নওরঙ | Indian pitta | Pitta brachyura
নওরঙ | ছবি: ইন্টারনেট এরা ভারি লাজুক পাখি। গলাটা মিষ্টি। গান শুনলে যে কারোরই ভালো লাগবে। হয়তো এমনও হতে পারে শ্রোতা ওদের গানে মজে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু দেখা পাচ্ছেন না। হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তারপরও বের করতে পারছে না ওর অবস্থান। কারণ এরা গাছের পাতার আড়ালে নিজেকে বন্দি করে রাখে কৌশলে। এ পাখির বাংলা নাম অনেক। বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি ইত্যাদি। হিন্দি নাম নওরঙ। কোনো কোনো অঞ্চলে হালতি পাখি নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষীবিশারদ ‘অজয় হোম’ হিন্দি নামটার বাংলা করেছেন ‘বর্ণালি’। তবে এ দেশে ‘নওরঙ’ নামে বেশি পরিচিত। নওরঙের ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান পিট্টা,(Indian pitta)’ বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পিট্টা ব্রাকাইউরা'(Pitta brachyura) গোত্রের নাম: ‘পিট্টিদি’। লম্বায় নওরঙ ২০-২১ সেন্টিমিটার। লেজ একেবারেই খাটো। প্রথম দেখাতে মনে হবে বুঝি ওদের লেজই নেই। খুব ভালো করে পরখ করলে লেজটা ধরা পড়বে। ওদের পালকে রয়েছে লাল, সাদা, কালো, হলুদ, নীল, সবুজ ও বাদামি রঙের সংমিশ্রণ। মাথার ওপরটা হলদেটে পট্টির মতো। গলার নিচটা সাদা। চোখের দু’পাশ মোটা দাগের কাজল কালির টান দেওয়া। দাগটি একেবারে ঘাড়ে এসে ঠেকেছে। চোখের ওপর রয়েছে সরু সাদা টানা দাগ। পিঠ, কাঁধ সবুজ। ঠোঁট কালো। ডানার শুরুটা নীল, নিচের অংশ বাদামি। বুকের তলার দিকে লালচে বাদামি। লেজের নিচের পালক টুকটুকে লাল। পা ফিকে বেগুনি। নওরঙ পাতাঝরা জঙ্গলের বাসিন্দা। মাটিতে বিচরণ করে সর্বদাই। মাটিতে পড়ে থাকা পাতা উল্টে-পাল্টে খাবারের সন্ধান করে। কেঁচো, পোকামাকড় প্রধান খাবার।মিষ্টি গলার নওরঙ শিস দেয় বেশ উচ্চস্বরে। ‘হুই হুইট-টিউ… টিউট টিউট টু…’ সুরে গান গায়। সুরে ছান্দসিক তাল আছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি গানে বেশি পারদর্শী। গান গাওয়ার সময় মাথাটা ঘাড়ে ঠেকিয়ে আকাশমুখী হয়ে গান গায়। খুব বেশি উড়াল দিতে পারে না নওরঙ। থেমে থেমে ওড়ে। প্রজনন মৌসুম আষাঢ় থেকে শ্রাবণ। নিচু গাছের ডালে বাসা বাঁধে। বাসা লম্বাটে ধাঁচের। ডিম পাড়ে ৪ থেকে ৬টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৪ থেকে ১৬ দিন। বাচ্চা উড়তে শেখে ২০ থেকে ২৫ দিনে। উড়তে শেখার আগেই বাচ্চারা মাটিতে নেমে মায়ের পেছন পেছন হাঁটাহাঁটি করে। সে মুহূর্তেই বাচ্চারা বিপদে পড়ে যায় বেশি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 01/06/2012
দুধরাজ | Asian paradise flycatcher | Terpsiphone paradisi
