হলদেবাদামি ভূতম পেঁচা | Buffy Fish Owl | Ketupa ketupu
হলদেবাদামি ভূতম পেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। দেশের সুন্দরবন ছাড়া অন্যত্র দেখা যাওয়ার রেকর্ড নেই। কেউ দেখে থাকলে সেটি বিপদগ্রস্ত পাখি হতে পারে। মূলত এরা নদ-নদী, হ্রদ কিংবা বড়সড়ো জলাশয়ের কাছাকাছি বৃক্ষে বিচরণ করে। বিচরণের ক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ এলাকা বেশি পছন্দের। এছাড়াও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ মিটার উচ্চতায় দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। অন্যসব পেঁচাদের মতো এরাও দিনের বেলায় গাছ-গাছালির ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দিনের আলো ফুরিয়ে এলে বা গোধূলিলগ্নে শিকারে বের হয়। একাকী কিংবা জোড়ায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। দলবেঁধে বিচরণ করে না। দেখতে ভয়ঙ্কর দর্শন হলেও একেবারেই নিরীহ গোত্রের পাখি। স্বভাবে লাজুক। অন্যসব শিকারি পাখিদের মতো হিংস নয়। কণ্ঠস্বর ভৌতিক। ভরাট কণ্ঠে ‘বুপ্-বুপ্-বুপ্-বুপ্’ আওয়াজ করে মানুষের কলজে কাঁপিয়ে দেয়। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ এদের কণ্ঠস্বর শুনতে না পেলেও সুন্দরবনে কর্মরত বাওয়াল, মৌয়াল কিংবা জেলেরা মাঝে মধ্যে শুনতে পান। বাংলাদেশের বাইরে এদের বিস্তৃতি ভারত, দক্ষিণ মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার জাভা-বালি পর্যন্ত। আমাদের দেশে প্রজাতিটি বিরল দর্শন হলেও বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘হলদে-বাদামি ভূতম পেঁচা’, ইংরেজি নাম: ‘বাফি ফিস আউল’ (Buffy Fish Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: Ketupa ketupu | এরা ‘মেটে মেছোপেঁচা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৮-৪৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথা ও ঘাড় হলদে-বাদামি ডোরাযুক্ত। মাথার দু’পাশে আছে কান পশম, যা ঝুঁটি আকৃতির দেখায়। চোখের দু’পাশে কপালের ওপর সাদা টান। মুখমণ্ডল হলদে-বাদামি। দেহের উপরাংশ গাঢ় বাদামি রঙের ঘন মিহি রেখা। ডানার ওপরে সাদাটে দাগ। দেহের নিচের দিকে হলদে-বাদামির আড়াআড়ি রেখা। গোলাকার চোখের বলয় হলুদ রঙের। তারা গাঢ় বাদামি। ঠোঁট শিং রঙা, আকারে খাটো, নিচের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। পায়ের আঙুল ফ্যাকাসে হলদে। প্রধান খাবার: মাছ, কাঁকড়া সরীসৃপ, ইঁদুর, ব্যাঙ ও বাগদাচিড়িং। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মে। অঞ্চলভেদে ভিন্ন। মরা গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-২৯ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে মাসখানেক সময় লেগে যায়। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/10/2015
প্যারা শুমচা | Mangrove Pitta | Pitta megarhyncha
প্যারা শুমচা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির বনচর পাখি। গড়ন ত্রিভুজাকৃতির। আকর্ষণীয় চেহারা। শরীরের তুলনায় লেজের দৈর্ঘ্য বেমানানই বটে। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে কেউ লেজটা কেটে দিয়েছে। চিরসবুজ অরণ্যের বাসিন্দা। দেশে বলতে গেলে একমাত্র সুন্দরবনেই দেখা মেলে। সাধারণত একাকী বিচরণ করে। তবে মাঝেমধ্যে জোড়ায়ও দেখা যায়। