পিয়ং হাঁস | Gadwall | Anas strepera
পিয়ং হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট শীতের পরিযায়ী পাখি। হেমন্তের শুরুতেই বাংলাদেশে চলে আসে। আশ্রয় নেয় উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন জলাশয়ে, নলবনে কিংবা হাওর-বাঁওড় বা নদ-নদীতে। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। খাদ্য সংগ্রহ করে দেশি হাঁসের মতো ডুবিয়ে ডুবিয়ে। ওড়ার সময় ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা যায় শিসের মতো। পুরুষ পাখি তেমন একটা হাঁকডাক দেয় না। শুধু প্রজনন মৌসুমে শিস দিয়ে ডাকে। স্ত্রী পাখি ডাকে ‘গ্যাক-গ্যাক’ আওয়াজ করে। স্বভাবে বেশ শান্ত। অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের সঙ্গে মিলেমিশে শিকারে বের হয়। বসন্তের শুরুতেই নিজ বাসভূমে ফিরে যায়। প্রজাতির বিস্তৃতি ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায়। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মালদ্বীপ ছাড়া প্রায় দেশেই কম-বেশি নজরে পড়ে (প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এদের বিস্তৃতি)। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এরা শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে ব্যাপক। দেখতে কিছুটা দেশি হাঁসের মতো বিধায় মানুষকে সহজে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয় শিকারিরা। পাখির বাংলা নাম: ‘পিয়ং হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘গ্যাডওয়াল’ (Gadwall), বৈজ্ঞানিক নাম: Anas strepera | পরিযায়ী এরা ‘পিয়াং হাঁস’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫০-৫১ সেন্টিমিটার। ওজন ৭৪০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রং বদলায়। এ সময় ওদের ঠোঁট ধূসর, পিঠ ধূসর-বাদামি, ডানার প্রান্তে তামাটে পট্টি, বুকে গোল রেখা, পেট সাদা এবং লেজের তলা কালো দেখায়। প্রজননের বাইরে পুরুষ পাখির পিঠ কালচে হয়। মাথা গাঢ় বাদামির সঙ্গে কালচে হয়। স্ত্রী পাখি পুরুষদের চেয়ে কিছুটা বেশি বাদামি হয়। আর ঠোঁটের দু’পাশ থাকে হলদেটে। উভয় পাখির চোখ কালচে, পা, পায়ের পাতা বাদামি-হলুদ। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদের বীজ-কচিডগা এবং জলজ কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে আগস্ট। মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জলাশয়ের কাছে মাটিতে বা ঝোপের ভেতরে শুকনো ঘাস-লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসা আরামদায়ক করতে নিজেদের ঝরা পালক দিয়ে বিছানা তৈরি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৮-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/06/2014
দেশি গাঙচষা | Indian Skimmer | Rynchops albicollis
দেশি গাঙচষা | ছবি: ইন্টারনেট এরা বিপন্ন প্রজাতির পাখি। আইইউসিএন এ প্রজাতির পাখিকে সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে’ এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত। এক সময়ে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসে এদের দেখা যেত। সম্প্রতি এতদাঞ্চলে গাঙচষা নজরেই পড়ে না। জানা যায়, সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। ‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল’ উল্লেখ করেছে বিশ্বে গাঙচষা পাখির আনুমানিক সংখ্যা ৪০০০ থেকে ৬৭০০টি। তবে বাংলাদেশে এ পাখির বিচরণ রয়েছে। শীতে পদ্মা, মেঘনার চরাঞ্চলে এবং হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেল ও দমারচরে এদের দেখা মেলে। এটি নিঃসন্দেহে পাখিপ্রেমীদের জন্য একটি সুখবর। এরা ঝাঁক বেঁধে বড় নদীর মোহনার ওপর উড়ে উড়ে শিকার খোঁজে। এ পাখির বড় গুণ হচ্ছে দেহটাকে না ভিজিয়েই শিকার ধরতে পারে। পরিশ্রান্ত হলে বালুচরে বিশ্রাম নেয় এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ওভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ভোর ও গোধূলিলগ্নে শিকার ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন ওরা উড়তে উড়তে ‘ক্যাপ-ক্যাপ-ক্যাপ..’ সুরে ডাকে। এই পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি গাঙচষা’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান স্কিমার’ (Indian Skimmer), বৈজ্ঞানিক নাম: Rynchops albicollis | লম্বায় ৪০ সেন্টিমিটার (ডানা ৩৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৭.৭ সেন্টিমিটার)। ঠোঁটের আকৃতি ছুরির মতো লম্বাটে। নিচের ঠোঁটের তুলনায় ওপরের ঠোঁট সামান্য খাটো। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল। ডগা কমলা। মাথা ও ঘাড় কালো। কপাল ও গলা সাদা। কাঁধ, ডানা, লেজের উপরিভাগ কালো। প্রজনন মৌসুমে পিঠ কালচে বাদামি দেখায়। ডানার প্রান্ত সাদা। গলার নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দেশি গাঙচষা পাখি মৎস্যভুক। মাঝেমধ্যে জলজ পোকামাকড়ও শিকার করে। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত। বাসা বাঁধে নদীর আশপাশে। সাধারণত বালি খুঁড়ে এরা বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/09/2013
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
ধলাকোমর সুইবাতাসি | White rumped Needletail | Zoonavena sylvatica
ধলাকোমর সুইবাতাসি | ছবি: ইন্টারনেট দেখতে হিংস মনে হতে পারে আসলে তত হিংস নয়। তবে আক্রান্ত হলেই কেবল আক্রমণ করে। অনেক সময় মানুষকেও ছাড় দেয় না। বন্দি হলে ঠোঁট এবং নখের আঁচড়ে যখম করে দেয়। উড়ন্ত অবস্থায় এদের ঠোঁট, মাথা ও লেজ সমান্তরাল থাকে। ফলে দূর থেকে মাথা এবং লেজ শনাক্ত করা কঠিন হয়। শুধুমাত্র উড়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার কারণে মাথা-লেজ শনাক্ত করা যায়। শরীরের তুলনায় ডানা লম্বা থাকার কারণে উড়ন্ত অবস্থায় ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। মূলত এরা বন পাহাড় এবং জলাশয়ের মধ্যবর্তী স্থানে বিচরণ করে। হিমালয়ের ১৭৭০ মিটার উচ্চতায়ও দেখা যায়। স্বভাবে ভারী চঞ্চল। সারাদিন ওড়াওড়ি করে কাটায়। উড়ন্ত অবস্থায়ই পতঙ্গ শিকার করে। বেশ দ্রুত উড়তে পারে। একাকী কিংবা দলবদ্ধ হয়ে ওড়াওড়ি করে। জলপান ব্যতিরেকে পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। বাতাসি প্রজাতির মধ্যে একমাত্র এরাই অন্য প্রজাতির পাখির মতো ডালপালা আঁকড়ে ধরতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমবেশি দেখা যায়। ফলে নিরূপণ করা কঠিন এরা এতদাঞ্চলে আবাসিক নাকি পরিযায়ী? বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে বিরল দর্শন। ফলে আইইউসিএন এদের ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে শনাক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ধলাকোমর সুইবাতাসি’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট-রামপেড নিডলটেইল’ (White-rumped Needletail), বৈজ্ঞানিক নাম: Zoonavena sylvatica | এরা ‘ছোট পাহাড়ি বাতাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১১ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩ গ্রাম। শরীরের তুলনায় মাথা বড়। মাথা কালচে বাদামির সঙ্গে হালকা সাদা মিশ্রণ। পিঠ কালো। ডানা বাদামি। কোমর সাদা। লেজের গোড়া কালো, বাদবাকি বাদামি। অগ্রভাগ কাঁটার মতো সুচালো। গলা সাদা। দেহতল সাদা। ঠোঁট কালো, ছোট। ঠোঁটের অগ্রভাগ কিঞ্চিত বাঁকানো। পা ছোট, পশম আবৃত। প্রধান খাদ্য: উড়ন্ত পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। ধ্বংসাবশেষ গাছে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/01/2017
লেবুকোমর ফুটকি | Lemon rumped Warbler | Phylloscopus chloronotus
