কাঠ শালিক | Chestnut tailed Starling | Sturnus malabaricus
কাঠ শালিক | ছবি: ইন্টারনেট এ প্রজাতির অন্যান্য পাখি আমাদের প্রতিবেশী হলেও এদের ভেতর মানুষকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। যার ফলে পরিচিত এ পাখি সর্বসাধারণের কাছে অপরিচিত রয়ে গেছে অদ্যাবধি। এদের বিচরণ অপেক্ষাকৃত হালকা বন-বনানীতে। আবার শহরের দর-দালানেও বসত করে। তবে ভূমিতে খুব একটা বিচরণ করে না। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে প্রায়ই দেখি এ পাখিদের। আমার কাছে এদের বেশ সুদর্শন পাখি মনে হয়। গায়ের বর্ণ অতি উজ্জ্বল না হলেও দেখতে ভালোই লাগে। চলাফেরা করে এরা দল বেঁধে আবার জোড়ায়-জোড়ায় কিংবা একাকীও বিচরণ করে। মানুষকে এড়িয়ে চললেও মাঝেমধ্যে বিচরণ করে কোলাহল সম্পূর্ণ এলাকায়। এদের নিয়ে কথা বলতেই প্রসঙ্গক্রমে দেশের বিশিষ্ট পাখি বিশারদ শরীফ খান জানিয়েছেন, এরা দেশে সন্তোষজনকহারে বিচরণ করছে। বিচরণ করছে ঢাকা-শহরেও। তিনি আরো জানিয়েছেন, খিলগাঁও রেল গেটের কাছে একজোড়া পাখিকে বাসা বানিয়ে ডিম-বাচ্চা ফোটাতে দেখছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। এদের বাংলা নাম: ‘কাঠ শালিক’ ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাটটেইলড স্টার্লিং’(Chestnut-tailed Starling), বৈজ্ঞানিক নাম:‘স্টুরনাস মালাবারিকাস’ (Sturnus malabaricus), গোত্রের নাম: ‘স্টুরনিদি’। আমাদের দেশে প্রায় ৬-৭ প্রজাতির শালিক নজরে পড়ে। যথাক্রমে : ভাত শালিক, গোবরে শালিক, কাঠ শালিক, বামন শালিক, ঝুঁটি শালিক ও গাং শালিক। ‘চিত্রা শালিক’ নামে এক প্রজাতির শালিক সম্পর্কে জেনেছি ড. রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামক গ্রন্থে’। পাখিটা সচরাচর দেখা যায় না। দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। সৌভাগ্যটা অর্জন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করব। কাঠ শালিক লম্বায় ২০-২৩ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় ধূসরাভ-রুপালি। থুতনি-গলা সাদা। ঠোঁটের গোড়া নীল, মাঝখানটা সবুজ এবং ডগাটা হলুদ। পিঠ রুপালি ধূসরের ওপর হালকা খয়েরি। ডানার প্রান্তটা কালো। গলা ফিকে লালচের ওপর সাদাটে ধূসরের টান। বুক, পেট পাটকিলে। পা হলদেটে। লেজের উপরিভাগ ধূসর, তলদেশ পাটকিলে। কাঠ শালিকের খাদ্য তালিকায় রয়েছে কীটপতঙ্গ, ছোট ফল, ফুলের মধু ইত্যাদি। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। নরম লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিমে তা দেয় শুধু স্ত্রী পাখি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 31/10/2012
ছোট বাবুইবাটান | Small pratincole | Glareola lactea
ছোট বাবুইবাটান | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন, স্থানীয় প্রজাতির পাখি ‘ছোট বাবুইবাটান’। বাংলাদেশ ছাড়াও দেখা মেলে ভারত, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে বালুচরে। পদ্মা ও যমুনার চরে ব্যাপক দর্শন মেলে। এ ছাড়াও নদ-নদী কিংবা মোহনার দ্বীপাঞ্চলে অথবা সৈকতের বেলাভূমিতে শিকার খুঁজে বেড়াতে দেখা যায়। হাঁটাহাঁটি করে খুব দ্রুততার সঙ্গে। আবার অনেকে মিলে জলের কিনারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। একটা সময় এসে একেবারেই চুপচাপ থাকে, দূর থেকে দেখলে মনে হয় তখন বুঝি ওরা প্রার্থনারত রয়েছে। ওড়ে খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। তবে সোজাসুজি না উড়ে এঁকেবেঁকে