কালচে দামা | Naumanns Thrush | Turdus naumanni
কালচে দামা| ছবি: ইন্টারনেট ভূচর পাখি। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। এতদাঞ্চলে প্রজনন ঘটে না। চেহারা মোটামুটি আকর্ষণীয়। প্রাকৃতিক আবাসস্থল তুষারপাত হয় এমন তৃণভূমি অঞ্চল। পাথুরে এলাকায়ও দেখা যায়। বিচরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। পুরুষ পাখির গানের গলা ভালো। গাছের উঁচু ডালে বসে খুব ভোরে এবং গোধূলীলগ্নে গান গায়। স্বভাবে লাজুক। বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় লতাগুল্ম কিংবা ঝোপের নিচে। পরিত্যক্ত বা স্যাঁতস্যাঁতে এলাকার লতাপাতা উল্টিয়ে এবং ঘন ঘন ঠোঁট চালিয়ে খাবার খোঁজে। দ্রুত দৌড়াতে পারে, অসম্ভব দ্রুত। দুই পা একত্রিত করে লাফানোর মতো দৌড়ায়। গাছের উঁচুতে বিচরণ করে না। মাঝারি আকৃতির ফাঁকা ডালে বেশি দেখা যায়। দেশের সর্বত্র দেখা যাওয়ার নজির নেই। বৈশ্বিক বিস্তৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘কালচে দামা’, ইংরেজি নাম: ‘নাউম্যান’স থ্রাস’(Naumann’s Thrush), বৈজ্ঞানিক নাম: Turdus naumanni। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ২৩-২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৬৩-৮১ গ্রাম। মাথা, ঘাড় ও পিঠ জলপাই বাদামির সঙ্গে কালো ছিট। ডানার প্রান্ত পালক পাটকিলে। লেজ কালচে জলপাই রঙের। চোখের ওপর দিয়ে সাদা চওড়া টান ঘাড়ে ঠেকেছে। গলা আঁশটে ক্রিমসাদা। বুক থেকে লেজতল পর্যন্ত কালো-সাদা বুটিক। চোখ কালো। উপরের ঠোঁট কালচে, নিচের ঠোঁট হলদে জলপাই। পা ময়লা হলদে, নখ কালচে। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় ও কেঁচো। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। সাইবেরিয়া অঞ্চলে অধিক প্রজনন ঘটে। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ২-৭ মিটার উঁচুতে। গভীর কাপ আকৃতির বাসা। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, শুকনো ঘাস ও লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 25/08/2017
লাললেজ মৌটুসি | Fire tailed Sunbird | Aethopyga ignicauda
লাললেজ মৌটুসি | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। যত্রতত্র দেখা না গেলেও সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে নজরে পড়ে। মনোহর রূপ। কণ্ঠস্বরও সুমধুর। প্রথম দর্শনেই যে কেউ মুগ্ধ হবেন। তবে সেটি অবশ্যই পুরুষ পাখির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারায় বিস্তর তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি অনেকটাই নিষ্প্রভ। রূপের এমন পার্থক্য সত্ত্বেও নবীন পাখি দেখিয়েদের পক্ষে স্ত্রী-পুরুষ শনাক্ত করা কঠিন। ‘লাল লেজ মৌটুসি’ নামের এই পাখি যথেষ্ট অস্থিরমতি ও ফুর্তিবাজ। সারা দিন নেচেগেয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। যেন কোথাও একদণ্ড বসার সময় নেই ওদের। বিশেষত পুরুষ পাখির চঞ্চলতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। লাফালাফি বা নাচতে গেলে ওদের লম্বা লেজটা সোজা দাঁড়িয়ে যায়। সেই দৃশ্যটাও মনে রাখার মতোই। স্ত্রী পাখির লেজ খাটো হওয়ায় সেভাবে লেজের কারিশমা দেখাতে পারে না। প্রজনন মৌসুমে লাল লেজ মৌটুসির দেখা মেলে জোড়ায় জোড়ায়। আবার প্রজননের বাইরে একাকী দেখা যায়। মূলত এরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা। দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। ভূপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার মিটার উচ্চতায়ও এদের দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া এই পাখির বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও তিব্বত পর্যন্ত। হিমালয় অঞ্চলেও দেখা যায়। পাখির বাংলা নাম: ‘লাললেজ মৌটুসি’, ইংরেজি নাম: ‘ফায়ার-টেইলড সানবার্ড’ (Fire-tailed Sunbird), বৈজ্ঞানিক নাম: Aethopyga ignicauda | এরা ‘আগুন-রঙের বৃহত্তম মৌটুসি’ নামেও পরিচিত। এই প্রজাতির পুরুষ পাখি দৈর্ঘ্যে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার ও স্ত্রী পাখি সাত থেকে আট সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথার রং নীলাভ। ঘাড় রক্ত লাল। পিঠ ও লেজ কমলা-লাল। ডানায় জলপাই রঙের সঙ্গে নীল টান। গলা নীলাভ কালচে। বুকে হলুদের ওপর কমলা-হলুদ রঙের ডিম্বাকৃতি টান। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত জলপাই হলুদ। শরীরের তুলনায় লেজ বেশ লম্বা। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ধূসর জলপাই। পিঠ গাঢ় জলপাই। ডানায় নীলচে কালো পালক। লেজ খাটো ও বাদামি রঙের। উভয়ের ঠোঁট নীলচে কালো, লম্বা ও কাস্তের মতো বাঁকানো। চোখ ও পা কালো। প্রধান খাবার: ফুলের মধূ, ছোট পোকামাকড়, মাকড়সা ইত্যাদি। পাখিটির প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত। তবে অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। মোচাকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানায় গাছের তন্তু, শ্যাওলা ও মাকড়সার জাল দিয়ে। ডিম পাড়ে দুটি। তা দিয়ে ডিম ফুটাতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/05/2018
পাহাড়ি টুনটুনি | Mountain Tailorbird | Orthotomus cuculatus
পাহাড়ি টুনটুনি | ছবি: ইন্টারনেট পরিচিত প্রজাতির ‘টুনটুনি’ পাখির মতো যত্রতত্র এদের দেখা মেলে না। কেবলমাত্র দেখা মেলে ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমির বনে এবং ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্যে। পাহাড়ি চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে লতাগুল্মের ঝোঁপে এবং বাঁশবনে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এদের মায়াবী চেহারা। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। স্থিরতা নেই খুব একটা। যেন একদণ্ড বসার সুযোগ নেই কোথাও। এই আছে তো এই নেই। তবে যেখানেই থাকুক না কেন এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। জোড়ের পাখিটি সামান্য দূরে থাকলেও ডাকাডাকি করে ভাবের আদান-প্রদান চালিয়ে নেয়। সারাদিন নেচে-গেয়ে সময় কাটায়। লেজ উঁচিয়ে নাচে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি নানা কসরত দেখায় স্ত্রী পাখির মন ভোলানোর জন্য। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে। বেশ পরিপাটি বাসা। দুটি পাতাকে একত্রিত করে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা বাঁধে। অনেকটা দর্জির কাপড় সেলাই করার মতো। পাখির বাংলা নামঃ পাহাড়ি টুনটুনি, ইংরেজি নামঃ মাউন্টেন টেইলরবার্ড (Mountain Tailorbird), বৈজ্ঞানিক নামঃ Orthotomus cuculatus | এরা ‘সোনালি মাথা টুনি’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৭ গ্রাম। কপাল লালচে। মাথা সোনালি রঙের। ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজ ও ডানা লালচে। চোখের ওপরে সাদা-হলদে টান। গলা ও বুক ধূসর। পেট ও লেজতল উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁট দু’পাটি ভিন্ন রঙের। ওপরের অংশ কালো, নিচের ঠোঁট কমলা রঙের হলেও গোড়া শিঙকালো। চোখ বাদামি-কালো। পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি। স্ত্রী পাখির বর্ণে সামান্য তফাৎ রয়েছে। ওদের বুকে কালো রেখার উপস্থিতি নেই। প্রধান খাবারঃ পোকামাকড় বা কীট পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম মে-জুলাই সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে পাতা সেলাই করে। সেলাই করা বাসার ভেতর নরম তন্তু বা তুলা দিয়ে পরিপাটি করে নেয়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
