সাদা খঞ্জন | white wagtail | Motacilla alba
সাদা খঞ্জন | ছবি: ইন্টারনেট ধলেশ্বরী নদীর বাঁকেই মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের অবস্থান। সদরের অদূরেই মিরকাদিম পৌরসভা। সেটিরও অবস্থান ধলেশ্বরীর পাড়ে। এ মাঠে প্রতি বছর আমি কটি স্লিম গড়নের পাখিকে নির্ভয়ে বিচরণ করতে দেখি। বিশেষ করে ওরা শীত শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তেই এসে হাজির হয়। থাকে দীর্ঘদিন। একেবারে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত থাকে। পাখিগুলো দেখতে ভারি চমৎকার। চেহারাটা বেশ মায়াবী। জোড়ায় জোড়ায় কিংবা একাকী বিচরণ করে। সামান্য দূর থেকে ওদের দেখে আনন্দ পাই তখন। অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির পাখি এরা। স্থিরতা এদের মাঝে খুবই কম। মাঠে বিচরণকালে সারাক্ষণ লেজ নাড়তে দেখা যায়। আসলে ওদের কোমরের গড়নটাই অমন। গড়ন একটু ভিন্ন ধাঁচের হওয়ায় সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে। এ কারণে লেজটাও দুলতে থাকে। আর তা দেখে মনে হয় বুঝি ওরা নেচে বেড়ায় সারাদিন। এ পাখির বাংলা নাম: সাদা খঞ্জন, ইংরেজি নাম: হোয়াইট ওয়াগটেল (white wagtail), বৈজ্ঞানিক নাম: মোটাকিল্লা আলবা, (Motacilla alba), গোত্রের নাম: মোটাকিল্লিনি। সাদা খঞ্জন লম্বায় ৮ ইঞ্চি। চিকন শরীর। শরীরের তুলনায় লেজটা লম্বা। এদের কপাল, চোখের দু’পাশ, গলা ও গাল সাদা। মাথা, ঘাড়, ডানার কিছু পালক কালো। বুকে কালো ছাপ। পিঠ ছাই-ধূসর। কিছু পালক ধূসর-সাদার মিশ্রণ। লেজ কালো, দু’পাশের পালক সাদা। বুক ও পেটের সব পালক সাদা। ঠোঁট-পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে এক রকম মনে হলেও পার্থক্য সামান্য। স্ত্রী পাখি সামান্য দীপ্তিহীন। এরা পতঙ্গভুক পাখি। সারাদিন মাঠে কিংবা নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন সময় মে-জুলাই। মাঠ-প্রান্তর অথবা জঙ্গলের নীরব স্থানে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/03/2013
কালাঘাড় ডুবুরি | Black necked Grebe | Podiceps nigricollis
কালাঘাড় ডুবুরি | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। কেবল প্রচণ্ড শীতে সিলেটের হাওরাঞ্চলে অল্পবিস্তর দেখা মেলে। স্বাদুজলে বিচরণ করে। বিচরণ করে জোড়ায় জোড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট দলেও নজরে পড়ে। সাঁতারে খুব পটু। ঘন ঘন ডুব সাঁতার দিয়ে জলাশয় মাতিয়ে রাখে। জনমানবের সাড়া পেলে মুহূর্তে চুপসে যায়। নিরাপদবোধ মনে না হলে জলাশয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। খুব হুঁশিয়ারি পাখি, ভীতুও সাংঘাতিক। এতই হুঁশিয়ারি যে, ডিমে তা দেয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ডিমের ওপর আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখে। ফিরে এসে আগাছা সরিয়ে পুনরায় ডিমে তা দেয়। শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে ডুব সাঁতার দিয়ে বাসায় পৌঁছে। এরা লেজহীন পাখি। হাঁস আকৃতির হলেও ঠোঁট চেপ্টা নয়, সুচালো। নিজ বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে পিঠে চড়িয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বাংলা নাম: ‘কালাঘাড় ডুবুরি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক-নেকেড গ্রিব’ (Black-necked Grebe), বৈজ্ঞানিক নাম: Podiceps nigricollis | এরা ‘কালোমাথা ডুবুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ২৮-৩৪ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৩৬০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে অভিন্ন। কপাল, মাথার তালু ও ঘাড় কুচকুচে কালো। মাথা খাড়া। কান পশম সোনালি-হলুদ, যা চোখের পেছন দিক থেকে শুরু করে ঘাড়ের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ কালো। পিঠের দু’পাশ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। বুক কালো। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত সাদা। লেজ খাটো, নেই বললেই চলে। ঠোঁট সুচালো কুচকুচে কালো। চোখের বলয় লাল। চোখের তারা প্রবাল লাল। পা কালচে। পায়ের পাতা চওড়া এবং চেপ্টা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: ছোট মাছ, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এছাড়াও ছোট চিড়িং, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ ঝোপের ভেতর। ঝোপটি যেন ভেসে না যায় তার জন্য স্থায়ী আগাছা বা ঝোপের সঙ্গে বেঁধে রাখে বাসাটি। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। শরীরে পালক গজাতে সময় লাগে ১০-১১ সপ্তাহ। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/01/2016