দুধরাজ | ছবি: ইন্টারনেট শুধু গাছগাছালি নয়, প্রকৃতির সব ধরনের সুন্দরের আবাসস্থলই সুন্দরবন। যারা এ বনে গেছেন, তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তবে এটুকু বলতে হয়, একবার এ বনে গেলে বারবার যেতে ইচ্ছা করে যে কারোরই। এমনই অহঙ্কারী রূপ সুন্দরবনের। গিয়েছি সুপতির (শরণখোলা রেঞ্জ) জঙ্গলে। রেঞ্জ অফিসে প্রবেশ করে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়েছি ডেপুটি রেঞ্জারকে। তিনি আপ্যায়ন করে বনের ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিলেন। নদীর তীর ধরে হাঁটছি। কিছু অচেনা পাখি নজরে পড়তেই ক্যামেরাবন্দি করে নিয়েছি। এরই মধ্যে দেখতে পেয়েছি উঁচু গাছের ডালে বসে রয়েছে একটি ধবধবে সাদা পাখি। দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি। এ কী দেখছি! পাখি তো! দুধসাদা রঙের এ পাখি আগে কখনও দেখিনি। নাম শুনেছি। এবার নিজ চোখে দেখেছি। এ পাখির রূপের বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য নেই। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলব, আমাদের দেশের পাখিবিশারদরা এদের ‘স্বর্গীয় পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাখিটার বাংলা নাম: ‘দুধরাজ’। অঞ্চলভেদে সুলতান বুলবুল, হোসনি বুলবুল, নন্দনপাখি ইত্যাদি নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম: ‘এশিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার’ (Asian paradise flycatcher), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টেপসিফোন প্যারাডিসি’ (Terpsiphone paradisi)। পাখিটি বেশ লম্বা। লেজ ছাড়া ১৯-২২ সেন্টিমিটার। লেজসহ প্রায় ৩৩ সেন্টিমিটার লম্বা। শরীরের গড়ন চিকন। মাথায় কালো রঙের ঝুঁটি। ঝুঁটির চুলগুলো পালিশ করা কালো। কপালও কালো। ঠোঁট নীলচে, সামান্য বাঁকানো। গলা, বুক কালো। চোখের মণি নীল। পায়ের রঙ হালকা লালচে। পিঠের পালক অধিকাংশই ধবধবে রূপালি সাদা। ডানা ও লেজের পালক সাদা। কয়েকটা পালকে সাদার মাঝখানে কালো লম্বা লাইন। লম্বা লেজটি দুই পালক বিশিষ্ট। চুলের ফিতার মতো। এ হচ্ছে পুরুষ দুধরাজের শারীরিক বর্ণণা। অপরদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত চেহারা স্ত্রী দুধরাজের। ওদের লম্বা লেজ থাকে না। দেখতে সুশ্রীও নয়। মাথায় ঝুঁটি রয়েছে ঠিকই তবে পুরুষের মতো আহামরি রূপ নেই। পিঠের রঙ হালকা বাদামি, পেটে ধুসরের সঙ্গে সাদার মিশ্রণ। পাখিবিশারদ ছাড়া অন্য যে কেউ প্রথম দেখলে দুটিকে দুই প্রজাতির বলে ভুল করবেন। কণ্ঠস্বর কর্কশ। ভয় পেলে ‘কই কোঁ..কি.. ই..ই..ই..ক্যাঁচ..’ শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে। প্রজনন মৌসুমে মোলায়েম সুরে ডাকাডাকি করে। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে। কোনোটিই শ্রুতিমধুর নয়। স্বভাবে চঞ্চল। সুন্দরবনের বনমোরগ ওদের বন্ধু। সর্বদাই বনমোরগ-মুরগীর সঙ্গে ওঠবস করে। কারণ বনমোরগ ওদের শক্ত ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে খাবার সংগ্রহ করার সময় পোকামাকড় উঠে এলে তা খায় দুধরাজ। অপরদিকে বনমোরগেরও স্বার্থ আছে দুধরাজকে কাছে রেখে। সাপ-বেজি, বনবিড়াল ইত্যাদি নজরে এলে সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ শব্দ করে বন্ধুকে জানিয়ে দেয়। দুধরাজ শুধু সুন্দরবনে নয়, লোকালয়েও বাস করে। তবে একেবারেই কম। দুধরাজের প্রিয় খাবার কীটপতঙ্গ। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। গাছের সর্বোচ্চ ডালে ঘাস, লতাপাতা, মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফোটে ১৮-২০ দিনে। সব ডিম ফোটে না, সব শাবক বাঁচেও না। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 22/09/2012