লাল লতিকা হট্টিটি | Red wattled Lapwing | Vanellus indicus
লাল লতিকা হট্টিটি | ছবি: ইবার্ড যেখানে বড়সড়ো জলাশয় রয়েছে, সেখানে কম-বেশি ওদের বিচরণও রয়েছে। পানিতে সম্পূর্ণ শরীরটা ডুবিয়ে শিকার খোঁজে না। বড় জোর হাঁটুসমান পানিতে নেমে শিকার খোঁজে। ফাঁকা মাঠেও দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা জ্যোসনা রাতেও খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। একা কিংবা দলবদ্ধভাবেও বিচরণ করে। দেশের সর্বত্রই এ পাখিটাকে কমবেশি দেখা যায়। আমি প্রথম দেখেছি হাসাইলে। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় পড়েছে। গিয়েছি বছর চারেক আগে। নদীভাঙন দেখতে। পদ্মার পেটে ততক্ষণে হাসাইল বাজারটা হজম পক্রিয়ার পথে রয়েছে। হাসাইলবাসীর দুঃসময়ে পদ্মার পাড়ে পাখিটিকে দেখেছি সেদিন। একটি নয় ওরা সংখ্যায় একাধিক ছিল। দেখতে সুবিধাও হয়েছে তাই। কারণ পাখিরা একাকী থাকার চেয়ে দলবদ্ধ থাকা অবস্থায় বেশি সাহসী হয়। এতে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও পাওয়া যায় বেশি। পাখিটা দেখতে ভারি চমৎকার। কিন্তু কণ্ঠস্বর কর্কশ। দলের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা না হলে কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হট্টিটি..টি..টি..হট্টিট-টিট্’। স্ত্রী-পুরুষের কণ্ঠে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ কণ্ঠ একটু ভারী। কণ্ঠস্বর শুনেও স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য বোঝা যায়। পাখিটার বাংলা নাম: ‘লাল লতিকা হট্টিটি,’ ইংরেজি নাম: ‘রেড ওয়াটলড ল্যাপউইং’, (Red-wattled Lapwing) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ভ্যানেল্লাস ইন্ডিকাস’ (Vanellus indicus) গোত্রের নাম: ‘চারাড্রিআইদি’। আমাদের দেশে মোট দু’ধরনের হট্টিটি দেখা যায়। যথাক্রমে: ১. লাল লতিকা হট্টিটি, ২. হলুদ লতিকা হট্টিটি। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা। লতিকা চোখের দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গোল বৃত্তের রূপ নিয়েছে। সেটি দেখলে মনে হয় বুঝি ওরা চশমা পরে আছে। হট্টিটির গলা, বুক, মাথার তালু ও ঠোঁটের অগ্রভাগ কালো। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত লাল। চোখের পাশ থেকে ধবধবে সাদা টান ঘাড় হয়ে বুকের কিছু অংশসহ পেট ও লেজের তলা পর্যন্ত ঠেকেছে। ডানা বোজানো অবস্থায় পিঠ ও লেজের উপরি ভাগটা চকচকে বাদামির ওপর জলপাই রঙের আভা। পা বেশ লম্বা, বর্ণ হলুদ। হট্টিটি খুবই চতুর পাখি। চলাফেরায় থাকে অত্যন্ত হুঁশিয়ারি ভাব। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে বিপদ সংকেত, খুশির সংকেত, ডিমপাড়া ও বাচ্চা ফোটার সংকেত, বাচ্চা হারানোর সংকেত, বিপদ মুক্তির সংকেত। এ সুরগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কণ্ঠে তুলতে পারে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ পোকামাকড়, কেঁচো, কচি শাকসবজি ইত্যাদি । প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। মিলন শেষে মাটির অগভীর গর্তে অথবা মাঠ-প্রান্তরের নিরিবিলি স্থানে বাসা বাঁধে। বাসা দেখতে হাস্যকর। মাটির ঢেলা দিয়ে তৈরি করে। চারপাশে ছোট ছোট মাটির ঢেলা সাজিয়ে থালাকৃতির বাসা বানিয়ে মাঝখানে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। হট্টিটির বাচ্চাদের জলপান বেশ মজাদার। মা পাখিটা জলে ভেজে বাচ্চাদের কাছে এলে ওরা মায়ের ভেজা লোম চুষে জলপান করে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/09/2012