লেবুকোমর ফুটকি | ছবি: ইবার্ড পরিযায়ী পাখি। বাবুই পাখির আদলে গড়ন। গাট্টাগোট্টা মায়াবী চেহারা। পাহাড়ি অঞ্চলের সরলবর্গীয় বনের বাসিন্দা। বিশেষ করে ওক এবং পাইন বনে বেশি দেখা যায়। এ ছাড়াও রডোডেনড্রন উচ্চতর উচ্চতায় দেখা যায়। সমতলে দেখা যাওয়ারও রেকর্ড রয়েছে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। গাছের পত্রপল্লবহীন ডালে লেজ উঁচিয়ে ঘুরে ঘুরে উল্লাস করে। বিচরণ করে একাকি জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। মাটির কাছাকাছি থেকে খাবার সংগ্রহ করে। বেশিরভাগই লাফিয়ে চলে। অর্থাৎ কাছাকাছি এক গাছ থেকে অন্য গাছে গেলে উড়ে না গিয়ে লাফিয়ে যায়। গায়ক পাখি, কণ্ঠস্বর সুমধুর। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, নেপাল (হিমালয়ের পাহাড়ি জঙ্গল) উত্তর পাকিস্তান, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, উত্তর ইন্দোচীন ও দক্ষিণ চীন পর্যন্ত। আইইউসিএন প্রজাতিটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লেবুকোমর ফুটকি’, ইংরেজি নাম: লেমন রামপেড ওয়ার্বলার (Lemon-rumped Warbler), বৈজ্ঞানিক নাম: Phylloscopus chloronotus | এরা ‘সাদা-জলপাই পাতা ফুটকি’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৯-১০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড়ে সবুজাভ জলপাই রঙের সাদা ডোরা। পিঠ সবুজাভ জলপাই রঙের। ডানায় জলপাই রঙের ওপর আড়াআড়ি সাদাডোরা। কোমর উজ্জ্বল লেবু রঙের। লেজে ধূসর কালোর সঙ্গে সাদাটান রয়েছে। গলা সাদাটে। বুক হালকা লেবু রংমিশ্রিত সাদা। চোখের নিচে সাদা বলয়। ঠোঁট শিং কালো। পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে জলপাই রঙের। প্রধান খাবার লার্ভা ও অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ-গাছালিতে। শুকনো ঘাস দিয়ে প্যাঁচিয়ে বল আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১০-১৩দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 17/06/2016
ফিঙে | Black Drongo | Dicrurus macrocercus
ফিঙে | ছবি: ইন্টারনেট পক্ষীকুলের সমাজপতিরা একবার ‘পাখিরাজ’ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতি হচ্ছে যে পাখি যত ওপরে উঠতে পারবে সে হবে তাদের রাজা। ঘোষণা অনুযায়ী পাখিরা একদিন আকাশে ডানা মেলল। মূলত চিল, বাজ, শকুন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ছোট পাখিদের মধ্যে ফিঙের সাধ জেগেছে আকাশে ওড়ার, সমস্যা হচ্ছে সে এত ওপরে উঠতে পারছে না। বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই ওর মনে কূটবুদ্ধি এলো। ফিঙেটা চুপিচুপি চিলের পিঠে সওয়ার হলো। টের পায়নি তা চিল। চিল অন্য সব পাখিকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে ওপরে উঠেছে এক সময়। আশপাশে তাকিয়েছিল যখন নিশ্চিত হয়েছে আর কেউ অত ওপরে উঠতে পারেনি, তখন সে নিচে নামতে শুরু করল। আর সেই সুযোগেই ফিঙে চিলের পিঠ ছেড়ে আরেকধাপ ওপরে উঠে গেল। কর্তৃপক্ষ দেখেছে ফিঙের অবস্থানই সবার ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা এসেছে ‘আজ থেকে পাখিদের রাজা ফিঙে’। হ্যাঁ, ফিঙে খুবই সাহসী পাখি। চিল, বাজ, শকুনকেও ছেড়ে কথা বলে না। ওদের নাগালের মধ্যে এলেই ঠুকরিয়ে দেয়। বাসার কাছে গেলে মানুষকে পর্যন্ত আক্রমণ করে। ছোট পাখিরা ওদের অবস্থানের কাছাকাছি বাসা বেঁধে নিরাপদে থাকে তাই। পাখিটার বাংলা নাম: ‘ফিঙে’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক ড্রোঙ্গো’, (Black Drongo), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ডিক্রুরাস মেক্রোসারকাস’(Dicrurus macrocercus)। এ পাখি লম্বায় লেজসহ ২৮-৩১ সেন্টিমিটার। মাথা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত কালো পালকে আবৃত। কালোর ওপরে নীলাভ আভা বের হওয়াতে পালিশ করা চকচকে দেখায়। এদের ঠোঁট ধাতব কালো, গোড়ায় সাদা ফোঁটা থাকে। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পেটের ওপর থাকে সাদা রেখা। যা দূর থেকে আঁশটে দেখায়। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ, ফুলের মধু টিকটিকি, প্রজাপতি, ভীমরুল, কেঁচো ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। গাছের তেডালের ফাঁকে বাটি আকৃতির বাসা বানায়। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে পশুর পশম, সরু লতা-ঘাস ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/06/2013