লম্বাঠোঁটি শকুন | Cinereous Vulture | Aegypius monachus
লম্বাঠোঁটি শকুন | ছবি: ইন্টারনেট হিংস্র চেহারার মনে হলেও তত হিংস্র নয়। আকারে বড়সড়ো। অধিক ওজনের কারণে হাঁটাচলা করতে খানিকটা বেগ পেতে হয়। ভারিক্কিচালে হেলেদুলে কিংবা লাফিয়ে হাঁটাচলা করে। পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি নজরে পড়ে। দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, হিমালয় অঞ্চল, আফগানিস্তান, পর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্স, গ্রিস, স্পেন, তুরস্ক, মঙ্গোলিয়া, চীন পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘লম্বাঠোঁটি শকুন’, ইংরেজি নাম: ‘সিনেরিয়াস ভালচার’, (Cinereous Vulture) বৈজ্ঞানিক নাম: Aegypius monachus। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৯৮-১১০ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ২৫০-২৯৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৭-১২ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথা, পিঠ গাঢ় বাদামি সঙ্গে নীলচে ধূসরের মিশ্রণ রয়েছে। ঘাড় নীলচে ধূসর। ডানার পালক প্রান্ত কালচে বাদামি। ওড়ার পালক সাদা-কালো। লেজ খাটো কালচে বাদামি। গলা ময়লা সাদা চামড়ায় আবৃত। দেহতল কালচে বাদামি। ঠোঁটের গোড়া নীলচে ধূসর, অগ্রভাগ কালো। ওপরের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। পা ধূসর হলেও গোলাপি আভা বের হয়। প্রধান খাবার: সব ধরনের মৃতদেহ বা উচ্ছিষ্ট খাবার শামুক, পাখির ডিম, ছোট পাখি, খরগোশ, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে উঁচু গাছের ডালে সরু লাঠি দিয়ে। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৫০-৫৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/01/2018
সোনালি গলা বসন্ত বউরি | Golden throated barbet | Megalaima franklinii
সোনালি গলা বসন্ত বউরি | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থানীয় প্রজাতির পাখি ছাড়াও পরিযায়ী প্রজাতির পাখিরাও আমাদের দেশীয় পাখির তালিকায় রয়েছে। অর্থাৎ কোনো প্রজাতির পাখি যদি একবারের জন্যও বাংলাদেশে আসে তাহলে ওই প্রজাতিটি দেশীয় পাখির তালিকায় স্থান পাচ্ছে। তেমনি তালিকায় রয়েছে, ‘সোনালিগলা বসন্ত বউরি’ পাখি। কিন্তু ওদের দেখা আমাদের দেশে মিলে না সহসাই। বসন্তের শুরু থেকেই এই প্রজাতির খোঁজে আমি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ালেও নজরে মিলেনি অদ্যাবধি। তবে বন্যপ্রাণী বিশারদ ড. রেজা খান তার লেখা ‘বাংলাদেশের পাখি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রজাতিটি দেশে দেখা যাবার তথ্য না থাকলেও দুইজন ভিনদেশী পাখি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে সোনালিগলা বসন্ত বউরি পাখির সাক্ষাত পেয়েছেন।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘প্রজাতিটি অতি বিরল। আর হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ওরা বসন্তকালের পাখি। সারা বছর আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকলেও বসন্ত বউরি পাখিরা বসন্তকালের শুরু থেকে লোকালয়ে চলে আসে। গাছের ফল-ফলাদি খেয়ে সামান্য ক্ষতি করলেও বিনিময়ে মিষ্টি করুণ সুর আমাদের কানে দিয়ে যায়। আওয়াজ করে, ‘টুক্-টুক্-টুক..’ (প্রজাতি ভেদে আওয়াজ ভিন্ন) সুরে। অনেক দূর থেকে শোনা যায় সেই আওয়াজ। হঠাৎ আওয়াজটি কানে গেলে যে কেউ কামারের হাতুড়ির আওয়াজ মনে করতে পারেন।’ বিদঘুটে আওয়াজ হলেও সুরে রয়েছে চমৎকার তাল-লয়। শোনার আগ্রহ জাগে। এরা বৃক্ষচারী পাখি। দেখতে সুশ্রী। শরীরের তুলনায় মাথা বড়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও তিব্বত পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘সোনালিগলা বসন্ত বউরি’, ইংরেজি নাম: ‘গোল্ডেন থ্রোটেড বারবেট’(Golden-throated barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: Megalaima franklinii | দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার। কপাল লাল। তালুতে সোনালি পট্টি। সমস্ত দেহ সবুজ। ডানার গোড়ার পালক নীল। কান ঢাকনি সাদাটে। গলা সোনালি। বুকের দিকে সোনালি আভা দেখা যায়। নিচের দিকে বাদবাকি সবুজ। ঠোঁট ত্রিভুজাকৃতির, শক্ত মজবুত, কালচে। পা জলপাই রঙের। প্রধান খাবার: ছোট পাকা ফল ও ফুলের মধু। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। গাছের কাণ্ডে নিজেরা খোড়ল করে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/11/2018
