চখা চখি | Ruddy Shelduck | Tadorna Ferruginea
চখা চখি | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পদ্মার চরে দেখেছি। তখনো বুঝতে পারিনি এরা বিশেষ আকর্ষণীয় পাখি। প্রথম দেখাতে এদের পাতি হাঁস ভেবে ভুল করেছি। আসলে কিন্তু তা নয়। এরা হাঁস গোত্রের হলেও ভিন্ন প্রজাতির পাখি। এ পাখিরা ঘনঝোপ, ঘাস অথবা আগাছা বিস্তৃত জলাশয় এড়িয়ে চলে। পলিময় উপকূল অঞ্চল, হাওর, নদ-নদীতে এদের বিচরণ। এরা নিশাচর হলেও দিনের আলোতেও বিচরণ করে। বিশেষ করে ভোর-সন্ধ্যায় বেশি বিচরণ করে। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। আবার দলবদ্ধভাবেও থাকে। ডাকে উচ্চস্বরে ‘আ-আঙ্গ আ-আঙ্গ’ সুরে। ওড়ার সময় আওয়াজ করে ‘আ-আখ..আ-আখ’ সুরে। এ পাখি শীতকালে বাংলাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। এশিয়ায় মূলত এদের বিস্তৃতি তুরস্ক থেকে জাপান পর্যন্ত। এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকার উত্তর দক্ষিণাংশে এদের দেখা মেলে। এ পাখিদের বন্ধন অত্যন্ত মধুময়। কথিত আছে, কোনো কারণে যদি এদের জোড়া থেকে একটি পাখি মারা যায় অথবা শিকারিদের শিকারে পরিণত হয় তাহলে জোড়ের অন্য পাখিটি আর্তনাদ করতে করতে মারা যায়। এমনই অটুট এদের বন্ধন। আর এ বন্ধনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এদের নামকরণ হয় চখা-চখি। বর্তমানে পৃথিবীতে ওদের অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। জানা যায়, সমগ্র পৃথিবীতে এ পাখির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত হিসেবে রয়েছে। বাংলায় পুরুষ পাখির নাম: ‘চখা’ স্ত্রী পাখির নাম:‘চখি,’ দুয়ে মিলে নাম হয়েছে চখা-চখি। ইংরেজি নাম: ‘রাড্ডি শেলডাক’ (Ruddy Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না ফেররুগিনি’ (Tadorna Ferruginea), গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। এরা লম্বায় ৬৭-৭০ সেন্টিমিটার। ঠোঁট ৪.৩ সেন্টিমিটার। পা ৬ সেন্টিমিটার। লেজ ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। গায়ের অধিকাংশ পালকই কমলা-বাদামি বর্ণের। মাথা, গলা সাদাটে। ডানা ধাতব-সবুজ, সাদা, কালো এবং বাদামি। ঠোঁট, পা ও লেজ কালো। স্ত্রী পাখির বর্ণ সামান্য উজ্জ্বল। দেখতে প্রায় একই রকম। তবে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় প্রজনন মৌসুমে। এ সময়ে পুরুষ পাখির গলায় কালো বলয় তৈরি হয়। স্ত্রী পাখির হয় না। এরা সর্বভুক পাখি। জলজ পোকামাকড় থেকে শুরু করে ছোট মাছ, ছোট ব্যাঙ, ধান, ঘাসের কচি ডগা সবই খায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে তিব্বত ও উত্তর এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে। উঁচু মালভূমি বা জলাভূমির কাছাকাছি গর্তে পালক দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৮-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। পুরুষ পাখিটি পাশে বসে থাকে তখন। শাবক উড়তে শিখে ৫৫ দিনে। বয়োপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে প্রায় ২ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/12/2012
বাদা ছাতারে | Marsh Babbler | Pellorneum palustre
বাদা ছাতারে | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। প্রাকৃতিক বিস্তৃতি জলাশয় এবং নদীর কাছাকাছি নলবন, ঘাসবনে। দেখতে আহামরি না হলেও মায়াবি ধাঁচের চেহারা। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে অল্পবিস্তর নজরে পড়ে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। সামাজিক পাখি। স্বভাবে চঞ্চল। প্রজননকালীন সময়ে জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করলেও ছোট দল দেখা যায়। রাত্রিযাপনও করে দলবদ্ধভাবে। দলের একটি পাখি যেদিকে উড়ে যায় অন্যরাও সেদিকে উড়তে থাকে। আবার কেউ যদি পথ হারিয়ে ফেলে অন্যরা ডাকাডাকি করে তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। সবচেয়ে মজাদার বিষয়টি হচ্ছে এদের দলের কেউ ডিম-বাচ্চা ফুটালে শাবকদের যতœআত্তি দলের সবাই মিলেই করে। অনেক সময় দলের সবাই মিলে অন্যের ডিমে তা দিতে দেখা যায়। মূলত জলাশয় এলাকায়ই বিচরণ আধিক্য। বিশেষ করে শনবন, নলখাগড়ার বনের ভেতর আড্ডা জমায় ভালো। এদের গানের গলা সুমধুর নয়। কর্কশ। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদা ছাতারে’, ইংরেজি নাম: ‘মার্স ব্যাবলার’, (Marsh Babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: Pellorneum palustre | এরা ‘জলার ধারের ছাতারে’ নামেও পরিচিত। গড় দৈর্ঘ্য ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫-২০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। কপালে সাদা টান। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ গাঢ় বাদামি। গলা সাদা। পেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত হালকা সাদার সঙ্গে বাদামি ডোরা। চোখের মণি বাদামি। ঠোঁট শিং বাদামি। পা কালচে। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মে। জলাশয়ের কাছাকাছি ঘাসবন কিংবা লতাগুল্মের ভেতর ডিম্বাকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/05/2017
