঝেমধ্যে উইপোকা খেতে যায়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। গাছের তেডালে অথবা দালানের ফাঁকে খড়কুটা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। শাবক সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে উড়তে শেখে। লেখক: আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/07/2015
চন্দনা টিয়া | Alexandrine parakeet | Psittacula eupatria
চন্দনা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি ‘চন্দনা টিয়া’। দেখতে ভারি সুন্দর। স্লিম গড়ন। তোতা পরিবারের মধ্যে এ পাখিগুলোই বেশি আকর্ষণীয়। দেহের তুলনায় এদের লেজ অনেকটাই লম্বা। বিচরণ করে শুষ্ক ও আর্দ্র পাতাঝরা বনাঞ্চলে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যেও দেখা যায়। বিশেষ করে ফল এবং বীজজাতীয় শস্য খেতের আশপাশে বেশি নজরে পড়ে। ঝাঁকবেঁধে শস্য খেতে বিচরণ করার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে এরা। যা খায় তারচেয়ে বেশি অপচয় করে। কৃষকদের সঙ্গে এদের বৈরিতার কারণ ফসল নষ্ট করা নিয়ে। মাঝে মধ্যে এদের একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করতে দেখা যায়। কণ্ঠস্বর কর্কশ। ‘ক্রি-অ্যার’ সুরে ডাকে। কয়েক দশক আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ প্রজাতিটির সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও ইদানীং যত্রতত্র নজরে পড়ে না। খাঁচায় বন্দি এবং উঁচু গাছ-গাছালির সংকটের কারণে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে প্রজাতিটি দেশে মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার পর্যন্ত। অত্রাঞ্চলে এই পাখিগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নামঃ ‘চন্দনা টিয়া’, ইংরেজি নামঃ ‘অ্যালেক্সএনড্রিন প্যারাকিট’ (Alexandrine Parakeet) বৈজ্ঞানিক নামঃ Psittacula eupatria | অনেকে ভুল করে এদেরকে ‘সবুজ টিয়া’ নামেও ডাকে। প্রজাতির দৈর্ঘ্য ৫৬-৬২ সেন্টিমিটার। লেজ ২৯-৩২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখি আকারে কিছুটা লম্বা। তাছাড়া পুরুষ পাখির গলার পেছনে এবং ঘাড়ের পাশে রয়েছে গোলাপি বলয়। থুতনির কালো রেখা গলাবন্ধের সঙ্গে মিশেছে। সব দেহ ঘাস-সবুজ রঙের। কেবল ডানার মধ্য পালকে রয়েছে লালপট্টি। স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে গলার পেছনের গোলাপি বলয় নজরে পড়ে না। থুতনির কালো রেখার উপস্থিতি নেই। যুবক চন্দনার ক্ষেত্রেও এ রকমটি নজরে পড়ে। উভয়ের ঠোঁট গাঢ় লাল। ঠোঁটের ডগা কমলা-লাল। চোখের পাতা কমলা-হলুদ, বলয় নীল। প্রধান খাবারঃ ফল, ধান, গম, ভুট্টা, ফুলের রস, গাছের কচি পাতা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। তবে প্রথম পছন্দ নারিকেল গাছের কোটর। এ ছাড়াও কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা দুই-চারটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২৪ দিন। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
দেশি রাতচরা | Indian Nightjar | Caprimulgus asiaticus