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। ওড়ার চেয়ে লাফায় বেশি। খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। রাতেও খাবার খোঁজে। অথচ রাতে খুব বেশি চোখে দেখে না। এ অবস্থায় শত্রুর মুখোমুখি হলে আন্দাজে ডানা ঝাপটে কেটে পড়ে। বিষণ্ন কণ্ঠে ঠোঁট উঁচিয়ে ডাকাডাকি করে। সুর সুমধুর। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘প্যারা শুমচা’, ইংরেজি নাম: ‘ম্যানগ্রোভ পিট্টা’ (Mangrove Pitta), বৈজ্ঞানিক নাম: Pitta megarhyncha। কারো কারো কাছে ‘সুন্দরবনের শুমচা’ নামেও পরিচিত। দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির শুমচা পাখির দেখা মেলে। যথাক্রমে: প্যারা শুমচা, দেশি শুমচা, নীলঘাড় শুমচা, নীল শুমচা (পরিযায়ী) ও খয়রামাথা শুমচা (পরিযায়ী)। দৈর্ঘ্যে পাখিটি কমবেশি ১৮ থেকে ২১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওজন ৯২ থেকে ১২০ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। মাথা ধূসর বাদামি। ঠোঁটের গোড়ার দুই পাশ থেকে কালো প্রশস্ত রেখা ঘাড়ের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। গলার নিচ থেকে প্রশস্ত ক্রিম-সাদা রেখা ঘাড়ের কালো রেখার নিচে সরু হয়ে মিলেছে। পিঠ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত জলপাই-সবুজাভ। ডানায় নীল ছোপ। খাটো লেজ, রং কালো। দু-একটি পালকের ডগা আসমানি। দেহতল শিয়াল রঙের। তলপেট থেকে লেজের নিচ পর্যন্ত টকটকে লাল। চোখ কালো। ঠোঁট মোটা, ত্রিভুজাকৃতির। রং শিঙ কালো। পা দুটি লিকলিকে লম্বা। প্রধান খাদ্য ভূমিজ কীটপতঙ্গ, কেঁচো। লতাগুল্মাদির ভেতর নরম মাটিতে ঠোঁট ঠুকরে খাবার খোঁজে এবং ঝরাপাতা উল্টিয়ে পোকামাকড় খায়। প্যারা শুমচার প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। বাসা বাঁধে মাটিতে অথবা ফার্নে আবৃত গাছের কাণ্ডে। বাসা গোলাকার। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লাঠি, শুকনো শেকড়, শুকনো ঘাস বা লতাপাতা। দুই থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪ থেকে ১৬ দিন। শাবক উড়তে শেখে ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/04/2018
লাল বুক টিয়া | Red Breasted Parakeet | Psittacula alexandri
লাল বুক টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা হলেও শালবনে বেশি দেখা যায়। লোকালয়েও দেখা মেলে, তবে কম। স্থানীয় প্রজাতির হলেও সুলভ দর্শন অঞ্চলভেদে। যেমন: সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক নজরে পড়ে। বিচরণ করে ছোট-বড় দলে। কৃষকের ধান, গম, ভুট্টাক্ষেতে দল বেঁধে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করে, যা খায় তারচেয়ে বেশি নষ্ট করে। দেখতে ভীষণ সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর কর্কশ। সামাজিক পাখি, দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের যে কেউ বিপদের গন্ধ পেলে ‘ক্যাঁক..ক্যাঁক’ স্বরে ডেকে সবাইকে সতর্ক করে। বিপৎসংকেত পেয়ে সঙ্গীরা ঝটপট ডানা মেলে নিরাপদে পৌঁছায়। এত সতর্ক থাকার পরেও এরা শিকারিদের কবলে পড়ছে দেদার- যার ফলে আজ প্রজাতিটি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল বুক টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘রেড ব্রেসটেড প্যারাকিট’ (Red-Breasted Parakeet), বৈজ্ঞানিক: Psittacula alexandri | নাম: ‘সিট্টিসিদি’। এরা ‘তোতা ও মদনা’ নামে পরিচিত। প্রজাতি লম্বায় লেজসহ ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষের মাথা বেগুনি-ধূসর, কপালের ওপর কালো পট্টি, যা চোখের কাছে গিয়ে মিশেছে। ডানায় সোনালি আভা। গলা থেকে বুক পর্যন্ত গোলাপি। পেট নীলচে-সবুজ, তলপেট থেকে লেজের নিচ হলদেটে-সবুজ। লেজের ওপরের দিক নীলচে-সবুজ। লেজের ডগার কিনারটা হলদেটে। শক্ত মজবুত ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের বর্ণ ওপরের দিকে রক্ত লাল, নিচের অংশ কালো। স্ত্রী পাখির মাথা নীলচে-সবুজ। বুকের দিক গাঢ় গোলাপি। ঠোঁটের ওপরাংশ কালো, নিচের অংশ পাটকিলে-কালো। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির কনীনিকা ফিকে-হলুদ, স্ত্রী পাখির সাদাটে-হলুদ। উভয়ের পা ও আঙ্গুল ধূসরাভ-সবুজের সঙ্গে হলটে মিশ্রণ । প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ফুল, ফল, মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। পোষা তোতাদের দুধ-ভাত, কলা, বাদামের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।প্রকাশ: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/06/2017 এবং দৈনিক যুগান্তর, 31/08/2013
আমুর শাহিন | Amur Falcon | Falco amurensis
আমুর শাহিন | ছবি: ইন্টারনেট পাখির নাম ‘আমুর শাহিন’। আমুরল্যান্ডে বিচরণ আধিক্য বিধায় হয়তো এই নাম ওদের। এরা উপমহাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। সুদর্শন, স্লিম গড়নের পাখি। দেখতে কিছুটা ককাটিল পাখিদের মতো। পুরুষদের চেহারা চকচকে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ; ভিন্ন বর্ণের। প্রাকৃতিক আবাসস্থল খোলা মাঠপ্রান্তর, খোলা বনাঞ্চল। শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে হিংস নয়। একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আমুরল্যান্ড, ট্রান্সবিকালিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়া, উত্তর-পূর্ব মঙ্গোলিয়া উত্তর-পূর্ব চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়, উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে আইসিইউএন এদের শনাক্ত করেছে তাই। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘আমুর শাহিন ’, ইংরেজি নাম: ‘আমুর ফ্যালকন’, (Amur Falcon), বৈজ্ঞানিক নাম: Falco amurensis | এরা ‘লালপা তুরমুতি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ৩০-৩৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৯৭-১৫৫ গ্রাম। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ গাঢ় ধূসর। ডানা খানিকটা লম্বা। দেহতল ধূসর। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত লাল। চোখের বলয় কমলা হলুদ। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালচে বাঁকানো, গোড়া কমলা হলুদ। পা লালচে কমলা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা ভিন্ন। শরীরে ধূসর, হলুদ, সাদা, বাদামির মিশ্রণ ছিট। বাদবাকি পুরুষের মতো। প্রধান খাবার: ঘাসফড়িং, পতঙ্গ, ছোট পাখি ও ছোট সরীসৃপ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। গাছের উঁচু ডালে চিকন ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। মাস খানেকের মধ্যেই শাবক স্বাবলম্বী হয় এবং বাবা-মাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/10/2017
জলপিপি | Bronze Winged Jacana | Metopidius indicus