চাতক পাখি | Pied cucko | Clamator jacobinus
চাতক পাখি | ছবি: ইন্টারনেট গানের গলা এদের বড়ই মধুর। ‘পিউ, পি-পি-পিউ’ সুরে ডাকে। জাদু করা সেই সুর বিলিয়ে এরা স্থান করে নিয়েছে মানুষের মনে, বাংলা সাহিত্যে ও গানে। এ দেশের খুব কম মানুষই আছেন, যারা এ পাখির নাম শোনেননি। তবে পাখিটি দেখেননি এ ধরনের মানুষের সংখ্যা তার চেয়েও অধিক। আমি নিজেও দেখিনি এতকাল। দেখেছি কেবল সেদিন। পাখি দেখতে বেরিয়েছি নিজ গ্রামে। সঙ্গে নিয়েছি একটি হাই রেজুলেশনের বাইনোকুলার। সেদিন গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা জঙ্গলে প্রবেশ করেছি। ভরদুপুর। গা ছমছম করছে। এ জঙ্গলে ক’বছর আগে এক স্কুলমাস্টার গলায় ফাঁস লাগিয়েছেন। আমি নিজেও তার লাশ দেখেছি। স্মৃতি রোমন্থন করে একটু ভড়কে গেছি। দ্রুত প্রস্থানের উদ্যোগ নিয়েছি। বেরুতে গিয়ে নজর ঠেকেছে একটা শিরিষ গাছের উঁচু ডালে। ওখানে একটি পাখি বসে এদিক-সেদিক ঘাড় ঘুরাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়ে পর্যবেক্ষণে লেগে গেলাম। বেশ সুন্দর পাখি। সাদা-কালো চেহারা। অন্য সব বর্ণের উপস্থিতি নেই। আগে কখনও অমন পাখি দেখেছি বলে মনে হয়নি। ডর-ভয় ভুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাখিটাকে ভালোমতো দেখে নিলাম। যখন নিশ্চিত হলাম, এটি গায়ক পাখি চাতক, তখন একটা তৃপ্তি বোধ করলাম। যাক, পর্যাপ্ত না হলেও কিছু চাতক রয়েছে রায়পুরের (লক্ষ্মীপুর) চরপাতা গ্রামে। সেদিন চাতক দেখে আমি কিছুটা অনুপ্রাণিত বোধ করেছি পাখিদের কল্যাণে কিছু একটা করতে। পরিকল্পনা করেছি, পৈতৃক সম্পত্তিতে প্রকৃতির এ সন্তানদের জন্য ছোট্ট পরিসরে একটি অভয়াশ্রম গড়তে। যাতে ওরা নির্বিঘ্নে রাতে ঘুমাতে পারে। চাতক পাখি নিয়ে চমৎকার একটি মিথও আছে। সেটি হচ্ছে,’মুমূর্ষু মা কিশোর ছেলের কাছে জলপান করতে চাইলেন। ছেলে মায়ের আকুতি ভুলে খেলায় মেতে রইল। ইতিমধ্যে মা পরপারে চলে গেছেন। ছেলে পড়েছে অনুশোচনায়। জল জল করে চেঁচিয়ে পাড়াময় ঘুরতে লাগল। এমনকি মাকে জল পৌঁছে দিতে ওপারে যেতে চাইল। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল পাখি বানিয়ে দিতে। সৃষ্টিকর্তা ওর আবেদনটা মঞ্জুর করলেন। হয়ে গেল সে পাখি। লোকের বিশ্বাস, ওই কিশোর আজও উড়ে উড়ে স্রষ্টার কাছে জল প্রার্থনা করছে। এদের বাংলা নাম: ‘চাতক পাখি,| ইংরেজি নাম: ‘পায়েড কুক্কু’ (Pied cucko)| বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ক্লামেটর জাকোবিনাস’ (Clamator jacobinus)। গোত্রের নাম: ‘কুকুলিদি’। এ পাখি লম্বায় ৩৩-৩৫ সেন্টিমিটার। বর্ণ সাদা-কালো। ঝুঁটি, ঘাড়, পিঠ ও ডানা কালো। ডানার পাশটায় সামান্য সাদা ছোপ। গলা, বুক, পেট, লেজের নিচটা কালো। লেজের প্রান্ত সাদাটে। চক্ষু, পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। চেহারায় রাগী ভাব। তবে অত হিংস্র নয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ এদেরকে বড় বুলবুল পাখি বলে ভুল করে। এরা গাছের উঁচু ডালে অবস্থান করে। মাঝেমধ্যে মাটিতে নেমে আসে। মাটিতে হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। সমানতালে পা চালিয়ে হাঁটতে পারে না। প্রধান খাবার: ঘাসফড়িং, শুয়োপোকা, পিঁপড়া, লতাগুল্মের কচিপাতা। প্রজনন সময় জুন থেকে আগস্ট। কোকিলের মতো পরের বাসায় ডিম পাড়ে। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 31/08/2012
