ধূসর টি টি | Grey headed Lapwing | Vanellus Cinereus
ধূসর টি টি| ছবি: ইন্টারনেট পরিযায়ী পাখি। শীতে পরিযায়ী হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে হাজির হয়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, উত্তর-পূর্ব চীন, কম্বোডিয়া, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। স্বভাবে চঞ্চল। স্থিরতা নেই ওদের মাঝে। কোথাও একদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকার মতো সময় যেন ওদের নেই। সারাদিন দৌড় আর দৌড়। চঞ্চল হলেও একদম ঝগড়াঝাঁটির ধার ধারে না। দেখতে গো-বেচারা টাইপ চেহারা। মায়াবি গড়ন। শরীরের তুলনায় পা বেশ লম্বা। প্রজাতির অন্যসব টি-টি পাখিদের মতোই নদীর অববাহিকায় বিচরণ করে। স্যাঁতসেঁতে এলাকায় পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। ছোট দলে কিংবা একাকী বিচরণ করে। হাঁটার সময় লেজ কাঁপিয়ে হাঁটে। খাবারের সন্ধানে অনেক সময় হাঁটুজল অবধি নেমে পড়ে। সরাসরি জলে নামতে দেখা যায় না খুব একটা বরং কাদাজলে হাঁটু অবধি নেমে খাবার খোঁজে। শুকনো ঘেসো মাঠেও বিচরণ করে। দৌড়ে দৌড়ে পোকামাকড় ধরে। শিকারের পিছু ধাওয়া করে মুহূর্তেই থেমে যায়। এটা ওদের শিকার কৌশলও হতে পারে। ‘ধূসর টি-টি’ সমুদ্র সৈকতেও দেখা যায়। বালুবেলায় শিকার খুঁজে বেড়ায়। শিকার খুঁজতে গিয়ে মাঝেমধ্যে তীক্ষ কণ্ঠে আওয়াজ করে। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর টি-টি’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-হেডেড ল্যাপউইং’ (Grey-headed Lapwing), বৈজ্ঞানিক নাম: Vanellus Cinereus| এরা ‘মেটেমাথা টি-টি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামন্য বড়। উভয়ের মাথা, ঘাড় ও গলা ধূসর। পিঠ ধূসর বাদামি। লেজের উপরের দিক বাদামি। অগ্রভাগ কালো। লেজের নিচের দিক সাদা। বুক ধূসর কালো। পেট সাদা। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো, বাদবাকি হলুদ। চোখ চোখের বলয় হলুদ, তারা লালচে-বাদামি। লম্বা লিকলিকে পা হলুদ রঙের। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ধূসর। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, শুঁককীট ও ফড়িং। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। জলাশয়ের পাশে তৃণভূমিতে অথবা ধান ক্ষেতের স্যাঁতসেঁতে স্থানে ঘাস লতা-পাতা দিয়ে বাস বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-৫টি। তবে সাধারণত ডিম ৪টির নিচ পাড়ে না। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হয় ৪৫ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/09/2015
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
সোনালি মাথা টুনি | Golden headed Cisticola | Cisticola exilis
সোনালি মাথা টুনি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ চীন ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল উপকূলীয় এলাকা, তৃণভূমি, জলাভূমির পাড়ের ঝোপঝাড়, লম্বা ঘাসবন ইত্যাদি। এ ছাড়াও কৃষি জমির আশপাশের ছোট গাছগাছালি কিংবা ঝোপজঙ্গলে বিচরণ করে। পারতপক্ষে উঁচু গাছে বিচরণ করে না। সারাদিন গুল্মলতাদির ফাঁকফোকরে নেচে গেয়ে কাটায়। স্বভাবে শান্ত হলেও চঞ্চল অস্থিরমতির পাখি এরা। গানের গলা ভালো। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষ পাখির রঙেও খানিকটা পরিবর্তন আসে। চেহারাটা বেশ আদুরে দেখায় তখন। শরীরটাকে ফুলিয়ে বসে থাকলে দূর থেকে অনেক সময় গোলাকার কদমফুলের মতো দেখায়। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও উপমহাদেশীয় অঞ্চলে যত্রতত্র দেখা যায় না। আইইউসিএন এদেরকে উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সোনালি মাথা টুনি’, ইংরেজি নাম: গোল্ডেন-হেডেড কিস্টিকোলা (Golden-headed Cisticola), বৈজ্ঞানিক নাম: Cisticola exilis | এরা ‘ধলামাথা ছোটন’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির পুরুষ পাখি দৈর্ঘ্যে ৯-১১সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৭-১০ গ্রাম। স্ত্রী পাখি দেখতে প্রায় একই রকম হলে আকারে সামান্য ছোট এবং কিছুটা নিষ্প্রভ। প্রজনন পালক ভিন্ন। এ সময় পুরুষ পাখির মাথা সোনালি কমলা, অন্য সময় মাথা ও ঘাড়ে সোনালি পালক। পিঠ ও ডানা গাঢ় বাদামি ডোরাকাটা। লেজ সোনালি বাদামির সঙ্গে কালো। দেহতল ক্রিম সোনালি। চোখ বাদামি। ঠোঁট সরু ওপরের অংশ কালচে নিচের অংশ ত্বক বর্ণের। পা গোলাপি ত্বক বর্ণের। প্রধান খাবার: ছোট পোকামাকড়, ফড়িং, পিঁপড়া, মথ, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে আগস্ট। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। কাপ আকৃতির বাসা। বাসা বাঁধে নরম চিকন লতা, শিকড়, তন্তু ও তুলা দিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/12/2016
ঝুঁটিয়াল বাতাসি | Crested Tree swift | Hemiprocne coronata
ঝুঁটিয়াল বাতাসি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন। একসময় শীতে পার্বত্য এলাকায় দেখা যেত। হালে দেশে এদের দেখা যাওয়ার তেমন একটা নজির নেই। আশির দশকেও পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। প্রাকৃতিক আবাসস্থল বিক্ষিপ্ত গাছ-গাছালি, পর্ণমোচী বন। বন প্রান্তরের ন্যাড়া গাছ বেশি পছন্দ। একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। অবসরে দলের সবাই ন্যাড়া গাছের ডালে বসে গা খোঁটাখুঁটি করে। চেহারা অনেকটাই ভিনদেশি ‘ককাটিল’ পাখির মতো। পাখিবিশারদ ছাড়া প্রজাতি শনাক্ত করা কঠিনই বটে। দেখতে হিংস্র মনে হতে পারে। তবে পারতপক্ষে ওদের আচরণে হিংস্রতা প্রকাশ পায় না। আক্রান্ত হলেই কেবল আক্রমণ করে। আত্মরক্ষার্থে অনেক সময় মানুষকেও ছাড় দেয় না। বন্দি হলে ঠোঁট ও নখের আঁচড়ে জখম করে দেয়। শরীরের তুলনায় ডানা লম্বা। এ কারণে উড়ন্ত অবস্থায় ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। মূলত এরা বন-পাহাড়ি অঞ্চলে বিচরণ করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬৫ মিটার উচ্চতায়ও ওদের বিচরণ করতে দেখা যায়। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। একাকী অথবা দলবদ্ধভাবে সারা দিন ওড়াউড়ি করে কাটায়। উড়ন্ত অবস্থায়ই পতঙ্গ শিকার করে। বেশ দ্রুত উড়তে পারে। জলপান ব্যতিরেকে পারতপক্ষে ভূমি স্পর্শ করে না। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, দক্ষিণ চীন ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে বিরল দর্শন। ফলে আইইউসিএন এদের ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত পাখি হিসেবে শনাক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ঝুঁটিয়াল বাতাসি’, ইংরেজি নাম: ‘ক্রেস্টেড ট্রি সুইট’ (Crested Tree swift), বৈজ্ঞানিক নাম: Hemiprocne coronata | এরা ‘খোঁপাযুক্ত বাতাসি’ নামেও পরিচিত। পাখিটির গড় দৈর্ঘ্য ২৩ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য ভিন্নতা আছে। মাথা আসমানি-ধূসর। মাথায় ২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার উঁচু সবুজাভ নীল ঝুঁটি। পিঠ আসমানি ধূসর। ডানা লম্বা সুচালো কালচে, নিচের দিকে ধূসরাভ। লেজ লম্বা ও দ্বিখণ্ডিত। পুরুষ পাখির মুখাবয়ব লালচে-বাদামি। আর স্ত্রী পাখির মুখাবয়ব ধূসর। গলা ধূসরাভ। দেহতল ধূসরাভ-সাদা। চোখ বাদামি-কালো। ঠোঁট কালো এবং যথেষ্টই খাটো। পা কালচে। যুবাদের রং ভিন্ন। ঝুঁটিয়াল বাতাসির প্রধান খাদ্য কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়। গোবরে পোকার প্রতি আসক্তি লক্ষ করা যায়। এদের প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। গাছের ধ্বংসাবশেষে ওরা বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/05/2018
সবুজ হাঁড়িচাঁচা | Common Green Magpie | Cissa chinensis