জলপিপি | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির পাখি। সুলভ দর্শন। এক সময় গ্রামের দিঘি কিংবা বিল-ঝিলে এদের প্রচুর দেখা যেত। শিকারিদের অত্যাচারে গ্রামীণ জনপদ থেকে বিতাড়িত হয়ে এরা এখন হাওর-বাঁওড়ে আশ্রয় নিয়েছে। জানা যায়, সত্তর দশকেও ঢাকার চারপাশের জলাশয়ে এদের প্রচুর বিচরণ ছিল। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার জলাশয়ে ছোট ছোট দলে দেখা যায়। ডাহুকের মতো গড়ন হলেও বেশ পার্থক্য রয়েছে চেহারায়। পা তুলনামূলক লম্বা, পায়ের আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা। অনেকটা মাকড়সার পায়ের মতো দেখায়। যার ফলে এরা জলাশয়ের ভাসমান পাতার ওপর ভর দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়াতে পারে, যা অন্য প্রজাতির জলচর পাখির পক্ষে সম্ভব নয়। সে তুলনায় খুব বেশি উড়তে পারে না। ওড়ার সময় পা ঝুলিয়ে এবং গলা সামনে বাড়িয়ে ওড়ে। বেশিরভাগ জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। মিলন ঋতুতে ডাকাডাকি করে বেশি। প্রহরে প্রহরে ‘পি-পি-পি-পি-পি-’ সুরে ডেকে ওঠে। তাই এদের নামকরণের শেষ অক্ষরের সঙ্গে নিজস্ব সুরের ‘পি-পি’ শব্দটি যোগ হয়েছে। অনেক সময় ‘সিইক-সিইক’ সুরেও ডাকে। ডাহুকের মতো এদের সুরে তাল-লয় নেই। খানিকটা কর্কশ। পাখিটা দেশে অধিক পরিচিত নয়, যেমনটি ডাহুক। স্থানীয় লোকের কাছে ‘পিপি’ পাখি নামে পরিচিত এরা। পাখির বাংলা নাম: ‘জলপিপি’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রোঞ্জ উইংড জাকানা’ (Bronze Winged Jacana), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মেটোপিডিয়াস ইন্ডিকাস’ (Metopidius indicus), গোত্রের নাম: ‘জাকানিদি’। এরা ‘দলপিপি’ নামেও পরিচিত। লম্বায় পুরুষ পাখি ২৯ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৩২ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড়, গলা, বুক উজ্জ্বল নীলাভ-কালো। চোখের ওপরের দিক থেকে চওড়া টান ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ এবং ডানা সবুজাভ-ব্রোঞ্জ। ওড়ার পালক কালচে-বাদামি। লেজ খাটো, পাটকিলে লাল। ঠোঁট সবুজাভ-হলুদ। ঠোঁটের গোড়ায় সামান্য লাল ছোপের সঙ্গে সিসে-লাল বর্মদ্বারা আচ্ছাদিত, যা কপাল পর্যন্ত ঠেকেছে। লম্বা পা, ময়লা-সবুজ বর্ণ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: জলজ পোকামাকড়। এ ছাড়াও ঘাসবীজ, জলজ উদ্ভিদের কচিপাতা খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় জুন থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ওপর পানা বা ঘাসপাতা দিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/10/2013
কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া | Black naped monarch | Hypothymis azurea
কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া | ছবি: ইন্টারনেট পাখির বাংলা নাম: ‘কালোঘাড় নীলাকটকটিয়া’। ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক নেপড মোনার্ক’ (Black-naped monarch)| বৈজ্ঞানিক নাম: Hypothymis azurea। প্রজাতিটি ‘কালাঘাড় রাজন’ বা ‘কালো গ্রিবা পতঙ্গভুক’ নামেও পরিচিত। এ পাখি চঞ্চল হলেও হিংস্র নয়। গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে না। বেশির ভাগই জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। মাঝে মধ্যে একাকীও দেখা যায়। শীত মৌসুমে সমতলের ঝোপ-জঙ্গলে বেশি চোখে পড়ে। লুকিয়ে-চুকিয়ে ‘চুইচ চুইচ চুউ’ সুরে ডাকাডাকি করে। মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। কোথাও একদণ্ড দাঁড়ানোর জো নেই এ পাখির। রাজ্যের ব্যস্ততা নিয়ে দিন কাটায়। উড়ন্ত অবস্থায়ই শিকার ধরে। এরা দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বিস্তৃতি। দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্লিম গড়ন। নজরকাড়া রূপ। মায়াবীও বটে। এদের দিকে নজর পড়লে নিমিষেই চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য লম্বায় ১৬ সেন্টিমিটার। ঘাড়ে কালো প্যাঁচ। গলার নিচে সরু চিলতে কালো রেখা। পুরুষ পাখির প্রধান রং লালচে নীল। তবে নীলের আধিক্য বেশি থাকায় লালচে ভাবটা খুব একটা দেখা যায় না। বুক নীল। নীলটা ফ্যাকাসে হয়ে তলপেট পর্যন্ত সাদাটে হয়ে পৌঁছেছে। চোখ কালো। ঠোঁট নীল-কালো। পা ও পায়ের আঙ্গুল নীলচে কালো। মেয়ে-পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মেয়ে পাখির বর্ণ পুরুষের তুলনায় নিষ্প্রভ। তা ছাড়া গলায় কালো রেখা দেখা যায় না। এদের প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ। প্রজনন সময় মার্চ থেকে আগস্ট। গাছের তে-ডালায় পেয়ালা আকৃতির মজবুত বাসা বানিয়ে তিনটি ডিম পাড়ে। ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, 29/08/2018
গৃহবাসী বাতাসি | Little Swift | Apus affinis
গৃহবাসী বাতাসি | ছবি: ইন্টারনেট চড়–ইদের মতো এরাও ঘরকুনো পাখি। দিনে উড়ে বেড়ায় খোলা প্রান্তরে। রাতে পুরনো দর-দালানে আশ্রয় নেয়। বছরের পর বছর একই স্থানে কাটিয়ে দেয়। অতি সুলভ দর্শন, স্থানীয় প্রজাতির পাখি। ছোট-বড় দলে বাস করে। চেহারা তত আকর্ষণীয় নয় বরং হিংস রাগী দেখায়। কেবল আক্রান্ত হলে আক্রমণ করে। সারাদিন উড়ে বেড়ায়। উড়ন্ত অবস্থায় এদের ঠোঁট, মাথা ও লেজ সমান্তরাল থাকে। ফলে দূর থেকে মাথা এবং লেজ শনাক্ত করা কঠিন হয়। শুধুমাত্র উড়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার কারণে মাথা-লেজ শনাক্ত করা যায়। শরীরের তুলনায় ডানা লম্বা থাকার কারণে উড়ন্ত অবস্থায় ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। কণ্ঠস্বর কর্কশ, জোরে জোরে শিস দেয়। ছোট-বড় দলে বিচরণ করে। মাঝেমধ্যে জোড়ায়ও দেখা যায়। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। বাংলাদেশে সুলভ দর্শন, কোথাও কোথাও অতি সুলভ দর্শন। পাখির বাংলা নাম: ‘গৃহবাসী বাতাসি’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল সুইফট’ (Little Swift), বৈজ্ঞানিক নাম: Apus affinis | এরা ‘ঘর বাতাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ১২-১৩ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৩৩-৪২ সেন্টিমিটার। ওজন ২৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। কপাল বাদামি কালো পালিশ করা। মাথা, ঘাড় বাদামি কালো। পিঠ নীলাভ কালো। কোমর সাদা। লেজ কালো। গলা সাদা। দেহতল কালো। ঠোঁট কালো, ছোট। ঠোঁটের অগ্রভাগ কিঞ্চিত বাঁকানো। পা ছোট। পায়ের তুলনায় নখ বড় এবং ধারালো। প্রধান খাদ্য: উড়ন্ত পোকামাকড়, পিঁপড়া। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মে। অঞ্চলভেদে অক্টোবর থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে পুরনো দর-দালানে অথবা পুরনো পুলের বিমের ফাঁকে। ডিম পাড়ে ১-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/07/2017