আবাবিল | Barn swallow | Hirundo rustica
আবাবিল | ছবি: ইন্টারনেট পবিত্র কোরআন শরিফের ‘সুরা ফিল’-এর ৩ নং আয়াতে একটি পাখির বর্ণনা আছে। পাখিটির নাম ‘আবা-বিল’। সেটিই আমাদের দেশের আবাবিল পাখি। সে কারণে পাখিটির প্রতি দুর্বলতাও সৃষ্টি হয়েছে। যেভাবে হোক এ পাখি চিনতে হবে। এর আগে কালো লেজচেরা যে পাখিকে আবাবিল পাখি হিসেবে জেনেছি, সেটি আসলে আবাবিল নয়। দেখতে অবিকল আবাবিলের মতো হলেও ওরা অন্য গোত্রের। যারা আবাবিল পাখি চেনেন না, তাদের ধারণা, ওরাই আবাবিল। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, সাধারণত আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবাবিল উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে হিমালয় পেরিয়ে এ দেশে আসে। ফিরে যায় এপ্রিল থেকে মে নাগাদ। অর্থাৎ ৮-৯ মাস এ দেশে অবস্থান করে। আগেই বলেছি, এ পাখির প্রতি দুর্বলতা পবিত্র কোরআনের উদৃব্দতি থেকে। কাজেই আবাবিল চেনা চাই-ই। খুব বেশি দূরে যেতে হয়নি এ পাখি দেখতে। বছর তিনেক আগে চর ইন্দুরিয়ায় গেছি। এটি রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) উপজেলায় অবস্থিত। আমার সঙ্গে ছিল অনুজ সাংবাদিক এবিএম রিপন। রায়পুর থেকে খানিকটা দূরে চর ইন্দুরিয়া। আগে কখনও যাওয়া হয়নি। এই প্রথম মেঘনার চরে গেছি। বিশাল চর। চারদিকে ধুধু বালুচর। রোদে পুড়ে খাঁ খাঁ করছে চরের বালুকারাশি। বালুকারাশির ওপর তীক্ষষ্ট সূর্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়াতে দৃষ্টি দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। চোখ ধাঁধিয়ে উঠছে নিমেষেই। অনেক কষ্টে দৃষ্টি প্রসারিত করে খোলা প্রান্তরের আশপাশ দেখে নিচ্ছি। প্রকৃতিকে উপভোগ করার মুহূর্তেই আমার নজরে পড়েছে এক ঝাঁক লেজচেরা পাখি। ওরা চরের ওপর চক্কর দিচ্ছে। বসছে না কোথাও। দলছুট দু’একটি পাখি উড়ন্ত অবস্থায় পতঙ্গের পিছু নিচ্ছে। প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছোঁ মেরে শিকার ধরছে। দৃশ্যটি মজাদার বটে। তাকিয়ে রয়েছি অনেকক্ষণ। ওদের বসার অপেক্ষায় রয়েছি। না হলে ভালো করে দেখা যাবে না। মিনিট পঁচিশেক অপেক্ষার পর সে সুযোগটি এসেছে। মাত্র দুটি পাখি চরের পাশে পত্রপল্লবহীন একটি গাছের ডালে বসেছে। সে সুবাদে ওদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এ পাখির রঙ-রূপ আহামরি না হলেও দেখতে একেবারে মন্দ লাগেনি। পরখ করে দেখলে মায়াবী মুখটা ধরা পড়ে। বলে রাখা ভালো চর ইন্দুরিয়ার পাশেই ‘চর আবাবিল’ নামে একটি প্রসিদ্ধ স্থান রয়েছে। মিথ থেকে জানা গেছে, আবাবিল পাখিদের আধিক্যের কারণেই এ নামকরণ। বাংলা নাম: ‘আবাবিল’, ইংরেজি নাম: ‘বার্ন সোয়ালো’ (Barn swallow), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘হিরানডো রাসটিকা’ (Hirundo rustica), গোত্রের নাম: ‘হিরানডিনিদি’। লম্বায় ১২-১৩ সেন্টিমিটার। কপাল গাঢ় বাদামি। পিঠ পালিশ করা গাঢ় নীল। ডানার পালক, লেজ কালচে। চিবুক, গলা বাদামি। বুক মলিন সাদা। পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। আবাবিল পাখির লেজ চেরা। উড়লে চিলতে চাঁদের মতো দেখায়। কীটপতঙ্গ আবাবিলের প্রধান খাবার। এরা উড়ন্ত অবস্থায় পতঙ্গ শিকার করে। দলবদ্ধভাবে শিকার খোঁজে। নদী, বিল, হাওর-বাঁওড় কিংবা বালুচরে এদের দেখা যায় বেশি। আবাবিল পাখি যদিও গায়ক পাখির আওতায় পড়ে না, তথাপি সুরটা মধুর। ‘চিক্- চিক্… লি উইট’ সুরে ডাকে। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুলাই। বাসা বানায় পুরনো দালানের ফাঁকফোকরে। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। মৌসুমে দু’বার ডিম দিতে দেখা যায়। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই ডিমে তা দেয়। ফুটতে সময় নেয় ১৬-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 18/08/2012
শ্যামা | White rumped Shama | Copsychus malabaricus
শ্যামা | ছবি: ইন্টারনেট ‘পুউ উ উ-পিউউ-উস’ মিষ্টি সুরটা কানে বাজতেই ভাতঘুমটা ভেঙে গেছে। আহ, কী মধুর সুর! নিজ ঘরঘেঁষা আম শাখা থেকে সুরটা ভেসে আসছে। পরিচিত সুর। পাখিটা চিনি। নামও জানি। ওকে এক মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না। লুকিয়ে গান গাচ্ছে। ওদের স্বভাবটাই এমন। লুকিয়ে-চুরিয়ে গান গাওয়া। জানালার গ্রিল ভেদ করে দৃষ্টিটা বাইরে চলে গেছে ইতিমধ্যে। পাতার ফাঁক-ফোকরে খুঁজছি পাখিটাকে। দেখা পেলে ক্লিক করার সুযোগ পাব। ক্যামেরা, দুরবিন, টেপ রেকর্ডার, নোটশিট, রঙ পেন্সিল সব সময় হাতের নাগালে রাখি। খুঁজে যেন হয়রান হতে না হয়। পাখি দেখিয়েদের এ ক’টা জিনিস কাছে রাখা প্রয়োজন। কারণ ঘরের আশপাশের পাখিগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করতে গেলে এ ছাড়া বিকল্প নেই। বলে রাখা ভালো, পাখিরা ছবি তুলতে আপনাকে সময় দেবে না। আপনার জন্য আলাদা পোজও দেবে না। ওর পোজে সন্তুষ্ট হয়েই আপনার ক্যামেরা অন করতে হবে। সেটা যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে, পারলে দূর থেকে ক্লিক করতে করতে এগোতে হবে। যাতে উড়ে গেলেও ওর স্মৃতিটা অন্তত থেকে যায় আপনার ক্যামেরায়।মিনিট পাঁচেক ধরে খুঁজে অবশেষে পাখিটাকে নজরবন্দি করতে সক্ষম হয়েছি। ততক্ষণে অবশ্য ওর মিষ্টি সুর উধাও। মিনিট খানেকের মাথায় পাখিটাও উধাও। চোখের সামনে থেকে পাখিটা উধাও হলেও আমার মনে গেঁথে রয়েছে দীর্ঘদিন। কারণও আছে অবশ্য। যে পাখিদের নিয়ে এত গান এবং এত এত সাহিত্য রচনা হয়েছে, তাকে কি ইচ্ছে করলেই ভোলা যায়! যে পাখির কথা শুনলেন এতক্ষণ, তার বাংলা নাম: ‘শ্যামা’| ইংরেজি নাম: White rumped Shama| বৈজ্ঞানিক নাম: Copsychus malabaricus| লম্বায় শ্যামা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার (লেজের প্রান্ত থেকে ঠোঁটের অগ্রভাগ পর্যন্ত)। এদের শরীরের মোট ৬০ ভাগজুড়ে লেজের অংশ। মাথা, গলা, বুক, পিঠ, ডানা কুচকুচে কালো। পুরুষ পাখির পিঠ ও লেজের মধ্যাংশ ধবধবে সাদা। পেট উজ্জ্বল বাদামি-পাটকিলে। লেজের পালকের উপরিভাগ কালো, নিম্নাংশের বেশির ভাগ সাদা, অগ্রভাগ কালো ও হাল্কা বাদামি। লেজের পালকের পাশেই রয়েছে সাদার টান। ঠোঁট হালকা কালো, পা হালকা গোলাপি। চোখের মণি হালকা বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। শ্যামাকে অনেকে দোয়েল বলে ভুল করেন। এদের লম্বা লেজটা না থাকলে এ ভুলটা আরও বেশি বোধ হতো।