সবুজ হাঁড়িচাঁচা | ছবি: ইন্টারনেট দৃষ্টিনন্দন চেহারা। বোধ করি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হবেন যে কেউ-ই। দেশের আবাসিক পাখি হলেও সর্বত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই সবুজ হাঁড়িচাঁচার। দেখা মেলে অঞ্চলভেদে। বিশেষ করে চিরসবুজ বনের গিরিপথ অথবা আর্দ্র পাতাঝরা বনে দেখা মেলে কিছুটা। বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে এরা। মাঝেমধ্যে জোড়ায় জোড়ায়ও দেখা যায়। শিকারে বের হয় অন্যসব পাখির সঙ্গেও। ফিঙে বা পেঙ্গা পাখি এদের প্রধান সহচর। শিকার খোঁজে পাতা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে। হরবোলা পাখির মতো অন্য প্রজাতির পাখির ডাক নকল করতে পারে। নিজেরা ডাকে উচ্চৈঃস্বরে ‘পিপ্-পিপ্.. ক্লি-হুয়ি’ আওয়াজে। শিকাররত অবস্থায় মাঝেমধ্যে করুণ কণ্ঠে ডাকে, ‘আয়েইউ..আয়েইউ..’ সুরে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এরা প্রায় ২১ লাখ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিচরণ করে। সংখ্যায় এরা স্থিতিশীল। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘সবুজ হাঁড়িচাঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘কমন গ্রিন মেগপাই’ (Common Green Magpie), বৈজ্ঞানিক নাম: Cissa chinensis| এরা ‘পাতি সবুজতাউরা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৩৮-৪০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩০ গ্রাম। মাথা উজ্জ্বল সবুজ। মাথায় ঝুঁটি আকৃতির সবুজ পালকগুলো ঘাড়ের দিকে নেমে গেছে। দৃঢ় মজবুত ঠোঁট প্রবাল লাল। ঠোঁটের থেকে চোখের দু’পাশ দিয়ে কালোডোরা ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ থেকে লেজ পর্যন্ত পাতা সবুজ। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। লেজের ডগাটা সাদাটে। ডানার প্রান্ত ও মধ্য পালক তামাটে-মেরুন। লেজের দিকে ডানার কিনারে সাদা কালো মিশ্রণের গোলাকার ফুটকি। দেহের নিচের দিকটা অনুজ্জ্বল সবুজ। চোখ রক্তলাল। পা ও পায়ের পাতা প্রবাল লাল। স্ত্রী-পুরুষ পভখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মাথা কালচে-বাদামি। দেহের নিচের দিক ফিকে এবং বস্তিপ্রদেশ সাদা। প্রধান খাবার: ছোট সাপ, ছোট পাখি, পাখির ডিম-বাচ্চা, ব্যাঙ, টিকটিকিসহ বড় ধরনের পোকামাকড় এবং পচাগলা মাংস। প্রজনন কাল এপ্রিল থেকে মে। গাছের পাতার আড়ালে সরু কাঠি, শ্যাওলা, শুকনো পাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসার শ্রীছাদ নেই। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/09/2014
বড় চোখগেলো | Large Hawk cuckoo | Hierococcyx sparverioides
বড় চোখগেলো | ছবি: ইন্টারনেট বিরল পরিযায়ী পাখি (বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না)। শীতে কদাচিৎ সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে নজরে পড়ে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি পূর্ব ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। মূলত এরা চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। পাতার আড়ালে-আবডালে থাকতে পছন্দ করে। বিচরণ করে একাকি। সামাজিক বন্ধন খুব একটা নেই এদের মধ্যে। প্রজনন মৌসুমে খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে ডাকাডাকি করে। এ ছাড়াও পূর্ণিমা রাতে মধুর কণ্ঠে ডাকে ‘পিপক পিপকক.. সুরে। সুরে এক ধরনের মাদকতা রয়েছে। বারবার শুনতে ইচ্ছ করে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে এদের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় চোখগেলো’, ইংরেজি নাম: ‘লার্জ হাক কুক্কু’ (Large Hawk-cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Hierococcyx sparverioides | লম্বায় ৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ১২৫ গ্রাম। মাথার তালু ও ঘাড় ছাই-ধূসর। দেহের উপরাংশ ছাই-বাদামি ডোরা হলেও কিছু জায়গা থেকে লালচে-বাদামির আভা বের হয়। দেহতল সাদাটে। বুক থেকে লেজের তলা পর্যন্ত মোটা বাদামি বলয়যুক্ত। লেজের কালো ও বাদামি বিন্যাস থরে থরে সজ্জিত। লেজের অগ্রভাগ সাদা। চোখ কমলা-হলুদ। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। ঠোঁটের উপরের অংশ কালচে শিঙরঙা, নিচের অংশ সবুজাভ-সেøট রঙের। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের রঙে তফাৎ রয়েছে। ওদের ঘাড়ের পেছন দিক ফ্যাকাসে লালচে। বাদামির পরিবর্তে পিঠে লালচে ডোরা। বুকে স্পষ্ট বাদামি ডোরা। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, ছারপোকা, ফড়িং, গুবরে পোকা, মাকড়সা ও পিঁপড়া। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন ঋতু ভিন্ন হয়। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না বিধায় ডিম পাড়ে পেঙ্গা অথবা মাকড়মার পাখির বাসায়। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। প্রকৃতি এদেরকে ডিমের আকার ও বর্ণ ভিন্নতর করার ক্ষমতা দিয়েছে। যার ফলে এরা ছোট পাখির বাসাতে যখন ডিম পাড়ে তখন ডিমের আকৃতি ওই পাখিদের ডিমের সমান পাড়তে পারে। আবার বড় পাখিদের বাসায় বসলে বড় সাইজের ডিম পাড়ে। এমনকি ডিমের বর্ণও হুবহু মিলিয়ে ফেলতে পারে। যেমন পেঙ্গার বাসার জন্য ডিমের বর্ণ নীল, মাকড়মারের বাসার জন্য বাদামি ডিম পাড়ে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/06/2014
বড় জলকবুতর | Great Black headed Gull | Larus ichthyaetus
বড় জলকবুতর | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবল শীতে এ প্রজাতির আগমন ঘটে এ দেশে। পরিযায়ী হয়ে আসে দক্ষিণ রাশিয়া ও উত্তর-পূর্ব মঙ্গোলিয়া থেকে। আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশ ছাড়াও শীতে এ প্রজাতির সাক্ষাৎ মেলে ভারত ও পাকিস্তানে। শীত মৌসুমে খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে বিচরণ করতে দেখা যায় জলকবুতরকে। রাজধানীর পাশে বহমান বুড়িগঙ্গা নদীতেও দেখা মেলে এদের। তবে পরিযায়ী এ পাখি মিঠা পানির চেয়ে নোনা পানিতে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। সাগরের কাছাকাছি এলাকায় বেশি দেখা যাওয়ার মূল কারণ এটাই। জলকবুতর বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। চলাচলরত নৌযানকে অনুসরণ করতে দেখা যায় প্রায়ই। নৌযানের পেছন পেছন চক্কর মেরে উড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য একটাই, মাছ শিকার। শীতে নৌযাত্রীরা প্রায়ই দৃশ্যটি দেখার সুযোগ পেয়ে থাকে। আর সেই দৃশ্য উপভোগ করার মতোই। এ ছাড়া প্রজাতিটিকে বালুতটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বিশেষ করে দ্বীপাঞ্চলের জেলেপল্লীতে ওরা ঘুরঘুর করে। মূলত পল্লীর এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরা মাছ খাওয়ার লোভেই ওদের ঘোরাঘুরি। জলকবুতর স্বভাবে শান্ত। ঝগড়াঝাঁটি পছন্দ নয়। নিজেদের মধ্যে খুনসুটি বেধে গেলে বিরক্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠে ‘ক্রাআ-ক্রা-আ’। শীত মৌসুমে এ প্রজাতির উপস্থিতি দেশে সন্তোষজনক। শিকারি পাখি ছাড়া এদের পারতপক্ষে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে না। ফলে এরা আমাদের দেশে ভালো অবস্থানেই রয়েছে বলা যায়। পাখিটির বাংলা নামঃ বড় জলকবুতর, ইংরেজি নামঃ গ্রেট ব্ল্যাক-হেডেড গাল (Great Black-headed Gull), বৈজ্ঞানিক নামঃ Larus ichthyaetus | এরা ‘কালোশির গঙ্গা কবুতর’ নামেও পরিচিত। বড় জলকবুতর লম্বায় ৭০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। ডানার দৈর্ঘ্য প্রসারিত অবস্থায় ১৪২ থেকে ১৭০ সেন্টিমিটার। শীতে রং বদলায়। এ সময় মাথায় সাদার ওপর কালো ছোপ দেখা যায়। শীত কেটে গেলে মাথা ধীরে ধীরে কালো রং ধারণ করে। শুধু চোখের ওপরে ও নিচে অর্ধচন্দ্রাকারে সাদা ছোপ। দেহজুড়ে সাদা রঙের পালক, কেবল ডানার ওপরের দিক ও পিঠ ধূসর। ওড়ার পালকে সাদার ওপর কালো ফোঁটা। দেহতল ধূসর-ফিকে। ঠোঁট মোটা হলুদ। ঠোঁটের ডগা কালো-লালচে। পা ও আঙুল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ উভয় পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবারঃ মাছ। তবে বালুচরে ঘুরে পোকামাকড় খেতেও দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম মধ্য এপ্রিল। বাসা বাঁধে জন্মভূমিতেই। জলাশয়ের কাছাকাছি ভূমিতে ঘাস, লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে দুই থেকে ছয়টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১ থেকে ২৭ দিন। আর বাচ্চার স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪২ দিন। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।