দেশি মেটেধনেশ | Indian Grey Hornbill | Ocyceros birostris
দেশি মেটেধনেশ | ছবি: ইন্টারনেট দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি অদ্ভুত গড়নের ‘দেশি মেটেধনেশ’। এক সময় রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ বনাঞ্চলে দেখা যেত। শুষ্ক বনভূমির উঁচু গাছ-গাছালিতে বিচরণ করত। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে। বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও দেশি মেটেধনেশ বাংলাদেশে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তথাপিও প্রজাতিটিকে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। আমাদের দেশে মোট চার প্রজাতির ধনেশের সাক্ষাৎ মেলে। এদের প্রতিটি প্রজাতিরই স্বভাব কিংবা খাবার একই ধরনের। ধনেশ প্রজাতির সবাই প্রজনন সময়ে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। যেমন স্ত্রী পাখি স্বেচ্ছায় গাছের কোটরে ঢুকলে পুরুষ পাখি ওকে বন্দি করে রাখে। কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয় কাদামাটি দিয়ে। পুরুষ পাখি নিজেই কাদামাটি বহন করে এনে ঠোঁট দিয়ে লেপে দেয়। শুধু ছোট্ট একটি ছিদ্র রাখে বায়ু চলাচল এবং খাবারের জোগান দিতে। পুরুষ পাখিকেই খাবারের জোগান দিতে হয় তখন। ডিম-বাচ্চা ফুটলেও খাদ্যের চাহিদা মেটায় পুরুষ পাখিই। শাবক স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষ পাখিকেই খাবার জোগানে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চারা ফুরফুরে হলে ভেতর থেকে মা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে মাটির আস্তর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি মেটেধনেশ’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল’ (Indian Grey Hornbill), বৈজ্ঞানিক নাম: Ocyceros birostris | এরা ‘পুটিয়াল ধনেশ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৬১ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই। যেটুকু তফাত নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে, স্ত্রী পাখির ঠোঁটের ওপরের বর্ম ছোট ও ঠোঁটের ডগা অস্পষ্ট। বাদ বাকি পুরুষ পাখির মতোই। প্রজাতির পিঠ বাদামি-ধূসর। শরীরের পালকগুলো দেখতে অনেকটাই বালুকাময় মনে হয়। দেহের নিম্নাংশ কালচে ধূসর। ধূসর লম্বা লেজের মধ্য পালকের প্রান্ত সাদা। চোখের ওপরের ভ্রু প্রশস্ত সাদা। কান ঢাকনি কালচে ধূসর। ঠোঁট বাঁকানো, সূচালো। ঠোঁটের ওপর শক্তপোক্ত সেøট-কালো রঙের শিরন্ত্রাণ। পা ও পায়ের পাতা সেøট-কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঠোঁট হলুদ, শিরন্ত্রাণ নেই। প্রধান খাবার: গিরগিটি, টিকটিকি, ইঁদুর, গুবরে পোকা, ফল ও ফুলের পাপড়ি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। গাছের প্রকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৩৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/09/2014
বেসরা বাজ | Besra Sparrow Hawak | Accipiter virgatus