শ্যামা গায়ক পাখি। কণ্ঠটা ভীষণ মধুর। এরা অন্য পাখিদের কণ্ঠ নকল করতে ওস্তাদ। একেবারে হুবহু নকল করতে পারে। গভীর জঙ্গল এদের পছন্দ। গোসল করে নিয়মিত। বেশ ঝকঝকে দেখায় তাই। রোদ এদের শত্রু। যতটা সম্ভব ছায়া-শীতল স্থানে থাকতে পছন্দ করে। শ্যামা পতঙ্গভুক পাখি। মাটির পতঙ্গ ওদের বেশি পছন্দ। মাটির ওপর পড়ে থাকা পাতা উল্টিয়ে খাবার খোঁজে। এদের প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। সময়টা এলে পুরুষ পাখি অনবরত মিষ্টি সুরে গান গাইতে থাকে। মিলন শেষে গাছের কোটরে বাসা বানায়। কোটর স্বল্পতার কারণে মাটির কাছাকাছি পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। বাসার ভেতর ঘাস, লতাপাতা দিয়ে নরম গদি তৈরি করে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। (বি. দ্র. দয়া করে পাখিদের খাঁচায় বন্দি করবেন না) লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 08/07/2012
কমলাদামা | Orange Headed Thrush | Zoothera citrina
কমলাদামা | ছবি: ইবার্ড এ পাখি আমাদের প্রতিবেশী হলেও অনেক ভীতু এবং লাজুক স্বভাবের। স্বভাবে লাজুক হলেও এরা মানুষের একেবারে কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। মানুষও খুব একটা ক্ষতি করে না এদের। বরং আদর করে নানা নামে ডাকে। কেউ ডাকে কমলা বউ, কেউ ডাকে কমলাফুলি, আবার অনেকেই ডাকে কমলা দোয়েল নামে। তবে ‘কমলাদামা’ নামেই এটি অধিক পরিচিত। বাংলাদেশের সর্বত্র কমলাবউ পাখির বিচরণ। কম-বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সবখানেই। এদের অধিকাংশই বিচরণ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। তাই অনেকের ধারণা, কমলাবউর বাস ওই অঞ্চলেই। প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। রাজধানীর অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি স্থানেও এদের দেখা মেলে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ২০১০ সালে একবার দেখেছি। তারপর আর দেখিনি। বাসা তৈরির উপযুক্ত গাছপালার অভাবে রাজধানী থেকে এরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কমলাবউর রূপ যেমন, তেমনি গুণ। বিভিন্ন ধরনের কসরত দেখাতে পটু এরা। বিশেষ করে হিংস্র পোকামাকড় কিংবা ছোট সাপের বাচ্চা শিকারের কৌশল বেশ দর্শনীয়। অনেকটা নেচে-নেচে শিকার ধরে। এ পাখির ইংরেজি নামঃ অরেঞ্জ হেডেড থ্রাস (Orange Headed Thrush), বৈজ্ঞানিক নামঃ জুথেরা সিট্রিনা (Zoothera citrina), গোত্রঃ ‘মুস্কিকাপিদি’। কমলাবউ দোয়েল আকৃতির পাখি। হাঁটেও দোয়েলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। ফলে অনেকে এদের ‘দোয়েল’ বলে ভুল করে। লম্বায় এরা ২০ থেকে ২২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একরকম মনে হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে পুরুষ পাখি। কমলাবউ পাখির মাথা, ঘাড়, গলা ও বুক কমলা-বাদামি। তলপেট ও লেজের নিচের দিক সাদাটে। চোখের মণি গাঢ় পিঙ্গল। চোখের নিচ বরাবর পরপর তিনটি সাদা ছোপ। পিঠের পালক নীলাভ ছাই বর্ণের। পায়ের রঙ ফিকে গোলাপি। স্ত্রী পাখির বুকের রঙ সামান্য ফিকে। পিঠের ওপরের পালক ছাই ধূসর।