দেশি রাতচরা | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। গ্রামগঞ্জে বাস। বিশেষ করে হালকা ঝোপজঙ্গল কিংবা বাঁশবনে এদের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। প্রজনন মৌসুম ছাড়া বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে। দিনে ঘুমিয়ে কাটায়। সূর্যাস্তের খানিকটা পরেই ঝোপজঙ্গলের ভেতর থেকে ‘চউঙ্ক-চউঙ্ক-চউঙ্ক’ সুরে ডাকতে থাকে। কণ্ঠস্বর সুমধুর না হলেও সুরে তাল-লয় রয়েছে। রাত বাড়লে ডাকাডাকি বন্ধ। দেখতে মোটেও আকর্ষণীয় নয়। শারীরিক গড়নটাও একটু ব্যতিক্রম। গায়ের বর্ণ অনেকটাই গাছের মরা ডাল বা শুকনো পাতার মতো। গাছের ডালে বসলে খুব সহজে পাখি হিসেবে শনাক্ত করা যায় না। অপরদিকে মাটিতে বসে থাকলে শুকনো পাতার মতোই মনে হতে পারে। মাড়িয়ে গেলেও টের পাওয়া যায় না যে, এরা পাতা নাকি পাখি! বর্ণচোরা বিধায় নিরাপদে থাকার খানিকটা সুযোগ পায় ওরা। প্রজাতিটি এক সময় সুলভ দর্শন ছিল। হালে অসুলভ হয়ে উঠছে। প্রধান কারণই হচ্ছে আবাস সংকট। গ্রামে আগের মতো ঝোপজঙ্গলও নেই, নেই বাঁশঝাড়ও। যাতে করে প্রজাতিটি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বেও এরা ভালো নেই। ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া উত্তর-পশ্চিম ভারত, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান, হিমালয়ের দক্ষিণাংশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। পাখির নাম: ‘দেশি রাতচরা’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান নাইটজার’ (Indian Nightjar), বৈজ্ঞানিক নাম: Caprimulgus asiaticus | দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির ‘রাতচরা’ পাখির দেখা মেলে। রাতচরা লম্বায় ২১-২৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৪০-৪৬ গ্রাম। গায়ের উপরের রঙ কালচে-বাদামি মিশ্রিত ছিট। চোখের পাশ থেকে চিবুক পর্যন্ত অল্পস্বল্প খাড়া লোম। লেজ ও ডানা সামান্য লম্বা। বুক থেকে পেট পর্যন্ত রয়েছে আড়াআড়ি ডোরা দাগ। গলায় হালকা ক্রিমসাদা বন্ধনী। লেজের তলার পালক ফিকে রঙের। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রধান খাবার: ঝিঁঝি পোকা, ফড়িং, গুবরে পোকা ও উড়ন্ত কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে নিশাচর কীটপতঙ্গ শিকার করে বেশি। প্রজনন সময় জুন থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে সরাসরি মাটির ওপরে। শুকনো পাতা জড়ো করে তার ওপরে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/10/2015
ধুসরাভ মেঠো চিল | Montagu’s Harrier | Circus pygargus
ধুসরাভ মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট শীত মৌসুমে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে পরিযায়ী হয়ে আসে। নরওয়ে, গ্রেট ব্রিটেন, পর্তুগাল, রাশিয়া, (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) বেলারুশ, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। দেখতে ভয়ঙ্কর দর্শন হলেও মূলত এরা তত হিংস্র নয়। প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। প্রাকৃতিক আবাসস্থল কাঁটাওয়ালা চিরহরিৎ গুল্ম। বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উন্মুক্ত বনভূমি, বালিয়াড়ি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ। ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতায়ও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক (ডিটিটি) ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ধুসরাভ মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘মন্টেগুয়াস হ্যারিয়ার’ (Montagu’s Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus pygargus | এরা ‘মন্টেগুর কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪৩-৪৭ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৭-১১৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড়। গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ২৬৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৩৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড় ও পিঠ সুরমা ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালচে। লেজ কালচে ধূসর। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক হলদে বাদামি। দেহতল গাঢ় বাদামি। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, ছোট পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ঝোঁপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৪০ দিন। শাবক শাবলম্বী ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ২-৩ বছর। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/01/2017
গগনবেড় | Great white pelican | Pelecanus onocrotalus
গগনবেড় | ছবি: ইন্টারনেট দেশে খুব কমই দেখা মেলে এ পাখির। বলা যায় অতিবিরল প্রজাতির বৃহৎ জলচর পাখি এরা। সুন্দরবনসহ দেশের বিভিন্ন নদনদীতে তিনযুগ আগেও দেখা যেত। হালে খুব একটা দেখা যায় না। নব্বই দশকের শেষাবধি ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকে মাত্র ৩টি পাখির দেখা মিলেছে। ওখানে মাসখানেক কাটিয়েছে ওরা। বিদায় হয়ে আর ঢাকামুখী হয়নি পাখিগুলো। অতঃপর দেখা গেছে ২০০০ সালের দিকে দিনাজপুরের কাহারোল বিলে। সেখানে সংখ্যায় ছিল মাত্র একটি। স্থানীয় লোকজন পাখিটিকে ধরে রামসাগর দীঘির অভয়ারণ্যে নিরাপদে রাখলেও কিছুদিন পর সেটি মারা যায়। এতদাঞ্চলে এ প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পাওয়ার আর রেকর্ড নেই। বছর আটেক আগে পরিচিত একজন পর্যটক জানিয়েছেন, তিনি নাকি দুটি পাখি সুন্দরবনের শাখা নদীতে বিচরণরত দেখেছেন। ওদের সন্ধানে সেখানে গেলে নিরাশ হয়ে ফিরে আসি আমরা। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবন গিয়ে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েও আমরা সফল হয়নি। তবে এদের সাক্ষাৎ আমি সুন্দরবনে না পেলেও পেয়েছি ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকেই। পাখিগুলো দেখে সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। দেখতে ভারি সুন্দর, আকারেও বৃহৎ। শরীরের মাংসের আধিক্যের কারণে বেঁচে থাকতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত মাংসের লোভেই শিকারিরা এদের শিকার করে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া জলাশয় সংকটের কারণেও এরা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সুুন্দর এ পাখিদের বাংলা নামঃ গগনবেড় , ইংরেজি নামঃ গ্রেট হোয়াইট পেলিক্যান (Great white pelican), বৈজ্ঞানিক নামঃ Pelecanus onocrotalus। গগনবেড় লম্বায় প্রায় ১৮৩ সেন্টিমিটার। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা হলেও ডানার ওপরে রয়েছে গোলাপি আভা। বুক ও পেটের দিকে হলদেটে। ওড়ার পালক কালো। ঠোঁট বেশ বড়। ঠোঁটের নিচে রয়েছে চামড়ার থলে। থলের রঙ কমলা-হলুদ। ওপরের ঠোঁটের মধ্যে রয়েছে লম্বা প্লেট। নিচের ঠোঁটের কিনারা ধূসর। চোখের চারপাশে পালকহীন চামড়া। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। কপালে রয়েছে সাদা পালক, যা ওপরের ঠোঁটের গোড়ায় মিলিত হয়েছে। মাথায় রয়েছে সাদা ঝুঁটি। প্রজনন সময় কেটে গেলে গলার নিচের থলের বর্ণ বদলে হলুদাভ বা কমলা রঙ ধারণ করে। ওই সময় মাথার ঝুঁটির পালক ও গায়ে হলুদের আভা থাকে না। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখিদের ডানায় কালো এবং বাদামির পরিমাণ বেশি থাকে, আর ঠোঁট থাকে কালচে হলুদ। প্রধান খাদ্যঃ মাছ। এদের মাছ শিকারের কৌশল বেশ মজাদার। এরা দলবদ্ধ হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে মাছদের তাড়া করে নিজেদের থলেতে ঢুকিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে গিলে ফেলে। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে মে। বড় গাছে দলবদ্ধভাবে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন ডালপালা। বাসার শ্রীরিছাদ নেই। অগোছালো। চিল বা বাজপাখির বাসার মতো। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৯-৩৬ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় নেয় ৬৫-৭৫ দিন। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ৩-৪ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
ধলাগলা বাতাই | White cheeked Partridge | Arborophila atrogularis
ধলাগলা বাতাই | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। দেখতে অনেকটাই কোয়েলের মতো। তবে প্রজাতিভেদে ভিন্ন। দেশের সর্বত্র দেখার নজির নেই। কেবল বৃহত্তর সিলেট জেলার চিরসবুজ অরণ্যে দেখা মেলে। একসময় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে বিচরণ ছিল। দেখা যেত ওদের প্রিয় বিচরণ স্থান বাঁশবনে। সিলেট অঞ্চলের চিরসবুজ বনের ঝোপঝাড়ে ছোট দলে হেঁটে বেড়ায় এখনো। তবে সংখ্যায় খুবই কম। খাদ্যের সন্ধানে বেশিরভাগই খোলামাঠে বিচরণ করে। খাবার সংগ্রহ করে লতাপাতা উল্টিয়ে। চলাফেরায় খুব হুঁশিয়ারি ভাব লক্ষ্য করা যায়। সামান্য ভয় পেলে দৌড়ে ঝরা পাতার নিচে লুকিয়ে পড়ে। শুকনো পাতার সঙ্গে দেহের বর্ণ একাকার হয়ে যাওয়ায় দূর থেকে চেনার উপায় থাকে না। মন ভালো থাকলে গোধূলিলগ্নে ‘হুইও-হুইও’ সুরে গান গায়। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতিটির যৎসামান্য সাক্ষাৎ মেলে ভারত, মিয়ানমার ও চীনে। এরা বিশ্বে বিপদগ্রস্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আমাদের দেশে এ প্রজাতির পাখিগুলো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় এমন মানুষের হাতে। বিশেষ করে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকরা এদের বিভিন্ন কৌশলে শিকার করে। এ ছাড়াও প্রকৃতিতে এদের প্রধান শত্র“ হচ্ছে বেজি। আড়ালে আবডালে ঘাপটি মেরে থেকে হঠাৎ করে এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়িয়ে মাথাটা আলাদা করে ফেলে। এভাবে অপঘাতে প্রাণ হারিয়ে কোনো রকম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে প্রজাতিটি। প্রজাতিটির প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারলে যে কোনো সময় এরা আমাদের দেশ থেকে বিলীন হয়ে যেতে পারে। সিলেট অঞ্চলের প্রিয় পাঠক ভাইদের প্রতি অনুরোধ রইল এদের বাঁচিয়ে রাখার। পাখির বাংলা নাম: ‘ধলাগলা বাতাই’, ইংরেজি নাম: হোয়াইট-চিকেড পারট্রিজ (White-cheeked Partridge), বৈজ্ঞানিক নাম: Arborophila atrogularis | লম্বায় ২৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২২৫ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপাল ধূসর। মাথার তালু বাদামি। ঘাড়ের পালকে রয়েছে কমলা-হলুদের মিশ্রণ। পিঠের কালো দাগে রয়েছে হালকা বাদামির মিশ্রণ। চোখের পাশে কালো ডোরা। মণি লালচে বাদামি। গলা সাদা। কাঁধ কালো-লালচে ডোরা। বুক ধূসর। তলপেট কালো। লেজের তলা সাদা। পুরুষ পাখির ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা হালকা গোলাপি। প্রধান খাবার: পোকামাকাড়, রসালো ফল, ছোট শামুক ও শস্যবীজ। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। বাসা বাঁধে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর মাটির গর্তে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/03/2014
রাজ ধনেশ | Great Indian Hornbill | Buceros bicornis