শিয়ালে কীট কুড়ানি | Chestnut bellied Nuthatch | Sitta castanea
শিয়ালে কীট কুড়ানি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। দেশে যত্রতত্র দেখা যায় না, বিরল দর্শন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যৎসামান্য দেখা যেতে পারে। প্রাকৃতিক আবাসস্থল ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বন, ক্রান্তীয় পার্বত্য অরণ্য, খোলা পর্ণমোচী বন। শালবন বেশি পছন্দের। একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। হিংস নয়। স্বভাবে অত্যন্ত চঞ্চল। কাঠঠোকরা পাখিদের মতো গাছের খাড়া কাণ্ডে খুব দ্রুত হেঁটে উঠতে পারে। নিমেষেই গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে কীট-পতঙ্গ খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যায়। হয়তো এ জন্যই এদের নামকরণ হয় ‘কীট-কুড়ানি’। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, তিব্বত, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এরা বিশ্বব্যাপী হুমকি না হলেও উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘শিয়ালে কীট-কুড়ানি’, ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাট বেলিড নাটহ্যাচ’ (Chestnut-bellied Nuthatch), বৈজ্ঞানিক নাম: Sitta castanea | এরা ‘খয়রাপেট বনমালী’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি গড় দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৯ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামান্য পার্থক্য আছে। কপাল ও ঘাড় রূপালী-ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজ খাটো, কালো-ধূসর। মাথার দু’পাশ দিয়ে কালোটান ঘাড়ের কাছে পৌঁছে নিচে নেমেছে। ডানার প্রান্ত পালক কালচে-ধূসর। দেহতল শিয়ালে রঙের অথবা খয়েরি। ঠোঁট কালচে। পা ধূসর-কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা, পিঠ ও লেজ বাদামি ধূসর। দেহতল হালকা খয়েরি। বাদবাকি একই রকম। প্রধান খাবার: কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড়, মাকড়সা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। শ্যাওলা, তন্তু, শুকনো ঘাস, পালক ইত্যাদি বাসা বানানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/03/2017
কুড়া ঈগল | Pallas’s fish eagle | Haliaeetus leucoryphus
কুড়া ঈগল | ছবি: ইন্টারনেট মূলত উপমহাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। কাশ্মীর থেকে হিমাচল, পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের হিমালয়ের ১৮০০ ফুট উচ্চতায় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ পর্যন্ত বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়াও দক্ষিণ রাশিয়া, মধ্য এশিয়া হয়ে ট্রান্স বৈকালিয়া, দক্ষিণ পারস্য উপসাগর ও উত্তর বার্মায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আমাদের দেশের বড় নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় কিংবা দিঘি-নালার আশপাশে এক সময় বেশ দেখা যেত। গত কয়েক দশক ধরে এদের উপস্থিতি অপ্রতুল্য। যতদূর জানা যায়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও এদের অবস্থা সংকটাপন্ন। সে তুলনায় বাংলাদেশে উপস্থিতি সামান্য ভালো। এদের খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও বড় বড় বৃক্ষনিধনের ফলে প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। এ পাখি উঁচু গাছের মগডালে বাসা বাঁধে। নিরাপদ মনে হলে দীর্ঘদিন একই স্থানে ডিম পাড়ে। পরবর্তী বছরগুলোতে শুধু বাসাটাকে মেরামত করে নেয়। বেশির ভাগ জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। এরা রাত-বিরাতে ডেকে ডেকে প্রহর ঘোষণা করে। ডাকে ‘অহক্ষয়-অহক্ষয়’ সুরে। আই.ইউ.সি.