কমলাবউর প্রজনন সময় মার্চ থেকে মে। এ সময় স্ত্রী-পুরুষ পাখি একসঙ্গে চলাফেরা করে। অন্য সময় এরা মূলত আলাদা বাস করে। বাসা বাঁধার ব্যাপারে এরা যথেষ্ট খুঁতখুঁতে। পছন্দসই জায়গা খুঁজে পেলে তবে বাসা তৈরি করে। বাসার আদল চায়ের কাপের মতো। এমনকি চায়ের কাপের মতো হাতলও বানায়। হাতলটা দিয়ে গাছের ডালপালার সঙ্গে মজবুত করে বেঁধে রাখে। বাসা তৈরির উপকরণ শুকনো ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি। আর যাই হোক বাসাটা এরা খুবই সুন্দরভাবে বানাতে পারে। বাসা বানানো হলে তিন থেকে চারটি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। শান্ত স্বভাবের এ বাচ্চাদের স্বাবলম্বী হতে মাসখানেক লেগে যায়। তবে উড়তে শিখতে সময় নেয় ২০ দিনের মতো। তারপর মা-বাবার সঙ্গে থেকে ধীরে ধীরে শিকারের কৌশল রপ্ত করে। প্রধান খাবারঃ মূলত কীটপতঙ্গই এদের। সুযোগ পেলে কেঁচো, সাপের ছোট বাচ্চা শিকার করতে এরা পিছপা হয় না। খেজুরের রস কমলাবউর বেশ প্রিয়। রসের স্বাদ নিতে প্রায়ই খেজুর গাছের আশপাশে ঘুরঘুর করে। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
বউ কথা কও | Indian cuckoo | Cuculus micropterus
বউ কথা কও | ছবি: ইবার্ড আমাদের দেশে রাতজাগা পাখির বাস খুব একটা নেই। উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে রয়েছে লার্জ-টেইলড নাইটজার (রাতচরা), বিভিন্ন প্রজাতির পেঁচা, নিশিবক, বউ কথা কও ইত্যাদি। দেখা গেছে, এসব প্রজাতির পাখি স্বস্থানে বসেই রাত-বিরাতে বিলাপ করে। একমাত্র ব্যতিক্রম ‘বউ কথা কও’ পাখি। এ পাখিরা উড়তে উড়তেই ডাকাডাকি করে। দিনে যেমনি ডাকে তেমনি রাতেও। চাঁদনি রাত এদের প্রিয়। আকাশে চাঁদের ঝিলিক দেখলেই এরা ‘বউ কথা কও, হক কথা কও’ বা ‘টুটু…টুটু’ সুরে ডাকাডাকি করে (শব্দটি যার কানে যেমন বাজে) এবং একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে উড়ে বেড়ায়।” তথ্যটি জানিয়েছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।বউ কথা কও পাখির সুরের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে প্রায় তিন যুগ আগেই। তবে তখন ওদের গগনবিদারী আর্তচিৎকারটাই শুধু শুনেছি, কিন্তু দেখিনি। আকাশে উড়ে উড়ে বিলাপ করতে শুনেছি। ওই অবস্থায় দেখেছিও বহুবার। উড়ন্ত অবস্থায় মালুম করতে পারিনি ওদের বর্ণবৈচিত্র্য। কাছাকাছি থেকে দেখেছি অনেক দিন আগে। রায়পুরের (লক্ষ্মীপুর) ‘পূর্ব চরপাতা’ নামক স্থানে। বৈশাখের শেষ বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে জারুলশাখায় ওর সাক্ষাৎ পাই। খানিকটা উঁচুতে বসেছিল। কাজেই আশ্রয় নিতে হয় বাইনোকুলারের। পাখিটা ওপরের দিকে মাথাটা খাড়া করে রেখেছিল। পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টাও