রাজ ধনেশ | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পাখি। দেশে যত্রতত্র দেখার নজির নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের গহিন অরণ্যে কদাচিত নজরে পড়ে। বাংলাদেশ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মালেয়েশিয়া, নেপাল ও ভারতে দেখা মেলে। দেখতে যেমনি এরা অদ্ভূত গড়নের তেমনি স্বভাবেও অদ্ভূত। বিশেষ করে প্রজনন সময়ে অদ্ভূত কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। স্ত্রী পাখি স্বেচ্ছায় গাছের কোটরে ঢুকলে পুরুষ পাখি ওকে বন্দি করে রাখে। কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয় কাদামাটি দিয়ে। পুরুষ পাখি নিজেই কাদামাটি বহন করে এনে ঠোঁট দিয়ে লেপে দেয়। শুধু ছোট্ট একটি ছিদ্র রাখে বায়ু চলাচল এবং খাবারের জোগান দিতে। পুরুষ পাখিকেই খাবারের জোগান দিতে হয় তখন। ডিম-বাচ্চা ফুটলেও খাদ্যের চাহিদা মেটায় পুরুষ পাখিই। শাবক স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষ পাখিকেই খাবার জোগানে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চারা ফুরফুরে হলে ভেতর থেকে মা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে মাটির আস্তর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। তত দিনে পুরুষ পাখির অবস্থা দফারফা। দুর্বল হয়ে পড়ে অনেকটাই। এ পাখি আজীবন একই স্থানে বাস করে যদি জঙ্গলে কোনো অশান্তি না ঘটে। সবচেয়ে দৃষ্টান্তমূলক দিকটি হচ্ছে এদের জুড়ি আজীবনের জন্যই থাকে, মৃত্যু বা শিকারির হাতে ধৃত না হওয়া পর্যন্ত। এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ, ‘খক্-খক্-খক্’ শব্দে ডাকে। হঠাৎ ডানা ঝাপটালে ভয় পেয়ে লাগে। এ বিরল প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে মোটেই ভালো অবস্থানে নেই। এমনিই এদের প্রজনন সন্তোষজনক নয়। তার ওপর কবিরাজ নামক অপচিকিৎসকদের কবলে পড়ে এ পাখিগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গেছে আজ। তারা এ পাখির অবয়বটাকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের রোগের উপশম হয় এমনটি বয়ান করে ফুটপাতে ওষুধ বিক্রি করে। এ ছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িরা মাংসের লোভে এদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশালাকৃতির এ পাখি প্রথম দেখি ১৯৮৭ সালে খুলনার খালিশপুরে এক কবিরাজের কব্জায় বন্দি অবস্থায়। পাখিটার পাখার পালক কেটে তার পাশে বসিয়ে রেখেছে। উৎসুক জনতা এক নজর দেখছে, কবিরাজ তাতে মজা পাচ্ছেন আর ফন্দি আঁটছেন ওষুধ বেচার। দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি। পাখিটার বাংলা নাম: ‘রাজ ধনেশ’, ইংরেজি নাম: গ্রেট ইন্ডিয়া হরনবিল (Great Indian Hornbill), বৈজ্ঞানিক নাম: (Buceros bicornis) গোত্রের নাম: ‘বুসেরোটিদি’। এরা লম্বায় ৯৫-১০৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩-৪ কিলোগ্রাম। ঠোঁটের গড়ন অদ্ভূত, আকারে বড়। কাস্তের মতো নিচের দিকে বাঁকানো। ঠোঁটের ওপরে শক্ত বর্ম। ঠোঁটের ডগা লালচে বাকিটা হলদেটে। ঠোঁটের গোড়া, কপাল কালচে। মাথা, গলা, ঘাড় হলুদ বর্ণের। বুক, পেট কালো। ডানার অধিকাংশ পালক কালো মাঝ বরাবর সাদা পট্টি। লেজে সাদার ওপর কালো পট্টি। চোখের বলয় কালো, তারা বা মনি লাল। স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে চোখের বলয় লাল মনি সাদা। প্রধান খাবার: ফল-ফলাদি। এ ছাড়া ইঁদুর, গিরগিটি ছোট পাখি ইত্যাদি খায়। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। বড় বড় গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৮-৪০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 31/05/2013