এন এ প্রজাতির পাখিকে বিপন্নের তালিকায় স্থান দিয়েছে। এতে করে পরিষ্কার হয়ে গেছে এদের ভূত-ভবিষ্যত আমাদের কাছে। আমি নিজ গ্রামে ছোটবেলায় এদেরকে বহুবার দেখেছি। এখনো মাঝেমধ্যে নজরে পড়ে, তবে তা কালেভদ্রে। পাখির বাংলা নাম: ‘কুড়া ঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালাসেস ফিশি ঈগল’ (Pallas’s fish eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘হালিয়াইটাস লিউকরাইফাস’ (Haliaeetus leucoryphus), গোত্রের নাম: ‘এ্যাকসিপিট্রিদি’। লম্বায় ৭৬-৮৪ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ও গলা ফিকে সোনালি- পাটকিলে। পিঠ গাঢ় বাদামি। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ কালো, মাঝখানটায় সাদা বলয়। বুক থেকে নিচের দিকে ক্রমান্বয়ে ফিকে থেকে গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করেছে। ঠোঁট গাঢ় সেøট-কালো। পা হলদেটে সাদা। প্রধান খাবার: মাছ, সাপ, ব্যাঙ। প্রজনন সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ। বাসা বাঁধে উঁচু গাছের শিখরে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ঘাস, লতাপাতা ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৫-২৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/11/2013
ময়না পাখি | Common hill myna | Gracula religiosa
ময়না পাখি | ছবি: ইন্টারনেট পাখিটার নাম জানেন না, এমন মানুষ বোধকরি আমাদের দেশে খুবই কম আছেন। এরা এতই আকর্ষণীয় পাখি যে, উপঢৌকন হিসেবেও একে অপরকে প্রদানের রেওয়াজ চালু আছে এ দেশের মানুষের কাছে। এ পাখি না দেখলেও শুধু নামেই চেনেন অনেকে। শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়, গোটা বিশ্বে রয়েছে এদের ব্যাপক চাহিদা। কারণ এরা মানুষের কথাবার্তা হুবহু নকল করতে পারে। সেজন্য অবশ্য ওদের পস্তাতেও হচ্ছে খুব বেশি। নিছক শখের বশে অনেক চড়া দামে মানুষ এদের কিনে নিয়ে বন্দি করে রাখে। আমাদের দেশের মানুষও সে কাজটি করে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ি এলাকার কিছু লোক শিকার করে এদের মাংস পর্যন্ত খায়। এ কারণে এরা দুর্লভ হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। অথচ একটা সময় দেশের মিশ্র চিরসবুজ অরণ্যে এদের মোটামুটি সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। দেখা যেত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অরণ্যেও। এ পাখি সাধারণত মাটিতে নামে না। বৃক্ষচারী। সারাদিন গাছে গাছে বিচরণ করেই খাবার সংগ্রহ করে। জোড়ায় জোড়ায় কিংবা ছোট দলেও বিচরণ করতে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে মজাদার বিষয় হচ্ছে, স্ত্রী-পুরুষ পাখি আজীবনের জন্য জোড়া বাঁধে। সঙ্গী না মারা যাওয়া পর্যন্ত ওদের জোড় অটুট থাকে। এ পাখি সম্পর্কে জানার আগ্রহ যথেষ্ট রয়েছে দেশের মানুষের। অনেক পাঠক এদের নিয়ে লেখার অনুরোধ জানিয়েছেন আমাকে। পাঠকের সেই অনুরোধকে প্রাধান্য দিয়ে এ পাখি সম্পর্কে যৎসামান্য তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম। আশাকরি পাখিপ্রেমীরা এদের সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা নিতে পারবেন। পাখিটার বাংলা নাম: ‘ময়না’, ইংরেজি নাম: ‘কমন হিল ময়না’ (Common hill myna), বৈজ্ঞানিক নাম: গ্রাকুলা রেলিজিওসা (Gracula religiosa) | লম্বায় ময়না ২৫-২৯ সেন্টিমিটার। গায়ের পালক কালো। মাথা কুচকুচে কালো। ঘাড়ের উপরের দিক বেয়ে দু’পাশে দুটি বড় হলুদ লতিকা দু’ভাগ হয়ে চোখের নিচে নেমেছে। এদের কালো ডানায় একটি ছোট্ট সাদাটে পট্টি রয়েছে। চোখ গাঢ় বাদামি। ঠোঁট মজবুত গড়নের, বর্ণ কমলা-হলুদ। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। প্রজননের সময় গলা ও ঘাড়ে বেগুনি আভা দেখা যায়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। ময়না পাখি সর্বভুক। পোকামাকড় থেকে শুরু করে ফুলের মধু এবং ফল সবই খায়। পোষা ময়না ভাতও খায়। প্রজনন সময় বর্ষাকাল। মাটি থেকে প্রায় ১০-১৫ মিটার উঁচু গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। বাসা তৈরিতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, লতা ও পালক। একই বাসায় অনেক বছর ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫। শাবক উড়তে শিখলেই মা-বাবার কাছ থেকে সরে পড়ে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/03/2013