ছান্দসিক তালে ওড়ে। তেমনিভাবে উড়ে উড়ে এরা শিকারের পিছু নেয়। মানুষ অথবা অন্য যে কোনো বন্যপ্রাণী ওদের বাসার কাছাকাছি গেলে মাথার ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে চক্কর দিতে থাকে। এতে করে ওরা আরো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ওদের বাসার অবস্থান শনাক্ত হয়ে যায়। আর শত্রুপক্ষ সে সুবাদে ওদের ডিম-বাচ্চার ক্ষতি করার করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়ে যায়। যার ফলে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটে ব্যাপক। ছোট বাবুইবাটানদের কণ্ঠস্বর সুমধুর নয়। ‘টিক টিক টিক… টাক টাক টাক’ আওয়াজ করে। উত্তেজিত হলে কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে। স্বর তখন আরো কর্কশ হয়ে ওঠে। পাখির বাংলা নাম: ‘ছোট বাবুইবাটান’, ইংরেজি নাম: ‘স্মল প্রাটিনকোল’, (Small pratincole), বৈজ্ঞানিক নাম: Glareola lactea| লম্বায় ১৬-১৭ সেন্টিমিটার। কপাল হালকা বাদামি। চোখের কোণ থেকে ঠোঁটের গোড়া পর্যন্ত কাজলটান। ঠোঁট নীলাভ কালো, গোড়ার দু’পাশ লাল। চোখের বলয় সাদা, তারা নীলাভ। পিঠ বালুধূসর। ডানার দিকে হালকা বাদামির ওপর লালচে আভা। ডানার প্রান্ত কালো। ওড়ার পালক কালো। লেজের কিনারটা কালো। দেহতল সাদা। পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে উড়ন্ত কীটপতঙ্গের প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম ডিসেম্বর থেকে মার্চ। কোনো কোনো অঞ্চলে মার্চ থেকে এপ্রিলে বাসা বাঁধে (অঞ্চলভেদে সময়ের হেরফের লক্ষ্য করা যায়)। বাসা বাঁধে বেলাভূমি কিংবা পাথুরে এলাকায়। একাকী কিংবা কলোনি টাইপের বাসা বানাতেও দেখা যায়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/09/2014
ধূসর সারস | Demoiselle Crane | Anthropoides virgo
ধূসর সারস | ছবি: ইবার্ড বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দেশে আগমন ঘটে শীতে। হিমালয় পাড়ি দিয়ে মাঝেমধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চলে উপস্থিত হয়। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। মরু অঞ্চলেও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা বড়সড়ো ঝাঁকে। চলার পথে কারো ফসলের খেতে দলবেঁধে নামলে মুহূর্তেই ফসল তছনছ করে দেয়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। এ সময় উভয়ে জোরে জোরে দ্বৈত সঙ্গীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, উত্তর-পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, পশ্চিম ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সঙ্কটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে ধূসর সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর সারস’, ইংরেজি নাম: ‘ডেমোজিল ক্রেন’, (Demoiselle Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthropoides virgo | দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। গড় দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৫০-১৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২-৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার তালু ধূসর। মাথার পেছন থেকে কালো রঙ শুরু করে ঘাড়, থুঁতনি ও গলা হয়ে বুকের ওপর গিয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। চোখের পেছন থেকে সাদা পালক ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। সারা দেহ গাঢ় ধূসর। ওড়ার পালক কালো। লেজে সাদা-কালো লম্বা পালক, যা ঝুলে পড়েছে নিচে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। কমলা-লাল রঙের চোখ দুটি আকারে ছোট। পা ও পায়ের পাতা ময়লা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাঁকড়া, কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-২৯ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/04/2016