হলুদ পা হরিয়াল | Yellow Footed Green Pegion | Treron phoenicoptera
হলুদ পা হরিয়াল | ছবি: ইন্টারনেট সবুজে আচ্ছাদিত গ্রামটির নাম চরপাতা। আয়তনে বিশাল। ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিম নাম ধারণ করেছে। নামকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রায়পুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কটি। এটি গ্রামের বুক চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে গিয়ে মিলিত হয়েছে চাঁদপুর শহরে। বছর ত্রিশেক আগেও রাস্তাটি ছিল কাঁচা। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়েছিল বেশকিছু মোটাসোটা গাছ। তন্মধ্যে রেইনট্রি গাছ ছিল বেশি। ছিল বট-পাকুড় গাছও। এখন নেই। তো তেমনি দুটি পাকুড় গাছ ছিল ‘সিংহপুল’ নামক স্থানে। বিকেলে গ্রামের ছেলে-বুড়োরা সিংহপুলে এসে আড্ডা জমাতেন। কিশোর ছিলাম তখন আমি। তথাপিও যেতাম সেখানে মাঝেমধ্যে। আড্ডা দিতে নয়। পাকুড় ফল খেতে আসা হলুদাভ সবুজ রঙের পাখিগুলোকে একনজর দেখতে। প্রত্যহ গাছে একঝাঁক পাখি দেখা যেত পাকুড় পাকলে। দৃশ্যটি ছিল ভারি চমৎকার। গ্রামের প্রত্যেকেই উপভোগ করতেন সেটি। তাই বড়রা ওদের কখনো বিরক্ত করেননি। পাখিগুলো দেখতে অনেকটা কবুতরের মতো হলেও সৌন্দর্য বিচারে কবুতরের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে। নিজচোখে না দেখলে এ পাখির রূপের বর্ণণা দেয়া খুবই কঠিন। অনেকটা ‘অন্ধের হস্তি’ দর্শনের মতো। একটা সময় দেশের গ্রামগঞ্জে সুলভ দর্শন ছিল এ পাখি। নির্জন কোনো জঙ্গলে অথবা ছোট পাকা ফলবান বৃক্ষের নিচে গেলে ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। বর্তমানে খুব একটা নজরে পড়ছে না। ব্যাপকহারে ফলবান বৃক্ষ নিধনের ফলে এরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে প্রজননেও। এ পাখি আজ অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। এরা আজীবন বৃক্ষচারী। জলপান ব্যতিরেকে মাটিতে নামে না খুব একটা। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। স্বভাবে শান্ত। গায়ে পড়ে অন্য প্রজাতি তো দূরের কথা নিজেদের কারো সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়ায় লিপ্ত হয় না। পাখিটার বাংলা নাম: ‘হলুদ পা হরিয়াল’, ইংরেজি নাম: ‘ইএয়এলা ফুএটড গিণ্ঠন পিজিয়ন’ (Yellow Footed Green Pegion), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ট্রেরন ফোনিকোপটেরা’ (Treron phoenicoptera), গোত্রের নাম: ‘কলাম্বিদি’। অঞ্চলভেদে এরা ‘হরিকল বা বটকল’ নামে পরিচিত। লম্বায় এরা ৩২-৩৪ সেন্টিমিটার। হরিয়ালের গায়ের বর্ণ জলপাই সবুজের সঙ্গে ছাই-ধূসর মিশ্রণ। মাথা ধূসর। ঘাড়ে লালচে ছোপ। ডানা সবুজাভ কালোর ওপর হলদে টান। বুক এবং বুকের দুই পাশ ও বুকের নিুাংশ ধূসর। চোখের বলয় গোলাপি। পা ও আঙুল উজ্জ্বল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট এবং গায়ের রঙ পুরুষ পাখির চেয়ে সামান্য ফিকে। হরিয়ালের প্রধান খাদ্য ছোট ফল। বিশেষ করে বট-পাকুড় ফলের প্রতি আসক্তি বেশি। এ ছাড়া অন্যান্য ছোট ফল এদের প্রিয়। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল। বাসা বাঁধে গাছের উঁচু শাখায় ঘনপাতার আড়ালে। ডিমপাড়ে ২টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/04/2013
ধুসরাভ মেঠো চিল | Montagu’s Harrier | Circus pygargus