বালিহাঁস | Cotton Pygmy goose | Nettapus coromandelianus
বালিহাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বিশেষ করে পুরুষ পাখিটির রূপ অতুলনীয়। চেহারাটাও বেশ মায়াবী। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। এমনিতেই তো দেখতে ভীষণ সুন্দর তার ওপর আরো সুন্দর লাগে তখন। এরা উড়তে উড়তেই ডাকে। ‘ডিক ডিক, ডিরিক ডিরিক’ সুরে আওয়াজ করে জলাশয় বা গাছ-গাছালির ওপর চক্কর মারে। আমাদের দেশে এক সময়ে যত্রতত্র দেখা যেত। বর্তমানে হাওরাঞ্চল বা বড় ধরনের জলাশয় ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না। পাখি নিধনকারীদের অধিক লোভের কারণে আজ ওরা হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ একটা সময়ে এ পাখিরা যত্রতত্র বিচরণ করত দেশে। বিচরণ করতে দেখেছি আমার বাল্য বেলায় নানাবাড়ির পুকুরে। মামার মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি এ পাখির সঙ্গে তখন। এক মামা ধরার চেষ্টাও করেছেন। অধিক চাতুরিতার কারণে ফাঁদে ফেলতে পারেননি। এ পাখি সাধারণত মরা তাল, নারিকেল, খেজুর গাছের প্রাকৃতিক গর্তে বাসা বাঁধে। তবে ওদের প্রথম পছন্দ তালগাছ, দ্বিতীয় পছন্দ নারিকেল গাছের কোটর। এসব মরাগাছের মাথায় বৃষ্টির জল জমে প্রকৃতিগতভাবে গর্তের সৃষ্টি হলে এরা সেখানে বাসা বাঁধে। আমাদের দেশের বিশিষ্ট পাখি গবেষক শরীফ খান এ পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি নিজের তত্ত্বাবধানে এদের ডিম মুরগির তা দিয়ে ফুটিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাচ্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, তিনদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল।’ এ পাখির বাংলা নাম: ‘বালিহাঁস,’ ইংরেজি নাম: ‘কটন পিগমি গুজ বা কটন টিল,’ (Cotton Pygmy-goose or Cotton Teal) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘নেট্টাপাস কোরোমানডেলিয়ানাস,’ (Nettapus coromandelianus) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা বেলেহাঁস নামেও পরিচিত। বালিহাঁস লম্বায় ৩০-৩২ সেন্টিমিটার। আমাদের দেশের হাঁস প্রজাতির মধ্যে এরা সবচেয়ে ছোট আকৃতির। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাথার তালু পর্যন্ত কালো। পুরুষ পাখির গলার নিচে চওড়া কালো ফিতার মতো বন্ধনী রয়েছে। পিঠ, ডানা কালো। চোখের চারপাশ, বুক, পেট সাদা। লেজের আগা কালচে। সূর্যের আলো পড়লে উজ্জ্বল সবুজের আভা ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় অনেকখানি নিষ্প্রভ। ওদের গলায় সুদৃশ্য বন্ধনী নেই। গায়ের বর্ণ হালকা বাদামি ও সাদার মিশেল। আকারে পুরুষের চেয়ে সামান্য ছোট। বালিহাঁসের প্রিয় খাবার জলজ পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদের কচিডগা, শস্যবীজ ও ছোট মাছ। প্রজনন সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর। মরা নারিকেল, তাল, খেজুরগাছের কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৮-১২টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭দিন। ডিম থেকে বেরুলেই শাবক গাছের কোটর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে। অনেক সময় গাছের গর্ত গভীর হলে মা-বাবা ঠোঁট দিয়ে ঠেলে ওদের গর্ত থেকে বের করে দেয়। বালিহাঁসের বাচ্চারা ভীষণ দুষ্টু। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/11/2013