করেছে। সে সুবাদে নিচ থেকে উঁকি মেরে ওকে দেখে নিয়েছি। আসলে এ পাখিদের স্বচক্ষে দেখা অনেকটাই কঠিন ব্যাপার। যদিও এরা গ্রীষ্মকালে সচরাচর গ্রামগঞ্জে বিচরণ করে; তথাপি দেখা মেলে না। শুধু কানে সুর ভেসে আসে। কারণ এরা বেশ সুচতুর ও লাজুক। আত্মরক্ষাকে প্রাধান্য দেয়। আড়াল-আবডালে নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখে। ভূমি থেকে অনেকখানি ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে ওড়াউড়ি করে। ফলে সর্বসাধারণের নজরে খুব একটা পড়ে না। গ্রামগঞ্জে বউ কথা কও পাখি নিয়ে অনেক মিথ আছে। এর সঙ্গে বাঙালির একটা আবেগও জড়িয়ে আছে। আমাদের সাহিত্যে পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছে বউ কথা কও পাখি। অনেক গান, কবিতা রচিত হয়েছে এদের নিয়ে। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন বউ কথা কও পাখি নিয়ে। এদের নিয়ে যে মিথটি বেশি প্রচলিত তা হচ্ছে, ‘শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার এক পর্যায়ে শাশুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে বউকে অভিশাপ দিলে সে পাখি হয়ে যায়। স্বামীর প্রতীক্ষায় একটা গাছের ডালে বসে থাকে পাখিটি। স্বামী বেচারি দূরদেশ থেকে এসে মায়ের কাছে জানতে চায় তার আদুরে বউটি কোথায়? মা আঙুল তুলে গাছের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে তোর বউ’। বউয়ের উদ্দেশে ছেলে প্রশ্ন ছুড়ে, ‘বউ তুমি পাখি হয়ে গাছে বসে রয়েছ কেন?’ বউ জবাব দেয় না। কারণ সে মানুষের কথা বুঝতে সক্ষম নয়। বাধ্য হয়ে স্বামী বেচারি সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি পেশ করল, ‘আমাকে পাখি বানিয়ে দাও। আমি যেন বউয়ের ভাষা বুঝতে পারি’। সৃষ্টিকর্তা আবেদনে সাড়া দিয়ে তাকে পাখি বানিয়ে দেন। আর সে উড়ে উড়ে বউয়ের উদ্দেশে ডাকতে লাগল ‘বউ কথা কও … বউ কথা কও’। পাখিটির ইংরেজি নাম: ইন্ডিয়ান কুক্কু, (Indian cuckoo) বৈজ্ঞানিক নাম: কুকুলাস মাইকোপটেরাস, (Cuculus micropterus) গোত্র: কুকুলিদি। লম্বায় এরা এক ফুটের চেয়ে সামান্য বেশি। শরীরের উপরাংশ গাঢ় ধূসরের সঙ্গে পাটকিলে আভার সংমিশ্রণ। নিম্নাংশ মলিন ধূসর এবং সাদাটে মিশ্রণ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম। পার্থক্য সামান্য। স্ত্রী পাখির ডানা মলিন ধূসর, বুক পাটকিলের ওপর লালচে আভা। চোখের মণি উভয়েরই পাটকিলে। গোল চোখের পাতা কমলা হলদেটে। ঠোঁট পাটকিলে। চিবুক, পা, আঙুল হলদেটে। বউ কথা কও পাখি শীতকালে দেখা যায় না। গ্রীষ্মে এদের আগমন ঘটে। প্রিয় খাবার পোকামাকড়। গাছের ওপর বসেই এরা পোকামাকড় শিকার করে। পারতপক্ষে জমিনে এরা খুব একটা নামে না। এদের যৌনজীবন সুখকর নয়। স্থায়ীভাবে সাংসারিকও নয়। ব্যভিচারী যৌনজীবনে অভ্যস্ত। কোকিলের মতো বউ কথা কও বাসা বাঁধতে জানে না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এরা অন্য পাখিদের বাসায় চুরি করে ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। বাচ্চা লালন-পালন করে অন্য পাখিরাই। বউ কথা কও পাখিদের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।