লক্ষ্মীপেঁচা | Barn Owl | Tyto alba
লক্ষ্মীপেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিদের মুখাবয়ব অনেকটাই মানবশিশুর মতো। গোলাকৃতির মুখ, বড় বড় চোখ এবং চেপ্টা ঠোঁটটি মানুষের নাকের আদলে হওয়ায় এমনটি মনে হয়। একটা সময় এ পাখি আমাদের দেশে সুলভ দর্শন ছিল। বর্তমানে এদের বাসস্থান সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এরা কালেভদ্রে নজরে পড়লেও উৎসুক মানুষের কাছে নাজেহাল হয় খানিকটা। অবশ্য যারা এদের চেনেন, তারা মোটামুটি পাখিটাকে নিরাপদে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরাও মানুষকে কিছুটা নিরাপদ মনে করে। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এ পাখি। গভীর জঙ্গল এদের অপছন্দ। পুরনো দোর-দালান কিংবা গাছের কোটরে এদের বাসস্থান। নিরাপদ মনে হলে একই বাসায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। এরা নিশাচর হলেও খুব ভোরে এবং গোধূলি লগ্নে শিকারে বের হয়। কখনো মানুষের কোনো ধরনের অনিষ্ট করে না এরা; বরং কিছুটা উপকারেই আসে। ইঁদুর খেয়ে মানুষের ফসল রক্ষা করে। প্রতিদানে মানুষও এদের আগলে রাখার চেষ্টা করে। এদের মাংস ভক্ষণে অরুচি থাকায় শিকারিরাও এ পাখি শিকার করে না খুব একটা। এত কিছুর পরও ওরা আজ অস্তিত্ব সংকটে। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। খাদ্য সংকটও আরেকটি কারণ। তার ওপর রয়েছে গাছের প্রাকৃতিক কোটর স্বল্পতা এবং পুরনো দর-দালান হ্রাস পাওয়াতে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে চিরচেনা এসব পাখি সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল অচেনা হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ জেলায় অমনটি ঘটেছে। এ প্রজাতির একটি পাখি ছয়তলা ভবনে ঢুকে পড়লে ওটাকে অক্ষত অবস্থায় ধরে চিড়িয়াখানায় পাঠানোর উদ্যাগ নেয়া হয়। এ ধরনের প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায় আমাদের দেশে। এতে ওই পাখিটা নিরাপদ হতে পারলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায় ওদের পরিবারের। প্রথমত ওর জুড়ি পাখিটার আহাজারি, অবশেষে এলাকা পরিত্যাগ। দ্বিতীয়ত যদি ওই পাখির ডিম অথবা শাবক থেকে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমেয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বিরল বন্যপ্রাণী অথবা যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে ওকে চিড়িয়াখানায় না পাঠিয়ে বরং চিকিৎসা দিয়ে ওর পরিবেশেই ওকে উন্মুক্ত করে দেয়া। এ পাখির বাংলা নাম: লক্ষ্মীপেঁচা, ইংরেজি নাম: বার্ন আউল (Barn Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: টাইটো আলবা (Tyto alba), গোত্রের নাম: টাইটোনিদি। এরা লম্বায় ৩৪-৩৫ সেন্টিমিটার। এদের গোলাকৃতি মুখটি ধবধবে সাদা। ঘাড় ও ডানা হলদে-বাদামি। দেহের উপরের দিকটা সোনালি-বাদামি। গলা, পেট, বুক থেকে নিচের দিকে সামান্য চিতি। লম্বা ঠোঁটটি মাংসল সাদা। ঠোঁটের গোড়ার দিকে চেপ্টা মোমের মতো উন্মুক্ত ঝিল্লি মাংসল। চোখ গোলাকৃতির। লেজ খাটো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। লক্ষ্মীপেঁচার প্রধান খাবার ছোট সরীসৃপ, ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ইত্যাদি। জানা যায়, খাদ্য ও বাসস্থান ঠিকঠাক থাকলে বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করতে সক্ষম লক্ষ্মীপেঁচা দম্পতি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 11/01/2013