বেসরা বাজ | ছবি: ইন্টারনেট বাজ প্রজাতির পাখি। দেখতে চমৎকার। স্লিম গড়ন। স্বভাবে তত হিংস না হলেও শিকার ধরার প্রয়োজনে কিছুটা রুক্ষতা দেখায় বটে। ভালো পোষ মানে। পোষা বাজকে খাঁচায় বন্দির প্রয়োজন পড়ে না। পালনকর্তার নির্দেশে এদিক-সেদিক ওড়াউড়ি করে। দূর থেকে ইশরায় হাতছানি দিয়ে ডাকলে অথবা শব্দ করলে হাতে এসে বসে। বুনো বাজ শিকারে বের হয় একাকী। মাঝে মধ্যে জোড়ায় জোড়ায়ও দেখা যায়। প্রাকৃতিক আবাসস্থল চিরহরিৎ বন, ঘন বন। বিশেষ করে পতঙ্গ আছে এমন বনে বিচরণ আধিক্য। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, দক্ষিণ চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান মোটামুটি সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘বেসরা বাজ’, ইংরেজি নাম: ‘বেসরা’ (Besra Sparrow Hawak) বৈজ্ঞানিক নাম: Accipiter virgatus| প্রজাতির দৈর্ঘ্য ২৫-৩৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রঙে সামান্য তফাৎ রয়েছে। আকারে স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ গাঢ় নীল-ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালো। লেজ নীল-ধূসরের সঙ্গে ধূসর-সাদা ডোরা। দেহের তুলনায় লেজ লম্বা। দেহতল লালচে-সাদা মিশ্রণ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির ওপরের পালক গাঢ় বাদামী। উভয়ের ঠোঁট খাটো নীলচে কালো। পা সরু, হলদেটে। প্রধান খাবার: বড় পোকামাকড়, ছোট পাখি, ব্যাঙ, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ-জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। চিকন ডালপালা দিয়ে উঁচু গাছের ডালে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/02/2018
বাজপাখি | Common Buzzard | Buteo buteo
বাজপাখি | ছবি: ইন্টারনেট শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। নজরে পড়ে খোলা মাঠ-বিল প্রান্তরে। খরগোশ, সাপ, গলিত মাংস, কীটপতঙ্গ এসব শিকার করে। পারতপক্ষে জলাশয় থেকে মাছ শিকার করে না। চাষাবাদ হয় এমন ক্ষেত-খামারের কাছাকাছি বেশি নজরে পড়ে। ফসলের ক্ষেত্রেও বিচরণ রয়েছে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। অনেক ক্ষেত্রে ১০-১৫টির দলেও দেখা যায়। আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে অনেকখানি পরিধি নিয়ে ঘুরতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ শূন্যে ভেসে থাকতে পছন্দ করে। এরা শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে তেমন হিংস নয়। প্রজাতির চারাভিযান বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপ, রাশিয়া, আফ্রিকা, তুরস্ক, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। বিশ্বে এরা ভালো অবস্থানে নেই। >পাখির বাংলা নাম: ‘বাজপাখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন বাজার্ড’ (Common Buzzard), বৈজ্ঞানিক নাম: Buteo buteo | এরা ‘পাতি তিসাবাজ’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৪০-৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৪২৭ গ্রাম। প্রসারিত পাখা ১০৯-১৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী পাখি সামান্য বড়। মাথা, ঘাড়, পিঠ, ডানা ও লেজ কালচে বাদামির সঙ্গে সাদা ছোপ। ঘাড়ে, গলায় সাদা ছোপ স্পষ্ট। বুক, পেট ও বস্তি প্রদেশ হলদে বাদামির ওপর হলদে সাদা ছিট। চোখের বলয় হলুদ। কালো মণির চারপাশ বাদামি। বড়শির মতো বাঁকানো ঠোঁট কালো, গোড়া হলুদ রঙের। মুখের কিনারটাও হলুদ। পা হলুদ ও নখ কালো। প্রধান খাবার: খরগোশ, ছোট সাপ, ইঁদুর, টিকটিকি, ব্যাঙ, কাঁকড়া, পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মধ্য এপ্রিল। গাছের উঁচু শিখরে সরু ডালপালা দিয়ে অগোছালো বাসা বাঁধে। মাটিতে বা পাথুরে এলাকায়ও বাসা বাঁধে। একই বাসা বারবার ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ২-৪টি। তিন দিন অন্তর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৩-৩৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৬-৮ সপ্তাহ। তিন বছর বয়সে বয়োপ্রাপ্ত হয়। গড় আয়ু ২৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/05/2017