ধুসরাভ মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট শীত মৌসুমে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে পরিযায়ী হয়ে আসে। নরওয়ে, গ্রেট ব্রিটেন, পর্তুগাল, রাশিয়া, (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) বেলারুশ, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। দেখতে ভয়ঙ্কর দর্শন হলেও মূলত এরা তত হিংস্র নয়। প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। প্রাকৃতিক আবাসস্থল কাঁটাওয়ালা চিরহরিৎ গুল্ম। বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উন্মুক্ত বনভূমি, বালিয়াড়ি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ। ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতায়ও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক (ডিটিটি) ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ধুসরাভ মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘মন্টেগুয়াস হ্যারিয়ার’ (Montagu’s Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus pygargus | এরা ‘মন্টেগুর কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪৩-৪৭ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৭-১১৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড়। গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ২৬৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৩৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড় ও পিঠ সুরমা ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালচে। লেজ কালচে ধূসর। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক হলদে বাদামি। দেহতল গাঢ় বাদামি। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, ছোট পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ঝোঁপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৪০ দিন। শাবক শাবলম্বী ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ২-৩ বছর। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/01/2017
কালো পেঁচা | Brown Hawk owl | Ninox scutulata
কালো পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট প্রিয় পাঠক, মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত ‘প্রকৃতি বার্তা’র (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়) পেঁচা নিয়ে ফিচার পাঠে জানতে পারি যে, একটি পেঁচা বছরে প্রায় ৭০০টি ইঁদুর খেতে সক্ষম। আর একটি ইঁদুর বছরে ১০ কেজি ফসল সাবাড় করতে সক্ষম। অথচ সেই উপকারী বন্ধু পেঁচাকে অলুক্ষণে বলে গালি দেই আমরা। আর ‘কালো পেঁচা’ হলে তো কথাই নেই, বেশি বেশি অলুক্ষণে বলি ওদের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরের কারণে। ওরা এক নাগাড়ে ‘কু-উক-কু-উু-কু-উক’ সুরে ডাকতে থাকলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে। মানুষের ধারণা এই বুঝি কোনো বিপদ হানা দিচ্ছে পেঁচার ডাকে। অথচ ভুল সবই ভুল! এরা আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুর্লভ দর্শনও বটে। গ্রামীণ বন-বাদাড়ের বড় গাছের পাতাল আড়ালে কিংবা বাঁশ ঝোঁপে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। সাঁঝের বেলায় বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা একাকি। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন হাক আউল’ (Brown Hawk-owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ninox scutulata| এরা ‘খয়রা শিকারে পেঁচা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৭-৩৩ সেন্টিমিটার। মুখ ও মাথা কালচে-বাদামি। ঘাড় লালচে-বাদামি ফোঁটা। পিঠ গাঢ় বাদামি। দেহতল লালচে-বাদামির ওপর সাদা ডোরা টান। ঠোঁট কালচে, ঠোঁটের গোড়ায় সাদা ফোঁটা। চোখের তারা হলুদ। দূর থেকে চোখের তারা নজরে পড়লে মনে হয় বুঝি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। পা হলুদ, নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধান খাবার: ইঁদুর, সরীসৃপ, ছোট পাখি, ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের কোটরে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৩-২৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে মাসখানেক। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 13/03/2015
মেটেমাথা কুরাঈগল | Grey headed Fish Eagle | Ichthyophaga ichthyaetus
মেটেমাথা কুরাঈগল | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মোহনা এবং উপকূলের কাছাকাছি জলাশয় ও নিম্নভূমির বন প্রান্তরে বিচরণ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, লাওস, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও পশ্চিম ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। প্রজাতির দেখা মেলে একাকি বা জোড়ায়। মিঠা জলের জলাশয় এদের বিচরণের জন্য উত্তম। দুর্দান্ত সাহসী ও হিংস । নিজের শরীরের সমান ওজনের মাছ বা সরীসৃপ শিকার করতে সক্ষম। শিকার খুঁজে জলাশয়ের ওপর চক্কর মেরে। ওপর থেকে নিশ্চিত হলে কেবল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছোট মাছের প্রতি আসক্তি নেই বললেই চলে। আকারে বড়সড়ো মাছ দেখলে নিশানা ঠিক করে বিশাল ডানা মেলে মাছের পিঠ বা ঘাড়ে থাবা বসিয়ে দেয়। এ থেকে বাদ যায় না জলচর সাপও। দেশে এদের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। জলাশয় সংকুচিত এবং উঁচু গাছের অভাবে এরা হুমকির মুখে পড়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মেটেমাথা কুরাঈগল’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-হেডেড ফিস ঈগল, (Grey-headed Fish Eagle), বৈজ্ঞানিক নাম: (Ichthyophaga ichthyaetus)। এরা ‘মাছ মুরাল’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ৬১-৭৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য ৪২-৪৫.৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৬ কেজি। স্ত্রী পাখির প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য ৪৪.৫-৫১.৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২.৩-২.৭ কেজি। দেহের তুলনায় মাথা খাটো। মাথা বাদামি ধূসর। ঘাড় ও গলা লালচে বাদামি। পিঠ কালচে-বাদামি। বুক লালচে-বাদামি। পেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত সাদা। লেজ বাদামি, বৃত্তাকার এবং খাটো। ঠোঁট শিং কালো। শক্ত-মজবুত ধারালো ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। চোখ হলুদ-বাদামি। পা খাটো, নখ তীক্ষ, ধূসর-কালচে। স্ত্রী-পুরুষের চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রধান খাবার: মাছ। এ ছাড়া সাপ, ইঁদুর, খরগোশসহ বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ শিকার করে। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। জলাশয়সংলগ্ন উঁচু গাছের তে-ডালে সরু ডালপালা দিয়ে মস্তবড় বাসা বাঁধে। বাসা অগোছালো। একই বাসায় ফি বছরেও ঘর বাঁধতে দেখা যায়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৬৫-৭০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/08/2016
পাতারি হাঁস | Common teal | Anas crecca
পাতারি হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট প্রচণ্ড শীতে সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে। শীতের শুরুতে লতাগুল্ম আচ্ছাদিত বৃহৎ জলাশয়ে কিংবা হাওর-বাওরে ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করতে দেখা যায়। দেখা যায় জলাশয়ের ওপর ওড়াউড়ি করতেও। এদের ওড়ার গতিও ভালো। উড়তে উড়তে অনেক সময় পুরুষ পাখি নিচুস্বরে ডাকে ‘ক্রিট..ক্রিট’। প্রজাতিটি সুলভ দর্শন হলেও আমাদের দেশে এরা নিরাপদ নয়। বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। গত দশক আগেও দেশে এদের ব্যাপক বিচরণ ছিল। সে তুলনায় বর্তমান সময়ে নজরে পড়ছে না তেমনটি। ১৯৯৭ সালের দিকেও ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকে ব্যাপক দর্শনের নজির রয়েছে। দ্রুত এদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারনটিই হচ্ছে শিকারিদের দৌরাত্ম্য। দেখতে ভীষণ সুন্দর, ওজনে সামান্য হলেও এরা রেহাই পায় না নিষ্ঠুর শিকারিদের হাত থেকে। রসনাবিলাসিরা যদি একটু সংযত হন বোধ করি দেশের শিকরিরাই বিপাকে পড়ে যাবে এবং তারা পাখি শিকারে নিরুৎসাহী হয়ে পড়বে। তাতে করে হ্রাস পাওয়া প্রজাতির সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ পাখির বাংলা নাম: ‘পাতারি হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন টিল’ (Common teal), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস ক্রেককা’ (Anas crecca)। এরা ‘পাতি তিলিহাঁস’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রঙ বদলায়। এ সময় এদের মাথার রঙ লালচে-বাদামি এবং শরীরে গুঁড়ি গুঁড়ি রেখা দেখা যায়। মাথার দু’পাশে লম্বা দুটি সাদা ডোরা। চোখের ওপর থেকে ঘাড় পর্যন্ত দেখা যায় চওড়া ধাতব-সবুজ পট্টি। ডানা কালো, ধাতব সবুজ ও হলদেটে। লেজের নিচের পালক হলুদাভ ছোপ। স্ত্রী পাখির রূপ নিষ্প্রভ। মাথার তালু ও ঘাড় কালচে-লালচের মিশ্রণ। উভয়ের চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা জলপাই-ধূসর। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির সঙ্গে মা পাখির বর্ণের খানিকটা মিল রয়েছে। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদের কচিডগা ও বীজ। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট। জন্মভূমি সাইবেরিয়া অঞ্চলের জলাশয়ের পাশের ভূমিতে শুকনো লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৮-১২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। শাবক উড়তে শিখে ২৫-৩০ দিনের মধ্যেই। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/02/2014