বাদামিবুক চটক | Brown breasted Flycatcher | Muscicapa muttui
বাদামিবুক চটক | ছবি: ইন্টারনেট চড়–ই আকৃতির পরিযায়ী পাখি। দেখতে আহামরি না হলেও চেহারাটা মায়াবী ধাঁচের। স্বভাবে শান্ত। কিছুটা ভিরু প্রকৃতির। উড়ন্ত পোকামাকড় এদের প্রধান শিকার। উড়ন্ত পোকামাকড় নজরে পড়লে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শিকারের পিছু নেয়। বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ব্যতিত উত্তর-পূর্ব ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, দক্ষিণ চীন ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুঁচালো চিরহরিৎ বন। ভূপৃষ্ট থেকে ১৫০০ মিটারের উঁচুতেও এদের বিচরণ রয়েছে। তবে যেখানেই বিচরণ করুক না কেন জায়গাটা ঝোপঝাড় মুক্ত হওয়া চাই। বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়, আবার অঞ্চলভেদে কিছুটা দুর্লভও। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামিবুক চটক’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার’ (Brown-breasted Flycatcher), বৈজ্ঞানিক নাম: Muscicapa muttui| এরা ‘মেটেবুক চুটকি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির দৈর্ঘ্য ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১০-১৪ গ্রাম। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজের গোড়া পর্যন্ত জলপাই বাদামি (অনেক সময় মেটে বাদামি মনে হতে পারে)। ডানা এবং লেজের পালক উজ্জ্বল বাদামি। চিবুক ফ্যাকাসে বাদামি। গলা সাদা। বুক মেটে বাদামি। চোখের বলয় কালো, বলয়ের পাশে সাদাছোপ। ঠোঁট ত্বক বর্ণের সঙ্গে কালচে আভা। পা হলদে কমলা অথবা ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: পতঙ্গ, মাছি বা ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। গুল্মঝোপের ভেতর কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, তন্তু ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। শাবক উড়তে শিখে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/02/2017
কালো পেঁচা | Brown Hawk owl | Ninox scutulata
কালো পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত ‘প্রকৃতি বার্তা’র (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়) পেঁচা নিয়ে ফিচার পাঠে জানতে পারি যে, একটি পেঁচা বছরে প্রায় ৭০০টি ইঁদুর খেতে সক্ষম। আর একটি ইঁদুর বছরে ১০ কেজি ফসল সাবাড় করতে সক্ষম। অথচ সেই উপকারী বন্ধু পেঁচাকে অলুক্ষণে বলে গালি দেই আমরা। আর ‘কালো পেঁচা’ হলে তো কথাই নেই, বেশি বেশি অলুক্ষণে বলি ওদের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরের কারণে। ওরা এক নাগাড়ে ‘কু-উক-কু-উু-কু-উক’ সুরে ডাকতে থাকলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে। মানুষের ধারণা এই বুঝি কোনো বিপদ হানা দিচ্ছে পেঁচার ডাকে। অথচ ভুল সবই ভুল! এরা আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুর্লভ দর্শনও বটে। গ্রামীণ বন-বাদাড়ের বড় গাছের পাতাল আড়ালে কিংবা বাঁশ ঝোঁপে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। সাঁঝের বেলায় বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা একাকি। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন হাক আউল’ (Brown Hawk-owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ninox scutulata| এরা ‘খয়রা শিকারে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৭-৩৩ সেন্টিমিটার। মুখ ও মাথা কালচে-বাদামি। ঘাড় লালচে-বাদামি ফোঁটা। পিঠ গাঢ় বাদামি। দেহতল লালচে-বাদামির ওপর সাদা ডোরা টান। ঠোঁট কালচে, ঠোঁটের গোড়ায় সাদা ফোঁটা। চোখের তারা হলুদ। দূর থেকে চোখের তারা নজরে পড়লে মনে হয় বুঝি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। পা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধান খাবার: ইঁদুর, সরীসৃপ, ছোট পাখি, ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে মাসখানেক। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/03/2015
সবুজ ময়ূর | Green Peafowl | Pavo muticus
সবুজ ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট প্রাক্তন আবাসিক পাখি ‘সবুজ ময়ূর’। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। ১৯৪০ সালের দিকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। চির সবুজ বনের বাসিন্দা। বনতলে ঘুরে বেড়ায়। উড়তেও পারে। তবে তেমন একটা গতি নিয়ে উড়তে পারে না। উড়তে গিয়ে বারবার নিচের দিকে নেমে পড়ে। মূলত লেজের লম্বা পালক ওড়ার গতি দাবিয়ে রাখে। তা ছাড়া শরীরের ওজনও ওড়ার গতি আটকে দেয়। অন্যসব ময়ূরের মতো এরাও ঝরা পাতা উল্টিয়ে এবং মাটি আঁচড়ে খাবার খায়। ছোট দলে বিচরণ করে। একটি ময়ূরের অধীনে ৩-৫টি ময়ূরী থাকে। কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে ভোরে এবং গোধূলীলগ্নে। মন ভালো থাকলে পুরুষ পাখি নাচানাচি করে এবং পেখম মেলে কসরত দেখায়। পুরুষ পাখির তুলনায় স্ত্রী পাখি অনেকটাই নিষ্প্রভ। কণ্ঠস্বরও কর্কশ। পুরুষ পাখি ডাকে ‘ইয়েই-অও…’ সুরে। স্ত্রী পাখি ডাকে ‘অ্যাও-অ্যা…’ সুরে। ভয় পেলে কণ্ঠস্বর পাল্টে যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বর্তমানে বিশ্বে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এরা বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সবুজ ময়ূর’, ইংরেজি নাম: গ্রীন পিফাউল’(Green Peafowl), বৈজ্ঞানিক নাম: Pavo muticus | এরা ‘বর্মী ময়ূর’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১০০-১১০ সেন্টিমিটার। পেখম ১৫০-১৯০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষ পাখির ঘাড়, গলা এবং বুকের পালক আঁশের মতো উঁচু। মাথায় সুঁচালো ঝুঁটি। চোখের পাশে কমলা-ক্রিম রঙের চামড়া। পিঠের পালক গাঢ় সবুজ এবং কালচে-নীল। ডানা ঢাকনি সবুজ। ডানার মধ্যভাগের পালক কিছুটা বাদামি। সবুজ লেজের পেখমের প্রান্তে কালো চক্রের বেগুনি ফোঁটা। দেহতল পিতল সবুজের ওপর কালো টান এবং সবুজ-বেগুনি দাগ। স্ত্রী পাখির পিঠ গাঢ় বাদামি। পিঠের শেষ ভাগ এবং কোমর কালচে-বাদামি। লেজ পীতাভ, বাদামি ও কালো রঙের ডোরা। স্ত্রী পাখির পেখম নেই। অপ্রাপ্তবয়স্কদের সবুজাভ-তামাটে কোমর ছাড়া বাদবাকি দেখতে স্ত্রী পাখির মতো। প্রধান খাবার: পোকামকড় কেঁচো, ছোট সাপ, টিকটিকি, রসালো ফল, শস্যবীজ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি থেকে মে। ঝোঁপের ভেতর মাটিতে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/06/2015